১৪ মাস পর ঢাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন

আগের সংবাদ

চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক বাঁধন

পরের সংবাদ

অসংখ্য প্রশ্নের সুলুক সন্ধানে : ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির ‘ভাষার লড়াই’ হাজার বছরের। সে লড়াই এখনো চলমান। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ তুলনামূলক স্বল্পকালীন। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণতা লাভ করে নতুন দিকে বাঁক নেয়। ফলাফল হিসেবে ’৭১ সালে বাংলা ও বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসে মুক্তির স্বাদ লাভ করে।
বাঙালির ‘ভাষার লড়াই’ নিয়ে আলোচনা হয় না, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ নিয়ে সামান্যই আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনা খুবই প্রচলিত, খুবই গতানুগতিক ধরনের। সে আলোচনায় ‘ভাষার লড়াই’র আলোকপাত থাকে, বিস্তার থাকে না। ‘ভাষার লড়াই’ হারিয়ে যায় ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’র মধ্যে। ‘ভাষার লড়াই’-এর স্বতন্ত্র সত্তাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি আজ অবধি। দুটির পার্থক্যও আমরা বুঝি না কিংবা বোঝার চেষ্টা করি না।
বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ একটি গৌরবোজ্জ্বল সময়। আমরা মনে করে থাকি, এই গৌরবোজ্জ্বল সময়ের সূত্রপাত ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নাম রাষ্ট্রের উদ্ভবের মাধ্যমে। আমরা জানি, ‘পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করলে গর্জে ওঠে বীর বাঙালি। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হয় বাংলা।’ কিন্তু এটা সম্পূর্ণ সত্যি না। এ হলো আংশিক সত্য। এ লড়াইয়ের সূত্রপাত আরো অনেক আগেই। সাংস্কৃতিক সংগঠক, গবেষক গোলাম কুদ্দুছ ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ নামের ৭০০ পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থের মাধ্যমে সেই দীনতার অবসান ঘটিয়েছেন। এখানে ১৯টি অধ্যায়ের মাধ্যমে শতাব্দীর প্রাচীন আমাদের ‘ভাষার লড়াই’কে তিনি তুলে এনেছেন। অসংখ্য প্রশ্নের সুলুক সন্ধান দিয়েছেন।
দীর্ঘদিনের একটি কষ্টসাধ্য গবেষণার মাধ্যমে গবেষক গোলাম কুদ্দুছ ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’র ইতিহাসের শুধু পূর্ণতাই দেননি, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন দিকনিদের্শনা প্রদান করেছেন। ইতিহাসের একাধিক অমীমাংসিত সত্যকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তুলে এনে রায় প্রদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। ভাষাসৈনিক আলোকচিত্র শিল্পী আমানুল হক ওই গ্রন্থে একটি কঠিন সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তি যখন তথ্যনির্ভর হয় ইতিহাস তখন তা মানতে বাধ্য হয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার নয়, এটি ইতিহাসের ব্যাপার।’ ভাষাসৈনিক আলোকচিত্র শিল্পী আমানুল হক এ গ্রন্থে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অনেকেই শুধু প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ওপর পালিশ করে যায়- চ্যালেঞ্জ করে না, আপনি (গবেষক গোলাম কুদ্দুছ) করেছেন।’
গবেষক গোলাম কুদ্দুছ ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে শুধু প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করেননি; এখানে তিনি তুলে ধরেছেন বৃহত্তর এক প্রেক্ষাপট। তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে নয়, প্রাচীনকালে আরাকান শাসনামলে। পটভূমি সৃষ্টি করেছেন আরাকান রাজসভার কবিকুল, মধ্যযুগের কবিগণ। এর মাধ্যমে তিনি বাঙালির প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় আঘাত করেছেন, চ্যালেঞ্জ করেছেন। তার চ্যালেঞ্জকৃত প্রচলিত ইতিহাস হলো- প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’-এ বঙ্গবন্ধুর সরব উপস্থিতি। গ্রন্থখানায় সন্নিবেশিত তথ্যাদি পাঠ করলে কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বাইরে রাখা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম শহীদ। এ দুটি বিষয়ের মীমাংসা করেছেন ইতিহাসের নানান তথ্য-উপাত্তের আলোকে।
আমাদের ভাষার লড়াইটা যে হাজার বছরের, তা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে গবেষক গোলাম কুদ্দুছ। এখানেই প্রথমেই আছে বাংলা ভাষার উদ্ভব নিয়ে আলোচনা। বাংলা ভাষার ইতিহাসে চর্যাপদ, চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, শ্রী চৈতন্যদেব, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ প্রমুখ আলোচিত হয়। এটাকে ভাষার লড়াইয়ের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তারপর পরের অধ্যায়ে আছে, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেন আরাকান রাজসভার বাংলা ভাষার কবিকুল যেমন- দৌলত কাজী, মরদন, মাগন ঠাকুর, আলাওল, আবদুল করিম খোন্দকার প্রমুখ। মধ্যযুগের কবিদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এদের মধ্যে আছেন শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, কবি মুজম্মিল, হাজী মুহাম্মদ, শেখ মুত্তালিব, মুহম্মদ ফসীহ, আবদুল হাকিম, রামনিধি গুপ্ত, ভারতচন্দ্র, সৈয়দ নূরউদ্দিন, লালন শাহ, চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা কবি শ্রীমতি রহিমুন্নিচা, ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত। আমরা ইতিপূর্বে কখনো ভাবিনি আমাদের ভাষার লড়াইয়ে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগের কবি-সাহিত্যিকরা ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে, কখনো কখনো তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি নির্মাণ করে গেছেন। এমনকি বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের সূচনালগ্নের কবি ও সংগঠনেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ইতিপূর্বে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনায় এ সময়কালকে কেউ বিবেচনায় রাখেননি। ‘মনে রাখতে হবে ইতিহাস কখনো একরৈখিকভাবে লিপিবদ্ধ হয় না।’ অতীতে আমাদের দেশে হয়েছে। কারণ সেসব ‘গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের প্রভাব’… ‘ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানে প্রভাব ফেলতে পারে।’
বাংলা ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ নিয়ে গবেষণা খুবই অপ্রতুল। আবার আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এর সঙ্গে যুক্ত। এ নিয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ গ্রন্থের লেখক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ফলে তাদের মূল্যায়ন প্রভাবমুক্ত ছিল না। সে কারণে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার উপস্থাপন, বিশ্লেষণে বৈপরিত্য প্রত্যক্ষ করা গেছে। তারা একে অন্যকে খারিজ করে দেন। ভিন্ন মতাবলম্বিতার কারণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে তারা মানতে রাজি হন না। তারা বঙ্গবন্ধুকে ভাষাসৈনিক হিসেবে মানতেও নারাজ। এজন্য তারা তথ্য বিকৃতিও ঘটাতে কার্পণ্য করেননি। ফলে পাঠক দ্বিধান্বিত হয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে। গবেষক গোলাম কুদ্দুছ এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্লেষণ, বিভ্রান্তি, দ্বিধা আর বৈপরিত্যের দিকে ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে আলো ফেলেছেন। খারিজ করার মানসিকতার প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন। ‘সত্য অনুসন্ধানে অধিকতর গবেষণার দাবি রাখে। যেমন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে মগজ বেরিয়ে যে যুবকের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়েছিল তার প্রকৃত নাম কি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়? ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা এবং ১৯৪৮ সালের সংগঠিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি ইতিহাসে যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে কিনা- এ ধরনের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজে’ বেড়িয়েছেন গবেষক গোলাম কুদ্দছ এ গ্রন্থে।
‘প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল নানা পর্যায়ে। সশস্ত্র সংগ্রাম, অসহযোগ আন্দোলন, নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতা বৈঠক প্রভৃতি পদ্ধতিতে এ সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে রাজনীতি সচেতন মানুষ এবং ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ত কারোরই তা অজানা নয়।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে সরকার পরিবর্তন হয়। চার্চিল পরাজিত হয়। শ্রমিক দল বিজয়ী হয়। নতুন সরকার গঠন করে কেবিনেট মিশন। ‘এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারাকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমন্বিতরূপ প্রদান করা। কেবিনেট মিশন ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন না করে স্বাধীন ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের রাষ্ট্র-কাঠামো গঠনের সুপারিশ করে।’ কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। মুসলিম লীগ তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করে। এ দিবসকে কেন্দ্র করে বাংলা ও বিহারে দাঙ্গা বাধে। বিহারে দাঙ্গায় নিগৃহীতদের রক্ষার্থে তরুণ নেতা শেখ মুজিবের সাংগঠনিক দক্ষতা ও সাহসিকতা সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের দৃষ্টি

আকর্ষণ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‘লেখক-গবেষকদের কেউ কেউ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন এবং অনেকে রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন।’ এসব বিভ্রান্তি সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। অথচ তখনই অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এ সময়ের ইতিহাস, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও পরিবেশনের মাধ্যমে গোলাম কুদ্দুছ সময়ের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবকে স্বমহিমায় উপস্থাপন করেছেন। তখনই ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। বাঙালি লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক বাংলার পক্ষে নানান যুক্তি উপস্থাপন করেন। এ সংক্রান্ত তর্থ-বিতর্ক লেখালেখির বিশাল দলিল গোলাম কুদ্দুছের এ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। তখনো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়নি।
স্বাধীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে বেগম পত্রিকা, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে স্মারকলিপি প্রদান, করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিভিন্ন স্থানে হাঙ্গামা, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের যথার্থভাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। এখানে একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। সে ইতিহাসের ব্যাখ্যাও আছে। অতীতে এ সময়ের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিশ্লেষণে শেখ মুজিবের অবস্থানকে গৌণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণায় শেখ মুজিব বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব, ছাত্রলীগের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও অবদান শেখ মুজিবের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অবস্থানকে স্পষ্ট করে। কিন্তু অতীতের আলোচকরা ওই জায়গাটাকে একটি ধূসর পরিবেশ (এৎধু ধৎবধ) সৃষ্টি করে রাখেন। ফলে বির্তকের সৃষ্টি হয়। বির্তকের সৃষ্টি হয় কারণ তারা তর্ক পছন্দ করেন। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে যত প্রতিবাদ, আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। সব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শেখ মুজিবের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ গোলাম কুদ্দুছের ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে ধারাবাহিকভাবে আছে। যেখান থেকে প্রমাণ করা যাবে না, ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব অনুপস্থিত ছিলেন। এ কারণেই কি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনায় ১৯৪৮ সাল কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়? এ সময়কালের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষণ আর জিন্নাহর সমাবর্তন ভাষণে ‘নো নো’ ধ্বনি। এ ধরনের আংশিত সত্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বলা হয় শেখ মুজিব ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ যুক্ত ছিলেন না। গোলাম কুদ্দুছের ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থ আমাদের সাক্ষ্য দেয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কতিপয় ব্যক্তি বিশেষের চিন্তাপ্রসূত ও সংশ্লিষ্ট আন্দোলন ছিল না। এখানে নানান পেশার-শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শ্রেণি-পেশার মানুষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। এই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিব ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত হন।
ভাষা আন্দোলন রক্তাক্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ সালে। সে সময়ে কেন শেখ মুজিবকে নাজিমুদ্দিনের সরকার কারগারের বাইরে রাখতে ভয় পাচ্ছিল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য কারাগার থেকে শেখ মুজিবের নিদের্শনা আজো ১৯৪৮ সালের রাজনৈতিক তৎপরতার মতোই অস্পষ্ট থেকে যায়। গোলাম কুদ্দুছ ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থে নানান তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সেই অস্পষ্টতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এখানে আরো একটি জায়গায় এ গ্রন্থে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে মগজ বেরিয়ে যাওয়া যুবকটি কে ছিল? গোলাম কুদ্দুছের অনুসন্ধান, তথ্য, সাক্ষাৎকার প্রমাণ করে, সে যুবকের নাম সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। যা কিনা এতকাল বিস্মৃতির অতলে চাপা ছিল। সে সঙ্গে এখান থেকে আমরা আরো জেনে যাই, ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতার লেখা ও প্রকাশের ইতিহাস, প্রথম শহীদ মিনার, শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন, রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সংসদে ’৮৪ সালে ও ’৫২ সালে নানান তর্ক-বিতর্কের বিবরণীসহ যাবতীয় খুঁটিনাটি। এমনকি ভারতের শিলচর, কলকাতার অভিজ্ঞতাও এখানে উল্লেখ আছে সবিস্তারে।
’৫২-এর পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হওয়াতে ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ার সম্ভাবনা অপার। এছাড়া সে সময়ের কিংবা তারও আগের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এমন একটি সময়ে এ ধরনের তথ্য-উপাত্তভিত্তিক আকর গ্রন্থ ইতিহাসের দাবি মিটাতে যথেষ্টভাবে সহায়ক মনে করি। অনেক প্রশ্নের জবাব তৈরিতে সহায়তা করেছেন। ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থের মাধ্যমে গবেষক গোলাম কুদ্দুছের কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।

(ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন : গোলাম কুদ্দুছ, প্রকাশক : নালন্দা, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশকাল : ২০২৩)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়