সব মামলায় জামিন : জহির উদ্দিন স্বপনের মুক্তিতে বাধা নেই

আগের সংবাদ

বিভীষিকাময় এই মৃত্যুর দায় কার : ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে মালিককে তিনবার নোটিস দেয় ফায়ার সার্ভিস, রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকানের অনুমোদন ছিল না

পরের সংবাদ

বাংলা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ভেতর-বাহির

প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বায়ান্নর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার সফল আন্দোলন পরবর্তী বাংলা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন বাংলা চলচ্চিত্রের নির্মাণ পর্ব। মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের হাত ধরে বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের সেই অভিযাত্রা হিন্দি-উর্দু চলচ্চিত্রের বাজার সৃষ্টির প্রধান অন্তরায় রূপে দাঁড়িয়ে যায়। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরও কলকাতার বাংলা এবং বোম্বের হিন্দি ছবি পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে প্রদর্শিত হতো। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান। তবে সুযোগের মওকায় লাহোর ও ঢাকায় নির্মিত উর্দু ছবি কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিকল্পরূপে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে, পাশাপাশি ঢাকায় নির্মিত সুস্থ বিনোদনের বাংলা ছবির দাপটে। উর্দু ছবির প্রসারের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় ছিল ভাষা। বাংলা ছবি আমাদের সমাজ-জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল বলেই বাংলা ছবির দর্শকের অভাব ঘটেনি। সে সময়কার বাংলা ছবি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের স্বর্ণযুগের দাবি রাখে। বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে বাংলা চলচ্চিত্র নিজ গুণে উর্দু চলচ্চিত্রকে যেমন পরাস্ত করতে পেরেছিল। তেমনি পেরেছিল দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহ মুখো করতে। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলা চলচ্চিত্র-বাংলা সাংস্কৃতিক চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
পাকিস্তানি আমলে আমাদের সাংস্কৃতিক বিনোদনের অপরিহার্য অংশ ছিল প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখা। এ ছাড়া রেডিও শোনার শ্রোতারও অভাব ছিল না। রেডিওর চারপাশে বসে নাটক, গান শোনার প্রচলন ছিল সর্বাধিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিল রেডিও। ঢাকা বেতার, আকাশবাণী, বিবিধ ভারতে সম্প্রচারিত বাংলা নাটক, বাংলা গান শোনার শ্রোতা ছিল সর্বাধিক। যার মূলে ছিল ভাষা। ভাষার কারণেই কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্র, নাটক, গান আমাদের শ্রোতা-দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। জনপ্রিয় বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পীদের গান লোকমুখে যত্রতত্র শোনা যেত।
আমাদের সমাজ-জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাংলা ছবি পরিবার সমেত প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার প্রবণতা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিনোদনের এই মাধ্যমটি আর পূর্বাবস্থায় অক্ষুণ্ন থাকেনি। স্বাধীনতার পর বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা-স্থূলতা, দাঙ্গাবাজি ঢুকে পড়ে এবং ক্রমেই বাংলা চলচ্চিত্র তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে বসে। রংবাজ ছবির হাত ধরে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে সর্বনাশের যে ধারাটির সূচনা হয়েছিল; পর্যায়ক্রমে সেই অসুস্থ ধারায় আমরা হারিয়েছি চলচ্চিত্র বিনোদন এবং প্রেক্ষাগৃহগুলো হারিয়েছে অগণিত দর্শক। দর্শকরা সেই যে প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ হয়েছিল। তা আর পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। হালের দশা আরো করুণ। খোদ ঢাকা শহরে অনেক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে। গুলিস্তান, নাজ, স্টার, মুন, লায়ন, তাজমহল, শাবিস্তান, রূপমহল, শ্যামলী, বিউটি প্রভৃতি প্রেক্ষাগৃহগুলো এখন মার্কেটে পরিণত। দেশের অন্যান্য জেলা শহরগুলোর ক্ষেত্রেও একই দশা দেখা যায়। একই দশা কলকাতায়ও দেখা যায়। কলকাতায়ও অনেক প্রেক্ষাগৃহ মার্কেটে পরিণত হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের সব দেশেই চলচ্চিত্র শিল্পের দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। একটি স্রেফ বাণিজ্যিক। অপরটি সৃজনশীল। স্বাধীনতার পর দেশে সৃজনশীল ছবি নির্মিত হয়নি, এটা সত্য নয়। তবে বাণিজ্যিক ধারার দাপটে সৃজনশীল চলচ্চিত্র দাঁড়াতে পারেনি। বাণিজ্যিক ছবির লাগাতার প্রেক্ষাগৃহ বুকিংয়ের কারণে সৃজনশীল ছবি মুক্তি পর্যন্ত দেয়া সম্ভব হয়নি। এতে আর্থিক ক্ষতির শিকার সৃজনশীল চলচ্চিত্রের আশানুরূপ বিকাশ সম্ভব হয়নি। সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং অঙ্গীকারেই যুক্ত হয়েছেন। পুঁজির লগ্নিকারকরা বাণিজ্যিক ছবিতে বিনিয়োগ করলেও, সৃজনশীল চলচ্চিত্রে বিনিয়োগে মোটেও উৎসাহী হয়নি। লগ্নি করা পুঁজির মুনাফা সমেত ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কায় তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেনি। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা আশানুরূপ পায়নি, তেমনি নানাবিধ প্রতিকূলতা-বিড়ম্বনা উপেক্ষা করেই নির্মাতারা সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব করেছেন। তারা প্রত্যেকে স্বউদ্যোগ ও অঙ্গীকারেই সৃজনশীল ধারাটিকে বাঁচাতে মরণপণ চেষ্টা করছেন। চলচ্চিত্রের ন্যায় সৃজনশীল মাধ্যমটি বিনষ্ট হয়েছে মুনাফার লালসার কাছে। হিন্দি ও দক্ষিণ ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবির রিমেক ব্যবসায় এখন ভাটির টান পড়েছে। স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে ঘরে বসেই দর্শক আদি-রস গ্রহণ করতে পারছে। বাংলা রিমেক অর্থ খরচ করে দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন ফুরিয়েছে। আমাদের সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্র শিল্পের এরূপ করুণ ভাগ্যবরণ নিশ্চয় প্রত্যাশিত ছিল না। পুঁজির দৌরাত্ম্যের কাছে আমরা নিয়ত হার মানছি। যথার্থ অর্থে পুঁজিতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে পারিনি। এই পুঁজির দৌরাত্ম্যে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের সৃজনশীল বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের ন্যায় অভিন্ন ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকেও। হালের কলকাতার ছবি উদ্ভট-কিম্ভূত। বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। বিনোদনের উপাদানমাত্রই স্থূল, অশ্লীল এবং সহিংস মারামারি। বম্বে ও দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক ছবির বাংলা ভার্সন। ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল কলকাতায়। টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বহু পরে মুম্বাই ও মাদ্রাজে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠে। এখন কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে অতীত ঐতিহ্য ব্যতীত অবশিষ্ট কিছুই নেই। ঢাকার বাণিজ্যিক ছবি আর কলকাতার বাণিজ্যিক ছবি মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মাত্র। দুই বাংলার ছবিমাত্রই মুম্বাই এবং দক্ষিণ ভারতের সফল বাণিজ্যিক ছবির রিমেক। কলকাতার সৃজনশীল চলচ্চিত্রের ধারাও আমাদের দেশের ন্যায় স্বল্প পরিসরে কোনোক্রমে টিকে আছে। মুনাফাবাজ পুঁজির লগ্নিকারকদের মুনাফার লিপ্সার কাছে দুই বাংলার চলচ্চিত্র-শিল্প মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অথচ সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, রাজেন তরফদার, গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, পূর্ণেন্দু পত্রী, ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখ বরেণ্য ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতারা কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের গৌরবজনক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। বর্তমান বাস্তবতায় সেটা কেবলই হারানো অতীত স্মৃতি মাত্র।
স্বাধীনতার পর গ্রুপ থিয়েটার নাট্য আন্দোলন এবং এর অগ্রযাত্রা আমাদের আশান্বিত করেছিল। আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় গ্রুপ থিয়েটার যথার্থ ভূমিকাও পালন করেছিল। দেশপ্রেম, মতাদর্শিক অঙ্গীকারে তরুণদের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলা মঞ্চ নাটকের যে শুভ সূচনা হয়েছিল। কালক্রমে তা-ও এখন স্থবির প্রায়। নাটকের মাধ্যমে গণসচেতনতা সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু হয়েছিল, সেটাও পথ হারিয়েছে। মধ্যবিত্তের বিনোদনের মাধ্যমরূপে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। নাট্যকর্মীদের মধ্যেও পূর্বের ন্যায় অঙ্গীকার-একাগ্রতা লক্ষ করা যায় না। মঞ্চ নাটক হয়ে পড়েছে ব্যক্তিগত প্রচার-প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি স্বরূপ। মঞ্চে অভিনয়ের কারণে অভিনেতা-অভিনেত্রীর পরিচিতি পেয়ে টিভি, চলচ্চিত্রে প্রবেশের সুযোগ অবাধ হয়ে যায়। মঞ্চ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দ্রুত তারকা খ্যাতির মোহে মঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পূর্বে রাষ্ট্রীয় মাত্র একটি টিভি চ্যানেল ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি। সব টিভি চ্যানেলের নামও তাৎক্ষণিকভাবে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সে দলের লোকদের ঢালাও স্যাটেলাইট টিভির লাইসেন্স প্রদানের হিড়িক চলে। বেসরকারি চ্যানেলগুলোয় নাটক, সিরিজ নাটক নিয়মিত সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। মঞ্চ নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য এতে বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মঞ্চ নাটকে পারিশ্রমিক নেই। নেই রাতারাতি তারকা খ্যাতির সম্ভাবনাও। কিন্তু স্যাটেলাইট টিভিতে পারিশ্রমিক রয়েছে। তাৎক্ষণিক তারকা খ্যাতির অপার সম্ভাবনা তো রয়েছেই। কাজেই সেটা তো আকৃষ্ট করবেই। বেসরকারি টিভিগুলোর নাটক এবং সিরিজ নাটকে ভাষার বিকৃতি লক্ষ করা যায়। কতিপয় নাট্যকার কাম পরিচালকের নাটকের ভাষা এতটাই বিকৃত যে- বাংলা ভাষা পর্যন্ত ভাবার উপায় থাকে না। ভাষার এই বিকৃতি আমাদের ভাষার জন্য নতুন বিপদ নিয়ে এসেছে। যার প্রভাব আমাদের সমাজ-জীবনে লক্ষ করা যায়। বাংলা ভাষার এই বিকৃতি নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি নাটকের পুঁজি বিনিয়োগে অর্থাৎ স্পন্সর রূপে করপোরেট পুঁজির আধিক্য লক্ষ করা যায়। এসব নাটক চলচ্চিত্রের ন্যায় অশ্লীল-স্থূল নয়; কিন্তু চলচ্চিত্রের নব্য সংস্করণ বললে ভুল হবে না। দেশপ্রেম, মানবমুক্তি কিংবা মানবপ্রেমের বিপরীতে প্রায় নাটকে ব্যক্তির সুখ, দুঃখ, বিরহ, হতাশা, বেদনার প্রাধান্য দেখা যায়। আমাদের সমাজ জীবনের সংকট-অসঙ্গতি নাটকে দেখা যায় না। ভারতীয় হিন্দি সিরিয়াল থেকেও অনেক নাটক ধার-কর্জ করে নির্মিত হয়ে থাকে। তবে লক্ষণীয় একটি নাটক-সিরিয়াল শুরু থেকে শেষ অবধি কারো পক্ষে দেখা সম্ভব হয় না। কেননা সাত-আট মিনিট নাটক সম্প্রচারের পর পাঁচ মিনিটের নিয়মিত বিজ্ঞাপন বিরতির ধকল সয়ে কারো পক্ষেই সম্পূর্ণ নাটক দেখা সম্ভব হয় না। দর্শক হাতের রিমোট চেপে শত চ্যানেলের অন্যটিতে নিমিষে চলে যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়