রাজধানীতে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

আগের সংবাদ

ঝুঁকির মধ্যেই অনিয়ম বহাল

পরের সংবাদ

প্রকৃতির প্রতিশোধ

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রান্নাঘর লাগোয়া রুমটিতে শুয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মজিলা বেগম। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে তার। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার ফাঁক গলে শীতের তীব্রতা প্রবেশ করছে ঝাঁ ঝাঁ করে। বেড়ার ওপর দিকের ছিন্নভিন্ন অংশ, যা দিয়ে আকাশের মিটিমিটি তারার আবছা আলো দেখা যাচ্ছে কখনো কখনো। তোশকবিহীন কাঠের বিছানায় পিঠে অসহ্য ব্যথা হয়। গায়ে জড়ানো কাঁথাকে মনে হয় পানিতে চুবিয়ে আনা।
প্রকৃতির ডাক মধ্যদুপুর আর মধ্যরাত বোঝে না। যখন তার সময় হবে তখনই সে ডাক দেবে, যার ব্যত্যয় হয়নি আজো। এই মধ্যরাত্রিতে প্রকৃতির ডাকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য হন মজিলা বেগম। কিন্তু অন্ধকারে হাতড়িয়েও বদনা পান না তিনি। ঠাণ্ডায় কাঁপছে মজিলা বেগমের সমস্ত হাত-পা। কাঁপা কণ্ঠে তিনি নাতিদের ডাকেন, ‘বদনাটা কই রাখছস রে? তগর জ¦ালা আর ভাল্লাগে না।’ কিন্তু মজিলা বেগমের ক্ষীণ কণ্ঠের ডাক পৌঁছে না উঠানের ওপাড়ে হাফ বিল্ডিংয়ে শুয়ে ঘুমানো পুত্র, পুত্রবধূ কিংবা নাতিদের কানে। অন্ধকারে বদনা খুঁজে টয়লেটে ঢোকার পূর্বেই কাপড় ভিজিয়ে ফেলেন মজিলা বেগম। শীতের তীব্রতায় ঠকঠক করে কাঁপেন তিনি। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই কাঁথার নিচে ঢোকেন। শীত থেকে নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কাঁথা দিয়ে নাক অবধি ঢেকে ছানাভরা চোখে মিটমিট করে তাকালেন খড়ের চালার দিকে। চালার ঘন কুয়াশা ফোঁটা হয়ে টুপ করে পড়ে যায় তার কপালে। আবার কেঁপে ওঠেন মজিলা বেগম। প্রকৃতির এহেন বৈরী আচরণে তিনি রাগে চোখ বন্ধ করেন।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! স্বামীর হাতে নির্মিত হাফ বিল্ডিংয়ের দুটি রুমের একটিতেও জায়গা হয়নি মজিলা বেগমের। একটিতে থাকে একমাত্র পুত্র-পুত্রবধূ। অন্যটিতে নাতি-নাতনি। আজ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে মজিলা বেগমের ঠাঁই হয়েছে রান্নাঘরের পাশের এই জীর্ণ ঘরটিতে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এই হাড়কাঁপুনি শীতের রাতে শ্রদ্ধেয় ও গুরুজন হিসেবে তারই হাফ বিল্ডিং ঘরে গরম কম্বলের নিচে থাকার কথা ছিল; কিন্তু সেই কম্বলের নিচে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে তার পুত্র-পত্রবধূ। আর এই মাঘের শীতে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। পুত্রবধূ মজিলা বেগমকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। একমাত্র পুত্রকেও তিনি সুপুত্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি। পুত্রকেই বা দোষ দেবেন কী করে; পুত্র তার বউকে কিছু বলতে গেলেই সে পুরো বাড়িটাই মাথায় তুলে নেয়। মজিলা বেগমের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। পুত্র বা পুত্রবধূকে নয়; অবশেষে নিজের কপালকেই দোষ দেন। দোষ যে তার নিজেরও আছে। তিনি অনুশোচনায় আবারো দুচোখ বন্ধ করেন। বহিঃচক্ষু বন্ধ করলেও মানসচক্ষু তার ঠিকই খোলা। সে চক্ষু দ্বারা হৃদয়ের করিডোরে ছড়ানো বিশাল ক্যানভাসে যে ছবি ভেসে উঠছে, তা তিনি স্পষ্ট দেখতে পান।
আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। মজিলা বেগম তখন টগবগে যুবতী ছিলেন। শ্বশুর তার বিয়ের আগেই মারা যান। এ সংসারে এসে স্বামী ও পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্বাশুড়িকে পান তিনি। মজিলা বেগম শ্বাশুড়িকে সংসারের আপন মনে করতেন না। ওই বৃদ্ধা কবে মরবে; কবে তিনি আছান পাবেন- এই চিন্তায় তিনি অস্থির থাকতেন। বৃদ্ধার শরীর থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোয় বলে তিনি তার শ্বাশুড়ির বিছানা রান্নাঘরে স্থানান্তর করেন। তখন তিনি ভাবতেও পারেননি শ্বাশুড়ি কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন। যেটা তিনি আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। তিনি ফিসফিস করে বললেন- প্রকৃতিই আজ প্রতিশোধ নিচ্ছে। আহা! প্রকৃতির প্রতিশোধ কত নিষ্ঠুর; কত নির্মম!
শীতের সকালে, হালকা রোদে নিজেকে উষ্ণ করার প্রয়াসে মজিলা বেগম সূর্যের মুখোমুখি বসে আছেন। এই সকালে ঘুম আসার কথা নয়; অথচ কোনো এক অজানা কারণে তার দুচোখে ঘুম-পরীরা ভর করেছে, তিনি বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। রাতে বিছানা ভেজানোর কারণে পুত্রবধূ এই সাত-সকালেই তাকে বকাঝকা করেছে। এই বকাঝকাই প্রাপ্য হিসেবে তিনি মাথা পেতে নিয়েছেন। তিনি আজ বাকরুদ্ধ। তার মন গুমরে গুমরে কেঁদেছে, কিন্তু চোখ জোড়া একেবারেই কাঁদেনি। কান্নার যে ভাষা সে ভাষা শুধু মন নয়, চোখও হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ যে নেবেই, প্রকৃতির প্রতিশোধ যে অলঙ্ঘনীয়- এটা তিনি বোঝে গেছেন। মজিলা বেগম একমাত্র নাতিকে ডেকে বললেন- শোনো দাদুভাই, পিতা-মাতাকে কখনো কষ্ট দেবে না। বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশোনা করো। সেবাযতœ করো। যদি না করো তা হলে মনে রেখো- প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেবেই। আর প্রকৃতির প্রতিশোধ যে বড়ই নিষ্ঠুর!
মজিলা বেগম জানেন, এই কঠিন কথাগুলো বোঝার বয়স তার নাতির এখনো হয়নি; তবুও তিনি বলে চললেন- আমি চাই না আমার মতো ভুল কেউ করুক। আর প্রকৃতি তার ওপর কঠিন প্রতিশোধ নিক। প্রকৃতির প্রতিশোধ যে বড়ই নিষ্ঠুর, বড়ই বেদনার।
– মো. মাঈন উদ্দিন : ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়