১৪ মাস পর ঢাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন

আগের সংবাদ

চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক বাঁধন

পরের সংবাদ

একুশের বইমেলা : সারস্বত সমাজের মিলনোৎসব

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তধারা নামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যে বইমেলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তা-ই এখন বিস্তৃত হয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছেছে। প্রথমত বর্ধমান হাউসের আঙিনা পেরিয়ে রাস্তায় এসেছিল মেলা, ২০১৪ থেকে বাস্তবতা সামাল দিতেই মেলা পৌঁছেছে উদ্যানে। বাঙালির এই প্রাণের মেলা নানান কারণে আবেগের মেলা; প্রথমত এ মেলার সঙ্গে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিজড়িত; সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হওয়ার পর বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১৯৭১-এর ৭ মার্চের স্মৃতি, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের স্মৃতি, যুক্ত হয়েছে বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক শিখা অনির্বাণ এবং বিজয়স্তম্ভের গৌরব। বাংলার সারস্বত সমাজের মিলনোৎসব বইমেলা নিয়ে বাঙালির আবেগেরও যেন অন্ত নেই। মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিও মানুষের আবেগকে সম্মান জানাতেই তটস্ত থাকে বইমেলা নিয়ে। সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা ফেব্রুয়ারি এলেই বইমেলার আয়োজন নিয়ে নিজেদের আবেগের কথা প্রকাশ করেন মিডিয়ায়। প্রিন্টমিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার তৎপরতাও দৃশ্যমান হয়। বইমেলার আয়োজন এবং মিলনোৎসবে অংশগ্রহণকারীদের আগ্রহ ও উত্তেজনা উপলব্ধি করার সুযোগ পাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেও। অনেকের উপলব্ধি আর আদিখ্যেতায় মননে প্রতীতী জাগে, আমাদের আবেগ যেন চঞ্চল। প্রশ্ন ওঠে অমর একুশে গ্রন্থমেলা কতটা বাণিজ্যের অনুষঙ্গ, আর কতটা প্রাণের বা আবেগের? যখন বসন্ত আসি আসি করছে, তখনই তো পলাশ-শিমুলকুঁড়ি জাগিতেছে ডালে ডালে, মান্দারের কালচে-সবুজ কুঁড়ির কপাট খুলে আড়মোড়া ভাঙছে ফুলের রক্তিমাভা, যখন বসন্ত আসছে তখনই তো কোকিল গান ধরেছে শিমুলের ডালে- প্রেয়সী কোকিলার মন রাঙাতে; আর শত-সহ¯্র নতুন বইয়ের আগমন বার্তা উচ্চারিত হচ্ছে, দৃশ্যমান হয়ে উঠছে তাদের রংবাহারি প্রচ্ছদ। এতসব উৎসব আয়োজন, ঢাক-বাদ্য-সুরের কোলাহলে কী করে আমরা ভুলে থাকতে পারি বসন্তবরণ উৎসব, লাল-পাড় সরিষাফুল রঙা শাড়ি-সেমিজের আলোড়ন, পুষ্পশোভিত সুন্দরের কারুকাজ? এবং সমস্ত কারুকার্য-কোলাহলে বইমেলায় বিপণি বিতান খুলে প্রকাশনা ব্যবসায়ীকুল বাণিজ্যের পসরা সাজাতে চায়। উত্তেজনা এবং উদ্বেগ তখন একটাই, মেলা চলবে ক’দিন? ব্যবসায়িক সফলতা কে না নিশ্চিত করতে চায়? সুতরাং মেলার সূচনাতেই প্রার্থনা থাকে, এ সময়টাতে যেন বৃষ্টি না হয়; মেলায় অগ্নিসংযোগ বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবারের মেলার প্রথম দিনই বৃষ্টির দাপট প্রত্যক্ষ করল সবাই।
বইমেলাকে ‘সারস্বত সমাজের মিলনোৎসব’ বলে উল্লেখ করলাম বটে; কিন্তু মাসব্যাপী বইমেলার বাস্তবতা কী। বইমেলা যেহেতু ফেব্রুয়ারির আয়োজন, সুতরাং মেলার সময়কাল ২৮ দিন, চার বছর পর ২৯ দিন: যদি আমরা ২৮ দিনের ব্যাখ্যায় যাই, সেখানে উদ্বোধন এবং সমাপনী দুদিন; ৪ সপ্তাহে ৮ দিন ছুটির দিন; একদিন ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটি; ১ দিন বসন্তবরণ, একদিন ভেলেন্টাইন দিবস; সব মিলিয়ে ১৩ দিন মেলায় যে পরিমাণ ভিড় হয়, যে শিষ্টজনরা ২৮ দিনের ১৩ দিন মেলা এড়িয়ে চলতে চান। ভিড় মেলার জন্য কোন নেতিবাচক কথা নয়; কিন্তু মেলার দর্শনার্থীর ১০ শতাংশ যদি বই কিনতেন তাহলে নিশ্চয়ই মেলার ভিড় নিয়ে আশাবাদী হতে পারতাম; তারচেয়েও বড় কথা, দর্শনার্থীর ১ শতাংশ যদি পাঠে আগ্রহী হতেন! মেলার নানান বিষয় নিয়ে আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার সৎ সাহস দেখানো উচিত। গবেষণা করে সত্য উচ্চারণে আমাদের ব্রতী হওয়া উচিত প্রতি বছর মেলায় কত সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়? প্রকাশিত বইয়ের কত পার্সেন্ট বই লেখকের অর্থায়নে প্রকাশিত হয়, কত পার্সেন্ট বই প্রকাশক নিজের অর্থে প্রকাশ করেন? কত পার্সেন্ট বইয়ের জন্য লেখক সম্মানীর অর্থ প্রাপ্ত হন? আমি জানি এসব খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। অন্যদিকে একজন প্রকাশক কেন নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে আমার বই প্রকাশ করবেন? ভাগ্যবান কতিপয় ছাড়া কারো বই-ই তো বিক্রি হচ্ছে না; প্রকাশক কেন লোকসান গুনতে যাবেন? আবার বইমেলা যদি সারস্বত সমাজের মিলনোৎসব হয়; সারস্বত সমাজের কোনো প্রতিনিধির সামর্থ্য কোথায় বই কিনে মিলনোৎসবকে অর্থবহ করে তুলবার? প্রচার-প্রচারণায় সামর্থ্যবানের কাছে ধরাশায়ী হয়ে যাচ্ছেন মেধাবী-মননশীলরা। সৃষ্টি সৌন্দর্যের চেয়ে- মনন-মনীষার চেয়ে প্রাচুর্য-সামর্থ্য আর প্রভাববলয়ের কাছে এগিয়ে থাকছে। সরকারে বই ক্রয় কোটায় যাদের প্রভাব বা জ্যাক আছে তারা ছাড়া অন্যরা পিছিয়ে যাচ্ছে। ভালো বইয়ের বিপণন সরকারি কোটায়ও বঞ্চিত থাকছেন।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে আমার বন্ধু সত্তরের অন্যতম কবি ফারুক মাহমুদের ছোট্ট একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম বইমেলা নিয়ে; সেখানে আমার মনের সঙ্গে মিলে যায় এমন কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন কবি; বইমেলা প্রসঙ্গে লিখতে বসে বন্ধুর কথাগুলো স্মরণ করছি। বইমেলায় বই বিপণন প্রসঙ্গে কবি বলেন, “বইমেলা শুধু বেচাকেনার হাট নয়। এর সঙ্গে বাঙালির চেতনা এবং আবেগ জড়িত। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি জড়িত প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমি’ এই মেলার আয়োজক।…একুশের বইমেলা বাঙালির চেতনাপ্রবাহ নবায়নের সম্মিলন।”
ফেব্রুয়ারি ভাষা-সাহিত্যের মাস, বাঙালির মুক্তিরাকাক্সক্ষা অঙ্কুরিত হওয়ার মাস; রফিক-জব্বার-শফিউর-বরকতের মাস; তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিতে শহীদ মিনারকে ঘিরে জেগে থাকা চেতনার মাস; যে চেতনার স্পর্শে ‘অমর একুশের গ্রন্থমেলা’। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের অবদানকে সমুন্নত রাখতে আমরা কি প্রস্তুত? বসন্তের ছোঁয়ালাগা বইমেলাকে সামনে রেখে নিজেকে প্রশ্ন করতে চাই, কতটা প্রস্তুত আমি? মেলায় আমার কোনো নতুন বই আসছে কি-না সে বিষয়ে হয়তো নিশ্চিত নই; কিন্তু তাতে কি বইমেলা নিয়ে আমার দায়িত্ব ফুরিয়ে গেল? গত বছরের বইমেলায় আনন প্রকাশনী থেকে আমার উপন্যাস ‘পারমিতার জগৎ’ বেরিয়েছিল; কিন্তু ‘আনন’ স্টল বরাদ্দ পায়নি, তাই পারমিতার আলোর মুখ দেখা হয়নি; সে বিবেচনায় ‘পারমিতার জগৎ’ আমার এ বছরের বই; ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের জন্মকথা’ বইটিও গত বছর মেলার শেষ দিন মাঠে আসে, এটিকেও এবারের মেলার বই বলা যায়। ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা (দ্বিতীয় খণ্ড)’ আবিষ্কার প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে এবার; এবার মেলায় এসেছে মুহাম্মদ পাবলিকেশন থেকে কাব্য ‘যে পথে ব্যস্ততা গেছে’ এবং ছোটগল্প সংকলন ‘যুদ্ধযাত্রা এবং অন্যান্য গল্প’; প্রতিবিম্ব প্রকাশন থেকে কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার মায়াবন: শব্দ-শিল্প-ছন্দ-প্রকরণ’ সিদ্দিকিয়া পাবলিকেশন্স থেকে কাব্য ‘অবহেলাময় প্রিয় পথ’; ঐতিহ্য প্রকাশন থেকে গবেষণাগ্রন্থ ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় রূপান্তর’ এবং ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস ‘চন্দ্রাবতীর নূপুর’। ব্যাপ্তি আর বিপণন-সংশয়ে হয়তো দ্বিধায় আছেন প্রকাশক। আমার বইয়ের প্রকাশনা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো অসংখ্য বই আসছে এবারের মেলায়, প্রতিবারের মেলায়; কিন্তু সেসব বইয়ের মান ধরে রাখা যাচ্ছে না; প্রকাশনার নি¤œমানের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সারস্বত সমাজের মিলনমেলা।
লেখককুলের প্রস্তুতি থেকে পাঠক বা প্রকাশকের প্রস্তুতি তো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়; কিন্তু বইমেলা নিয়ে অত্যাবশ্যকীয় মেধাবী পরিকল্পনার খুবই অভাব। বইমেলাকে সামনে নিয়ে কেন এ হতাশা? বই তো বেরুচ্ছে অগণন, প্রতি বছর! একজন প্রাগ্রসর প্রকাশক, অনুজ কবি নতুন বই চিহ্নিত করতে বলেছেন, ‘যে বই অপঠিত, তাই তো নতুন বই আপনার জন্য।’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ বটে। পাঠবিমুখ জাতির জন্য প্রতি বছর যত সংখ্যক বই প্রকাশিত হচ্ছে তার একটা বড় অংশ অপঠিত থেকে যায়। কোনো কোনো বই বিক্রি হয়ে গেলেও অপঠিত থেকে যাচ্ছে; সুতরাং প্রতি বছর অপঠিত নতুন বইয়ের সঞ্চয় বাড়ছে; তারপরও প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন লেখকের নতুন শিরোনামের বই। কোনো কোনো প্রাজ্ঞ পাঠককে বলতে শোনা যায়, প্রতি বছর এত যে বই প্রকাশ পাচ্ছে, তার মধ্যে পাঠযোগ্য বই ক’টি? এভাবে তো আমাদের বই সংগ্রহশালায় অপাঠযোগ্য আবর্জনার স্তূপ

বাড়ছে ফি-বছর! অভিযোগ আরো আছে, বলা হয়, প্রতি বছর যেসব বই প্রকাশ পায়, তার একটা বড় অংশ না-কি ‘কাটিং-পেস্টিং’ প্রযুক্তিতে লেখা। এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে তদারকি করার তো কেউ নেই। আমাদের প্রকাশনা ক্ষেত্রে এত অরাজকতা, ভাবলে গা শিউরে ওঠে। সম্বৎসর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুকে যেভাবে লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার গাড়ি ছোটাচ্ছেন জনপ্রিয় (!) লেখককুল এবং তা থেকে একটা অংশ বই হয়ে চলে আসছে মেলায়। বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে বই আসছে। ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বই প্রকাশে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মান্য করছেন বলে শুনিনি। আমি কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করতে চাই না, দোষারোপও নয়। নানান বাস্তবতায় লেখক-প্রকাশক-বিপণন ব্যবস্থাপনা, সবাই আজ জিম্মি; সবাই আত্মপক্ষ সমর্থনে নানান তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি দিয়ে নিজেকে দোষমুক্ত করতে পারবেন নিশ্চয়ই; আমার মতো লেখককে বয়কটও করতে পারবেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সবটাই হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। কিন্তু জাতির মঙ্গলে আমাদের প্রয়োজন ‘আত্মসমালোচনা’ এবং ‘সদাচারী’ হবার অঙ্গীকার। সংকট যখন দুরারোগ্য, তখন সে সংকট মোচনের জন্য সবাইকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তির পথ খুঁজে পেতে হবে। হতে পারে যে উদ্যোগ সবার আগে গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা হলো জাতির পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করা। পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে আমাদের প্রজ্ঞার আঙিনা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। বইমেলা যখন সারস্বত সমাজের মিলনোৎসব, সেখানে কেন অশিষ্ট অভব্যতা হানা দেবে?
পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির উদ্যোগ কেবল সরকার, বাংলা একাডেমি, বা প্রকাশক সমিতির নয়; বরং এ উদ্যোগ নিতে হবে লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজহিতৈষী ব্যক্তি, শিক্ষকসমাজ এবং রাজনৈতিক নেতাদেরও। অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, যে ছেলেটি মুজিবাদর্শের রাজনীতি করেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা আওয়ামী লীগ করেন; তিনিও বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি বই, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ ইত্যাদি পড়েননি; অথবা তিনটির একটিও পড়েননি; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর বই তিনটি বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস জানতে এবং একজন রাজনীতিকের ভিত রচনা করতে পাঠ করা জরুরি। যাকে আপনার দলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মনোনয়ন করছেন, একবারও কি খোঁজ নিয়েছেন- তিনি সংস্কৃতি শব্দের মর্মার্থ জানেন কি-না? যিনি কবিতা চর্চায় নিয়োজিত, তিনি কবিতার নির্মাণকৌশল, বিষয়-প্রকরণ, রূপতত্ত্ব-রসতত্ত্ব, শিল্প চেতনা বিষয়ক কোনো বই পড়ে সময় অপচয়ে আগ্রহী নন। একজন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক গ্রন্থ পড়তে আগ্রহী নন; দর্শন-বিজ্ঞান-নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে অনাগ্রহের কথা না হয় না-ই বা বললাম।
আমাদের বইমেলা, যাকে আমরা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে জানি; এ মেলার প্রেক্ষাপট কেবল বিপণন-বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা কারো কাছে কাক্সিক্ষত নয়; এ মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বাঙালির স্বাধিকার লাভের সংগ্রাম; আছে আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষা; আছে লাখো মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস; সুতরাং আমরা যারা বিভিন্নভাবে নিজেদের মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবি; যারা আয়োজক-প্রকাশক, লেখক বা ক্রেতা; তাদের প্রত্যেককেই কিছু দায় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা আর চেতনার পরিচয় ধারণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি ‘সদাচার’ দিয়ে বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্রতী হবে; সে প্রত্যাশা বাংলাদেশের যে কোনো সচেতন মানুষ করবে, তা-ই সঙ্গত। মানুষের প্রত্যাশা বর্তমান সময়ে বাংলা একাডেমির কাছে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি; কারণ আজ যিনি বাংলা একাডেমির প্রধান নির্বাহী (মহাপরিচালক) হিসেবে দায়িত্বে আছেন, মানুষের কাছে তিনি ‘জাতিসত্তার কবি’ অভিধায় পরিচিত। দীর্ঘদিন তিনি বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করেছেন তার কবিতায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা বলেছেন। তিনিই তার কবিতায় বলেছেন-
রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
কেউ কেউ তুণধারী, কেউ কেউ বেহালাবাদক
কারো হাতে একতারা কারো হাতে ধারালো ফলক
অনন্ত সময় জুড়ে জমিজমা জুড়ে
আমরা তো উৎসবে মেতেছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।’
(আমরা তামাটে জাতি \ আমরা তামাটে জাতি)
“যতোদূর বাংলাভাষা ততোদূর এই বাংলাদেশ” বলে তিনি আমাদের স্বপ্নাকাক্সক্ষা জাগিয়েছেন, তার কাছেই তো আমরা প্রত্যাশা করব, তার নেতৃত্বে ‘অমর একুশের গ্রন্থমেলা’ এবং বাংলা একাডেমি নতুন পথের দিশা পাবে। একজন শুদ্ধাচারী কবি এবং কাব্যকোবিদ হিসেবে তিনি অনেকের চেয়ে ভালো বলতে পারেন দেশের কোথায় কোন নিভৃতে বসে কোন কবি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাব্যচর্চায় ব্রতী আছেন; আমি বিশ্বাস করি তার তত্ত্বাবধানে শুদ্ধাচারী কবি, যিনি দেশের যে প্রান্তেই আছেন, তাকে শনাক্তকরণের মাধ্যমে মূল্যায়িত করবেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য বই সমাদৃত হবে তার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে; মূল্যায়িত হবেন উত্তীর্ণ গ্রন্থের প্রকাশকও। আক্ষরিক অর্থে বইমেলা হয়ে উঠবে আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী ইতিবাচক এক উৎসব। বইমেলা থেকে অনুসন্ধিৎসু পাঠক সহজেই খুঁজে নিতে পারবেন বাঙালির নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আবশ্যিক বইগুলো; তার হাত ধরেই বিকশিত হবে সমালোচনা সাহিত্য এবং প্রকাশিত হবে সমালোচনা সাহিত্যের স্বতন্ত্র পত্রিকা।
আমার বিশ্বাস সমালোচনা সাহিত্য বিকশিত হলে প্রশস্ত হবে আমাদের চিন্তার জগৎ, আমাদের সহিষ্ণুতা বাড়বে; খুলে যাবে আত্মসমালোচনার দুয়ারও। বইমেলা প্রসঙ্গে ফারুক মাহমুদের সাক্ষাৎকারের আরো দুটি প্রস্তাবের কথা সবার বিবেচনায় আনতে চাই; ১. মেলায় লেখক-পাঠক-প্রকাশক এবং ক্রেতার মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি; বাংলা একাডেমি পরিচালিত ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানটিকে নতুন বিন্যাসে উপস্থাপন করা যায়, প্রয়োজনে এ অনুষ্ঠানে লেখকের পাশাপাশি প্রকাশক এবং পাঠককেও যুক্ত করা যায়। এবং ২. মুদ্রণ-বাঁধাইয়ের মতো বাহ্যিক মানের পাশাপাশি লেখার মান বৃদ্ধির জন্য সবার উদ্যোগ জরুরি। বইমেলা সর্বাঙ্গ সুন্দর এবং সফল হবে তখনই, যখন বাংলার সারস্বত সমাজ বইমেলার উৎসবে অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে; যখন সারস্বত সমাজ সদাচারী হয়ে উঠবেন। তবে আমাদের পাঠাভ্যাস যদি প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে যে বিপর্যয় ফণা তুলে আছে মাথার ওপর, তা থেকে পরিত্রাণ পাবার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না। তাই আবেদন করব, আসুন লেখক-পাঠক-প্রকাশক, আসুন সবাই মিলে সৎ-আন্তরিক এবং অঙ্গীকারবদ্ধ হই- নতুন বইগুলো পাঠসীমায় আসুক; চেতনা আলোকিত করুক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়