দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

সাংবাদিকতাসহ জীবনানন্দের জীবনবেদ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আনন্দ খোঁজার উপাদানে ঠাসা জীবনানন্দ। যার সামান্যই উদ্ধার হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে করা নানা গবেষণা ও লেখায়। চেষ্টা চালাতে থাকলে আরো উদ্ধার হবে। মিলবে অনেক কিছুর তালাশ। ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ দাশের বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৫ বছরের ঘটনাবহুল জীবনের নানা বাঁকে অনেক ঘটনা। দুদেশের জায়গায়-জায়গায় বহু স্মৃতি তার।
কর্মজীবনের বড় অংশ শিক্ষকতায় কাটানো জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কর্মজীবনে শিক্ষকতা করলেও এই পেশার প্রতি তার খেদ, অভিমান ও বিরক্তির নানা প্রকাশ রয়েছে। শিক্ষকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধতার কথা বিভিন্ন সময়ে তার সুহৃদদের কাছে লেখা চিঠিতেও আছে। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের স্থায়ী ও সম্মানজনক চাকরি ফেলে কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ার মাঝেও অনেক ঘটনা। প্রথম কাজ নিয়েছিলেন দৈনিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায়। সেখান থেকে চাকরি খোয়ান তার সমসাময়িক (একই বছরে জন্ম) কবি কাজী নজরুল ইসলামের (তিনি তখন তুমুল জনপ্রিয়) ‘সমালোচনা’ করার কারণে। ১৯২৯-৩০ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে লাহোরে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় স্বাধীনতা প্রস্তাব গৃহীত হয়। নেহরু তখন ওই মাসের ২৬ তারিখকে পূর্ণ স্বরাজ দিবস ঘোষণা করেন। সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ১৯৪৭ সালের ২৬ জানুয়ারি হুমায়ুন কবিরসহ আরো কয়েকজনের উদ্যোগে যাত্রা শুরু স্বরাজ পত্রিকার। সম্পাদক করা হয় সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে। সাহিত্যপাতার সম্পাদক জীবনানন্দ দাশ। অফিস কলকাতা শহরের শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে। হরিশংকর জলদাসের (জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, পৃষ্ঠা ১৫১) তথ্য অনুযায়ী, জীবনানন্দ স্বরাজে কাজ করেছেন সাত মাস (১৯৪৭ সালের জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে ওই বছরের জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত)। তিনি ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই মাসেও যে এই পত্রিকায় ছিলেন তা বোঝা যায় ওই তারিখে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা একটি চিঠিতে। যেখানে তিনি স্বরাজের কাজ ভালো লাগছে না বলে তাকে জানান। স্বরাজের পূজা সংখ্যার জন্য অচিন্ত্যকে একটি গল্প পাঠানোরও অনুরোধ করেন। এই লেখার জন্য অচিন্ত্যকে ৫০ টাকার কম সম্মানী দেয়া হবে না বলেও জীবনানন্দের চিঠিতে উল্লেখ ছিল। বিভিন্ন বর্ণনায় এও পাওয়া যায়, স্বরাজ পত্রিকার কাজ সেরে প্রতি সন্ধ্যায় হাঁটাপথ ধরে হিন্দ সিনেমা হলের পাশে ৫৪ গণেশ চন্দ্র এভিনিউতে সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার অফিসে যেতেন। পার্ট টাইম কাজ বা আজকের বাস্তবতায় ক্ষেপ মারতেন সেখানে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখায় বলা হয়েছে সেখানে তারা ‘আড্ডা’ করতেন।
অথচ সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবননান্দকে বরিশালে থাকতেই ভরসা দিয়েছিলেন, যতদিন স্বরাজ থাকবে ততদিন তার চাকরিও থাকবে। সঞ্জয়-সত্যপ্রসন্ন ও হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রæতি পেয়েই তিনি বরিশাল থেকে কলকাতায় যান।
দেশভাগের ডামাডোল শুরু হলে পূর্ববাংলার হিন্দুরা নিজেদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন, যা থেকে খোদ জীবনানন্দও মুক্ত থাকতে পারেননি। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দের ছাত্র এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত উপন্যাসিক শামসুদ্দিন আবুল কালামের বর্ণনা বলছে- বরিশাল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতা গিয়েই (১৯৪৭) জীবনানন্দ ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কাজ নেন। জীবনানন্দের আগ্রহে তিনিও এই পত্রিকায় কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন।
জীবনানন্দ স্বরাজ পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ‘মনমর্মর’ নামে একটি বিভাগ খুলেছিলেন। যেখানে অনেক সাহিত্যিক বন্ধু তাদের ব্যক্তিগত গদ্য লিখেছেন জীবনানন্দের অনুরোধে। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ এই পত্রিকায় জীবনানন্দ নিজেই একটি গদ্য লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে। তারই দায়িত্বে সে বছর প্রথম পূজাসংখ্যাও প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ভূমেন্দ্র গুহর ভাষ্য অনুযায়ী : ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে, পূজার আগে দৈনিক স্বরাজ পত্রিকা কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করে কোনো এক রবিবার। নজরুল তখন স্মৃতিশক্তিহীন। ওই সময়েই স্বরাজের জন্য তিনি লেখেন, ‘নজরুল ইসলাম’ নামের প্রবন্ধটি। এডিট হয়নি। প্রæফ দেখাও হয়নি। পত্রিকায় ছাপার জন্য পড়ে থাকে সম্পাদকের টেবিলে। তা নিয়েই তোলপাড়। ভূমেন্দ্র গুহর বর্ণনায় এসেছে, অন্যান্য কারণের সঙ্গে নজরুলকে নিয়ে এই প্রবন্ধের ইস্যুটাও স্বরাজ পত্রিকা থেকে জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির উপলক্ষ হয়ে ওঠে।
চরম দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্যে জীবনাতিপাত করা জীবনানন্দের জন্ম ধনাঢ্য ঘরে। তার জীবনবেদও কাব্যময়। বরিশাল শহরে তাদের পরিবার ছিল অন্যতম সম্ভ্রান্ত এবং প্রভাবশালী। এমনকি আধুনিক বরিশালের রূপকার বলা হয় যে অশ্বিনীকুমার দত্তকে, তিনিও মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে হেরেছিলেন জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দ দাশের কাছে। আমাদের সেই জীবনানন্দকেই চিনতে হয় বাংলাদেশের বরিশাল, বাগেরহাট, ভারতের কলকাতা, খড়গপুর, দিল্লিসহ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা, কিছুদিনের সাংবাদিকতাসহ কর্মজীবনের কোথাও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে থিতু হতে পারেননি এই কবি। তার সোনার খনি থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাসও। এসব সৃষ্টিতে তিনি ফিরে আসেন বারবার।
কবি জীবনানন্দ দাশ বোধ হয় খুবই অল্প কিছু মানুষের একজন, যিনি তার কবিতার মাধ্যমে মানুষের জন্ম-মৃত্যু আর কর্মকাণ্ডকে মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রকাশ তার ‘দুজন’ কবিতায় …
‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়, …?’
বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগান এ রকমই একটি কথা অন্যভাবে বলেছিলেন : মানুষের মতোই নক্ষত্র ও গ্রহগুলোর জন্ম হয়, জীবনযাপন করে, আবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
একজন মানুষের জীবনকালের পরিমাপ হয় দশকের ভিত্তিতে; সূর্যের জীবনকালের ব্যাপ্তি এর চেয়ে ১০ কোটি গুণ বেশি। নক্ষত্রের তুলনায় আমরা হলাম প্রজাপতির মতো, দ্রুত ধাবমান, ক্ষণস্থায়ী।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালে বরিশাল জেলায়। বাবা সত্যানন্দ দাশ একজন স্কুলশিক্ষক, প্রবন্ধকার, ব্রহ্মবাদী নামে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মা কুসুমকুমারী দাশ হাসির গান ও কবিতা লিখতেন।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হয় ১৯২৭ সালে ‘ঝরা পালক’; এর পর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬); ‘বনলতা সেন’ তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। তার মৃত্যুর পর বের হয় রূপসী বাংলা (১৯৫৭) ও বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)।
বাংলা কাব্যসাহিত্যে এ রকম একটি নতুন ধারা হঠাৎ তিনি তৈরি করতে সমর্থ হননি বরং ক্রমাগতভাবে তা অর্জন করেছেন। তার গভীরতর উপলব্ধিকে তিনি অনবরত শব্দ, ভাষার প্রয়োগে এমন এক স্তরে উঠিয়ে এনেছেন, যার ফলে কবিতার শরীর থেকে বিকীর্ণ মহাজাগতিক ব্যাপ্তি আমরা অনুভব করি।
তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি কবিতা, এমনকি যাকে মরমি কবিতা বলা হয়… কিছুই মানবজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন কোন শূন্যের জিনিস নয়, তবে অভিজ্ঞতার বহুলতা আছে।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো যেন ইতিহাসের বিশাল-বিশাল সময়ের বাঁককে ধারণ করে আছে মহাজাগতিক স্বপ্নকে নিয়ে।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের কাছে রাসবিহারী এভিনিউয়ে ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার ঠিক আগের দিন ১৩ অক্টোবর কলকাতা রেডিওতে জীবনানন্দ দাশ জীবনের শেষ কবিতাটি পড়েছিলেন ‘মহাজিজ্ঞাসা’। এই দুর্ঘটনার ঠিক ৮ দিনের মাথায় ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে তিনি মারা যান। তখন তার বয়স মাত্র ৫৫ বছর।
অনেকে তার এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলতে পছন্দ করেন। এ প্রসঙ্গে তার মৃত্যুচিন্তাতাড়িত কিংবা বিপন্ন বিস্ময়মাখা পঙ্ক্তিমালার দোহাই মানেন। কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় তার শেষ দিনগুলোর যে বিবরণ ভূমেন্দ্র গুহ এবং অন্যরা জানান, তাতে এই উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন যে, জীবনানন্দ মরতে চেয়েছিলেন কিংবা তার মৃত্যুটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং আত্মহত্যা।
কলকাতা রেডিওতে জীবনের শেষবার পঠিত ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি জীবনের গূঢ় দর্শনে পূর্ণ।
বস্তুত মানুষ সবাই নিরন্তর বহমান সময়ের থেকে খসে গিয়ে সময়ের জালে জড়িয়ে পড়ে। এটা একটা মায়া, কুহক, বিভ্রান্তি; অবিরল শূন্যের গ্রাস।
তারপরও ২২ অক্টোবর এলেই আমাদের মনের ভেতরে সেই পুরনো বিভ্রান্তিটি খচখচ করে ওঠে- জীবনানন্দ কি তবে আত্মহত্যাই করেছিলেন, নাকি মৃত্যুকে তিনি আলিঙ্গন করেছেন অথবা ভেবেছিলেন যে, জীবনের লেনদেন ঘুচেই যেহেতু গেছে, সুতরাং অন্ধকারে চিরকাক্সিক্ষত মানুষের মুখোমুখি বসে থেকে এইবার না হয় দুদণ্ড শান্তির আয়োজন।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জীবনানন্দ দাশ প্রায়ই নাকি ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। এর চেয়েও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে গত একশ বছরে কলকাতা শহরে ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা একটাই।
জীবনানন্দ রচনা করেছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ কবিতা, এক ডজন উপন্যাস, প্রায় পঞ্চাশটি গল্প ও বহু প্রবন্ধ। তিরিশের দশক থেকে মৃত্যুবধি তিনি গল্প-উপন্যাস রচনা করে গিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোর একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তার কবিতারও এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ গ্রন্থিত হয় তার জীবদ্দশায়, যদিও আরো কয়েকশ কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- অধিকাংশই বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। ‘মাল্যবান’ তার লেখা প্রথম উপন্যাস, যা গ্রন্থিত হয় ১৯৭০ সালে। বাস্তবিকই তার অকালমৃত্যুর পরে কারোর ধারণাই ছিল না যে তার পাণ্ডুলিপির ট্রাঙ্কের ভেতর এতগুলো অপ্রকাশিত গল্প ও উপন্যাস রয়েছে।
জীবনানন্দ মনে করতেন যে সমাজ ও অর্থনীতির সমস্যায় বহু মানুষের জীবন চিরকাল চক্করে ঘুরে চলেছে। এসব পরিস্থিতি নিয়ে তিনি যে উপন্যাস লিখেছেন তার কাঠামো সাধারণ উপন্যাসের থেকে আলাদা- এই উপন্যাসের শুরুও নেই, শেষও নেই। তার দু-একজন সাহিত্যিক বন্ধু দু-একটি উপন্যাস পড়ে বলেন যে এই উপন্যাস লেখার ব্যাকরণ মানছে না, তাই এগুলো চলবে না। তাই জীবনানন্দ নিজেও এগুলোকে ঘষা-মাজা করে প্রকাশ করার চেষ্টা করেননি।
তার নিজের কিন্তু বিশ্বাস ছিল যে মানুষের আসল সমস্যাকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে এ রকম উপন্যাসের প্রয়োজন আছে- তাই বিশ বছরের বেশি সময়ে কয়েক ডজন খাতা ভর্তি করে এত গল্প-উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তিনি এও জানতেন যে ইউরোপের কিছু নামি লেখক এই ধরনের উপন্যাস লিখেছেন- যদিও জীবনানন্দের সব উপন্যাসই একান্তভাবে বাঙালির জীবনসংকট নিয়ে। কবি হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশও ছিলেন গম্ভীর, ভেতরগোটানো এবং গাঢ় নির্জন ধরনের মানুষ। বেঁচে থাকার সময়, তার লেখালেখির ধরন ও চরিত্রের গড়নের কথা কাছের ও দূরের মানুষেরা কিছু কিছু জানতেন। এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো করে জানতেন বুদ্ধদেব বসু।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রগতি পত্রিকার সৌজন্যে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর পরিচয় ও আলাপ হয়। দুজনের সেই আলাপ পরে বন্ধুত্বে গড়ায়। এক হিসেবে, বুদ্ধদেব বসুই জীবনানন্দের প্রথম মুগ্ধ পাঠক ও প্রচারক; যিনি নিন্দুকের মুখে চপেটাঘাত করে জীবনানন্দের কবিতার পক্ষে কলম ধরেছেন। পরিচয় ও বন্ধুতার কিছুদিন পরেই আমরা দেখতে পাই, ১৯৩০ সালের ৯ মে, শুক্রবার, জীবনানন্দ দাশের যখন বিয়ে হয় ঢাকার পাটুয়াটুলি লেনের ব্রাহ্মসমাজে, তখন বন্ধু অজিত দত্ত প্রমুখকে সঙ্গে করে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন বুদ্ধদেব বসু। স্ত্রী লাবণ্যর সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দিত ভঙ্গিতে বুদ্ধদেবের পরিচয় করিয়ে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ইনি কবি বুদ্ধদেব বসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, রতœ।
মাল্যবান জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখা হয় জুন ১৯৪৮ সালে, অল্প কয়েকদিন সময়ের ব্যাপ্তিতে। তার জীবদ্দশায় উপন্যাসটি ট্রাঙ্কবন্দি অবস্থায় চাপা ছিল। মৃত্যুর কুড়ি বছর পর, তার ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘নিউ স্ক্রিপ্ট’ থেকে এটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণে নামপত্রে প্রকাশকের নাম, প্রচ্ছদ : সত্যজিৎ রায়, কপিরাইট : লাবণ্য দাশ ও সমরানন্দ দাশ, মূল্য : ১০ টাকা- এই কথাগুলো উল্লেখ ছিল। বইয়ের কোথাও প্রকাশকাল উল্লেখ নেই।
জীবনানন্দ দাশ সচেতনভাবেই সিরিয়াসলি ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি কখনো প্রতিভা বসুর কাছে উপন্যাস বিক্রির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে চিঠিতে ছদ্মনামে উপন্যাস লিখবার বাসনার কথা জানিয়েছেন এবং বয়সে ছোট কিন্তু বন্ধুর মতো জীবনানন্দ-অনুরাগী প্রভাকর সেনকে গল্প-উপন্যাস পড়তে দিয়েছেন। এমনকি ‘মাল্যবান’-এর চিত্রনাট্য লিখে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে জমা দেবেন বলেও ভেবেছেন। কারণ প্রেমেন তার বন্ধু এবং বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। কাজেই গল্প-উপন্যাসের জগতে জীবনানন্দ দাশ হঠাৎ খেয়ালে কবিতা থেকে কলম তুলে ঢুকে পড়েছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
জীবনানন্দকে বাঙালি পাঠকবিশ্বে তুলে ধরেছিলেন যে শুভাকাক্সক্ষী বুদ্ধদেব বসু তার উপযুক্ত সমাধিফলকই লিখে গিয়েছিলেন, যখন তিনি তাকে ‘আমাদের নির্জনতার কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। হতে পারে সেই নির্জনতার কারণেই আজ অবধি বাংলা সাহিত্যের এই মহৎ ব্যক্তিত্বের একটি মাত্র জীবনী লেখা হয়েছে বাংলায়- অন্য কোনো ভাষায় একটিও নয়।’
শেষোক্ত এই উদ্ধৃতি-অংশে যে-টীকার উল্লেখ করা হয়েছে, তারই দৌলতে আমরা জানতে পেরেছি যে, ক্লিন্টন বি সিলির এ পোয়েট অ্যাপার্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে।
তার আগে জীবনানন্দ নামে গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা একটা জীবনীগ্রন্থ বেরিয়েছিল ১৯৭১ সালে। এটিই ছিল বাংলা সাহিত্যে কবির ওপর লেখা প্রথম জীবনীগ্রন্থ। পরে তার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জীবনানন্দ দাশ নামে প্রভাতকুমার দাসের লেখা একটি জীবনীগ্রন্থ বের হয় ১৯৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ক্লিন্টন এটিকে ‘উৎকৃষ্ট একটা জীবনী’ বলে অভিহিত করেছেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও নিরেট সত্যটা এই যে, বাংলা সাহিত্যপ্রেমী একজন বিদেশি, মার্কিন নাগরিক ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা সাহিত্যে যিনি ‘নির্জনতম কবি’ বলে অভিহিত, সেই কবির দ্বিতীয় বিস্তারিত জীবনীটি লেখার জন্য যেভাবে প্রাণিত হন এবং আমাদের আলোচ্য সেই বিশালায়তনের গ্রন্থটি রচনা করেন, এক অর্থে, তা বিস্ময়করই বটে।
আমরা এখন জোর গলায় বলতে পারি, পোয়েট অ্যাপার্ট তথা অনন্য জীবনানন্দ কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও তার কাব্যকৃতি নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত সবচেয়ে বিস্তারিত ও ঋদ্ধ গ্রন্থ। স্মর্তব্য, গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল মার্কিন তথা ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকদের সঙ্গে জীবনানন্দ ও তার কাব্যকৃতির পরিচয় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্য থেকে।
ফারুক মঈনউদ্দীনের নিবিড় ও নিষ্ঠশ্রমে বাংলায় অনূদিত হওয়ার পর এ-গ্রন্থ এখন বাংলা সাহিত্যেরও এক অবিচ্ছেদ্য মূল্যবান সাহিত্য-দলিলে পরিণত হলো। নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করার মতো করে জীবনানন্দকে তিনি যেভাবে আবিষ্কার করেন, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কাছেও

মনে হয়, আহা আমরা এতদিন আমাদের নিজের ভাষার এই কবিকে এভাবে আবিষ্কার করতে পারিনি কেন?
ক্লিন্টন বি সিলি ‘কল্লোলে’ জীবনানন্দের প্রকাশিত প্রথম ‘নীলিমা’ কবিতার সূত্র ধরে বলেন, ‘১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে কল্লোলে যখন ‘নীলিমা’ ছাপা হয়, তখন সঠিক কবিতাটি স্পষ্টতই সঠিক ক্ষেত্র পেয়েছিল, কারণ লেখাটা বহু তরুণ কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার স্মৃতিকথা কল্লোল যুগে বলেন যে কবিতাটি পড়ে তিনি এতই চমৎকৃত হন যে তিনি তৎক্ষণাৎ অপরিচিত এই কবির সঙ্গে পরিচিত হতে চলে যান। তখন তার এমতো উচ্চারণের ভেতর দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নজরুলের কবিতার সংক্রমণ থেকে বেরিয়ে আসছেন জীবনানন্দ এবং নিজের একান্ত কণ্ঠস্বরে চিহ্নিত হওয়ার লক্ষণাক্রান্ত হতে শুরু করেছেন। না হলে ‘নীলিমা’ কবিতা তাকে ঘনিষ্ঠতর করছে কেন বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অচিন্ত্যকুমারদের সঙ্গে? তাদের প্রায় প্রত্যেকেই জীবনানন্দের সঙ্গপিপাসু হতে অতটা উদ্বেল হয়ে উঠবেন কেন?
ঠিক এই ঘটনার পর, বিশেষত বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের কাব্যসত্তার বিকাশে যে ভূমিকা গ্রহণ ও পালন করে চলেন প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে, ক্লিন্টন বি সিলি তার বিবরণ তুলে ধরেছেন এই অধ্যায়ে অকৃপণভাবে। পাশাপাশি শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত দাস তরুণতর জীবনানন্দের কাব্যপ্রয়াসকে যেভাবে, যে ভাষায় আক্রমণ করেন তার রক্ষণশীল ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিজাত বিচার থেকে, ক্লিন্টন বি সিলির উদার দৃষ্টিভঙ্গিকে তা বিচলিত না করে পারেনি।
সজনীকান্ত জীবনানন্দ ও অন্য আধুনিক কবিদের রচিত কবিতাকে অভিহিত করতেন ‘গবিতা’ বলে। কিন্তু জীবনানন্দসহ ত্রিশের কবিরা যে শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল কাব্য ও সাহিত্যবোদ্ধাদের চোখের সামনে দিয়েই নিজেদের দৃঢ? অবস্থান তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন, পরিবর্তিত কালের প্রেক্ষাপটে নিজেদের পৃথক সাহিত্যিক বা কাব্যিক সত্তাকে স্পষ্ট করার অভিযানে অক্লান্ত ছিলেন এবং সেক্ষেত্রে নানা বিপত্তি ও বাধা সত্ত্বেও তারা যে সাফল্যের মুখ দেখছিলেন, সিলি তার বইয়ের এই অধ্যায়ে তারও বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছেন।
সবশেষে তিনি যে-উদাহরণ তুলে ধরেন, তাতে করে সিলির সাহিত্যিক সূ² বিচারক্ষমতার তারিফ না করে পারি না, যখন তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান সরাসরি শুরু হয় : ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
জীবনানন্দের ভালোবাসার অনুভূতির প্রকাশ একই রকম আন্তরিক, কিন্তু একই সঙ্গে আমরা যা দেখি তা স্বকীয়ভাবেই জীবনানন্দীয়।’
এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় ‘বরিশালে ফেরা’, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে জীবনানন্দের কবিজীবনের পাশাপাশি তার অন্যতর সাহিত্যিক প্রয়াসের বিবরণ। সিলি জানাচ্ছেন, এ-অধ্যায়ের সূচনাতেই, ‘১৯৩০-এর দশকের প্রথমার্ধে জীবনানন্দ নববিবাহিত ও বেকার অবস্থায় বরিশাল প্রত্যাবর্তন করেন।’
ততদিনে প্রকাশিত হয়ে গেছে তার কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক। ১৯৩০ সালের মধ্যে পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়ে গেছে তার ধূসর পাণ্ডুলিপির (১৯৩৬) প্রায় সমুদয় কবিতা। সিলি জানাচ্ছেন, ‘এই দুই গ্রন্থের মাঝখানে তিনি বহু কবিতা ও গল্প রচনা করেন, কিন্তু সেসব ছাপতে দেননি। এমনকি একটা শিরোনামহীন অসমাপ্ত উপন্যাসও লিখেছিলেন ১৯৩৩ সালে।
এসব গদ্য প্রকাশের পর জীবনানন্দের বাস্তব ভাষারীতিসিদ্ধ কথ্য বাংলা এবং জীবনঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য ভুবন আবিষ্কার করার ক্ষমতার- যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে আত্মজীবনীমূলক চরিত্রের সূ² ইশারার উপস্থিতিসমৃদ্ধ এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়।’
তার এসব গদ্য রচনা কোথায় এবং কোন পরিবেশে তিনি লিখছেন, তার পটভূমিই শুধু নয়, ভাষারীতি এবং বিষয়বস্তুর মর্মের আলোচনায়ও তিনি যে বিস্তারের সুযোগ নেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
এই অধ্যায় অধিকার করে আছে ‘বাংলাদেশকে মহিমান্বিত করে রচিত’ কবির ৬০টি সনেটের সংকলন রূপসী বাংলারও বিস্মৃত আলোচনা। গ্রন্থিত কবিতাগুলোর আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যে মূল্যায়নে ব্রতী হন, তাকে নাকচ করে দেয়া প্রায় দুঃসাধ্য।
বলা যেতে পারে, ক্লিন্টন বি সিলির এ-বক্তব্য একান্তভাবে তারই বিশ্লেষণ, রূপসী বাংলার পাঠ-পরবর্তী তার অনুভবসিক্ত প্রগাঢ় উচ্চারণ, যেখানে তিনি বলেন, ‘বহিরঙ্গে যেটাই বলা হোক না কেন, জীবনানন্দের সনেটগুচ্ছ বুদ্ধিজীবীসুলভ রচনা নয়।
নাড়িছেঁড়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বক্তব্যের ভেতর দিয়ে এগুলোর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কোনো এক রোমান্টিকের শিশুসুলভ হৃদয়ের পুনর্লব্ধ ভালোবাসার কথা। তিনি যখন এ রকম উদ্বেলিত উচ্ছ¡াসের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে আপন মনে কথা বলেন, তখন কান পেতে শুনলে বোঝা যেত, এসব অতি ব্যক্তিগত প্রায় বক্তব্যের জন্য কবি লজ্জায় দগ্ধ হয়ে যেতেন। এ রকম একান্ত চর্চায় জীবনানন্দ পরিপূর্ণভাবে পুনর্যাপন করেন বাংলার সঙ্গে, প্রাণী-উদ্ভিদ-আকরিক গ্রামবাংলার সঙ্গে, নগরবাংলার মানবসমাজের সঙ্গে নয়।’
‘বরিশালে ফেরা’ অধ্যায়ে জীবনানন্দের প্রায় সব কবিতার বইয়ের পাশাপাশি তার গদ্য-রচনা প্রয়াসের বিবরণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সেগুলোর চুম্বকাংশের উদ্ধৃতিসহ প্রাসঙ্গিক বিবরণ ও আলোচনা। ক্লিন্টন বি সিলির পঠনপাঠনের ব্যাপ্তি যে কতটা গভীর ও অনুপুঙ্খ, এ অধ্যায় থেকে তার প্রমাণ মিলবে পদে পদে।
জীবনানন্দ সম্পর্কে সুওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রেরই একটি বিষয় জানা আছে যে, জীবনানন্দ-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ইতিমধ্যে তার ‘বনলতা সেন’ কবিতাকে মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও কবি এডগার অ্যালান পোর ‘টু হেলেন’ কবিতার প্রায় সমূল অনুবাদ বলে ব্যাখ্যাসহ প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু মার্কিন এই গবেষক জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতার দীর্ঘ আলোচনায় কোথাও এ ধরনের প্রয়াস চালাননি। ভুলেও নয়। এবং ‘টু হেলেন’ যে সিলির পড়া নেই, এ-কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ফলে যারা বা যেসব গবেষক ‘বনলতা সেন’কে ‘টু হেলেনে’র অনুসৃতি মাত্র বলে থাকেন, তাদের এই বইয়ের এ-অধ্যায়টিতে ‘বনলতা সেনে’র আলোচনা নিঃসন্দেহে চমকিত করবে।
‘যুদ্ধকাল : প্রস্তাবনা ও ফলাফল’ এ-বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বলা যেতে পারে, জীবনানন্দ সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত অধ্যায়গুলোর অন্যতম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূচনার পটভূমিতে জীবনানন্দের জীবন ও তার কাব্যকৃতির আলোচনা মুখ্য হয়ে উঠলেও এ-অধ্যায়টিতে প্রাসঙ্গিক অন্যবিধ আলোচনাও বাদ পড়েনি। যেমন, অধ্যায়ের শুরুতেই ক্লিন্টন বি সিলি বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যে-আলোচনার সূত্রপাত করেন, তা যথার্থই শুধু নয়, জীবনানন্দ সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে।
যেমন, ‘১৯৪০-এর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ও মার্কসবাদে দীক্ষা নেয়া বাঙালি লেখকদের প্রসঙ্গ অবশ্যই বিবেচনায় আনা উচিত। আগের দশকগুলোতে সাহিত্যিকরা নিজেদের আধুনিক ও প্রথাগত ধারায় বিভক্ত বলে মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত ও আধুনিক উভয় ধারার বলে প্রমাণিত ও প্রভাবশালী ছিলেন উভয় শিবিরেই।
তবে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে ১৯৪০-এর আগে মার্কসবাদ প্রভাব বিস্তার করার আগে পর্যন্ত আধুনিক ও প্রথাগত- এই দুটি ছিল সাধারণ বিভাগ, যার যে-কোনো একটিতে লেখকেরা পড়তেন। কিছু লেখক সরাসরি কমিউনিস্ট হয়ে যান, অন্যরা ছিলেন সমর্থক, তবে বাকিরা সমর্থকও ছিলেন না।
লেখকদের কেউ কেউ সাহিত্যিক-রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধাচরণ করে একজোট হন, অন্যরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক আনুগত্য থেকে মুক্ত ছিলেন। জীবনানন্দ এ ধরনের দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন দূরবর্তীভাবে, তবে তার কবিতায় রাজনৈতিক সচেতনতা প্রতিফলিত হতে থাকে আগের চেয়ে বেশি।
সিলি এখানেই থেমে থাকেন না, তার বক্তব্যের সমর্থনে হাজির করেন আরো নানা উদাহরণ। এবং এসবই করেন যুদ্ধের পটভূমিতে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি জীবনানন্দের কাব্য-মানসের বিলোড়নটিকে আরো প্রত্যক্ষ করার জন্য।
তিনি আবু সয়ীদ আইয়ুবের মন্তব্যও উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন, ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বলেছেন, তিনি বাংলার সবচেয়ে বিভ্রান্ত কবি। আইয়ুব তাঁর বনলতা সেন গ্রন্থের কবিতাগুলো উপভোগ করেছেন- তিনি মনে করতেন সতীর্থ কোনো কবির চেয়ে সম্ভবত জীবনানন্দের উপলব্ধি ছিল গভীরতর। কিন্তু তিনি জীবনের দর্শন নির্ধারণ করতে গিয়ে নিদারুণ ব্যর্থ হয়ে কোনো কিছু সূত্রায়িত করতে পারেননি।
বনলতা সেনের কবিতাগুলো কবিতা হিসেবে, ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ হিসেবে চমৎকার ছিল। আইয়ুব স্বীকার করেন, এমনকি বনলতা সেন-পরবর্তী কিছু সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণও কবিতা হিসেবে সফল। জীবনানন্দ একজন কৃষক বা ভিখারি কিংবা একটা হরিণের মৃত্যুকে একভাবে দেখা এবং একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা ধারণ করেন। তবে আইয়ুব আবারো বলেন, যদি দর্শনটা আদৌ বোধ্য হয়, দার্শনিক কবিতাগুলো ব্যর্থ হয়, যেহেতু দর্শন ব্যর্থ।’
জীবনানন্দের জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিচারে ক্লিন্টনের বিশ্লেষণ-প্রয়াস একপেশেমিতায় পর্যবসিত নয়। ফলে আমরা দেখি, তিনি, জীবনানন্দ যে রাজনীতির বাইরে থাকতে পারেননি, কিংবা তখনকার বাস্তবতা তাকে রাজনীতি-নিস্পৃহ থাকতে দেয়নি, সেটা তুলে ধরতেও তিনি কসুর করেননি।
শেষ করছেন তিনি ’৪৭ সালের দেশভাগের সুগভীর মর্মবেদনা ও হাহাকার দীর্ণতা জীবনানন্দ কীভাবে তার কবিতা বা কাব্যকর্মে তুলে ধরছেন, পেশ করছেন তার পরিচয়বাহী স্বাক্ষর। এবং ‘রাজনীতির কবিতা’ নামে যে-অধ্যায়টি যুক্ত করা হয়েছে এ-বইয়ে, সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এখানে নানা দৃষ্টান্ত সহযোগে তুলে ধরা হয়েছে বামপন্থি, তথা কমিউনিস্ট চক্রভুক্ত সাহিত্য-ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা এবং এসবের পরিণতি তার সৃজনকর্মে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, ক্লিন্টন বি সিলি তারও বর্ণনা দিয়েছেন সবিস্তারে। তিনি দেখিয়েছেন, জীবনানন্দের কবিস্বভাব মূলত তার স্বকাল ও জীবনের দ্ব›দ্ব-সংঘাতেরই ভাষিক অনুরণন, স্রেফ রাজনীতিকেন্দ্রিক কিছু নয়।
‘উপন্যাসের আরেকটি প্রয়াস’ এ-বইয়ের এমনই একটি অধ্যায়, যেখানে জীবনানন্দের গদ্যচর্চা তথা কথাসাহিত্য, বিশেষভাবে তার উপন্যাস রচনার পটভূমি ও প্রয়াসের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে তার জীবনের দ্ব›দ্ব-সংঘাতজনিত নানা টানাপড়েনের কথাও।
ক্লিন্টন বি সিলি এ-বই নিজের ভূমিকায় জীবনানন্দের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন, শেষও করেছেন তার মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার বিবরণ দিয়ে।
সত্যি বলতে কি, জীবনানন্দকে মার্কিন তথা ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠককুলের সঙ্গে পরিচিত করাতে পোয়েট অ্যাপার্ট নামে কবির যে সাহিত্যিক-জীবনী রচনা করেন তিনি, ফারুক মঈনউদ্দীনের স্বচ্ছন্দ ও সাবলীয় অনুবাদে সম্পাদিত অনন্য জীবনানন্দ নামের সেই জীবনীই বাংলা ভাষাভাষী জীবনানন্দ-প্রেমিকদের জন্য অপরিহার্য গ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত জীবন তার ঘোর কালো ছিল। কিন্তু সেসব ভুলে থেকে যে লেখালিখিতে একটু শান্তি পাবেন, তাও কপালে জুটেনি। সিটি কলেজে ধর্মীয় কারণে ঝামেলা হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। যার দরুণ জুনিয়র প্রভাষকদের চাকরি চলে যায়। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তাদেরই একজন। ব্যাস, গুজব রটানো হয় কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে তিনি চাকরি হারান। পত্র-পত্রিকা থেকে তার লেখা ফেরত আসে। নতুন কবিতার সংকলনে তার নাম আসে না।
শুরুর দিকের বই প্রকাশের জন্য প্রকাশক পাননি, নিজ খরচেই প্রকাশ করতে হয়েছিল। লেখক ও সমালোচক সজনীকান্ত ছিলেন তার সাহিত্যিক জীবনের সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা। শুরু থেকেই তিনি জীবনানন্দের লেখার একটা না একটা অভিযোগ বের করতেনই। তৎকালীন ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় তিনি জীবনানন্দের কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগসহ তীব্র সমালোচনা করেন। কবির পরিচয়েও একটি কালো তকমা লেগে যায়। কিন্তু এতোসবের পরেও জীবনানন্দ মুচকি হেসে বলেছিলেন,
‘সজনীকান্ত বাবু তো আমার ভালোই প্রচার করছেন।’
জীবনের প্রতি উদাসীন হয়ে যান। একবার তিনি সপরিবার দিল্লি যান। ঘুরতে বের হয়েছিলেন। সেখানে ছোট ভাতিজা অমিতানন্দ মেয়ে মঞ্জশ্রীর একটা গয়না খেলতে নিয়ে হারিয়ে ফেলে। গয়নাটা খুব দামি ছিল। এ নিয়ে বকাবকি, রাগারাগি মিলে একটা হাঙ্গামা বেধে যায়। কিন্তু এসবে বিন্দুমাত্র ভ্রæক্ষেপ নেই কবির। তিনি আপন মনে ঘুরছিলেন আর হয়তো মনে মনে নতুন কবিতা বুনছিলেন।
‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কপি পাঠিয়ে মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করেন। রবীন্দ্রনাথ জবাব দেন,
‘কল্যাণীয়েষু,
তোমার কবিতাশক্তি আছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এতো জবরদস্তি কেন বুঝতে পারি নে’
ব্যথিত হয়েও থেমে থাকেননি জীবনানন্দ। পরে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বের হলে তারও একটি কপি পাঠিয়ে দেন ঠাকুরের কাছে। এবারেও ঠাকুর বলেন,
‘কল্যাণীয়েষু,
তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।
ইতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
এবারো জীবনানন্দ ব্যথিত হন। হয়তো তিনি আরো ভালো কিছু আশা করেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী, ধূর্জটি প্রাসাদকেও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের থেকেও খুব ভালো প্রত্যুত্তর পাননি।
এসবের কথা চিন্তা করেই হয়তো ডায়েরিতে লিখেছিলেন,
‘চিরদিন দুঃখ ভোগ করে যাওয়াই তো জীবনের উদ্দেশ্য নয়…।’
তবে সব সময়ই তার লেখার যথাযথ মূল্যায়ন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এত প্রতিবন্ধকতা ঠেলে কবিতা চালিয়ে যাওয়ার গুণের কারণেই হয়তো তিনি তাকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এছাড়াও সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও দীপ্তি ত্রিপাঠী তার সুন্দর মূল্যায়ন করেন। দীপ্তি ত্রিপাঠী তার বইয়ে লিখেছিলেন,
‘এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ’।
চারদিকের এত এত বাঁধা, এত অবমূল্যায়ন, প্রতিবন্ধকতা কবির জীবনকে বিভ্রান্ত করলেও কবিমানসকে বিন্দুমাত্র হেলাতে পারেনি। এসব কিছুর পরোয়া না করেই তিনি লিখে গেছেন।
তবে কবির ভেতরকার সেই মানুষ জীবনানন্দ যেন বেঁচে থেকেও মরে গিয়েছিলেন। তার কবিতায় বারবার আত্মহত্যার কথা এসেছে।
জীবনানন্দ দাশ বাস্তবতার কবি নন, পরাবাস্তববাদের কবি। তাই তিনি মৃত্যুর চেয়ে অপমৃত্যুর ছবি আঁকেন বেশি। তিনি লাশ কাটা ঘরের মর্মান্তিক পরিবেশ তুলে ধরেন। দেখান যে, ইঁদুর যেমন ওষুধ খেয়ে ভেবেছিল খাদ্য-অপমৃত্যুর শিকার হয়, মানুষও লাশ কাটা ঘরে অমনই নিয়তির শিকার হয়। মুখে তার রক্তের ফেনা ওঠে।
খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে জীবনানন্দ দাশ তার কাব্যসম্ভারে বারংবার ‘ভাঁড়’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি যেমন বাস্তবের উপরিতল ভেদ করে, গভীরে চোখ নামিয়ে মানুষের দুর্গতি, লাঞ্ছনা, অসহায়ত্ব, অপমৃত্যু দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন সমাজের অন্তঃসারশূন্য ভাঁড়ামিকে। ত্রিশ-চল্লিশের দশকে একদিকে মানুষ ভাগ্যবিড়ম্বিত বিপন্ন হয়েছে, অন্যদিকে মানুষ হৃদয়হীন ভাঁড় হয়েছে, আবার শকুনও হয়েছে, মানুষ শকুনের খাদ্যও হয়েছে। এমন অস্তিত্ব বিপন্নের ট্র্যাজেডি আর কারো কবিতায় নেই জীবনানন্দ ছাড়া।
অনেকে তাকে নির্জনতার কবি বলেছেন। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। নির্জনতার কবি হন বা না হন, তিনি স্বল্পবাক ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে একাকী ছিলেন। কোলাহলমুখর, প্রচারপ্রবণ, যোদ্ধাবেশ তার ছিল না। তার মৃত্যু তার নির্জন বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এ কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তার প্রভাব আছে। তিনিও নজরুলের মতো দেশবন্ধুকে চেতনার পক্ষে জীবনানন্দ দাশ ও চেতনাসঞ্চারী কবিতা লিখেছেন। নজরুল শেষদিকে ইসলামি গজল লিখেছেন, তাতে বেজে উঠেছে মরমি সুর। এ সুর জীবনানন্দের শেষদিককার কবিতাগুলোতে প্রভাব ফেলেছে।
নজরুলের মতো জীবনানন্দের কবিতা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যটি অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাতে হাতে ছিল। সেই যে অমর পঙ্ক্তি, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সুর দিয়ে এ কবিতাটি গান হিসেবে গাওয়া হয়েছে। রূপসী বাংলার কবি হিসেবে তিনি আজ বাঙালির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত।
হেমন্ত ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রিয়তম ঋতু। হেমন্তের এক রাতেই তিনি অনন্তের পথে পাড়ি দেন। জীবনানন্দপ্রেমীদের কাছে তাই ২২ অক্টোবর এক বিরহছোঁয়া দিন। এদিন তিনি তার সমস্ত শিল্পপ্রচেষ্টার কিছু শেষ করে, কিছু অসমাপ্ত আর বেশির ভাগই অপ্রকাশিত রেখে চোখ বুজেছেন।

এ কে এম রেজাউল করিম
প্রবাসী লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়