দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে করণীয়

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্মার্ট শব্দটি শুনলেই একটি সাজানো-গোছানো সুন্দর পরিপাটি রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলো স্মার্ট এবং দুর্নীতিমুক্ত জনবান্ধব দেশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। যা এশিয়া মহাদেশে বেশির ভাগ দেশের কাছে স্বপ্ন। এশিয়া মহাদেশে বেশির ভাগ দেশের এক নম্বর সমস্যা দুর্নীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব।
বর্তমান বিশ্ব ডিজিটাল প্রযুক্তির হাওয়ায় ভাসছে। আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে দেশে দেশে নতুন নতুন পদ্ধতি বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে এবং বর্তমান বিশ্বে অনলাইন শ্রমশক্তিতে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এবং নতুন নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
১৩ বছর আগে বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল। রূপকল্প ২০২১-এর মূল উপজীব্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য অর্জনে প্রণয়ন করা হয়েছিল, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১। এ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অভাবনীয় সফলতা লাভের পর বর্তমান সরকারের ভিশন-২০৪১ স্মার্ট বাংলাদেশ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রপকল্প ২০২২-এর সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট অত্যাধুনিক পাওয়ার গ্রিড, গ্রিন ইকোনমি, দক্ষতা উন্নয়ন, ফ্রিল্যান্সিং পেশাকে স্বীকৃতি প্রদান এবং নগর উন্নয়নের সার্বিক কাজ এগিয়ে চলেছে’- এই মহাপরিকল্পনাকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের মহাসড়ক।
সরকারের প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে এমন উদ্যোগ সফল তখনই হবে, যখন এই উদ্যোগের সঙ্গে দেশের সব জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা থাকবে। জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে সরকার যদি সৎ ও আন্তরিকভাবে কাজ করে তখন অর্থনীতি মজবুত হবে এবং দেশ এগিয়ে যাবে। ‘২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির স্মার্ট বাংলাদেশ’। সরকার উপরোক্ত ঘোষণা দেয়ার পর মানুষের মাঝে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। যার যার অবস্থান থেকে আলাদা আলাদা মতামত ও পরামর্শ প্রদান করছে। তবে যে যাই বলুক সরকারের দক্ষতা ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সফলতা। যদি সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে থাকে, তাহলে জনগণের সঙ্গে এটা এক ধরনের প্রতারণা করা হবে বা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে জনগণকে বোকা বানানোর পাঁয়তারা বলে বিবেচিত হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন ও সেই অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করার মানসিকতা, অর্থ সংকুলানের ব্যবস্থা ও সুশাসন জরুরি।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন করতে হলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, আইন ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো তৈরি এবং সব পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনগণ এখনো নিরক্ষর ও অর্ধশিক্ষিত। এসব জনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিবান্ধব, প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত করা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দক্ষমানব সম্পদ তৈরি করা সহজসাধ্য কাজ নয়। তবুও এই জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই মানবিক ও সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও হিউম্যানওয়ারকে সংযুক্ত করে স্মার্ট সিটি, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট ভিলেজ, স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলে সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজে লাগাতে পারলে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে। হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও হিউম্যানওয়ার এর মধ্যে হিউম্যান ওয়ার অর্থাৎ মানুষকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে সব প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি পরিচালানা করার মতো দক্ষ মানবসম্পদ না থাকে তাহলে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।
ডিজিটাল কানেকটিভিটি ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করা যাবে না। তাই ডিজিটাল কানেকটিভিটি হতে হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মহাসড়ক। ডিজিটাল কানেকটিভিটির মাধ্যমে সারাদেশকে প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। ডিজিটাল কানেকটিভিটি ছাড়া স্মার্ট সিটি বা স্মার্ট টেকনোলজি কোনোটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। আশার কথা হলো, বর্তমান বাংলাদেশ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। যেমন- ২০২১ সালে দেশে প্রথম পরীক্ষামূলক ৫এ কানেকটিভিটি সেবা চালু হয়েছে এবং এরই মধ্যে ৫এ কানেকটিভিটি সেবার ব্যাপারে জনগণের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার জাতীয় অর্থনীতিতে আইসিটি খাতের অবদান ২৫ শতাংশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাজ করে যাচ্ছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সরকার নীতিগতভাবে চারটি মূলস্তম্ভ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে; যথা- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমির আলোকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি সন্নিবেশিত করে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এবং প্রতিটি স্তম্ভের বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট সময়ে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যদিও আমাদের দেশে পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবায়নের বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ইউনিভার্সাল আইডির কথাই ধরা যাক। এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০২৫ সালের মধ্যে ডিজিটাল আইডি গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি, ২০৩১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে শতভাগ। কিন্তু প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা যথা সময়ে অর্জন হওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ সংশয় প্রকাশ করেছেন।
স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বিনির্মাণে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নে ৫এ কানেকটিভিটি সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য সহজ হবে।
স্মার্ট সিটি বিনির্মাণে শহরে ও গ্রামে আলাদা আলাদাভাবে সবার জন্য কানেকটিভিটি অ্যাপ তৈরি করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সব নাগরিক সহজে নাগরিক সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। অবশ্যই এই অ্যাপ মোবাইল ফোন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার সুযোগ থাকতে হবে। নাগরিক জীবনের সব চাহিদা পর্যায়ক্রমে প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিকায়ন করে সহজলভ্যতা বাড়ানো দরকার। অন্যদিকে স্মার্ট ভিলেজ বলতে এমন এক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বুঝাবে যেখানে সব গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং উন্মুক্ত উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারের মাধ্যমে স্থানীয় নাগরিকরা বিশ্ববাজারে সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাবে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের বিভিন্ন সেবা প্রদান ব্যবস্থাকে উন্নত করা, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস বিকাশে স্মার্ট ভিলেজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
অপরদিকে স্মার্ট ভিলেজের অন্যতম উপাদান স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার। স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের জন্য ন্যানো টেকনোলজি এবং এ আই ব্যবহার করে পরিকল্পনামাফিক কোন জমিতে কতটুকু সার ও ওষুধ প্রয়োজন হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। যাতে করে কম খরচে উৎপাদন দ্বিগুণ বা তিনগুণ করা যাবে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের বিকল্প নেই।
স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজের বাস্তবায়নের জন্য, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট হসপিটালিটিজ, স্বাধীন নগর প্রশাসন, আধুনিক জননিরাপত্তা, কৃষি ইন্টারনেট, ডিজিটাল কানেকটিভিটি ও স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাস্তবায়িত অসংখ্য উদ্যোগের মধ্যে ভালো অনুশীলনের অন্তত ১১টি উদ্যোগ রয়েছে, যা নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সহযোগী হবে।
সামগ্রিক বিশ্লেষণে করে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন কতটা দ্রুততর করা যায় এবং ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট জাতি উপহার দেয়ার লক্ষ্যে সরকার যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, এখন শুধু দেখার অপেক্ষা মহাপরিকল্পনার আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশের বাস্তবায়ন কাজ কত দ্রত এগিয়ে নিতে পারে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহজসাধ্য হবে না। এখানে মূল বাধাগুলো হচ্ছে- আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জনসংখ্যার আধিক্য, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, আধুনিক শিক্ষার অপ্রতুলতা, রাজনৈতিক অবিশ্বাস, জনগণের ভোটাধিকার, সুশাসনের অভাব, ঘুষ-দুর্নীতির লাগমহীন বিস্তার, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, পরিবারতন্ত্র ও অস্বচ্ছতার কারণে রূপকল্প-২০৪১ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া কঠিন হবে। সরকার ৪টি মাইলস্টোন লক্ষ্যমাত্রা ধরে এগোনোর পরিকল্পনা করেছে। প্রথম. ২০২১ সালের রূপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ, যা কিছুটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সেই আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, দ্বিতীয়. ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, তৃতীয়. ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থ. ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সালের জন্য।
তবে কোনো কিছুই অসাধ্য নয়। শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করা। তায় ২০৪১ সালে স্মার্ট ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- এমন প্রত্যাশা অবাস্তব নয়।

রবি রায়হান
কবি ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়