দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

প্রসঙ্গ : বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা দিবস এবং এর আন্তর্জাতিকতা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ‘মাতৃভাষা মাতৃস্তন্যের ন্যায়, মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি যারা অনুরাগহীন, তারা পশু বিশেষ।’ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বলেন, ‘মাতৃভাষা হচ্ছে ব্যক্তির পরিচিতির একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান এবং পৃথিবীর বুকে স্বীয় অবস্থান খুঁজে নেয়ার অন্যতম উপায়। মাতৃভাষাতেই আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ধারার গোড়াপত্তন করি এবং নিজেদের বহির্বিশ্বে তুলে ধরার প্রথম প্রয়াস পাই।’ জাতিসংঘ মাতৃভাষাকে ‘মানবজাতির সম্মিলিত উত্তরাধিকার’ আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভাষা সংরক্ষণে দ্বিগুণ প্রচেষ্টা গ্রহণের অনুরোধ করেন। বিশ্বের বিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষীর মুখের ভাষা বাংলাসহ বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৬ হাজারটি মাতৃভাষা সংরক্ষণে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে নিজ মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে সর্বপ্রথম বিশ্বে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন।
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকতার গোড়াপত্তনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়ে লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘সহজিয়া কড়চা’ কলামে বলেন, ‘১৯৭৪-এর ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা স্বীকৃত হয়। এক সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। তিনি তাঁর ভাষণ দেন বাংলায়। জাতির জীবনে তা ছিল অবিস্মরণীয় ঘটনা। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের একটি শুভ সূচনা করেন।’ সেদিন থেকেই বাংলা ভাষা এবং এর রক্ষার জন্য বাঙালির রক্তস্নাত একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বের তাবৎ ভাষার রক্ষাকবচ হিসেবে আন্তর্জাতিককরণের প্রচেষ্টা শুরু।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়, যোগ্য নেতৃত্ব এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি আবদুস সালাম ও রফিকের নেতৃত্বে ‘মাদার্স ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অ্যাসোসিয়েসন’-এর মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের জন্য জাতিসংঘে যে আহ্বান জানানো হয়; তা বাস্তবায়িত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনের কমিশন ২-এর অধিবেশনে বাংলাদেশের মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
ভারত-বাংলাদেশে মাতৃভাষার ওপর আঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম, আত্মবলীদানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া হবে, এমনি এক আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধী শতাধিক ভাষার দেশ ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত, তা জানতে চেয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একখানা চিঠি লেখেন। তার উত্তরে বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে জানান, ‘The only possible national language for inter provincial intercourse is Hindi in India…’ (রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জি-প্রভাত কুমার বন্দোপাধ্যায়)
ভারতের রাষ্ট্রভাষার এ প্রসঙ্গ নিয়ে এবং হিন্দি ভাষার সমর্থনে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীতে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সর্বভারতীয় বহু ভাষাবিদদের সঙ্গে ড. তারাপুর ওয়ালা, ভাষাবিদ বিধুশেখর শাস্ত্রী, অধ্যাপক হেমন্ত সরকার এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (পরে ডক্টর) উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ পণ্ডিতবর্গ ‘হিন্দিভাষা’কে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করলে তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর তীব্র বিরোধিতা করে ভারতের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ করার পক্ষে তার মত ও যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “… শুধু ভারতবর্ষে কেন সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চে’।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী গোপালাচারী মাদ্রাজের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ‘হিন্দিভাষা’ প্রচলনের নির্দেশ দিলে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হিন্দিভাষা বিরোধিতা ও নিজেদের মাতৃভাষা তামিল রক্ষা আন্দোলনে আন্দোলন মিছিলকালে দুজন তামিল পুলিশের গুলিতে নিহত হন। মাতৃভাষার জন্য বিশ্বে তারাই প্রথম শহীদ। হিন্দি ভারত এই ভাষাশহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়নি।
১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত পাকিস্তান বিভাজনের পূর্বেই কথিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। সে বছর ১৭ মে অবাঙালি চৌধুরী খালেকুজ্জামান মুসলিম লীগের দলীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ওই বছরেরই জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদও উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি জানান। এর তীব্র প্রতিবাদ জনিয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক বেগমে প্রবন্ধ লেখেন। এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাশেমকে আহ্বায়ক করে ‘তমদ্দুন মজলিস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘তমদ্দুন মজলিস’-এর প্রথম ও সাধারণ সভা তৎকালীন মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে কবি জসীম উদ্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ বক্তৃতা করেন। ১৯৪৭-এর ৬ ডিসেম্বর ‘তমদ্দুন মজলিস’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, করাচিতে সরকারি শিক্ষা সম্মেলনে ‘উর্দু’কে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্রসভা ও রাজপথে মিছিল হয়। ওই মিছিলে সেøাগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দুর পাশে বাংলা চাই’। বাংলা ভাষার দাবি সংবলিত লিপি পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী নুরুল আমিন ও আফজাল খাঁনকে দিলে তারা ‘বাংলাভাষা’কে রাষ্ট্রভাষা করার ওয়াদা প্রকাশ করেন। যদিও পরবর্তীতে নুরুল আমিন বেইমানি করেছিলেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘comrade’ পত্রিকায় লেখেন, ‘To surrender Bengali to Urdu or Hindi as the language of the Court and University will be a shamefull Surrender of Bengal to an outsider….’ ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর অধ্যাপক শাহেদ আলী ও ডক্টর এনামুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’।
উল্লেখ্য, তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের অবাঙালি সরকার প্রধান এবং তাদের তাঁবেদার বাঙালি শাসকগোষ্ঠীও ‘উর্দু’কেই রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শামসুল হককে আহ্বায়ক করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ Committee of Action for State Language গঠিত হয়। ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রায় সব ছাত্রনেতাই গ্রেপ্তার হন। পরে আন্দোলন ও সরকারের সঙ্গে চুক্তির ফলে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্তিলাভ করেন। ১৬ মার্চ সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে স্মরণতব্য যে, বঙ্গবন্ধু মুক্তাবস্থায় তো বটেই, কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায়ও নানা কৌশলে ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ নবজাত পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় এবং ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan.’ এই ঘোষণায় সম্মিলিত ছাত্র সমাজ ঘড় ঘড় প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
অন্যদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে যে দুজন মনীষী সংসদে থেকে বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তারা হলেন সর্বজনাব ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ২২/০২/১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে খসড়া-নিয়ন্ত্রণ প্রণালির ২৯ ধারার সংশোধনী প্রস্তাব করে বলেন, ‘উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে পরিগণিত করতে হবে।’ আর মওলানা ভাসানী ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলঘরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট বক্তৃতা ইংরেজিতে দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ করে ১৭ মার্চ তার নির্ধারিত আলোচনায় বলেন, ‘এটা বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ। এই অ্যাসেম্বলির যিনি সদর (স্পিকার) তিনিও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলবেন।’ প্রত্যুত্তরে স্পিকার জানান, ‘যিনি যে ভাষা জানেন তিনি সেই ভাষাতেই বলবেন।’ মওলানা দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘তা হবে না, আপনি রুলিং দেন বাংলায় বলতে।’
সংসদে ও বাইরে বাংলার পক্ষের ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হতে হতে গণআন্দোলনের রূপ নেয়। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২তে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আবারো ঘোষণা দেন যে, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এরই প্রতিবাদে আবদুল মতিনের নেতৃত্বাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরিতে আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে ২৮টি ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের মূল নেতাদের সমন্বয়ে ‘সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এই পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল, সভা, বিক্ষোভ মিছিলের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সরকার ওই দিন সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে সকাল থেকেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকে। এক প্রর্যায়ে বিশাল ছাত্র সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করলে ছাত্রনেতা আবদুল মতিন, গাজীউল হকের উত্তেজনামূলক ভাষণে উদ্বেলিত হয়ে ছাত্ররা বাংলা ভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভাঙার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। অতঃপর দশ দশজনের গ্রুপে ছাত্ররা সেøাগান নিয়ে বেরোতে থাকলে তারা আটক ও পুলিশের বেদম নির্যাতনের শিকার হন। এতে উত্তেজিত ছাত্রেরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস এবং গুলি ছুড়তে শুরু করে। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আবুল বরকত, জব্বার, রফিকসহ নাম না জানা অনেকেই। একুশের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ২২ তারিখ লাখো মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করেন। ওইদিন সফিকসহ বহু ছাত্র-জনতা পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে প্রাণ হারান। ৭/৮ জন শহীদের পরিচয় মিললেও পুলিশি গুমের জন্য অন্য ভাষাশহীদদের নাম জানা যায়নি। মাতৃভাষার জন্য এত লোকের প্রাণ বলীদান বিশ্বকে হতবাক করেছে। কালক্রমে পাকিস্তান সরকার বাঙালির আত্মাহুতির কাছে মাথা নত করে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাঙালি তথা বাঙালি মুসলমারদের ওপর বাংলা ভাষা রক্ষার দায়ভার কেন বর্তাল? এর ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। এখনে শুধু দুজন খ্যাতনামা মনীষী ইতিহাসবিদের উদ্ধৃতি দেয়া গেল। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. সুনীতি ভূষন কানুনগো বলেন, ‘মুসলিম অধিকারের পূর্বে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ, জাতি হিসেবে বাঙালি এবং ভাষা হিসেবে বাংলার কোন অস্তিত্ব ছিল না। সুলতানি আমলের শেষ পর্যায়ে এক দেশ, এক জাতি এবং এক ভাষা নিশ্চিত রূপে চিহ্নিত হইয়া যায়। … সুলতানি আমলেই বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং দ্রুত গতিতে বিবর্তিত হইয়া আধুনিক ভাষায় রূপ লাভ করে। (বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল- ড. সুনীতি ভূষন কানুনগো)
আর ইতিহাসবিদ কাজী জাফরুল ইসলাম লিখেন, ‘মধ্যযুগের মুসলিম শাসকেরাই বাংলা সাহিত্য চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মুসলিম লেখকেরা বাংলা সাহিত্যে Matter of Sanskrit and Matter of Bengal-এর সঙ্গে Matter of Arabia, Matter of Persia and Matter of Hind সংযুক্ত করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে বহুজাতিক সাহিত্য করে তুলেছিলেন। (মধ্যযুগের মুসলিম শাসকেরাই বাংলা সাহিত্যের স্থপতি- কাজী জাফরুল ইসলাম)। তাই রবীন্দ্রনাথ বা জিন্নার বাংলাভাষা বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে তৎকালীন পূর্ববাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণকে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ত দিয়ে সুরক্ষিত রাখতে হয়েছে।
বাংলাদেশের বাঙালিদের মাতৃভাষার জন্য এ রক্ত দান, এ আত্মাহুতি বৃথা যায়নি। বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা হয়েছে। বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালির আত্মসচেতনা এসেছে। বাঙালি-জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়েছে। অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ত্রিশ লাখ জীবনের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাঙালির নিজস্ব হোম স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলাভ হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক, বাংলা বাঙালির হোক’ ভবিষ্যদ্বাণী পুরাপুরি সফল হয়েছে। নজরুলের ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের মুক্তির চিরকালীন সেøাগান।
বাঙালির মাতৃভাষা আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য দেশকে কতটুকু প্রভাবিত করেছে জানি না, তবে আসামের বাংলা ভাষাভাষীদের খুবই প্রভাবিত করেছিল। সেখানে বাংলা ভাষার জন্য প্রবল আন্দোলন হয়েছিল এবং পুলিশের গুলির আঘাতে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন। তাদের এই আত্মদানের কথা সর্বপ্রথম জানা যায় ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত সুবির করের লেখা ‘বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে। ভারত বিভাগের পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপিনাথ বরদৈলর ঘোষণা ‘আসাম পর আসামিজ’, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার দাবদাহ সৃষ্টি করে। আসামের বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের তারা বহিরাগত প্রমাণ করার জন্য বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার ডায়ালেক্ট বা উপভাষা প্রমাণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হয় ‘বাঙাল খেদা’ অভিযান। ১৯৬০ সালে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় বিল কর্তৃক মন্ত্রীদের নির্দেশ দেয়া হয়। আবারো শুরু হয় বাঙাল খেদা অভিযান। এতে ক্ষুব্ধ বাঙালিরা ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলেন’-এর ব্যানারে ১৯৬০ সালের ২ ও ৩ জুলাই শিলচরে বিশাল জনসমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরদিন সমস্ত বারাক উপত্যকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এতে বাঙালিদের ১০ হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সরকারি হিসাবে ৪০ জনকে হত্যা এবং ৫০ হাজার লোককে নিরাশ্রয় ও বাস্তুহীন করা হয়।
এতে বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক, উত্তেজনা এতই প্রবল হয় যে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ‘শিলচর সংগ্রাম পরিষদের’ ব্যানারে লাখো বাঙালি তাদের প্রণের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। উত্তেজিত বাঙালি ছাত্র-জনতা ৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় বেরিয়ে এলে সরকারের লেলিয়ে দেয়া ‘আসাম রাইফেলস’ ও ‘সেনাবাহিনী’ বিনা উস্কানিতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে বাঙালিদের হত্যা করে। ঘটনাস্থলেই শচিন মোহন পাল, চণ্ডিচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, কুমুদ দাস, সুকোমল পুরোকায়স্থ, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, কুমারী কমলা ভট্টাচার্য এবং পরে সত্যেন্দ্র কুমার দেব ও বীরেন্দ্র সূত্রধরসহ ১১ জন বাঙালি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শহীদ হন। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মাহুতি দেয়া শহীদ অহমিয়া-বাঙালিদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষদের হার্দিক সমবেদনা ও ঐকান্তিক ভালোবাসা।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘২১শে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে তার ভাষণে বলেন, ‘একুশের পথ ধরেই শুরু হয়েছিল বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তা অর্জনের অগ্রযাত্রা। চুয়ান্নর নির্বাচন,পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জন এবং বিশ্বময় বাঙালির গৌরব ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি সে অগ্রযাত্রারই সাফল্যগাথা ও গর্বের ইতিহাস। মহান ভাষা আন্দোলনের বিমূর্ত চেতনাই দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য ও বাস্তব করে তোলে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষার চর্চা ও সকল দেশের জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার অনুশীলন, প্রয়োগ ও প্রসার ঘটিয়ে পৃথিবীময় মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে একুশের শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য আমি দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।’ বর্তমানে ‘বাংলা ভাষা’কে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বর্তমান সরকার।

এ বি এম ফয়েজ উল্যাহ, নজরুল গবেষক ও কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়