১৪ মাস পর ঢাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন

আগের সংবাদ

চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক বাঁধন

পরের সংবাদ

ভাষার অস্তিত্ব এখন সংকটে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রধান অবলম্বন হচ্ছে তার ভাষা, তার ধর্মমত নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করে আমরা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭১ সালে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটির উদ্ভব হয়েছিল, তার রূপরেখা তৈরি হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা। প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। বাংলা বর্ণমালা সবচেয়ে সাজানো বর্ণমালা।
কিন্তু আমাদের সমাজ বাস্তবতায় মাতৃভাষা বাংলা শুদ্ধভাবে চর্চা করার আগ্রহ অনেকের মধ্যেই তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে সন্তানরা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে হয়তো পাড়ি জমাবে, তাই অনেক অভিভাবকও মনে করেন নিজের মাতৃভাষাটা ঠিকমতো চর্চা না করলেও চলবে। বাংলা ব্যাকরণ বলে যে পাঠ্যপুস্তকটি রয়েছে, তা খুব সম্ভবত অন্যান্য বিষয়ের পাঠ্য বিষয়গুলোর তুলনায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর কাছে সর্বাপেক্ষা অবহেলিত। যেন এ বিষয়ে কোনো রকমে পাস করলেই চলবে। বিষয়টি বুঝে আত্মস্থ করার কোনো প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না। অথচ কোনো ভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে-পড়তে গেলে ব্যাকরণ জ্ঞান থাকাটা আবশ্যক।
অন্যদিকে রেডিও, টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা ভাষার ওপর এক অদৃশ্য নিপীড়ন যেন চলছে। দু-একটি রেডিও চ্যানেল ছাড়া অধিকাংশ রেডিও উপস্থাপকরা বাংলা ইংরেজির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন। প্রমিত বাংলা সেখানে যেন বড্ড বেমানান। ইউটিউব আর ফেসবুকে যে চটকদার বিজ্ঞাপনগুলো চোখে পড়ে তা অশুদ্ধ বানান আর স্থূল রুচির সীমাহীন বহিঃপ্রকাশ। যেসব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয়, সেখানেও নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যেমন বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড দিন দিন কমতে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে বাংলা নামের দোকানের সংখ্যাও। এমনকি বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রেও এখন খুব কম লোকই বাংলা ব্যবহার করে। অনেকের ভেতর ভ্রান্ত বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে লেখালেখি ইংরেজিতে করলে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি ঘটে।
ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার শব্দকোষে পরিমার্জন, পরিবর্ধন আসবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম ইদানীং অতি স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে বাংলা কথ্যভাষাতে এমন কতিপয় শব্দ সংযোজন করেছে, যা কোনোভাবে ভাষার অলংকার হয়ে উঠতে তো পারছে না বরং কিছুক্ষেত্রে আমাদের ভাষার স্বকীয়তা ও শ্রæতিমধুরতা নষ্ট করছে। আবার বাংলায় কথা বলা নিয়ে অনেকের মধ্যে হীনমন্যতাও জাগে। অনেকেই বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলাকে স্মার্টনেস ভেবে থাকে।
বাংলা ভাষার আরেকটি শক্তির জায়গা এর বৈচিত্র্যময় সাহিত্য। হাজারো বছরের বেশি সময় ধরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বাংলা সাহিত্যের পাঠক দিন দিন কমে আসছে। বাংলা সাহিত্যের যে বিশাল রতœভাণ্ডার আছে তার সংস্পর্শে খুব কম সংখ্যক তরুণরা যুক্ত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, মধুসূদন রচনাবলি পাঠে তাদের আগ্রহ খুব সামান্যই। নতুন প্রজন্মের কম সংখ্যক ছেলেমেয়েই বই পড়ে। যতটুকু পড়ে, তা কেবল সস্তা চটুল লেখাগুলো, যা এখন অনলাইন সাহিত্য প্ল্যাটফর্মগুলোর মুখ্যবিষয়। এসব লেখা অধিকাংশই নিরাবেগ যৌনতায় ভরা। সৃজনশীল চিন্তাচেতনা সম্পন্ন ভালো লেখকের বইগুলো এখন পাঠকপ্রিয়তা হারাচ্ছে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রচুর বই প্রকাশিত হলেও হালকা সেন্টিমেন্টের লেখাগুলোই কেবল পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। বিপরীতে ইতিহাস, দর্শন, জ্ঞান বিকাশের বই তেমন প্রকাশিত হচ্ছে না, পাশাপাশি পাঠকপ্রিয়তাও পাচ্ছে না। পাঠকের চিন্তাজগৎ আন্দোলিত করার মতো প্রকাশিত বইগুলো পাঠকপ্রিয়তা হারাচ্ছে, যার মূলেও দায়ী আমাদের বিদ্যমান অপসংস্কৃতির বিস্তার ও মানসিক বৈকল্য।
বাংলাভাষা সব থেকে বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনে। বেপরোয়া আকাশ সংস্কৃতি তথা প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের ঘরে ঘরে হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়াল দেখার হিড়িক মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি সুচতুর কায়দায় ঘরে ঘরে প্রবেশ করছে আমাদের অলক্ষে। হিন্দি সিরিয়ালগুলোর অনুকরণে সামাজিক অবক্ষয় ঢুকে পড়েছে সমাজে। আমাদের বেসরকারি চ্যানেলগুলো হিন্দি অনুষ্ঠানগুলোর অনুকরণে বিভিন্ন রিয়্যালিটি শো আয়োজন করছে। আমাদের চিরায়ত লোক সংস্কৃতির অনুষ্ঠানগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা আমাদের এখানে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনে।
পাশাপাশি হিন্দি গানের বেগবান স্রোতে আমাদের সমৃদ্ধশীল বাংলা গানের ভাণ্ডার যেন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম হিন্দি গানের তুলনায় বাংলা গান তেমন শুনছে না। পাশাপাশি আমাদের এখানে বিয়ে, পালা পাঠন কিংবা বনভোজনের মতো সামাজিক অংশগ্রহণমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে লাউড স্পিকারে হিন্দি গান বাজানো হয়। বাংলা গান এখন একেবারেই উপেক্ষিত। অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ হিন্দি নাচ-গানে ক্রমেই বাঙালি দর্শকরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসন কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। পাকিস্তানি শাসকরা দুই যুগব্যাপী তাদের শাসনামলেও আমাদের উর্দুভাষীতে পরিণত করার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল অথচ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আজ ঘরে ঘরে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব নিঃসন্দেহে দুর্ভাবনার জন্ম দেয়।
হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা যখন দিন দিন তার মর্যাদা হারাচ্ছে, তখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাভাষী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখা, নতুবা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা দিন দিন হুমকির মুখে পড়বে। আর মাতৃভাষা যথাযথ চর্চা না করলে আমরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত জাতি হয়ে উঠতে পারব না। দেশে প্রতি বছর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বড় বড় ডিগ্রিধারীরা বেরুচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভালো বাংলা লিখতে পারে এমন নাগরিকের সংখ্যা দিন দিন কমছে। জাতীয় জীবনে এটা কোনো আশার বার্তা নয়, বরং দুর্ভাবনার জন্ম দেয়। পৃথিবীর বুকে যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল, যে আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে আমরা লাভ করেছিলাম একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র; সেই রাষ্ট্রে ভাষার গুরুত্ব যেন জাতীয় জীবনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল থাকে; এ ব্যাপারে যথার্থ গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি অন্য কোনো ভাষা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে, সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে।
একমাত্র ভাষানির্ভর নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী চেতনাই পারে গণতন্ত্রকে বিকশিত করে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তা বারবার পথ হারিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনার ধারাবাহিকতাও ক্রমাগত পিছু হটছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনার ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার আন্দোলন এবং সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। ভাষার দাবি মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চরম আকার ধারণ করেছে।
তাই সমষ্টিগত উন্নতি সমাজে এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। এসব আত্মকেন্দ্রিকতার অবসান ঘটানো এবং সমষ্টিগত মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়েই আমাদের সমষ্টিগত মানুষের ভাষা সংস্কৃতি সর্বজনীন হতে পারবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়