দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক যাত্রা অতঃপর বিজয়ের মুকুট অর্জন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং শেখ সাহেব হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতী ইউনিয়নের চুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন মো. শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির ওপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। ১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানেও তিনি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক তৎপরতার বেড়ে যায়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ বছরের ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধুসহ আরো কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু এবং অন্য ছাত্র নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, রাজনীতির নামে মৌলিক গণতন্ত্র প্রচলন এবং পাকিস্তানের কাঠামোতে এক-ইউনিট পদ্ধতির বিরোধী নেতাদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন শেখ মুজিব।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন যা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসের ১ তারিখে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার কার্য পরিচালনা করেন। ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু এবং আরো ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এতে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ শিরোনামে মামলার এক নম্বর আসামি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে এবং অভিযুক্ত সব আসামিকে ঢাকা সেনানিবাসে অন্ত্যরীণ করে রাখা হয়। এ মামলাকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুসহ অভিযুক্ত সবার মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণআন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, কারফিউ, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশকিছু হতাহতের পর আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। উপাধি প্রদানের ঘোষণা দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হবে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন এবং ১৯৭০ সাল নাগাদ কার্যত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তিনি এ ঘোষণা দেন।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসির সম্পাদিত একটি জরিপে শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত হন।
অসংখ্য কারণে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমার্থক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। স্বাধীনতার অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে তিনি ধাপে ধাপে জড়িয়ে ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস। এই ইতিহাস যাতে বিকৃত না হয়ে বস্তুনিষ্ঠ হয় সে দায়িত্ব আমাদেরই।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়