এমসিসিএইচএসএলে দুর্নীতির অভিযোগ

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে দুষ্ট চক্রের থাবা

পরের সংবাদ

আয়রে আমার রূপালি রূপকথা : কবিতার ছন্দে নূপুরের ধ্বনি

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সমকালীন সাহিত্যে রাশেদ রউফ একটি অনিবার্য নাম। শিশু সাহিত্যে ঈর্ষাযোগ্য অর্জন তার। তাকে বলা হয় কিশোর কবিতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব। আমাদের চারপাশের জগৎ, জীবন এবং নিসর্গমাধুরী তার অনুভবে যে আলো আর স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়, রাশেদ রউফ তার শব্দ চয়নে, ছন্দ-নৈপুণ্যে, উপমা আর চিত্রকল্পে সেই অনুভবকেই অপরূপ কুশলতায় রূপায়িত করেন। শুধু নিসর্গ নয়, বাংলাদেশের আবহমান ইতিহাস ঐতিহ্য যে গৌরবগাথা, তার প্রতিও রয়েছে তার সুগভীর অনুরাগ। অন্যদিকে তাকে আন্দোলিত করে যায় স্মৃতিময় অতীতের কথকতা, সোনা-রূপা ঝরানো আশ্চর্য সব দিনের বর্ণালী। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ভাষা আন্দোলন তার অন্তরে চেতনা হিসেবে কাজ করে। একে অনুষঙ্গ করে প্রচুর লিখেছেন তিনি। ২০২৪-এর অমর একুশে বইমেলায় বড়ো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘চন্দ্রাবতী একাডেমি’ প্রকাশ করেছে, রাশেদ রউফের কিশোর কবিতার অসাধারণ গ্রন্থ ‘আয়রে আমার রূপালি রূপকথা’। বইটিতে কিশোর কবিতার নানা বাঁক রূপ রূপকল্প সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
প্রতিটি কবিতা ভালোবাসার গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাতায় পাতায়।
আয়রে আমার জাম্বুরি মাঠ, আয়রে সবুজ ছায়া
ছড়িয়ে থাকা স্বপ্নগুলোয় জড়িয়ে রাখি মায়া।

পাখ-পাখালি বন-বনানী লজ্জাবতী লতা
নতুন করে শোনায় তাদের মায়াবী রূপকথা
সবার বুকে খুশির জোয়ার, সবাই আছে সুখে
আমিই কেবল ঘরবন্দি, কষ্ট বাড়ে বুকে।

সুদিন আসুক, মানুষ হাসুক, আয়রে স্বাধীনতা
আয়রে আমার ছন্দমুখর রূপালী রূপকথা।
(আয়রে রূপালি রূপকথা, পৃষ্ঠা-১১)
আমাদের চারপাশের সুন্দর প্রকৃতির রূপ আমাদেরকে প্রতিদিন হাসতে শেখায়, বাঁচতে শেখায়। আমরা বেড়ে উঠি সুন্দর আলোকময় পৃথিবীতে। এখানে আছে রোগ শোক, দুঃখ ব্যথা। এসব আমাদের আনন্দকে কিছুটা হলেও বিঘিœত করে। করোনার কালো থাবায় দেশ যখন অন্ধকারে ডুবে যেতে বসেছিল তখন আমাদের সাহসী মানুষগুলো নামে প্রতিরোধে। মানুষের কাছে সব অশুভ শক্তির পরাজয় কালে কালে। কবি এখানে সুদিনকে প্রত্যাশা করেছেন ছন্দ সুর বাক্যের মাধ্যমে। কবির প্রার্থনা হয়তো কবুল করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। আমাদের দেশ থেকে করোনার মরণ থাবাকে আমরা ঠেকাতে পেরেছি। কবি তার ভাবনায় পাখির মধুর গানের সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্যকেও প্রার্থনা করেছে বর্ণে বর্ণে।
বইটিতে আয়রে আমার রূপালি রূপকথার মতো আরেকটি কবিতা রয়েছে তাতেও কবি আনন্দ দিনের বন্দনা করেছেন। নাম না জানা রোগব্যাধিকে ভয় না করে দেশের মানুষকে ভালো থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
সবাই বলে ‘ভালো থেকো’ আমিও বলি তাই,
বুনো হাওয়ায় ছন্দ তুলে কষ্টকে সামলাই।
লাশের পরে লাশ পড়ছে, শোকবৃষ্টি শুরু
চতুর্দিকে ভয়-আতঙ্ক, বুকটা দুরু দুরু।

পাখির পাখায় গাছের শাখায় মনটা রেখে বলি;
‘অশুভ সব অসুখ-বিসুখ দিয়ে জলাঞ্জলি
নতুন করে সূর্য্য উঠুক, ছুটুক আলোর বান
সবুজ ছায়ায় অরূপ মায়ায় জেগে উঠুক প্রাণ।

(ভালো থেকো, পৃষ্ঠা- ১৩ )
আমরা জানি প্রকৃতি যখন পৃথিবীর নানা চাপকে সহ্য করতে না পারে, তখন প্রকৃতি নিজেই তার প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন। গবেষণার ইতিহাসে দেখে গেছে, প্রতি একশ বছর পর পর প্রকৃতি তার রুদ্ধরূপ প্রদর্শন করে থাকেন। তখন তার রুদ্ধমূর্তি আমরা দেখতে পায়। করোনার কথা আমরা নিশ্চয় ভুলে যায়নি। সেই একটা সময় আমরা সবাই ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিলাম। ঘরের বাইরে গেলেই যেন বিপদ। সেই বিপদ দিনের নানা কথাকে ছন্দে ছন্দে কবি রাশেদ রউফ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন সেই দিনের কথা।
আমাদের জীবনে করোনা যমদূত হয়ে এসেছিল। এ কথা আমাদের প্রজন্ম কখনো ভুলবে না। আমাদের উত্তর প্রজন্ম হয়তো শত বছর পরও তা উল্লেখ করে থাকবে। যেমন আমরা মনে করি সেই ওলাওঠা বা কলেরার কথা। সেই ভাইরাসটিও ছিল জীবনঘাতি। যতই দুঃখ বেদনাই আসুক মানুষ বার বার তা জয় করেছে। কবিও করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির উপায় বের করার জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কবিতায়,
করোনা মানে না ছোট আর বড়, জানে না গুরু বা শিষ্য
দেখাও যায় না, বোঝাও যায় না; সে রাগী-সে অদৃশ্য।

বিজ্ঞানী তুমি সহসা তাড়াও করোনার যত বিষ-শর,
তোমার কর্মে মর্মে মর্মে সহায়তা দেবে ঈশ্বার।
(বিজ্ঞানীর দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব,
পৃষ্ঠ- ১৫)
কবি রাশেদ রউফ বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতান্ত্রিক, অসম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা। তিনি বেড়ে উঠেছেন সৃনির্মল মুক্ত বাযুর গ্রামীণ জনপদে। গ্রামের পরিবেশ, মানুষের সরলতা তার মনে দোলা দেয় বার বার। তাইতো তিনি লেখেন,
কর্মকে যদি ধর্মই ভাবি
কোথাও কখনও হবে না ভুল
চারদিক হবে আলো ঝলমল
খুশি আনন্দে ফুটবে ফুল।
(একটি মানুষ, পূষ্ঠা-১৬)
কিংবা
কোনো কিছু বুঝতে হলে
ঠিক ভেতরে ঢুকতে হয়
অন্যকে যে কষ্টে ফেলে
তাকে কিন্তু ধুঁকতে হয়।
(কেমন করে, পৃষ্ঠা- ১৭)
পুরো বইটিতে ছোট ছোট কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি তার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোয় মূলত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বায়ান্নের একুশ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সব বিষয়ে কবি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন ছন্দ মাত্রা ও অন্তমিলের চমৎকারিত্বে।
ফেব্রুয়ারির তপ্ত দুপুর
রপ্ত চলে ভাষা-
বুকের ভেতর দীপ্ত সাহস
জাগিয়ে তোলে আশা।
বুকের ভেতর একুশে বীজ
বীজের ভেতর চারা,
বাংলা ভাষার ভালোবাসায়
মনটা পাগলপারা।
ফেব্রুয়ারির চিন্তা-চেতন
ভাসে কাব্য-গানে
ভাষার আশা, কোথায় উড়ে
শহীদ মিনার জানে।
(শহীদ মিনার জানে, পৃষ্ঠা-২৫)
একাত্তরে আমরা যখন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন জাতির পরিচয় ও লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি তার মূলে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বে বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর কামান গোলার মুখে সাহসে বুক পেতে ছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বান এবারে সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। তাই তো তিনি আমাদের জাতির পিতা।
মুজিবের ছবি এঁকেছি এ বুকে
উচ্চ রেখেছি শির
তিনি আমাদের স্বপ্নপুরুষ
প্রিয় পিতা এ জাতির।
তিনি দিয়েছেন বাঁচার সাহস
পতাকার অধিকার
তার প্রেরণায় এগিয়ে যাচ্ছি
মানি না তো কোনো হার। (মুজিবের ছবি,পৃষ্ঠা- ১০)
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা যখন ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করে সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিশু রাসেলকেও হত্যা করে নির্মমভাবে। সে কথা ইতিহাস বলে যাবে পৃথিবী যতদিন থাকবে। তার কোনো পাপ ছিল না। অপরাধ শিশু রাসেল বঙ্গবন্ধুর সন্তান। ঘাতকরা তাকে বুলেটে বুলেটে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। সেই স্মৃতি নিয়ে কবি রাশেদ রউফ লিখেছেন,
একটি ছেলে ছিল, এখন সেই ছেলেটি নেই
তার জন্যে কান্না এমন, হারিয়ে ফেলি খেই।
সেই ছেলেটি প্রিয় রাসেল, আদরমাখা মুখ
বঙ্গবন্ধুর চোখের মণি, বাংলাদেশের বুক।
(বঙ্গবন্ধুর চোখের মণি, পৃষ্ঠা-২৮)
বইয়ে মোট ৩৮টি কিশোর কবিতা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আরো ভালো লাগার কবিতা রয়েছে, যেমন শিশুর প্রতি ভালোবাসা, সুরের টানে, নিয়ম, উন্নত দেশ চাই, নেই বন্ধন, দাঁড়াও বাংলাদেশ, দেশের সাত্ত্বনা, কবিতাগুলো। কবি আমাদের চারপাশের জীবনযাপনের নানা চিত্র কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
একটি মানুষ ঘাম বেচে খায়
নাম বেচে খায় কেউ
বেকার মানুষ গুনতে থাকে
কর্ণফুলীর ঢেউ।

চতুর্দিকে অত্যাধুনিক
টেকনোলজির ছন্দ
সেই সময়ে কোথাও কোথাও
কলকারখানা বন্ধ।
(মে দিবসে, পৃষ্ঠা-৩৭)

রাশেদ রউফ বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা রচনা করলেও তিনি নাগরিক জীবনের নানা সমস্যকেও তুলে ধরে তা সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন দায়িত্বশীলদের প্রতি। তাই তো তিনি নিজের শহরকে নিয়েও লিখেছেন,
চট্টগ্রাম যেন ছোট্ট সে গ্রাম
ঘারাতে বসেছে তার অতীত সুনাম।
সামান্য বৃষ্টিতে হয় গলা-জল
শহরকে মনে হয় সাগর অতল
রাস্তায় গাড়ি নয়, চলে সাম্পান
হয় না তো কোনো ক্রমে মুশকিল আসান!
চট্টগ্রাম যেন ছোট্ট সে-গ্রাম
কখনো কি ফিরে পাবে আগের সুনাম?
(‘চট্টগ্রাম; নয়, ‘ছোট্ট গ্রাম;, পৃষ্ঠা-৩৮)

বইয়ের শেষ পৃষ্ঠার কবিতা পড়ে মনের আবেগ কেউ ধরে রাখতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। এত আবেগ মাখানো কবিতা কারো তেমন পড়া হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদরের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল। যাকে ১৫ আগস্টেও কালরাত্রিতে ঘাতকরা গুলি করে রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রাসেল সে যেন সবার হৃদয়ে আঁকা ছবি।
রাসেল রাসেল কোথায় তুমি, কোথায় কর বাস
তোমার দিকে তাকিয়ে সবাই মাসের পরে মাস।
তোমার জন্য আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে হুহু
কাঁদে পাখি গাছগাছালি নদী মুহুর্মুহু।
সেই উচ্ছ¦াস, শ্বাস-প্রশ্বাস, নেই তো কোলাহল
তোমার জন্য কাঁদছে স্বদেশ, বুবুর চোখে জল।
(বুবুর চোখে জল, পৃষ্ঠা- ৪৮)
পুরো বইটিতে ৪০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতাগুলো রাশেদ রউফের একেবারে নতুন লেখা। তিনি এ কবিতাগুলোর মাধ্যমে একটি নিরীক্ষা চালিয়েছেন বলে আমার ধারণা। তাই তো কয়েকটি কবিতাকে ছড়ার অবয়বে দেখা গেলেও সেগুলো নিরেট কিশোর কবিতা। বইটির বহুল পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি। সুন্দর ঝরঝরে উন্নতমানের অফসেট কাগজে ছাপা বোর্ড বাইডিং বইটিতে চমৎকার সব ছবি এঁকেছেন শিল্পী আলমগীর জুয়েল। আর বইটি দাম রাখা হয়েছে মাত্র ৪০০/-টাকা।
শিবুকান্তি দাশ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়