ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

যুদ্ধ দিনের জনপদ

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২৭ মার্চ পাকিস্তানি মিলিটারিদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত, ১৬ এপ্রিল বিহারিদের আক্রমণ; তারপর থেকে গ্রামে আছি। আব্বা, মা, ভাই-বোনেরাও এসে আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের বাড়ি জামদিয়ায়। তখন এপ্রিলের শেষ। যশোর-নড়াইল বাস চলে না। মিলিটারি গাড়ি আসেনি কয়েক দিন। তাই বড় রাস্তায় গিয়ে বসি। এমনি এক বিকালে বসে আছি। সেদিন চাড়াভিটার হাটের দিন ছিল। একজন পাশে এসে বসল। নানা কথা। দেশের কথা, শহরের কথা, আমার কথা জানতে চাইল। তিনি আমনে (আমিনদ্দিন) জমাদ্দার। তার বাড়ি আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে, কয়েকটা ধান ক্ষেতের পরে। অনেক ক্ষণ গল্প করে গামছাটা কাঁধে ফেলে চলে গেলেন হাটের দিকে। রাতে শুয়েছি। খানিক রাতে নীরবতা ভেঙে গুলির আওয়াজ। পূব দিক থেকে। বাতাসে ফুর ফুর সুর তুলে উড়ে গেল গুলিটা। আবার একটা। দরজা খুলে দুজনে বের হলাম। ¤øান জ্যোৎসনা। আমাদের আগেই সেজোভাই বেরিয়ে পড়েছেন। দ্রুত জমাদ্দার বাড়ি ঢুকলেন। তার পায়ে বাঁধল এক মৃতদেহ। দেহটা উল্টালেন। বললেন- এখানে থাকা যাবে না, চলো। আমনে জমাদ্দার ওখানে মরে পড়ে আছে। সকালে ও বাড়িতে গেলাম। অনেক মানুষ এসেছে। মৃতদেহ ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সবাই। কে মারল? জমাদ্দারকে মারা হয়েছে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে। তবে গুলির আওয়াজ কেন? নানা প্রশ্ন। একজন বলল থানায় খবর দিতে, কিন্তু থানায় তো কেউ নেই! আমনে জমাদ্দারের তিন বউ। কেউ মুখ খুলছে না। ছোট বউটা নবযৌবনা, সন্তান হয়নি। সুন্দর গড়ন, সুন্দর চেহারা। রহমান মোল্লা বললেন ছোট বউকে বাঁশকলে দিলেই সব জানা যাবে। (দুটো চিকন বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে তার মধ্যে পা ঢুকিয়ে চাপ দেয়া।) ছোট বউ দ্রুত এসে রহমান মোল্লাকে জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রাখল- না গো, আমি কিছু জানি নে। রহমান মোল্লা বলিষ্ঠ যুবক। তাকে যদি অমন সুন্দর মেয়েটা জড়িয়ে ধরে, কার সহ্য হয়! বাঁশকলের প্রস্তাবে অনেকে আপত্তি করতে থাকলেন। বেলা গড়িয়ে গেল। মৃত্যু রহস্যের কুলকিনারা হলো না।
বসুন্দিয়ার হাট থেকে একদিন বাররার শফি মিনা আসছিলেন, ক’জনের সঙ্গে। তাদের হাতে লণ্ঠন, কাঁধে সদাই। শফি মিনা চেয়ারম্যান ছিলেন। পথে নকশালরা ছুরি মেরেছে। ছুরি কাঁধের দুই হাড়ের মাঝ দিয়ে সোজা কলিজায় বিঁধেছে। সেখানেই শেষ। নকশালরা তখন সুদখোর, মহাজন, ভূস্বামী নিধনে তৎপর।
একদিন সাইকেলে করে যশোর শহরের উদ্দশে রওনা হলাম। ছাতিয়ানতলার পর তারাগঞ্জ। এখানে বিধ্বস্ত বিহারি মহল্লা। মার্চ শেষে বাঙালির ক্যান্টনমেন্ট অভিযানের সময় তাণ্ডবে বিধ্বস্ত সব। ভাঙা ঘর পড়ে আছে। তারাগঞ্জ ছাড়িয়ে দাইতলার কাছে এলাম। রাস্তার পাশে দাইতলা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে বাঙ্কার বানিয়ে, বালির বস্তার উপর রাইফেল সাজিয়ে প্রহরায় আছেন কয়েকজন ইপিআর জওয়ান, খাকি পোশাক, মাথায় হেলমেট। সশস্ত্র যোদ্ধা, প্রশিক্ষিত বাঙালি। সশস্ত্র প্রতিরোধের কঠিন প্রচেষ্টা। মার্চজুড়ে ছাত্র-যুবক সাধারণ মানুষের যুদ্ধের মহড়া হয়েছে, লাঠি নিয়ে। আর এরা নিয়মিত বাহিনীর সদস্য, সত্যিকারের যোদ্ধা। সংখ্যায় চার-পাঁচজন হবে। তাদের সমস্ত অবয়বে দৃঢ়তার প্রকাশ। ওরা জীবনবাজি রেখেছে। ওদের দৃঢ়তা দেখে, প্রতিরোধের প্রত্যয় দেখে, নিয়মিত যুদ্ধের চিত্র দেখে সাহস পেলাম। নিজস্ব অভিজ্ঞতা মনে পড়ল : খালিশপুরে ২৭ মার্চ আমরা ২০-৩০ জন, হাতে বন্দুক, পকেটে গুলি। পাকিস্তানি মিলিটারি দেখামাত্র গুলি চালানো হলো। ঘটল অবিশ্বাস্য বিপর্যয়। প্রকট শব্দে অবিরাম গুলি আসতে থাকল; এলো নেভির গান বোট, বুম বুম শব্দে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে যখন কামানের গোলা আমাদের দিকে মারা হলো, তখন আমরা বিমূঢ়। এমনটা কল্পনা করেনি কেউ। বুক কেঁপে উঠল, হাতের বন্দুক হাতে রইল। ওরা কাছে এসে একে একে পাঁচ-ছয়জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করল। এখানে এই ক’জন ইপিআর ওই ক’টা রাইফেল দিয়ে কী করবে! টিকতে পারুক আর না পারুক, রুখে দাঁড়িয়েছে, এটাই প্রয়োজন, এই মরণটাই এখন বাঁচার উপায়। মাথার উপরে একটা ধীরগতি উড়োজাহাজ কয়েকবার চক্কর দিল। পরের দিন কয়েকটা গোলা এসে পড়ল ওদের বাঙ্কারের উপরে। কী জরিপ আর কী নিখুঁত নিশানা! ইপিআর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বাঁশের লাঠি নিয়ে মার্চে আমাদের কুচকাওয়াজ যে কত তুচ্ছ ছিল তখন বুঝিনি। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরেছে। যখন দেশটা মৃত্যুপুরী হয়ে গেছে, তখন সেই মৃত্যুর ফাঁক গলে কলেজ পড়–য়া, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া দুঃসাহসী ছেলেরা গেছে আসল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ। তারা স্টেনগান চালাতে শিখেছে, গ্রেনেড মারতে শিখেছে, গেরিলা যুদ্ধ শিখেছে, নিয়মিত

যুদ্ধ শিখেছে; নিজের পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে প্রাণ দিতে শিখেছে। গড়ে উঠল বিশাল মুক্তিবাহিনী। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধার সহায়ক।
আমরা শহরতলীর বিহারি বসতি এড়াতে উত্তরের মেঠোপথে নেমে গেলাম। শেখহাটি হয়ে নির্মীয়মাণ ঢাকা রোডের ব্রিজের ওপর দিয়ে ব্রিজ পার হলাম। আশপাশে ঝোপঝাড় জঙ্গল। তখনো জানতাম না যে এই নির্জন ব্রিজের তলাতেই বধ্যভূমি। ব্রিজের তলায় মরা-নদীর পাড়ে কচুরিপানার ধারে বিহারিরা বহু মানুষকে খুন করেছে। শহরে টিকতে না পেরে প্রাণভয়ে যারা এই পথে বের হয়েছে, তাদের ধরে এখানে হত্যা করা হয়েছে। বন্ধু তিমির বরণের বাবা এখানে নিহত হয়েছেন। শঙ্কর সাহার বাবারও কোনোদিন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারও এপথে শহর ছাড়বার সম্ভাবনা ছিল।
শহরের প্রবেশমুখে কেউ কোথাও নেই। নাথপাড়ায় প্রদীপ নাথের বাড়ির দিকে তাকালাম। কেউ নেই, পুরো এলাকাই নির্জন, সবাই শহর ছেড়ে গেছে। পণ্ডিত পুকুরর কাছে এসে মনে হলো মঈনুদ্দিন মিয়ার বাসার দিকে গেলাম, তার কাছ থেকে শশুরের (ফিরোজা বেগমের বাবার) খবর পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। ওখানে বিহারি, আধাবিহারিরা থাকত। মইনুদ্দিন মিয়ার নাম ধরে বার কয়েক ডাকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। নিরাপদ মনে হলো না। আবার খালধার রোড দিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এক বুড়ো বিহারি মাথায় করে দুটো টিন আনছিল, আর একজন সুঠাম বিহারিকে দেখে সে বলল- ‘মালাউন কা ঘর সে লায়া।’ আক্ষেপ হলো। ওদের পেরিয়ে অম্বিকা বসুর বাড়ির সামনে এসে পড়লাম। জমিদার পরিবারের পরিত্যক্ত বিশাল এই বাড়িতে কোনায় কানায় কয়েক ঘর দরিদ্র হিন্দু থাকতো। মিলিটারি আগ্রাসনের পর বিহারিরা হুমকি দিত- সব মালাউন আওরাতকে মিলিটারিদের হাতে ধরিয়ে দেবে। আতঙ্কে সবাই পালিয়েছে। বাড়ি পৌঁছলাম, ভেতরে ঢুকলাম। তালা ভাঙা। দরজার শিকল খোলা। ভেতরে সবই আছে শুধু ঘরে রাখা চালগুলো কারা নিয়ে গেছে। চাল ছড়িয়ে আছে ঘরের বারান্দায়। শিকলটা কোনো রকম লাগিয়ে রেখে বের হলাম। আবার সেই পথ ধরে জামদিয়ায়।
পাশের করিমপুর গ্রামে প্রবোধ স্যার থাকতেন। একদিন তার কাছে গেলাম। শিক্ষক মানুষ। শহরের লোন অফিস পাড়ায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন সেই বাড়িওয়ালা স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিন্দু ভদ্রলোক শহর ছেড়ে নিজ গ্রামে যাওয়ার পথে পরিবার-পরিজন নিয়ে এক রাত প্রবোধ স্যারের এই বাড়িতে ছিলেন। তারা যাওয়ার পর প্রবোধ স্যারের স্ত্রীর কিছু গহনা পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রবোধ স্যার সাইকেলে করে সেই ভদ্রলোকের গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত যেয়ে সেখান থেকে সব গহনা নিয়ে এসেছেন।
দু-চার দিন পর আব্বা যশোর যেতে চাইলেন। চাড়াভিটায় এসে একটা রিকশা ভ্যান পাওয়া গেল। চাড়াভিটা চলেকলের করিম ভাইসহ আরো দু-একজন মানুষ পাওয়া গেল। আব্বাসহ ওরা ভ্যানে বসলেন। আমি আর ছরোয়ার সাইকেলে। যখন ঝুমঝুমপুরে পৌঁছলাম, বিহারিরা থামালো। শুনেছিলাম যে বিহারিরা একটা কুয়ো বানিয়েছে। বাঙালিদের ধরে সেই কুয়োর পাশে জবাই করছে, বাঙালির রক্তে কুয়ো ভরছে। যে বিহারিরা আমাদের ভ্যান থামাল, তাদের অনেকেই চেনা, তারাও আমাদের চেনে। করিম ভাইকে ভ্যান থেকে নামাল। জিজ্ঞাসা করল- ওই দিন তুমি ছিলে, না? ওই দিন বলতে যে দিন নড়াইল থেকে ক্যান্টনমেন্ট অভিযানে আগত অভিযাত্রীরা বিহারিদের তছনছ করেছিল। করিম ভাই অস্বীকার করলেন। করিম ভাইয়ের বয়স তিরিশ পয়ত্রিশ। ওরা আমাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে করিম ভাইকে নিয়ে গেল বিহারি পল্লির মধ্যে। করিম ভাই জবাই হবেন! ভ্যান দ্রুত আর এন রোডে আমাদের বাড়ি এসে থামলে আব্বা ওপারের বিহারিপট্টির দিকে ছুটে গেলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হামদর্দ দাওয়াখানার বিহারি হেকিম সাহেবকে নিয়ে এলেন। একটা রিকশায় দু’জনে ছুটলেন ঝুম ঝুম পুরের দিকে। সাইকেলে পিছু নিলাম। করিম ভাই বিহারিপট্টির ভেতর থেকে বের হয়ে আসলেন। আতঙ্কে আধমরা হয়ে গেছেন। আবার ফিরে এলাম গ্রামে।
আমার বড় সমস্যা ফিরোজা বেগমের কান্না। সেই যে পাঁচ তারিখে পথে শুনেছে যে তার আব্বাকে মিলিটারিরা গুলি করেছে, সেই থেকে সে অবিরাম কেঁদে চলেছে। মাঝেমধ্যে ধমকাই, তাতে ওর কান্না শুধু বাড়েই। এই ক্রন্দনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় একদিন ভোর না হতেই সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম, সঙ্গে ছরোয়ার। যাবো ফিরোজা বেগমের বাপের বাড়ি কালীগঞ্জ। তিনি মরবেন কেন- তিনি তো মুসলিম লীগার! সোজা রাস্তায় মৃত্যু ওৎ পেতে আছে। মেঠো পথ ধরলাম, মাইল তিরিশেক হবে। দহাকুলা আর বাঘারপাড়ার মাঝে ছোট্ট গাঙ্গ। বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর পাড়েই থানা। থানায় দারোগা পুলিশ নাই। খাজুরার পথে এগোলাম। গ্রামের পথ। লোকজন খুবই কম। খাজুরা বাজারে দু-একটা দোকান খোলা। এক প্রান্তে একজন হিন্দু ময়রা লুচি ভাজছে- বেজায় সাহস তার, অথবা নিরুপায় অথবা বোকা! আবার গাঙ্গ পার হওয়া। এখানেও বাঁশের সাঁকো। খেয়ায় সাইকেল পার করলাম। যখন শ্বশুর বাড়ির ‘ফয়লা’ গ্রামে পৌঁছলাম, তখন বেলা দুটো হবে। দোতলা বাড়ি, সঙ্গে অনেক চালা ঘর। শহর থেকে বেশ দূরে। তখন এপ্রিলের শেষ বা মে’র প্রথম, তবু জন মানবশূন্য। বড় চাচা একা উঠানের এক কোনে টিউবওয়েল চেপে গোছল করছেন। দেখা হতেই বললেন- ‘সব শেষ, ওই যে ওইখানে মাটি দিয়ে থুইছি।’ সব আশা নিভে গেল।
ভেবেছিলাম যা শুনেছি সব ভুল। তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই মরবেন না। হলো তার উল্টো। কালীগঞ্জ বাজারে তিনি তার নিজের বাড়িতেই ছিলেন। কয়েকদিন বের হননি। পহেলা এপ্রিল একটা সাইকেল নিয়ে কয়েরগাছি গেলেন। একটা মাছ ধরালেন। বাড়ি ফেরার জন্য যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক ধরে আসছেন। হঠাৎ মিলিটারি লরির বহর সামনে এসে পড়ল। কথা নেই বার্তা নেই, একরাশ গুলি! মিলিটারির গুলিতে ঘায়েল হয়ে গেলেন। তার হাতের তালুতে গুলি, মুখে গুলি, বুকের সামনে গুলি, পিঠে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে গেছে গুলি। রক্তাক্ত সফেদ পাঞ্জাবী। ঢলে পড়লেন রাস্তার পাশেই। শেষ হয়ে গেলেন। তাকে সামনে থেকে গুলি করা হয়েছে, বোধ করি চলন্ত ট্রাক থেকেই। মিলিটারি লরির বহর ঝিনাইদাহর দিকে চলে গেলে গ্রামবাসী দু-একজন এলেন। মৃতদেহ ফয়লা গ্রামে নেয়া হলো। কাফনের কাপড়ের কেউ চেষ্টাও করলেন না। দোকান পাষাণ সব বন্ধ। তাড়াতাড়ি মাটি চাপা দিয়ে আতঙ্কিত সবাই যে যেদিকে পারেন চলে গেলেন। নূর আলী মিয়া সমাহিত হলেন, যে কাপড়ে শহীদ হয়েছেন সেই কাপড়েই। মোবারকগঞ্জ সুগার মিল প্রতিষ্ঠায় তার অবদান আছে, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তার অবদান আছে, অনেক স্কুল-কলেজের পরিচালনা পর্ষদের তিনি সদস্য। আজ মরার সময়ে কেউ নেই। মিলিটারিরা দাঁড়ায়নি। কোনো কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। জেলা-শহর থেকে অনেক দূরে একজন পথচারীকে নির্বিচারে গুলি করে শেষ করে দিল। এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞ চলেছে সেই ২৫ মার্চ থেকে। নূর আলী মিয়ার একটা একটা রাজনৈতিক জীবন ছিল। ষাটের দশকে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। খুলনা বিভাগীয় উন্নয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে তার আর এক প্রতিদ্ব›দ্বী চান্দ আলী নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তার লাশ উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, উল্টো পুলিশ কেসের আসামি হয়ে বন্দি হলেন। তাকে ছাড়িয়ে আনতে সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের কাছে যাওয়া হয়েছিল। ইয়াকুব খান নূর আলী মিয়াকে অব্যাহতি দেন এবং বলেন নূর আলী মিয়া যেন অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা শহরের সেক্রেটারিয়েটে বিশাল দেয়াল-লিখন দেখেছি ‘সুদখোর চান্দ আলী হত্যার মধ্য দিয়ে নকশাল বাড়ি আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে দেয়া হলো’। আন্দোলন পরিচালনা করত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী)। নাজেহাল হলেন নূর আলী মিয়া।
দেবব্রতর বাবা সুধীর বাবুকে ২৮ মার্চ মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফেরেননি। ষাটের দশকে যশোর পৌরসভা নির্বাচনে সুধীর বাবু মুসলিম লীগের হয়ে প্রার্থী ছিলেন। তিনি ধর্মে ছিলেন হিন্দু। নূর আলী মিয়াও মুসলিম লীগ করতেন, তিনি ধর্মে ছিলেন মুসলমান। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, গণহত্যায় হিন্দু-মুসলমান বাছবিচার করেনি। সুধীর বাবুকে ওরা কেন মারল? নূর আলী মিয়াকে কেন মারল? মসিয়ুর রহমানকে কেন মারল! ভাসানী ন্যাপের অ্যাডভোকেট জব্বারকে কেন মারল! এদের বয়স প্রায় ষাট। এরা তো অস্ত্রধারী ছিলেন না। কোনো মিটিং-মিছিল, বোমা হামলা বা এমন কিছু থেকেই তাদের ধরা হয়নি। যুদ্ধ হয় সৈন্যে সৈন্যে। এখানে হত্যা করা হলো ভারী অস্ত্রধারী সৈন্যদের দ্বারা সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে। মাইলের পর মাইল বস্তি জ¦ালিয়ে দিল, ব্রাশ ফায়ার করল। এই লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য কার কতটুকু কী করণীয় ছিল? কারো কি কোনো দায়িত্ব ছিল না! মার্চের ১৫ থেকে ২৪ পর্যন্ত সামরিক জান্তার সঙ্গে আমাদের নেতাদের আলোচনা হয়েছে। কি আলোচনা হতো তা জানা যেত না। এখন জানা যায়, সে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল ক্ষমতা ভাগাভাগি। নেতারা যাই চান না কেন, জনগণের বুঝতে বাকি ছিল না যে, পাঞ্জাবী সামরিক জান্তা বাঙালিকে দেশ পরিচালনার ভার দেবে না; তাই স্বাধীনতার বিকল্প নেই। সে জন্য কি এত মূল্য দিতে হলো! দেশকে অখণ্ড রাখতে কি এই গণহত্যা! নিশ্চয়ই নয়। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাঞ্জাবী জেনারেলরা জানত যে আন্দোলন দমাতে যদি একটা গুলিও চলে, তবে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। ২৬ মার্চের ভাষণে ইয়াহহিয়া খান বলেছিলেন- শেখ মুজিব ও তার দল সমান্তরাল প্রশাসন চালাচ্ছে, এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যাবে না। ক্ষমতা দেখানোর জন্যই কি এই হত্যাযজ্ঞ! মার্চে পূর্ব পাকিস্তান চলছিল আওয়ামি লীগের নির্দেশমতো। মিলিটারি সরকারের নির্দেশ মানা হতো না। মিলিটারি পথে নেমেছে মার্চের প্রথমেই। আমরা তাদের ঢিল মেরেছি, ককটেল মেরেছি, তাদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধের পাঁয়তারা করেছি; সংঘর্ষে বাঙালি মরেছে, পাকিস্তানি সেনাও মরেছে। তাদের ক্ষমতার প্রতি এই চ্যালেঞ্জ তারা বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়নি। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে তারা অস্ত্র এনেছে, মিলিটারি এনেছে। আমাদের নেতারা সবই জেনেছেন। কিন্তু মৃত্যু আমাদের পথ ছাড়েনি। পাকিস্তানি মিলিটারিদের কোনো বিচারও হয়নি।
বিকেলে দুই ভাই ঘর থেকে বের হলাম। বাড়ির পাশেই তাজা কবর, ফিরোজা বেগমের পিতার। কালীগঞ্জ বাজারের দিকে গেলাম। মাইলখানেক পথ। এ পথেও নির্জনতা। বাজারের প্রান্তে শ্বশুর বাড়িতেও কেউ নেই। আশপাশের বাড়িতেও কেউ নেই। রাস্তার গায়ে একটা জরাজীর্ণ ঝুপড়িতে এক অতি দরিদ্র হিন্দু দম্পতি থাকত। মিলিটারিরা তাদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছে। পথ ধরে এগোচ্ছি। পাশের গলি থেকে শুধু একটা কুকুর বেরিয়ে এসে রাস্তা পার হলো। পাগলা মোহম্মদ বেরিয়ে এলো এক গলি থেকে- ও একটা নিরাশ্রয় নিঃস্ব যুবক, বুদ্ধি কম। জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় থাকিস? উৎসাহের সঙ্গে বলল – এই যে এই সব বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। নির্জন শহরে আর এগোতে সাহস হলো না। গা ছম ছম করছে। তখন সম্ভবত মে মাসের প্রথম। এক মাস হয়ে গেছে। যশোর শহর থেকে অনেক দূরে এই প্রত্যন্ত শহর এখনও এক পরিত্যক্ত জনপদ। সংলগ্ন গ্রামগুলোও জনশূন্য। মৃত্যুর বিভীষিকায় জনপদ এতই আতঙ্কিত। নূর আলী মিয়ার কয়েকটি বাস ছিল- খুলনা-কুষ্টিয়া লাইনে চলতো। মিলিটারিরা একটা বাস নিয়ে গেছে। বিহারিরা আর একটা নিয়ে গেছে।
পরদিন ভোরে, জামদিয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। খাজুরা থেকে বাঘারপাড়ার মাঝখানে পথে দেখা হলো এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে। তাদের হাতে কাঁধে কাখে পোটলা পুটলি। পরিবারের যুবকটিকে চিনি। রোস্তমপুরের বাসিন্দা। মা, স্ত্রী-সন্তানসহ প্রায় সাত-আট জন চলেছেন। গন্তব্য ভারত। বারোবাজারের উত্তর দিয়ে পশ্চিমে যাবেন সীমান্ত পার হতে। পুরো তিরিশ পয়ত্রিশ মাইল পথ হেঁটেই যাবেন। তেমন কোনো বিপদে ছিলেন বলে মনে হয়নি। তবু যাচ্ছেন। নিরাপত্তার কথা ভেবে। হয় তো ভয় পেয়েছেন। হয়তো ভারতে আত্মীয়স্বজন আছে।
দ্বিপ্রহরে জামদিয়ায় পৌঁছলাম। ফিরোজা বেগম এলো। বললাম- আরে কিচ্ছু না, কিচ্ছু হয়নি, সব গুজব। ফিরোজা বেগম প্রজাপতির মতো উড়তে লাগল। আব্বা, মা সকালে যশোর চলে গেছে। হয়তো এই ভয়াবহ মিথ্যাটার সামনে থাকতে হবে না বলে? পরদিন হাটে যাচ্ছি। পথে মৌলভী সাদেক জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি এটা কী বললে? আমি বললাম- এছাড়া আর উপায় কী? তিনি বললেন- বুঝতে পারছি। মৌলভী মানুষ, মসজিদের ইমাম; তবু আমার এই মিথ্যা কথাটা হাসিমুখে মেনে নিলেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়