ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে : কলকাতায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

সমন্বয় নেই ভবন তদারকিতে : আইনের ফাঁক গলে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন > রাজউকের নকশা মেনেই সেবা সংযোগ দেয়ার পরামর্শ

পরের সংবাদ

থিয়েটারের অনিবার্য দ্রোহী মামুনুর রশীদ

প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে নিয়মিত নাট্যচর্চার ইতিহাস প্রায় স্বাধীনতার সমান বয়সি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চা বা নাট্য আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গেলে যে নামগুলো দৃশ্যপটে আসবে মামুনুর রশীদের নাম তার প্রথম দিকেই থাকবে। মামুনুর রশীদের হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলন এক নতুন পথের সন্ধান পায়। মামুনুর রশীদ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী স্কুল-কলেজ ও উৎসবভিত্তিক নাট্যচর্চা বাদ দিলে মূলত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই মামুনুর রশীদের নাট্যপ্রচেষ্টা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলা সময়ে তিনি সেখানে বসে রচনা করেন তার প্রথম নাটক ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’। যদিও সেখানে নাটকটি মঞ্চায়নের চেষ্টা সফল হয়নি, কিন্তু এই সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে তার নাট্যপ্রচেষ্টা শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করার সুবাদে মামুনুর রশীদ প্রত্যক্ষ করেন নকশাল আন্দোলন ও সিপিএমের উত্থান। তৎকালীন বাম রাজনীতির প্রতি শিল্প-সাহিত্যের মানুষদের চিন্তাভাবনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের মমত্ববোধ তাকে মার্ক্সবাদী ধ্যান-ধারণার দিকে ধাবিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই মামুনুর রশীদের সাক্ষাৎ ঘটে আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে। তার দ্বারাও মামুনুর রশীদের রাজনৈতিক চেতনা প্রভাবিত হয়।
যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধকালীন নাটক মঞ্চায়নের স্বাপ্নিক মামুনুর রশীদ স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন নাটক মঞ্চায়নের তৃষ্ণা নিয়ে। কেননা কলকাতায় অবস্থানকালীন তিনি সেখানকার থিয়েটারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, সাক্ষাৎ পেয়েছেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বদের।
স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকজন সমমনা বন্ধু-অগ্রজকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আরণ্যক নাট্যদল। ফেব্রুয়ারি যেহেতু ভাষার মাস, তাই সিদ্ধান্ত হলো তাদের প্রথম প্রযোজনা হবে মুনীর চৌধুরী রচিত ‘কবর’ নাটকটি। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ‘কবর’ নাটকের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ, আরণ্যক নাট্যদল ও মামুনুর রশীদের নাট্যপ্রচেষ্টার যাত্রা শুরু হলো। মামুনুর রশীদ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নাটকের নির্দেশক, আরণ্যক নাট্যদল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নাট্য প্রদর্শনী করা দল। এর পরপরই মামুনুর রশীদ মঞ্চে নিয়ে আসেন পশ্চিমের সিঁড়ি- যে নাটকটি মঞ্চায়নের স্বপ্ন মাথায় নিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
পূর্বেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই মামুনুর রশীদের মধ্যে মার্ক্সবাদী চেতনা গড়ে ওঠে। ষাটের দশকের চীনা বিপ্লব দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। এসবের প্রতিফলনই ঘটে তার পরবর্তী নাট্যপ্রচেষ্টায়। একটি সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নে তিনি বাংলাদেশের নাটকে এক উন্মাতাল আবহের সৃষ্টি করেন। তার নাটকের কেন্দ্রীয় বিষয় ‘মানুষ’। এই মানুষ নিম্নবর্গের মানুষ। এদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহই তিনি তার নাটকে ব্যবহার করেছেন। এসব মানুষের পরাজয় যেমন তাকে ব্যথিত করে, তেমনি এদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির উত্থানের সম্ভাবনাও তাকে উজ্জীবিত করে। এ ক্ষেত্রে মামুনুর রশীদ প্রতিষ্ঠিত ‘আরণ্যক নাট্যদল’-এর স্লোগানও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আরণ্যক মনে করে, ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণিসংগ্রামের সুতীক্ষè হাতিয়ার।’ সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব আছে। সেই শ্রেণি হচ্ছে- খেটে খাওয়া মানুষ। এই খেটে খাওয়া মানুষদের অন্তর্গত সংঘাত, মানবিক সংকট, জীবনের উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ চিত্রিত হয়েছে মামুনুর রশীদের নাটকে। যা পশ্চিমের সিঁড়ি হয়ে গান্ধর্ব নগরীর মাধ্যমে মামুনুর রশীদের নাটকে আভাসিত হয়। আর এর প্রকৃত স্বরূপ পাওয়া যায় ওরা কদম আলী নাটকের মাধ্যমে। এরপর ওরা আছে বলেই, ইবলিশ, অববাহিক, এখানে নোঙর, গিনিপিগ, একেবারে শ্রেণিসংগ্রামকে সমান্তরালে রেখেই চলে এই নাট্যযাত্রা।
১৯৮৮-তে রচিত সমতট নাটকে এসে কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। এবার আর সরাসরি শ্রেণিসংগ্রাম নয়, সামনে আসে মানুষ ও সমাজের অন্তর্গত বিচিত্র বিষয়াবলি। রচনা করলেন ‘মানুষ’। এরপর লেবেদেফ, পাথর, জয়জয়ন্তী, রাষ্ট্র বনাম, সংক্রান্তি, রাঢ়াঙ, শত্রæগণ, ভঙ্গবঙ্গ এবং হালের কহে ফেসবুক। রুশ দেশীয় পরিব্রাজক-গবেষক থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদ, কীর্তনের দল, মুক্তিযুদ্ধ, সং যাত্রার দল, সাঁওতাল, পশ্চিমা শোষক শ্রেণি, দেশভাগ, প্রযুক্তির অপব্যবহার- সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তার নাটকে।
মামুনুর রশীদ শুধু বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের বিষয়-উপাদানেই বৈচিত্র্য আনেননি, তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নাটকে নিরীক্ষাও করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। তিনি ছিলেন নাটককে মঞ্চের গণ্ডিবদ্ধ সীমানা থেকে মুক্ত করার প্রয়াসী। নাটককে মুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি নাটককে নিয়ে যেতে চেয়েছেন থিয়েটারপাড়ার চৌহদ্দীর বাইরে, মফস্বলে, গ্রামের আনাচকানাচে। যার ফল ‘মুক্তনাটক’।
সমাজ ও রাষ্ট্রের দুঃসময়ে মামুনুর রশীদের নাটক মানুষকে জাগরণের অভয় বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনে শোষণ ও বঞ্চনাহীন সমাজ গঠনের বাসনাকে নিয়ত জাগ্রত রেখেছে। তাই মামুনুর রশীদের নাট্যদর্শন আজ পরিণত হয়েছে এক সামগ্রিক নাট্যদর্শনে। আর মামুনুর রশীদ পরিণত হয়েছেন থিয়েটারের এক ‘অনিবার্য দ্রোহী’তে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ৭৬ বছরে পা রাখলেন নাট্যজগতের এই কিংবদন্তি।

:: অপু মেহেদী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়