সব মামলায় জামিন : জহির উদ্দিন স্বপনের মুক্তিতে বাধা নেই

আগের সংবাদ

বিভীষিকাময় এই মৃত্যুর দায় কার : ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে মালিককে তিনবার নোটিস দেয় ফায়ার সার্ভিস, রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকানের অনুমোদন ছিল না

পরের সংবাদ

কবিতার সঙ্গে একটা মানুষ হাঁটছে, আজো হাঁটছে

প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি মৃণাল বসু চৌধুরীকে নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা আমি কখনো করতে পারিনি। শুধু তার কীর্তি, সাহিত্য বা অবদান নিয়ে সন্দর্ভ আমার কলম থেকে বেরোবে না। কারণ ব্যক্তি মৃণালদা আমার লেখার মাঝে পাশে এসে বসেন। আর উচ্চারণ করেন-
‘নিজের সঙ্গে একটা মানুষ/ছায়ার সঙ্গে একটা মানুষ/রোদের মধ্যে একটা মানুষ/হাঁটছে কেবল হাঁটছে কেবল হাঁটছে’।
এই হাঁটার শিক্ষাটাও আমার মৃণালদার কাছ থেকে পাওয়া। বাংলাদেশের জনৈক বিখ্যাত কবির কবিতার একটি পঙ্ক্তি তিনি বারবার আমাকে শোনাতেন। পঙ্ক্তিটি হলো-
অমিত সম্ভাব্য কবি দাবি করে একার সন্ন্যাস।
তিনি কবিদের গদ্যে যাতায়াত নিয়ে কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল ছিলেন। আমি বলতাম, ধুসস, কবিতা লিখে কী ঘণ্টা হয়! কবিতা কেউ কেনে না। আর এত কবি! তার চেয়ে গদ্য ভালো। খেটে খাও। মজুরি তো মেলে। রীতিমতো রাগ করতেন। বারবার বলতেন, ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়, কবিতা হলো এক বিপন্ন বিস্ময় যা লেখককে স্বর্গসুখ দান করে’। এমন একজন মানুষকে নিয়ে লিখতে গেলে হুড়মুড়িয়ে এসে হাজির হয় ব্যক্তিগত স্মৃতি।
কবি মৃণাল বসু চৌধুরীর সঙ্গে ঠিক কবে আলাপ হয়েছিল ঠিক মনে নেই। বছর উনিশ-কুড়ি হবে। সদ্য চাকরিতে অবসর নেয়া দুবাই ফেরত এই কবি প্রথম আলাপেই ধীরে ধীরে বলেছিলেন যে কখনো কারো অনুগামী হইও না। তখন আমরা তুমুল সুনীল অনুগামী। কথাটা বেশ আঁতে লেগেছিল। তখন মৃণাল বসু চৌধুরীর কবিতা বেশ কিছু পড়েছি অবশ্যই কিন্তু সেভাবে পড়িনি যেভাবে পড়লে একজন কবিকে জানা যায়। স্বভাবজাত ঔদ্ধত্য নিয়ে পড়তে শুরু করলাম তার কবিতা। উদ্দেশ্য এরপর দেখা হলে তার কবিতা দিয়ে তাকে অপদস্ত করা। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম এ তো ছুপা রুস্তম। প্রচারের আলোয় থাকেন না অথচ কবিতায় কী অসাধারণ লালিত্য। যতি চিহ্নের ধার ধারেন না, শব্দকে গড়িয়ে দেন অনায়াস দক্ষতায়। কবিতা বয়ে যায় নদীর স্রোতের মতো। কবিতা পড়ে সোজা ফোন। দেখা করতে চাই। বাড়িতে এসো। তোমার বৌদির সঙ্গে আলাপ হবে। দিনক্ষণ স্থির করে বাড়িতে যেতেই যে হৃদয় স্পর্শ করা আপ্যায়নে ভরিয়ে দিলেন তা আমার চিরকাল মনে থাকবে। বৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। রাজপরিবারের কন্যা। অভিজাত ব্যবহার। তুমুল ফর্সা। আমি সেদিন মৃণালদাকে চুপিসারে বলেছিলাম, কাজী নজরুল কি বৌদিকে ভেবেই ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে’ লিখেছেন? তুমুল অট্টহাস্যে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সেই বাসা। বলেছিলেন, ইতিহাসের সাল তারিখ সম্পর্কে এত কম জ্ঞান- আরে আমার জন্মের আগে সেই গান নজরুলের লেখা হয়ে গিয়েছিল। আপনার জন্ম? বললেন, আমি জন্মেছি ১৯৪৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। সেদিন থেকে তিনি হয়ে গেলেন আমার মৃণালদা। তার জীবন বড়ো অদ্ভুত। খুব অল্প বয়েসে তিনি পিতৃহারা হন। একমাত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে বাবা চলে যান পরপারে। ফলে বাল্যে ও কৈশোরে তার বেড়ে ওঠা অনেক বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে। সে সম্পর্কে কিছু কিছু গল্প করে থাকলেও মনে করতে চাইতেন না সেইসব দিন। বাংলা নিয়ে পড়াশোনা এবং এমএ পাস করলেন বাংলা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বলতেন যে অভাবের জন্য বিজ্ঞান পড়িনি তা নয়, আসলে খুব ছোট থেকে বাংলা কবিতা আমায় টানতো, সেজন্য বাংলা পড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার দ্বিতীয় বছরে অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে তার কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেসময় তিনি ‘কবিপত্র’ নামে একটি কবিতা পত্রিকা প্রকাশ করে বেশ হইচই ফেলেছেন।
তখন পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার তুমুল ক্রান্তিকাল। সদ্য গড়ে ওঠা হাংরি আন্দোলন নিয়ে প্রকৃত কবিতার সাধারণ পাঠক বেশ বিরক্ত। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তারা শ্মশান, গোরস্তান, ভাটিখানা ও শেয়ালদা স্টেশনে তারা কবিতা পাঠের আয়োজন করতেন; ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ লেখা জীব-জন্তু, দেবতা, দানবের মুখোশ পাঠাতেন মন্ত্রী, সমালোচক, প্রশাসকদের; কবিদের সমালোচনা করতেন বিবাহের কার্ডে; তৎকালীন মানদণ্ডে অশ্লীল স্কেচ ও পোস্টার আঁকতেন ও বিলি করতেন। বাণিজ্যিক পত্রিকায় গ্রন্থ রিভিউ করার জন্য জুতোর বাক্স পাঠাতেন কিংবা সাদা কাগজ পাঠাতেন ছোটগল্প নামে। তাদের রচনায় প্রশাসন ও মিডিয়াকে আক্রমণ করতেন। এই সমস্ত অসাহিত্যিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা দাবি করতেন যে অচলায়তনকে ভাঙা যাবে। মানুষ তিতিবিরক্ত। মৃণালদাও। এদিকে এই সময়ে মৃণালদা ‘কৃত্তিবাস’-এর কবিতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিও পছন্দ করছিলেন না। তাদের পথচলাও মৃণালদার মনে হয়েছিল ‘সংগ্রামী নয় আপসকামী’। ঠিক তখনই পুস্কর দাসগুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে উঠল শ্রæতি আন্দোলন। মৃণাল বসু চৌধুরী ও পরেশ মণ্ডল শ্রæতি আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু ঐতিহ্যশালী ও হাংরির বাইরে অন্য কিছু একটা করে দেখাবার, যা বামপন্থি স্লোগান সর্বস্বতার বাইরে, যা কিনা সমাজ, সংস্কার, উগ্র আধুনিকতার বাইরের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেবে, সেরকম কিছু করার উদ্যোগ।
ইতোমধ্যে ১৯৬৪ সালে মৃণালদার কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। স্বভাবলাজুক মৃণালদাকে রীতিমতো তাগাদা দিয়ে কবিতাটি ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠাতে বাধ্য করেছিলেন কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়। বয়স মাত্র কুড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ধরেই নিয়েছিলেন ছাপা হবে না। কিন্তু দিন পনেরোর মধ্যে একটি চিঠি এসেছিল ডাকে। সম্পাদক সাগরময় ঘোষের লেখা। জানিয়েছিলেন, কবিতাটি তার পছন্দ হয়েছে, ছাপা হবে সময়মতো। সেই চিঠিপ্রাপ্তি ও প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়টা কেমন কাটিয়েছিলেন মৃণালদা? এক সাহিত্যসভায় মৃণালদা বলেছিলেন স্বীকার করতে লজ্জা নেই, কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরেই কেটেছিল কয়েকটা দিন। মৃণালদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন বেলাভূমি’ প্রকাশিত হলো ১৯৬৫ সালে। বইটা কবি, লেখক ও বিদগ্ধজনের প্রশংসা পেলেও পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। তখনই মৃণালদার মনে হয় যে নিজের লেখার অবয়ব এমন উচ্চতায় নিতে হবে যা তার সিগনেচার হয়ে ওঠে।
‘গভীর সমুদ্র থেকে/দিনশেষে মাছের বদলে/হারানো তাবিজ নিয়ে/ফিরে আসে বিষণ্ন যুবক’।
বাজার চলতি সাহিত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। এই সময়ে মৃণালদা কবিতার বই প্রকাশ নিয়ে আর মাথা ঘামাননি। পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়লেন শ্রæতি আন্দোলনে।
শ্রæতি আন্দোলন নিয়ে এত কথা বলতে হচ্ছে তার কারণ এটাই বাংলা কবিতার শেষ কবিতা আন্দোলন যা সমষ্টিগত চেহারা নিয়েছিল। শ্রæতি আন্দোলন নিয়ে মৃণালদা যা ব্যাখ্যা দিতেন তা এরকম- ‘শ্রæতি লেখকদের প্রধান কাজ প্রকরণগত। বিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলন যেমন তাদের শিক্ষিত করেছে নিজের অভ্যন্তরে তাকাতে এবং দেশকাল সময়ের প্রেক্ষিতে অনিবার্য ছিল তা। সেই অবচেতন স্তরের অলৌকিক অনুভূতি লৌকিক ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে বর্জন করতে হয়েছিল যাবতীয় প্রচল পদ্ধতি। শব্দের ধ্বনিগুণকে আবিষ্কার করলেন তারা নতুনভাবে, শব্দের একক অর্থ, স্পষ্ট ও অব্যর্থ। সেই সঙ্গে শব্দের চিত্রগুণ। ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের দুটি রূপ দৃশ্য ও শ্রব্য। শব্দের একটি উপাদান বর্ণ, ধ্বনির সাংকেতিক চিহ্ন। অর্থাৎ একাধারে সাংকেতিক ও দৃশ্যময়। ভাষা প্রচলনের পর থেকে বর্ণের এই দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ অবজ্ঞাত হয়েছে, তাকেই নতুন মূল্যে আবিষ্কার করলেন ‘শ্রæতি’র লেখকরা। ‘মৃণালদার কবিতার বাঁকবদল বুঝতে হলে অতি অবশ্যই এই আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হবে যা এখনকার তরুণ প্রজন্ম সেভাবে জানে না।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শহর কলকাতা’। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘যেখানে প্রবাদ’ (১৯৭২), ‘গুহাচিত্র’ (১৯৭৬), ‘এই নাও মেঘ’ (১৯৮২), ‘শুধু প্রেম’ (১৯৮২) এবং ‘ধারাবাহিক অবহেলা’ (১৯৮৭)। এরপর দীর্ঘ ১২ বছর কবিতার জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন তিনি। কলকাতার বাইরেই শুধু নয়, এ সময় দেশের বাইরেও ছিলেন দীর্ঘদিন। কবিতার জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন ভেঙে তিনি ফিরে আসেন ১৯৯৯ সালে। প্রকাশিত হয় তার ‘কবিতা সংগ্রহ’। পরের কবিতার বই ‘এবার ফেরো সন্ন্যাসে’ প্রকাশ হয় ২০০০ সালে। তারপর প্রায় প্রতি বছরই প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার বই। কখনো বা একেরও বেশি। এভাবেই এগিয়ে চলে তার কাব্য সফর। ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয় ‘শব্দনির্মাণ’, ‘যদি ওড়ে উড়ে যায়’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘মায়াবি উত্তাপ’, ‘স্বর্গ থেকে নীলপাখি’, ‘স্বপ্নে সমর্পণে’, ‘শূন্যতার ছায়া’। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় ‘যাদুঘরে শব্দহীন’, ‘মায়াবন্দরের দিকে’, ‘ঘুম উড়ে আসে’, ‘আসছি দাঁড়াও’। বাংলাদেশ থেকে ২০১৩-২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘তবে কি ফিরেই যাবো’, ‘যেখানে স্বাধীন মেঘ’ এবং ‘নির্বাচিত কবিতা’। ২০১৯ সালের বইমেলায় ঢাকার ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত হয় ‘১০০ প্রেমের কবিতা’। কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘ডাকঘরে টুকরো আকাশ’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘শিরোনামে পাপ নেই’। ২০০৬ সালে তার গল্পগ্রন্থ ‘যন্ত্রণার এ পিঠ ও পিঠ’ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশ হয় ‘স্বপ্ন পারাপার’। তার মধ্যেই প্রকাশিত হয় তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘শব্দ-স্মৃতিঘর’। শিশু ও কিশোরদের জন্য তার ছড়ার বই ‘এখন যদি রবিঠাকুর’, ‘তিনের পিঠে দুই’। গল্পগ্রন্থ ‘অদ্ভুত সব ভূত’।
মৃণালদা অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এপারের কবি বা লেখকরা যতই পাঠকবন্দিত হোন না কেন, স্বীকৃতি বা পুরস্কারদানের ব্যাপারে ওখানে বিদেশিদের কোন স্থান নেই। সরকারি বা বেসরকারি সকল স্তরে। ভারতে সেসব নেই। কিন্তু এই শৃঙ্খলটা প্রথম ভাঙলো সমধারা। ‘সমধারা সাহিত্য পুরস্কার-২০১৯’ দেয়া হলো কবি মৃণাল বসু চৌধুরীকে। সঠিক সম্মান প্রদর্শন। সমধারার কাছে আমরা অর্থাৎ ভারতীয়রা চিরকৃতজ্ঞ থাকি এই রকম বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। ক্রেস্ট বা উত্তরীয় মারফত সম্মান প্রদর্শন নয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। এপার বাংলার পত্রিকায় সেই অনুষ্ঠানের শিরোনাম হলো ‘অপার বাংলার সাহিত্যাকাশে ডানা মেললো সমধারা’। দৈনিক স্টেটসম্যানে। আমার নিজের বাংলাদেশ প্রেমের পেছনে মৃণালদার অবদান কম নয়। একবার বাংলাদেশে একই মঞ্চে আমরা দুজনে কবিতার ওপরে বক্তব্য রাখছি। আমি মৃণালদা সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে বললাম, ‘মৃণালদা হচ্ছেন কবিদের কবি’। আমি বলে নেমে এসেছি। মৃণালদা উঠে বললেন, ‘অমিত ঠিকই বলেছে যে আমি কবিদের কবি, তাই কবিরা আমায় পছন্দ করেন, আর অমিত হলো তরুণীদের প্রিয়। দেখুন, বাঁদিকের কোণে দাঁড়িয়ে কেমন সই বিলোচ্ছে’। বলে থামলেন। আর উপস্থিত সব দর্শকের দৃষ্টি পড়ল আমার দিকে। সে কী বিড়ম্বনা। মুহূর্তে মাইক তুলে নিলেন মৃণালদা। বলতে লাগলেন, ‘এটাই স্বাভাবিক, এটাই পৃথিবীর নিয়ম। নতুন প্রজন্ম সব সময়ে পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের পছন্দ করেন। আমাদের জায়গা হয় দ্রোণাচার্যদের দলে। তাই আমার মনে হয় ষাট বছর বয়স হলে কবিদের আর প্রেমের কবিতা লেখা উচিত নয়’। তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে খুব আশাবাদী ছিলেন মৃণালদা। বলতেন, ‘নতুন প্রজন্মের কবিরা যারা ইতিহাস ও পরম্পরা জেনে কবিতা লিখতে এসেছেন,তাদের হাতেই বাংলা কবিতার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তাদের ভাষা, প্রকাশভঙ্গি, চিত্রকল্প মুগ্ধ করে আমায়। মনে হয় ওদের কলমেই দীর্ঘজীবী হবে বাংলা কবিতা’।
মৃণালদার অনেক কবিতা আমার চেতনায় মুহুর্মুহু ঢেউ তোলে। নাম- একটা মানুষ।
‘ধর্ম যে তার ব্যক্তিগত/আদর্শ তার ব্যক্তিগত/চিন্তা ভাবনা ব্যক্তিগত/জীবন যাপন ব্যক্তিগত/যন্ত্রণা ভার ব্যক্তিগত/তবুও কেমন একলা মানুষ/রোদের মধ্যে ছায়ার মানুষ/ছায়ার মধ্যে রোদের মানুষ/সংঘবদ্ধ হবার জন্য/ভিড়ের মধ্যে একলা মানুষ/হাঁটছে কেবল হাঁটছে কেবল হাঁটছে’
নৈরাশ্যবোধ, হতাশা, ক্লিষ্টতাময় জীবনের দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা এ কবির কবিতায় সংকটের সত্যমৌলিকতাকে বিকাশ ঘটায়। অস্তিত্ব সংসারবেদনা অপ্রাপ্তিবোধ মানুষের জীবন স্পন্দনকে নির্বিকারচিত্তে বিমূর্তের জাগরণ ঘটায় এই কবিতায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থূলতা, ঐতিহ্যের পর স্পর্শকে অস্বীকার করে তীব্র যন্ত্রণাবোধকে প্রাণিত করে লিখেছিলেন-
‘বিপ্লবে উদ্যোগী নও/আগুনেও প্রচণ্ড অনীহা/অথচ অনন্তকাল পুড়তে পুড়তে ছাই/অহর্নিশ বুকের ভেতর তীব্র হলাহল নিয়ে…’
কেন তার কবিতা এত মনোগ্রাহী? এককথায় বলা যায় তার অধিকাংশ কবিতার অবয়ব ছোট। শব্দের ব্যবহারজনিত সংযম ও কৃপণতা এবং স্পেস ও সাংকেতিকতা, পরিহাস ও স্যাটায়ার সহযোগে কবিতার ভাষা উত্তরাধুনিক কবিতার মতো অনেক বেশি তির্যক যা আমরা অন্যদের কবিতায় পাই না। তিনি ফতোয়াকে আক্রমণ করেছেন কিন্তু তাকে অস্বীকার করেননি। তিনি পরিমিতিবোধের কবি, স্মিতবাক কবি, ভদ্রগোছের কবি। তার মুগ্ধতার ভাষা অনুদ্বেলিত, তার ঘৃণার ভাষা সুপরিশীলিত; তার প্রতিবাদের ভাষা বিদ্বেষমুক্ত, তার প্রেমের ভাষা পরিণত। সব ক্ষেত্রেই তিনি আবেগের আতিশয্য এবং উচ্চারণের প্রগলভতাকে পরিহার করেছেন। তিনি কল্পনাকেও কখনো লাগামহীন হতে দেননি। উদার মানবতাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী কবি। তার কবিতায় মানবতবাদী সুর প্রবল, তবে তা প্রগলভ নয়। আধুনিক কবি হয়েও তিনি শিল্পের বিমানবিকীকরণ তত্ত্বে গা ভাসিয়ে দেননি। তার কবিতায় নৈসর্গিক ও মানবিক হয়ে ওঠে সমন্বয়ী ও সংশ্লেষিত। তিনি লিখছেন-
‘ঠোঁট শুধু উচ্চারণ জানে/সত্য বা অসত্য নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই/চোখ শুধু সাক্ষী থেকেছিল/বৈধ কি অবৈধ/এ বিষয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই…’
বাংলাদেশে আমি ও মৃণালদা একসঙ্গে বহুবার গেছি ও থেকেছি। সম্ভবত সেটা ২০১৯ সাল। ঢাকার একটি সাহিত্যপত্রিকার প্রতিনিধি মৃণালদা’র সাক্ষাৎকার নেবেন। আমি তাকে একটি প্রশ্ন করার অনুরোধ করি। প্রশ্নটা ছিল- কবি-সাহিত্যিকরা বড্ড প্রচারকাঙাল, এই প্রচারের ডামাডোলের আড়ালে হারিয়ে যান প্রকৃত লেখক, তাই কি আজ কবিতা লেখক-পাঠকের দূরত্বের সূত্রপাত হয়েছে? প্রশ্নের উত্তরে মৃণালদা বললেন- ‘খ্যাতির লোভ সবারই থাকে। এমনকি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীও চান তার ত্যাগ নিয়ে আলোচনা হোক। এটা অন্যায় নয়। কিন্তু এই লোভ যখন কাঙালিপনায় পর্যবসিত হয়, তখনই হয় মুশকিল। প্রচারের জন্য দলবাজি করে নিজেকে অনন্য প্রমাণ করার চেষ্টা যারা করছেন, তাদের অনেকেই সাহিত্যের ইতিহাস ও পরম্পরা জানেন না। তাই বোঝেনও না কী লিখছেন এবং সে লেখার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। তাদের অনেকের লেখার মধ্যে কারিগরি বিদ্যা আছে, ক্রিয়েটিভিটি নেই। তা সত্ত্বেও দলের মানুষদের কাছে তারা প্রয়োজনী হয়ে ওঠেন। কবি ও পাঠক দুজনকেই সমাহিত হতে হবে, তবেই প্রত্যক্ষ হবে সৌন্দর্য। কবিতার কাছে পার্থিব-অপার্থিব সৌন্দর্যের কাছে দ্বিধাহীন সমর্পণই আমাদের মুখোমুখি করি দেয় অন্তর্লীন সৌন্দর্যের সঙ্গে। কবিতার কাছে ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতির কাছে সমর্পিত না হয়ে যারা পেতে চান মূর্খ হাততালি, তাদের সকলের জন্য রবীন্দ্রনাথের ঐকতান কবিতার সেই অমোঘ উচ্চারণটি স্মরণ করি-
সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি/ভালো নয়, ভালো নয়, নকল সে শৌখিন মজদুরি।
তাই পাঠক ও সমালোচকের চোখ এড়িয়ে প্রকৃত কবির মৃত্যু হবে না। কোনো দিন। ইতিহাসও এই কথা-ই প্রমাণ করেছে বারবার।
যে মানুষের শরীরে রোগ চট করে বাসা বাঁধতে পারেনি এই লকডাউন তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেললো। রক্তে হু হু করে বাড়লো ক্রিয়েটেনিন। দুবার হাসপাতাল ঘুরে এলেন। করোনায় আক্রান্ত হলেন। ফোন করে বললেন তার অসুস্থতার কথা। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন মৃণালদা, অনেক কথা জমে আছে’। নাহ, আর পারলেন না। তার চলে যাওয়া এ সংবাদে অনুরণিত হচ্ছিল তারই কবিতা।
রেখে দিও/সব রেখে দিও/যদি ফিরি/কোনোদিন যদি ফিরে আসি।

মৃণাল বসু চৌধুরী : ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪৪-২ মার্চ, ২০২২

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়