দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

জাতীয় প্রেস ক্লাবে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা-উত্তর সাংবাদিকতা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে। পরিবার থেকে এ সময় ঠিকমতো টাকাপয়সাও মিলছে না। সাংবাদিকতায় এম.এ শেষ পর্বের ছাত্র, স্বশস্ত্র ভাবে এবং একই সঙ্গে রণাঙ্গন সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থেকেছি মুক্তিযুদ্ধে। অতএব ৩৫/৩৬ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর বিপিআই, অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের ছোট্ট সংবাদ সংস্থাটায় যোগ দিলাম রিপোর্টার হিসেবে। অফিসটি ছিল ব্যক্তি মালিকানার সাবেক পাকিস্তানি এক সংবাদ সংস্থার ঢাকা ব্যুরো অফিস। যেদিন যোগ দিলাম, সেদিন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। ঘটনাচক্র সেদিনই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এবং সোজা লন্ডনের দিকে যাত্রা করলেন। কাকতালীয় ভাবে আমার পূর্ণ পেশাগত জীবনের প্রথম ‘রিপোটিং এ্যসাইমেন্ট’ও, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর সংগ্রহের কাজ দিয়ে।
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে অগাষ্ট ১৫, ১৯৭৫। সময়টা নবীন বাংলাদেশের এমন এক সময়, যা আমাদের মত নবীন সংবাদকর্মিদের একদিকে আবেগে উচ্ছসিত করেছে, আবার ভয়ংকর সব ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শি হয়ে চরম হতাসায় নিমজ্জিত করেছে। পেশাগত জীবনের অনুষ্ঠানিক শুরু যেহেতু বিপিআই নামের ক্ষুদ্রায়তনের একটি বার্তা সংস্থায়, সেহেতু নবীন রিপোর্টার হয়েও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিভিন্ন তৎপরতর খবর লেখার সুযোগ হয়েছে আমার – যা অতি সামান্যই।
স্বাধীনতার পরক্ষণে নতুন উদ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক আজাদ ও বাংলার বাণী। সাবেক দৈনিক পাকিস্তান দৈনিক বাংলা হয়েছে; পাকিস্তান অবজারভার হয়েছে বাংলাদেশ অবজারভার। এ ছাড়াও আছে মর্নিং নিউজ, পূর্বদেশ সহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র ও দুটি সংবাদ সংস্থা। যে সংবাদপত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ছিল, মন খুলে কিছুই লিখতে পারেনি, তারা মনখুলে নতুন দেশ ও তার সরকারকে স্বাগত জানাতে থাকলো।
তোপখানা রোডের ঢাকা প্রেস ক্লাব এরই মধ্যে নতুন দেশের জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরিণত হয়েছে। আমরা নবীনেরা তখনো সদস্য হয়নি ক্লাবের, যদিও স্বাধীনতার পরের সময়টাতে সিনিয়রদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের সুবাদে লাল বিল্ডিংটাতে গিয়ে পুড়ি খেয়ে আসার ঘটনা অবাধেই চলেছে আমাদের। ১৯৭২ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ এর অগাষ্ট পর্যন্ত নানান ঘটনাপ্রবাহের নীরব দর্শক হিসেবে, এবং একই সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মিদের অভিজ্ঞতার নিরীখে জেনেছি, বঙ্গবন্ধু কতটা সাংবাদিকবান্ধব ছিলেন। তাঁর সময়ে আর কোনো শীর্ষ রাজনীতিবিদের এতোটা কাছে যেতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়না কোনো সাংবাদিক।
মনে পড়ে, জাতির পিতা সর্বপ্রথম জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসেন ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই। সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকেই সেদিন উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেসনে বক্তব্য রখেন। ক্লাবে ঢুকেই তিনি পুরনো কর্মচারীদের সাথে করমর্দন করেন, কারও কারও সাথে বুক মেলান হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে। তাঁর সেদিনের ভাষণটি ছিল স্বাধীনতা-উত্তর কালের সাংবাদিকতা ও বিদ্যমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যময় একটি ভাষণ। জাতির পিতা সেদিন অকপটে এমন কিছু সত্য তুলে ধরেন – যা তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।
আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস নির্মাণ ও যুদ্ধপরবর্তীকালের সমাজ বাস্তবতা অনুধাবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে। কারণ সদ্য-স্বাধীন দেশের অনেক রুঢ় বাস্তবতার কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন সেদিন।
ভাষণ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেদিন এই ভাবে ঃ “আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও ছিলেন। আমি অনেকদিন তাঁদের সঙ্গে জেলখানায় কাটিয়েছি। এবারের সংগ্রামে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা আজ আমাদের মধ্যে নাই। তেমনি নাই ৩০ লক্ষ লোক, যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। তাঁদের কথা চিরদিন আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে এবং যে আদর্শের জন্য তাঁরা জীবন দিয়েছেন, সে আদর্শে যদি বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়, তাহলে তাদের আত্মা শান্তি পাবে।”
তিনি বলেছিলেনঃ“ সাংবাদিক ভাইদের কাছে আমার কয়েকটা স্পষ্ট আরজ আছে। আপনারা জানেন, বিপ্লবের মাধ্যমে এই স্বাধীনতা এসেছে এবং সে বিপ্লব ছিল রক্তক্ষয়ী। এমন বিপ্লবের পরে কোন দেশ কোন যুগে এতটা স্বাধীনতা – ভোগ করতে পারে নাই, যা আমরা করছি। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। এজন্য আপনাদের কোন কাজে কখনো কোন রকম হস্তক্ষেপ করি নাই। যদিও নূতন বাংলাদেশ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ। বিপ্লবের পূর্বেকার সরকার একটা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মতো ছিল। আর যাঁরা এদেশে ছিলেন, জাতীয় সরকার কি করে চালাতে হয় সে বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাদের তাই নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। শুধু মুক্তিবাহিনীর ভায়েরাই অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করে নাই। জনগণকেও লড়তে হয়েছে স্বাধীনতার শত্রæদের বিরুদ্ধে। হানাদার বাহিনী যাওয়ার সময় আমাদের স্বাধীনতার শত্রæদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গেছে। আমাদের কাছে এর দলিল আছে। শত্রæদের বিচারের সময় আপনারা সে সব দলিল দেখতে পাবেন।”
দেশ স্বাধীনের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় রাষ্ট্রের ভবিস্যত গতিপথ ব্যাখ্যা করেছিলেন জাতির পিতা। বলেছিলেন : “ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি এবং এই সব আদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, এটাও আপনারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন। আমরা এই চারিটি আদর্শের ভিত্তিতেই দেশের শাসনতন্ত্র তৈরী করতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্রের একটা মূলনীতি আছে। গণতন্ত্রের অর্থ পরের ধন চুরি, খুন-জখম, লুঠতরাজ বা পরের অধিকার হরণ করা নয়। তার জনকল্যাণমূলক একটা নীতিমালা আছে। সাংবাদিকতারও এমনি একটা নীতিমালা আছে। আমরা জানি, সাংবাদিকদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যারা সামরিক চক্রের হীন কাজে সহায়তা করেছেন। তারাই ধরিয়ে দিয়েছেন সেইসব সাংবাদিকদের, যাঁরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। এই তথাকথিত সাংবাদিকদের একজন কোন দৈনিক কাগজে সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করতেন। তিনি আল-বদরের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিলেন। এমন সাংবাদিকও আছেন, যাদের এই ধৃষ্টতামূলক কাজের নজির আমাদের কাছে আছে। তারা হানাদার বাহিনীকে সংবাদ সরবরাহ করতেন। কিছু কিছু সাংবাদিক নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করতেন। কিন্তু তারা স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যান্টনমেন্টে খবর সরবরাহ করেছেন। আপনারা কি বলবেন যে, তাদের গায়ে হাত দিলে গণতন্ত্র এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার উপর আঘাত করা হবে?”
প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে সেদিন তিনি আরও ষ্পষ্ট করে বলেছিলেন : “যিনি একদিন দৈনিক ‘পয়গাম’ চালাতেন, তিনি যদি আয় উপার্জনহীন কোন ব্যক্তির আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি একখানি দৈনিক কাগজ বের করেন, তা হলে স্বভাবত:ই প্রশ্ন ওঠে, তাঁর এই মালিকের টাকা কোত্থেকে এলো? এরপর আবার এই রাতারাতি গজিয়ে-ওঠা মালিক-সাংবাদিক সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখতে আরম্ভ করলেন। —- রাতারাতি একটা কাগজ বের করে বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে কেউ যদি বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে, তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই সেটা সহ্য করবেন না। কারণ, তা আমাদের স্বাধীনতা নষ্ট করবে। ‘ওভরসীজ পাকিস্তান’ নামে কোন সংস্থা যদি এখান থেকে খবরের কাগজ প্রকাশ করে, তাহলে আমাকে কি করতে হবে? আপনারা সামান্য কিছু লোকের স্বার্থ দেখবেন, না সাড়ে সাত কোটি লোকের স্বার্থ, যে ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে, তাঁদের স্বার্থ দেখবেন? বিপ্লবের পরে সংবাদপত্র যে স্বাধীনতা পেয়েছে, তা এদেশে আর কখনো ছিল না। এই জন্যই রাতারাতি খবরের কাগজ বের করেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ ছাপান হয়, “এক লক্ষ বামপন্থী হত্যা” “বিমান বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ” ইত্যাদি। কিন্তু এসব কি লেখা উচিত? এবং এ সব কার স্বার্থে ছাপান হয়?”
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সদ্য-স্বাধীন দেশের অনেক রুঢ় বাস্তবতা উঠে এসেছিল। তিনি বলেছিলেন : “আপনারা ধর্মনিরক্ষেতার কথা বলেন। আমিও বলি। কিন্তু কোন কোন খবরের কাগজে এমন কথাও লেখা হয়, যা সাম্প্রদায়িকতার চরম। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চব্বিশটি বছর প্রগতিশীল সাংবাদিকরা সংগ্রাম করেছেন। আমরা সংগ্রাম করেছি, বাংলার মানুষ সংগ্রাম করেছে। আমাদের ছেলেরা, কর্মীরা জান দিয়েছে, জেল খেটেছে। সে নীতির বিরুদ্ধে যদি কোন সাংবাদিক লেখেন তাহলে আপনারা কি করবেন? এটাও আপনাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। একখানা কাগজে লেখা হয়েছে, “গণহত্যা চলছে।” গণহত্যার কথাই যদি বলেন, তবে আমি আপনাদের বলবো যে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় বহু আওয়ামী লীগ কর্মী আর প্রগতিশীল কর্মী মারা গেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে গণহত্যা হয় নাই। এ জন্যে দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এত বড় বিপ্লবের পরে, হানাদারদের দ্বারা সংঘটিত এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরেও যে আর একটা হত্যাকাণ্ড হয় নাই, তার জন্য বাংলার মানুষ ও প্রগতিশীল কর্মীদের আপনারা নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানাবেন। অনেকে ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলে থাকেন। যারা আমাদের দুদিনে সাহায্য করেছে তারা নাকি আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পকেটে ফেলে রাখবার চেষ্টা করছে। এ ধরনের কথা বলা কি সাংবাদিকতার স্বাধীনতা?এর নাম কি গণতন্ত্র? যদি কেউ অনাহারে মরে থাকে, আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন। তার জন্য আমিও দায়ী হবো। আমি চেষ্টা করছি, যাতে কেউ অনাহারে না মরে। যদিও দেশে খাবার নাই। আমাদের খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩০ লক্ষ টন। আমি বিদেশ থেকে ১৭ লক্ষ টন এনেছি। ভারত ৭ লক্ষ টন খাবার দিয়েছে। এছাড়া “আনরড” এবং ইউ,এস,এ, কানাডা ও রাশিয়া থেকেও খাবার পাওয়া গেছে। সাধ্যমত সবাই আমাদের সাহায্য করছে। এর ভিতর ভারতীয় চক্রান্ত কোথায়? অথচ কোন কোন খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে “৫০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য ভারতে পাচার”, “আমরা কি সত্যিই সার্বভৌম” ইত্যাদি।”
তিনি আরও বলেন : “অনেক কাগজের শিরোনামা আমার কাছে আছে। এই কাগজগুলো ফরমান আলী খানের দয়ায় ঢাকায় বসে নয় মাস কাজ করেছে, কিন্তু তাদের আজও ছোঁয়া হয় নাই। অনেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক মা-বোন-বউ ঘরে ফেলে অকুল পাথারে ভেসে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ফরমান আলীর অনুগ্রহভাজনরা এখানে বসে আরামে খবরের কাগজ চালান এবং হানাদারদের সাথে সহযোগিতা করেন। এরপর স্বাধীনতা পেয়ে তাঁরা রাতারাতি বিপ্লবী হয়ে গেছেন। তাঁরা এখন সরকারের বিরুদ্ধে লেখেন। তাঁদের সরকার ক্ষমা করতে পারে, জনগণ ক্ষমা করবে কিনা সন্দেহ আছে।”
এ পর্যন্ত বলেই বিপ্লবোত্তর দেশের সাংবাদিকতার নীতি ও আদর্শের নিরীখে নিজের সুচিন্তিত মনোভাব তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। বিশেষ করে সদ্য-স্বাধীন দেশে যেভাবে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার নামে একটি শ্রেণীর হাতে দেশবিরোধী তৎপরতা চলে আসছিল, মূলত সেদিকেই তিনি আলোকপাত করেন।
“সরকারের যেমন স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আছে, তেমনি নীতি পালনের দায়িত্ব আছে, আইন-শৃঙ্খরা রক্ষার দায়িত্বও আছে। আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উচ্ছঙ্খলতা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না। অথচ কোন কাগজে লেখা হয়েছে, “মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও”। যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, এখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চান তা হলে তা কি আপনারা সহ্য করবেন? আপনাদের যে কোন কথা বলবার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আপনাদের একটা নীতিমালাও রয়েছে। স্বাধীন দেশে যথেচ্ছাচার চলতে দেওয়া যেতে পারে না।”
সদ্য-স্বাধীন দেশের সরকারকে নাস্তানাবুদ করতে পরিকল্পিত ভাবে প্রয়াস চলছিল তখন। স্বাধীনতার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় সরকারের সমালোচনা তুঙ্গে তোলা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত চারজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল তাঁরা সকলেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য।
এসব উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক সমাজের কাছে অনুরোধ করেন : “অনুগ্রহ করে একটু নিজেদেরও স্ক্রিনিং করুন। একটু বলুন, এই লোকগুলো এই কাজ করেছে। আমরা তা মেনে নেবো। আর যদি নিজেরা কিছু না করেন আমাকে বলবেন। আমি করবো। আমাকে করতেই হবে। কারণ, পাকিস্তানের নামে পয়সা নিয়ে এসে যদি কেউ রাতারাতি খবরের কাগজ বের করে আর মানুষের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে আমাদের সব নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করবার চেষ্টা করে, এখানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়াবার চেষ্টা করে, জাতির আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে সেটাকে স্বাধীনতা বলা যায় না। সে স্বাধীনতা কোন সরকার, কোন জনগণ, কোন প্রগতিশীলা দল কোনদিন সমর্থন করতে পারে না।”
সরকারের সমালোচনার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলন ঃ“স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, তা রক্ষা করা তার চেয়েও কষ্টকর। তবু বিপ্লবের পরে ছ’মাসের মধ্যে আপনারা যতখানি স্বাধীনতা পেয়েছেন ততখানি স্বাধীনতা এদেশে এর পূর্বে কেউ পায় নাই। কিন্তু অনেকেই তার সুযোগ নিয়ে দুষ্কর্মে মেতে উঠেছে। —- কোন কোন কাগজে সমালোচনা করে বলা হয়, এখনকার অবস্থা আইয়ুব ও ইয়াহিয়া সরকারের আমলের চেয়েও খারাপ। ১৯৫৮ সালে যখন মার্শাল-ল জারী হয়েছিল এবং আমাকে বন্দী করা হয়েছিল, তখন এরা কিছুই লেখেন নাই। আবার এরাই এখন লখেন, “চালের মণ একশো বিশ টাকা।” চাল থাকতেও আমি দিচ্ছি না। এসব কথা যারা লেখে, তারা মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতি করে। এর নাম কি সাংবাদিকদের স্বাধীনতা? ”
“ আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা, আমি চেষ্টা করে দেখছি। বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমার আন্দোলন। সেই জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব নষ্ট হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও আমাদের আদর্শ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নাই। রাজাকার, আল-বদররা এখন কিছু কিছু বড় বড় প্রগতিশীল নেতার আশ্রয় নিয়ে “প্রগতিশীল” বনে গেছে। আসলে তারা খুনের মামলার আসামী। তাদের নামে হুলিয়া রয়েছে। —এক্ষেত্রে আমার কর্তব্য কি, আপনারাই বলুন। —আপনারা সাংবাদিক। আপনাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে আপনারা নিজেরাও আত্মসমালোচনা করুন। আপনারা শিক্ষিত, আপনারা লেখক, আপনারা ভালো মানুষ। আপনারাই বলুন, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। আমরা নিশ্চয়ই আপনাদের সাথে সহযোগিতা করবো।”
মুুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছি। সাংবাদিকতা নেশার বিষয় মনে হয়েছে আমার, পেশার চাইতেও। ওই সময়ে এরকমই একটা ধারণা নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা আত্মসমর্পণ করেছে, এবং বাকিরা লুকিয়ে আত্মরক্ষা করছে মাত্র। আর কখনোই ওরা মাথা তুলে দাঁড়াবেনা বা দাঁড়াতে পারবেনা। কিন্তু এই বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম হয়েছিলাম যে, যুদ্ধে হেরে আত্মসমর্পণ করেছে কেবল পাকিস্তানি সৈন্যরাই, কিন্তু তাদের দেশীয় অনুচররা নয়। এই ‘পাকিস্তানি ছিটমহল’ গুলো কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার অঙ্গনেও বিরাজ করেছিল।
অতএব প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সেদিন পরিস্থিতির গভীরতা অনুভব করতে শুরু করেছিলাম বৈকি। একদিকে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা,মুক্ত তথ্য প্রবাহের স্বাভাবিক দাবি, অন্যদিকে সেই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলার ভয়ংকর সব পরিকল্পিত প্রয়াস! বলা বাহুল্য, সংকট অনুভব করতে পারলেও আমাদের মতো নবীনদের করার কিছু ছিলোনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘটনার বয়ান শুনে আমরা নবীরনরাও ভাবতে শুরু করেছিলাম – যে কোনো মূল্যে এই সর্বনাস প্রতিহত করা উচিৎ।
স্বাধীনতা উত্তরকালে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর মধ্য অগাষ্ট পর্যন্ত, বঙ্গবন্ধুর এমনি অনেক যুগান্তকরি ভাষণ ও কিছু কিছু অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শি হবার সুযোগ হয় আমাদের মতো অনেক নবীন সংবাদকর্মির। পরবর্তিতে সেইসব ভাষণ যখন নতুন করে পড়ি, বুঝবার চেষ্টা করি, অনুভব করি, কতটা অন্তর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি তাঁর জন্মভূমিকে ভালোবেসেছিলেন। কতটা আবেগ ও উপলব্ধি দিয়ে তিনি তাঁর দেশকে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধীরা, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্বার বিরোধীরা, কেউ বসে ছিলো না। সদ্যস্বাধীন দেশের সরকারকে অকেজ এবং নতুন রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে দিতে সব ধরণের অস্ত্রের ব্যবহার করে চলছিলো তারা। এই ধরণের প্রচারণা কেবল লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ থেকেই আসেনি, এসেছে ‘অতিবিপ্লবী’ কিছু মহল থেকেও, যারা সময় বুঝে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চেয়েছিল।
সদ্য-স্বাধীন দেশের সরকারকে আঘাত করতে আরও যে অস্ত্রটির ব্যবহার করা হয়েছিল – তা ভারত প্রসঙ্গ। যে ভারতের সর্বাত্বক সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই ভারতকে ঘিরেই পরিকল্পিত কূট প্রচারণা চালানো হয়েছে। বলা হচ্ছিল, ভারতীয় মিত্র বাহিনী, যারা মুক্তি বাহিনীর হাতে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, অনেকে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের মাটি থেকে আর কখনোই নিজ দেশে ফিরে যাবেনা। আরও বলা হচ্ছিলো – ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চায়, মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়, সত্যিকার ভাবে স্বাধীন হতে দিতে চায়না বাংলাদেশকে।
কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন বলেই এসব শংকা বাস্তবে পরিণত হয়নি। মাত্র দুই মাসের মাথায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য বাংলাদেশের মাটি থেকে নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। ঢাকা স্টেডিয়ামটির অবস্থান বঙ্গবন্ধু এভিন্যু ঘেঁসে, আমাদের বিপিআই সংস্থা অফিস থেকে পায়ে হেঁটে গেলে মাত্র দুই মিনিটের পথ। অতএব গিয়ে পৌঁছলাম আমি। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা ক্যামরাটা হাতে নিয়ে গিয়ে বসে পড়লাম স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে। একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন, তাঁকে স্যালেুট জানালেন মিত্র বাহিনীর লে.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং তাঁর বাহিনীর সদস্যরা। এরপর ঘটলো সংক্ষিপ্ত সামরিক কুচকাওয়াজ। উল্লেখ্য, তার মাত্র চারদিনের মাথায়, ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি, যার ব্যক্তিগত অবদান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ।
এরপর আসে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, যেদিন তিনি জাতির সামনে তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ এর কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। নবীন সংবাদকর্মি হিসেবে আমরা বহুসংক্ষকই সেদিনের নীতিনির্ধারণি বক্তিতাটি শুনবার সুযোগ পেয়েছিলাম সংসদে উপস্থিত থেকে। বস্তুত নতুন এই রাষ্ট্রনীতি নিয়ে পরবর্তিতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্রবামপন্থিরা একে একদলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। তাদের বহির্বিশ্বের সমর্থক ও পৃষ্টপোষকরা একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ তুলে। এই নতুন রাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল মিলে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠণ করা এবং সম্মিলিত জাতীয় নেতৃত্ব অবকাঠামোয় দেশকে সামনের দিকে অগ্রসর করা। এটি ছিল একটি স্বপ্ন।
আজ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এসে যখন পেছনের দিকে তাকাই, ফেলে আসা ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন কেবলই মনে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল পাকিস্তানি শৃঙখল থেকে, ২৩ বছরের বন্দিত্ব থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিতে একটি নতুন রাষ্ট্রই কেবল জন্ম দিতে চান নি, সেই রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে, একটি শোষনমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে স্বপ্নের পূরণ দেখে যেতে পারেন নি তিনি। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক রাষ্ট্রের যা গতানুগতিক বা তাঁর ভাষায় ‘শোষকের গণতন্ত্র নয়’,তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিপূর্ণ জনগণতান্ত্রিক ও সাম্যের বাংলাদেশের, এবং সকল অর্থে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। কিন্তু সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন, এমন কি তাঁর দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা তখন চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার মাধ্যমে, তাঁর সরকারের পতনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতে সোপার্দ করতে চেয়েছিল। এরই ফলে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাষ্টের বর্বরোচিত হত্যাকান্ড, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনককে যেমন হত্যা করা হয়, একই সঙ্গে রুদ্ধ করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বাভাবিক যাত্রাপথ।

(জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে লেখকের প্রকাশিতব্য ‘বঙ্গবন্ধু ঃ নবীন সংবাদকর্মীর চোখে’ স্মৃতিগ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত অংশ।)

হারুন হাবীব
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়