দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

বাঙালি সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হবে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সংস্কৃতি বা কৃষ্টি, culture, নৃতত্বে, কোন সমাজের জীবন-ধারার চলমান অনুকৃতি। মানবজাতির প্রথম বিকাশের সময় হতেই সংস্কৃতি মানব সমাজ ও প্রাণীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর নানামুখী সৃষ্টির মধ্যে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবাণ প্রাণী। মানুষ ভৌগলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং জৈবিকসহ নানান বৈশিষ্ট্যের কৌশলসমূহের ওপর নির্ভর করে।
‘সংস্কৃতি’ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘সংস্কার’ শব্দ থেকে। ‘সংস্কার’ অর্থ শুদ্ধি, পরিষ্করণ, মার্জন, ব্যাকরাণাদির শুদ্ধি, ভুল সংশোধন, মেরামত, ব্যুৎপত্তি, কর্ম ও স্মৃতিজ মনোবৃত্তি, স্বভাবসিদ্ধ স্থায়ীভাব। আর ‘সংস্কৃতি’ অর্থ সংস্করণ, সংস্কারকরণ, বিশুদ্ধিকরণ, অনুশীলন লব্ধ দেহ-মন-হৃদয় ও আত্মার উৎকর্ষ। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির আরেকটি অর্থ ‘কৃষ্টি’। এ শব্দটির ‘বৃষ’ ধাতু নিষ্পন্ন। এর অর্থ ভূমি কর্ষণ, হালচাষ, কৃষিকর্ম, অনুশীলন, মানবতার সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষের সাধনা ইত্যাদি। এ দিক থেকে বিচার করলে সংস্কৃতি ও কৃষ্টি প্রায় সমার্থবোধক হলেও সাধারণ্যে সংস্কৃতিই বহুল প্রচলিত। বাংলায় ‘কৃষ্টি’ শব্দটি সংস্কৃতির চাইতে বেশি অর্থবোধক। কিন্তু শব্দটিতে যেহেতু কর্ষণ ও কৃষি অর্থ জড়িত তাই অনেকেই এর প্রতি বিমুখ। সংস্কৃতি মূলত সংস্কৃত ভাষার শব্দ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো কালচার (culture)। এটি জার্মান কুলটুর (Kultor) শব্দ থেকে আগত। যার আভিধানিক অর্থ হল cultivation বা কর্ষণ। Culture এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়। ‘কালচার’ কথাটির প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন বেকন্। তার মতে ‘সংস্কৃতি হল মানুষের নিবিড় সত্তার সারভাগ। ’তবে সংস্কৃতির সবচেয়ে মানানসই সংজ্ঞা প্রদান করেছেন নৃবিজ্ঞানী টাইলর। তিনি তার primitive Culture নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: culture is that complex whole which includes knowledge , belief , art, moral, law, custom and other capabilities and habits acquired by man as a member of society’.
অর্থাৎ-‘সংস্কৃতি হল সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত আচার -ব্যবহার, জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতি, আইন-প্রথা ইত্যাদির জটিল সমাবেশ।’ সংস্কৃতি শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো আস সাকাফা বা তাহজীব। এর অর্থ হল কৃষ্টি, কর্ষণ, পরিমার্জন, অনুশীলন বা উৎকর্ষ সাধন। কর্ষণ, অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যা সফল ও উৎকৃষ্টতর পর্যায়ে উপনীত হয় তাই সংস্কৃতি। এর সাধারণ বোধগম্য অর্থ হলো মার্জিত রুচি ও উত্তম স্বভাব। এ তিনটি (সংস্কৃতি, কালচার ও সাকাফাহ) শব্দেই ঠিকঠাক করা, সংশোধন করা ও পরিশুদ্ধ করার অর্থ নিহিত রয়েছে। এর পারিভাষিক সংজ্ঞাতেও এ অর্থটি পুরোপুরি রক্ষিত হয়েছে।
পরিভাষায় বিশ্বাসলব্ধ মূল্যবোধে উদ্ভাসিত, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত মন-মানসিকতাকেই সংস্কৃতি বলা হয়। অন্যকথায় পরিশুদ্ধ করণের নাম হচ্ছে কালচার। ১৮০৫ সন পর্যন্ত ইংরেজী ভাষায় এ শব্দটির কোন ব্যবহার দেখা যায় নি। সম্ভবত ম্যাথু আর্ণল্ড ক্যালচার পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছন। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত এ শব্দটি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী এর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তবে মি. ফিলিপ বাগবী এর একটি চমৎকার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে : কালচার বলতে যেমন চিন্তা ও অনুভূতির সকল দিক বুঝায়, তেমনি তা কর্মনীতি, কর্ম পদ্ধতি এবং চরিত্রের সকল দিককেও পরিব্যাপ্ত করে। কালচার বা সংস্কৃতি শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধা দেখা দেয় এই যে, তার পূর্ণ চিত্রটি উদঘাটন করার জন্য মন ঐকান্তিক বাসনা বোধ করে বটে, কিন্তু তার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিশেষজ্ঞরা খুব বেশি বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কৃতির বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাকে নাম দেয়া হয়েছে কালচার বা সংস্কৃতি। আসলে এগুলো সংস্কৃতি নয় সংস্কৃতির বাহন মাত্র।
সংস্কৃতি বা কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা- সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্মের মাধ্যমেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা। কারণ পৃথিবীর শুরুতে মানুষের নিজ নিজ ধর্মের মধ্যেই তাদের কালচার বা সংস্কৃতি প্রথিত ছিল। যা আজও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের যাপিত জীবনের মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের আদিবাসীদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। বর্তমানে তাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাদের ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশসহ নানামুখী উন্নয়নে তারা সচেষ্ট।
‘সংস্কৃতির মধ্যে অবশ্যম্ভাবীরূপে এমন একটি গুন বা বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যা সততা, ন্যায়-পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, মানবিকতা, উপযোগিতা, সৌন্দর্যবোধ, শিল্পকলা বা নান্দনিকতার সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত; এবং যা কোনভাবেই মানবতাবিরোধী বর্বরতার সাথে সংযুক্ত নয়। মানবাচরণকে ‘সংস্কৃতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার এটিই হচ্ছে প্রথম ও প্রধান শর্ত।
সাধারণ ভাবে মানবের আচরণ, জীবিকার উপায় উপকরণ, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, নাটক, চিত্র, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি চারু ও কারু শিল্পকলাকে সংস্কৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। এগুলির রূপায়ন শুধু সংস্কৃতিই নয়, সংস্কৃতির বাহনও বটে। মানুষের চিন্তা, কল্পনা, ধ্যান, ধারণা, ভাবানুভূতির অভিব্যক্তি হিসেবে শিল্পকলা, সংস্কৃতির বাহন রূপে যে জগৎ ও জীবনের পরিচয় ফুটে ওঠে, সংস্কৃতির উপকরণ সেখানেও বিদ্যমান। সংস্কৃতির মতো সভ্যতাও মানব সমাজে বহুল প্রচলিত জীবনবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা।
সভ্যতা (Civilization) মানবীয় কৃষ্টির (Culture) আদর্শ অবস্থা। এর বৈশিষ্ট্য বর্বরতা ও অযৌক্তিক আচরণের সম্পূর্ণ নিরসন এবং প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক ও মানবীয় সম্পদসমূহের সর্বাধিক ব্যবহার। সভ্যতা মানব সমাজের উপর প্রযোজ্য এবং এটার মাধ্যমে বস্তুগত ও সামাজিক সমৃদ্ধির সমূহ উন্নত অবস্থা বুঝায়।
সংস্কৃতি বা সভ্যতা তুলনা করলে সংস্কৃতি দ্বারা চিন্তার বিকাশ ও মানবিক উন্নয়ন বুঝায় আর সভ্যতা সামাজিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায়কে প্রকাশ করে। কাজেই বলা যায়, সংস্কৃতি মানসিক অবস্থাকে প্রকাশ করে আর সভ্যতা মানুষের প্রকাশ ক্ষেত্রকে তুলে ধরে। সংস্কৃতির সম্পর্ক চিন্তাগত বা আত্ম মনোজাগতিক আর সভ্যতার সম্পর্ক বৈষয়িক ও বস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমটি আভ্যন্তরীণ ও ভাবধারাগত অবস্থা আর দ্বিতীয়টি বাহ্যিক জগতের কার্যকারিতার নাম।
বস্তু ব্যক্তির সার্বিক সুস্থতা, সঠিক লালন ও বর্ধন লাভের জন্য যেমন দেহ ও প্রাণের ভারসাম্যপূর্ণ উৎকর্ষ একান্তই আবশ্যক। তেমনি একটি জাতির সঠিক উন্নতির জন্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুরোপুরি লালন একান্তই জরুরী। বলা যায় সভ্যতা হচ্ছে দেহ আর সংস্কৃতি হচ্ছে তার জীবনপ্রবাহ বা প্রাণ।
সাহিত্য-শিল্প মূলত জীবন ও জগতের প্রতিচ্ছবি। এরিষ্টটল শিল্পকে প্রাণিজগৎ ও জড়বস্তুর অনুকরণ (Imitation) বলেছেন। এখানে অনুকরণ অর্থ জীবন ও জগতের অনুলিপি মাত্র নয়। শিল্প হল বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমভেদে বাক্সময়, রূপময়, ধ্বনিময় অথবা ভঙ্গিমাময় অভিব্যক্তি। অনুকরণের তারতম্য থাকতে পারে, যেমন কোথাও বাস্তবানুগামিতা, কোথাও কল্পনাশ্রয়ীতা, কোথাও কল্পনা- বাস্তবের মিশ্রণে অনুভবের সঞ্চরণ। ক্রোচে শিল্পকলাকে ‘প্রকাশ’ (Expression) তথা সৃষ্টি (Creation) বলেছেন। এ সৃষ্টি অবাস্তব, অলৌকিক নয়। জগৎ জীবনের প্রচ্ছায়ে নব প্রকাশমূর্তি, মানব শিল্পের মধ্য দিয়ে বিশ্বসৃষ্টির পূর্ণজন্ম হয়। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত বাগেম্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী তে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, মানুষের শিল্প দেবতার অনুকরণ- ‘দেব শিল্পনাম অনুকৃতি’। এ শিল্প সৃষ্টিতে প্রাণীর প্রাণ স্পন্দন এবং জড়বস্তুর প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে।
মূলত ‘সংস্কৃতি’ দ্বারা উন্নততর মতাদর্শ, যা মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যমান (Values) কে বুঝানো হয়। তবে উল্লেখিত সংজ্ঞার আলোকে সংক্ষেপে বলা যায়: মানব জীবনের সার্বিক কার্যক্রমের পরিমার্জিত রূপই সংস্কৃতি। অর্থাৎ সবকিছুকে সুন্দর, শোভন, স্বচ্ছ এবং বিশিষ্টভাবে ক্রমান্বিক অগ্রযাত্রায় উপস্থাপন এবং আত্মস্থ করাই হচ্ছে সংস্কৃতির পরিপূর্ণ প্রকাশ এবং বিকাশ।
ইসলামের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মিলনের মনোবৃত্তি সবচেয়ে প্রকাশ পেয়েছে কৃষ্টি ও জ্ঞান- কর্ষণার ক্ষেত্রে। ‘গ্রীকের প্লেটো, ইসলামের আফলাতুন, তাদের সক্রেটিস আমাদের বোখরাত। অগ্নি -উপাসক ইরানবাসীর পেহলবী ভাষা এখন ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ট ভাষা। মওলানা রুমীর মসনবীকে বলা হয় ‘পেহলবী ভাষার কুরআন!
এই ভাষাতেই লেখা হল ‘শাহনামা’ জগতের অন্যতম শ্রেষ্ট মহা-কাব্য। কর্ডোভা, গ্রাণাডা, বাগদাদ, দিল্লী, আগ্রা, সবত্রই একই সুর: বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান, বৈষম্যের মধ্যে মিলনের সন্ধান। ইসলামের কোথায় সংকীর্ণ রূপ? কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন: সঙ্গীতে ও শিল্পে দেখুন! ভারতীয় সঙ্গীতের কথাই ধরা যাক। ধ্রæপদের লৌহ প্রাচীর ভেঙ্গে সে যখন ঢুকলো, তখন ধ্রæপদকে সে অস্বীকার করলো না; তার সঙ্গে মিতালি করে সে সৃষ্টি করলো আরও তিনটি শাখা: খেয়াল টপ্পা ও ঠুংরী। বর্তমানে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরী- এই চারটে মিলেই ভারতীয় সঙ্গীত। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এখন এগুলোকে আমরা পরম নিষ্ঠার সাথে শিক্ষা করি।
শুধু যে সংস্কৃতিতে ইসলাম আদর্শধর্মী তাই নয় দর্শনের দিক খেয়াল করলেও দেখতে পাই ইসলাম মিলন-ধর্মী, মেল-বন্ধনের অপরূপ নিদর্শন। ইহকাল- পরকাল, আল্লাহ-রাসূল, কুরআন- হাদীস, সাদা- কালো, বাদশা- গোলাম, কাফ্রী- ইরানী, আফগান-তুরানী, আরবী- হিন্দুস্থানী সব এক করে দিয়ে বৃহত্তর মানব গোষ্ঠী সে রচনা করেছে। বিশ্বমানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের স্বপ্ন রয়েছে তার চোখে। ‘স্থাপত্য শিল্পেও ‘তাজমহল’ এই সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক। দর্শনের দিক দিয়ে দেখলেও ইসলামকে দেখবেন মিলন-ধর্মী। ইহকাল পরকালকে সে মিলিয়েছে।
জীবন চর্চাই সংস্কৃতি। আর জীবন যেহেতু গতিশীল তাই সংস্কৃতিও গতিশীল। জীবন যেখান থেকে শুরু, সংস্কৃতির সূচনা বিন্দুও সেখানেই। পৃথিবীতে মানুষের প্রথম জীবন চর্চা যেহেতু মহান আল্লাহর হিদায়াত ও আনুগত্য দিয়েই শুরু। তাই এ প্রথম জীবন চর্চাই ছিল ইসলামী সংস্কৃতির সূতিকাগার। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায় যে, আদম (আ.) এর দ্বারাই ইসলামী সংস্কৃতির গোড়াপত্তন হয়। এবং যুগে যুগে নবী রাসূলগণের মাধ্যমে তা বিকশিত হয়ে শেষ নবী মুহাম্মদ সা. এর যুগে এসে পূর্ণতায় পৌঁছায়। কুরআন মাজীদের পঞ্চমা সূরা মায়েদায় বলা হয়েছে: আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম। এবং আমি ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। মানুষের বিগত হাজার হাজার বছরের ইতিহাস তার সংস্কৃতিরই ইতিহাস। কারণ প্রথম থেকেই সে সভ্য ছিল। কাজেই সে ছিল একটি সুন্দর রুচিশীল সাংস্কৃতিক জীবনের অধিকারী।
মানব জীবনের দুটি দিক। বস্তগত ও আধ্যাত্মিক এ দুটিরই রয়েছে বিশেষ বিশেষ চাহিদা। সে চাহিদা পরিপূরণে মানুষ প্রতি মুহুর্তে থাকে গভীর ভাবে নিমগ্ন। একদিকে যদি দৈহিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে তাকে টানে জীবিকার সন্ধানে, তা হলে তার আত্মার দাবি পূরণের জন্যে তার মন হয় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাই মানুষের বস্তুনিষ্ঠ বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণের জন্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তাকে সহায়তা করে। ধর্ম-বিশ্বাস, শিল্পকলা, সৌন্দর্যবোধ ও দর্শন নিবৃত্ত করে তার আত্মার বিকাশ। ব্যক্তির সূ² ও সুকোমল আবেগ-অনুভূতি এবং হৃদয় ও আত্মার দাবি যে সব উপায়-উপকরণ পূর্ণ করে তাই হচ্ছে সংস্কৃতি। সঙ্গীত, কবিতা, চিত্রাংকণ, সাহিত্য, ধর্ম-বিশ্বাস, দার্শনিক চিন্তা প্রভৃতি এক-একটা জাতির সংস্কৃতির প্রকাশ মাধ্যম। কোন বাহ্যিক ও বৈষয়িক উদ্দেশ্য লাভের জন্য এসব তৎপরতা সংঘটিত হয় না। আত্মিক চাহিদা পূরণই এগুলোর আসল লক্ষ্য। এসব সৃজনধর্মী কাজেই অর্জিত হয় মন ও হৃদয়ের সুখানুভূতি আনন্দ ও উৎফুল্লতা। একজন দার্শনিকের চিন্তা ও মতাদর্শ, কবির কাব্য ও কবিতা, সুরকার ও বাদ্যকারের সুর-ঝংকার এসব ব্যক্তির হৃদয়-বৃত্তির বহি:প্রকাশ। এসব মুল্যবোধ হৃদয়ানুভূতি ও আবেগ-উচ্ছ¡াস থেকেই হয় সংস্কৃতির রূপায়ন। কিন্তু সভ্যতার রূপ এ থেকে ভিন্নতর। বস্তুনিষ্ঠ জীবনের রূঢ় বাস্তব ও প্রকৃত উন্নতির স্তর ও পর্যায় সমষ্টি হচ্ছে সভ্যতা। বিশেষ-নির্বিশেষ সকলের পক্ষেই তা মূল্যায়ন করা সহজ এবং হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। যেমন- গ্রীক সভ্যতা, আর্য সভ্যতা, সেমিটিক সভ্যতা, দ্রাবিড় সভ্যতা, হরপ্পা ও ময়েনজোদারো ইত্যাদি।
ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত মতে: পাক- ভারতে কোন কালেই কোন আদিম অধিবাসী (aborigines) ছিলনা! আর্যই হোক, অনার্যই হোক, সবাই এসেছিল বিদেশ থেকে। Dr. R. c. Majumdar ও A. D. Pusalkar বলেন:
`No kind of men originated on the soil of India; all her human inhabitants having arrived from other lands, but developing within india’.
অনেকেই সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এক মনে করেন। সভ্যতা (Civilization) কালচার বা সংস্কৃতির সাথে সংশিষ্ট, কিন্তু সংস্কৃতি (Culture) নয়। তবে এ দুয়ের মাঝে সাদৃশ্য অনস্বীকার্য। সভ্যতা আকাশচুম্বী প্রাসাদ নির্মাণ করেছে; সংস্কৃতি সে প্রাসাদকে মহিমামন্ডিত ও সুশোভিত করে দিয়েছে। বস্তুত সভ্যতা ও সংস্কৃতি দুটিই মানব জীবনের মৌল প্রয়োজন। সভ্যতা একটা জাতিকে বস্তুনিষ্ঠ শক্তিতে মহিমাময় করে আর সংস্কৃতি তাকে গতিবান করে নির্ভুল পথে।
সারা বিশ্বের বুকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বাংলাদেশ আজ অনন্য। বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। ষড়ঋতুর সবকটি সময়ে সে হেসে ওঠে অন্য এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। এই বৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতিতে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির নানা দিক। সর্বক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতির যে অগ্রযাত্রা তা বিশ্বের আর কোন দেশে নেই। বাঙালীর ঐতিহ্য বসন্ত। কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়ের- ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত’। এটাই বাস্তবতা। শীতের নান্দনিক পিঠাপুলি আজ গ্রামের গলিপথ ছেড়ে শহরের উজ্জ্বল আলোর নীচে শিল্পকলা একাডেমিগুলোতে রাজধানীর আলোময় মঞ্চে নিত্য শোভার সাথে সুবাস ছড়ায়। ঐতিহ্যসম্পন্ন নানান রকম মিষ্টি পিঠার আয়োজনের সাথে আজ জীবনের প্রয়োজনে নতুন নতুন যুক্ত হওয়া ঝাল পিঠা, নুডুলস, পিৎজা, স্যাণ্ডউইচ, বার্গারের মত হাই রেটের খাবারের সব সংস্কৃতি। এখন ঘরে ঘরে ডায়াবেটিসের কারণে মিষ্টি পিঠার পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে ঝাল পিঠার নতুন সংযোজন। তারসাথে নানান রকম পাণীয়, চা কফির উষ্ণ সুবাসিত ধোঁয়া আমাদের নিত্য দিনের আধুনিক সংস্কৃতি।
প্রাচীন কালের বিভিন্ন পুজা পার্বন উপলক্ষে আয়োজিত মেলার সাথে নদীর কুলে, বটবৃক্ষের ছায়ার পাশাপাশি আজ শহর ও রাজধানীর বিভিন্ন মেলা সংস্কৃতির নতুন অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখছে। বৈশাখী মেলা, পৌষ মেলার সাথে যুক্ত হয়েছে রাজধানীর মাসব্যাপী একুশে গ্রন্থমেলা, বৈশাখী মেলা, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক) মেলা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, প্রযুক্তি উদ্ভাবনী মেলা, উন্নয়ন মেলা, রিহ্যাব মেলা, মিনাবাজার ইত্যাদি।
আমাদের সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় আমাদের জাতীয় দিবসগুলির যথাযোগ্য পালন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পালিত হয় অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৬ মার্চ, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এপ্রিল মাসের এক তারিখে বাংলা নববর্ষ এবং মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৬ ডিসেম্বর অত্যন্ত জাকজমকের সাথে পালন আমাদের সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য।
বাঙালি সংস্কৃতিতে নারীরা আজ বিশ্ব^ দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমাদের নারীরা আজ সমাজ, সংসার পরিচালনার পাশাপশি রাষ্ট্র, দেশ পরিচালনা করছেন নিজ যোগ্যতা ও প্রাজ্ঞতায়। শিক্ষায়, গবেষণায়, মননে, সাহিত্যে এবং মানবিকতাসহ সমাজের সবক্ষেত্রে স্ব স্ব যোগ্যতার মহিমায় উজ্জ্বল। তারা আজ বিচারক থেকে শুরু করে ভিসি, ডিসি, এসপি থেকে বৈমানিক পর্যন্ত। যেটি বিশ্ব দরবারে এক চমকপ্রদ আলোর ফুলকি হয়ে চমকিত।
বাঙালি সংস্কৃতি আজ বাঙালির প্রাণ। এই সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায় তাহলে বাঙালি জাতিসত্তা বাঁচবে না। বসন্ত, নবান্ন, বর্ষবরণ, শীত, বিভিন্ন সাহিত্যের অনুষ্ঠান, কবিতা উৎসব, প্রকাশনা উৎসবসহ নানামুখী উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের সংস্কৃতি আজ এক নতুন উচ্চতায়। অসত্য, অন্যায়, অসুন্দর এবং সাম্প্রদায়িক চেতনাকে রুখতে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার অনুশীলন করতে সচেষ্ট থাকবো। এ প্রত্যয় আজ সময়ের।

ড. শাহনাজ পারভীন, কবি, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়