দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও স্মার্ট বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিপ্লব বলতে শক্তি বা জোর প্রয়োগে সরকার ও সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও নতুন ব্যবস্থার পত্তনকে বুঝায়। তবে তার একটা সর্বজনীন সংজ্ঞা হতে পারে ‘আমূল বা মৌলিক পরিবর্তন’ যা শিল্প বিপ্লবকে সংজ্ঞায়িত করতেও সাহায্য করবে। শিল্প বিপ্লবের ধারণাটি প্রায় ৩০০ বছর আগের। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগে যান্ত্রিক শক্তি আবিষ্কারের ফলে ইউরোপের শিল্পজগতে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তা প্রথম শিল্প বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত। বাহুবল ব্যতিরেকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও জলশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করা হয়। এই বিপ্লব মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ক্রমশ শক্তিশালী বুর্জোয়ায় রূপান্তর করে এবং বিশ্ব পুঁজিবাদের ভিত্তি তৈরি করে।
বস্ত্র শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রথম বিপ্লবটা শুরুতে ব্রিটেনে, পরে আহমেদাবাদ ও জাপানে পরিলক্ষিত হয়। বস্ত্র শিল্প ছাড়াও লৌহ শিল্প, কৃষি ও খনি খনন কাজে এই বৈপ্লবিক ধারা পরিব্যাপ্ত হয়। আমেরিকায় তা ১৭৬০ থেকে ১৮২০ বা ১৮৪০ সালের মধ্যে ঘটে যায়।
তারপর ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে রেলপথ নির্মাণ এবং টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়। স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব ছিল এর সহযোগী। এই বিল্পবের কারণে হাতের কাজ আরো বেশি মাত্রায় মেশিন দখল করে নিতে থাকে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণে ওয়ান অফ টেকনোলজির জায়গার মাস প্রোডাকশন টেকনোলজি ব্যাপকতা পেতে শুরু করে।
তারপরের দাপটটাকে তৃতীয় শিল্প বিল্পব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুফল স্বরূপ বিশ্বে মহামন্দার সূচনা হয়; বেকারত্ব চরম রূপ ধারণ করে, আয়-উপার্জন কমতে থাকে, জীবনযাত্রার ব্যয়ে ঊর্ধ্বগামিতা হয়, যার কারণে ডিজিটালাইজেশনকে সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে বেছে নেয়া হয়। কম্পিউটার ও সুপার কম্পিউটার এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বল্প মূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য ও সেবা দান সম্ভব হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বিশেষত ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে যন্ত্রপাতি আরো অধিক হারে মানবশক্তির জায়গা দখল করতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পৃথিবীর অনেক দেশে এ বিপ্লবের সূচনা হলেও আমাদের দেশ পর্যন্ত তা পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিসমুহ
ইত্যবসরে ২০১১ সালে জার্মানিতে একটি উচ্চতর প্রযুক্তিগত কৌশলের উদ্ভব ঘটে, যাকে ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪’ নামে অভিহিত করা হয়। জার্মান সরকারের ক্রম সম্প্রসারিত প্রয়াসের কারণে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় কম্পিউটারের সার্বিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। সেই সরকারের ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কৌশলের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল উৎপাদনের (বৃহৎ আকারে) শর্তে কাস্টমাইজেশন, সেলফ অপটিমাইজেশন, সেলফ কনফিগারেশন, সেলফ ডায়াগনসিস, কগনিশন এর প্রবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জটিল কাজে কর্মীদের বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির বিকাশ।
আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা ৪ আই আর হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ, উন্নত যোগাযোগ এবং স্বপর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্টম মেশিন তৈরি করার জন্য বড় আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) কে সংযোগ করা হয়’। এসবের কারণে বাস্তব আর ভার্চুয়াল জগৎ একাকার হতে শুরু করেছে। শোয়াবের ভাষায় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার একত্রিত বা একীভূত করে এবং বায়োলজির পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন করে উৎপাদন পদ্ধতিতে এবং প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলনই হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, রবোটিক্স, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, মাইক্রো প্রসেসর, থ্রিডি প্রিন্টিং, ক্লাউড টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব পিউপল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ডিজিটালইজড কনসেনসাস, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস টেকনোলজি, সম্পূর্ণ স্বশাসিত, স্বচালিত যানবাহন ও মেকাট্রনিক্স ইত্যাদি হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আনুষাঙ্গিক প্রযুক্তি।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহ
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে নিত্য-নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে ও পাবে। ভবিষ্যতে নিত্য-নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক জটিল ও সু² কাজকর্ম সহজে করা সম্ভব হবে। এই বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রীয়করণ ব্যাপকতা লাভ করবে। ধারণা করা হচ্ছে ব্যবস্থাপনা ছাড়া সকল কাজই মেকানিক্যাল রোবট বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট সম্পাদন করতে পারবে। যার ফলে পণ্য উৎপাদন ব্যয়, পণ্যের মান ও গুণগত অবস্থান নিঁখুত হবে এবং ভোক্তার পছন্দের ব্যাপ্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। তবে শিল্প বিপ্লবের কতিপয় প্রতিবন্ধকতার কথা পূর্বাহ্নে চিন্তায় রাখা প্রয়োজন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রতিবন্ধকতাসমূহকে মোটামুটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শ্রেণিতে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহারের উচ্চ ব্যয়, উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ-খাওয়ানোর জটিলতা, অতিরিক্ত বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনের সীমিত পরিসর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় রূপ নিতে পারে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাবিষয়ক উদ্বেগ, নজরদারি ও অবিশ্বাস, অংশীজনদের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে অনীহা, করপোরেট আইটি বিভাগের অপ্রয়োজনীয় হবার আশঙ্কা, সামাজিক বৈষম্যের কারণে অস্থিরতা বৃদ্ধি ও চাকুরি হারানোর যৌক্তিক ও অযৌক্তিক শঙ্কা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনা, মানদণ্ড এবং সার্টিফিকেশনের ফর্মের অভাব, অস্পষ্ট আইনি ব্যবস্থা এবং ডাটা সুরক্ষার আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় কতিপয় উদাহরণ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষ তার জীবনকে বেশিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর করবে। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ থেকে সহজতর হবে। মানুষের হাতে আধুনিক জীবন ও জীবিকার উপকরণ দ্রুত পৌঁছে যাবে এবং সারা বিশ্ব সত্যিকারের গেøাবাল ভিলেজে পরিণত হবে। ক্রমশ ভৌগোলিক সীমারেখা ও দূরত্ব অনেকটা অবাস্তব প্রমাণিত হবে। কর্মের পরিধি বিস্তৃত হবে। যারা মেশিন নির্মাণে ও মেশিনকে দাসে পরিণত করতে সক্ষম হবে, তাদের দাপট, আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাবে। যারা যত দ্রুত এই প্রযুক্তি হস্তগত করবে, নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনীতে সক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে, তারাই টিকে থেকে ডারউইনের Survival of the fittest তত্ত্বের সারবত্তা প্রমাণ করবে। তবে মানুষের অতি প্রয়োজনীয় বা ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সমাজে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। যেমন ‘কমদক্ষতা স্বল্প বেতন’ বনাম ‘উচ্চদক্ষতা উন্নত বেতন’ কাঠামো অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করবে। তবে নানা ধরনের নতুন কর্মসংস্থানের বিশাল এক দুয়ারও উন্মোচিত হবে। শিল্পের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতেও প্রযুক্তির ছোঁয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে ও পাবে। নিত্য-নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক জটিল কাজকর্ম সহজে করা সম্ভব হবে। অটোমেশনের ফলে কলকারখানায় মানুষের ওপর নির্ভরতা কমবে, সব কিছুই করা হবে যন্ত্রের মাধ্যমে। শ্রমিকদের স্থান দখল করবে মেকানিক্যাল অথবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের কালেও এসব পরিলক্ষিত হয়েছে বা হচ্ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও স্মার্ট বাংলাদেশ
পূর্বেই বলেছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উদ্ভব ঘটেছে ১৯৬৯ সালের কাছাকাছি সময়ে। তখন আমরা ছিলাম জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা বিজয়ী হলেও ধ্বংসপ্রায় দেশ ও অর্থনীতিতে পুনর্বাসন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের পূর্বেই বিদেশি মদদপুষ্ঠ শিখন্ডীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তার পরের অধ্যায় পশ্চাৎমুখীতার ইতিহাস যার কারণে ১৯৬৯ সালে বিশ্বের অনেক দেশেই তৃতীয় বিপ্লবের সূচনা হলেও সুদীর্ঘ সময় পর ১৯৯৬ সালের শেষভাগে তাকে বাংলাদেশে আত্মস্থ করার পদক্ষেপ গৃহীত হয়।
বাংলাদেশে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের ব্যাপক পরিচিতি ও ব্যবহারের পূর্বেই তৃতীয় শিল্প বিপ্লবকে পড়ি কি মরি গতিতে গ্রহণ করতে হয়েছে। অবশ্য তার ফলশ্রæতিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অবকাঠামোগত বুনিয়াদ তৈরি হয়েছে এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ জাতীয় চিন্তাভাবনা প্রাধান্য পেয়েছে। ইতোমধ্যে স্কুল পর্যায়েও ডিজিটালাইজেশনের ঢেউ লেগেছে। ইন্টারনেট আবিষ্কার ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারে বাংলাদেশে বহু হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আউট সোর্সিং এর বিকাশ ঘটেছে। ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কেন্দ্র করে দেশে অসংখ্য হাইটেক করপোরেশন ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ ঘটবে।
বাংলাদেশে আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে যে তা অসম্পূর্ণ প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবকে ধারণ ও অবলম্বন না করেই তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অসামান্য এগিয়ে যাচ্ছে। আগেই বলেছি সারা বিশ্বে ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহার ১৯৬৯ সালে শুরু হলেও বাংলাদেশে তা শুরু করা হচ্ছে ১৯৯৬ সালে। বিলম্বে শুরু করেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও তার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের নিরলস প্রয়াস ও পরিশ্রমে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ডিজিটালাইজেশন সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ডিজিটাল বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। ডিজিটাল বিপ্লব সম্ভব হলে স্মার্ট টেকনোলজির সময়োপযোগী অবলম্বনে শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন। ফলত এ যাবৎ যে সব সেবা জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছেছে সেগুলো হলো- ই-কমার্স, ই-ব্যাংকিং, ই-বুক, ই-ভোটিং, ই-হেলথ সার্ভিস, ই-ফাইলিং, ই-মিউটেশন, ই-পেপার। বর্তমানে দেশে ইলেকট্রিসিটি, গ্যাস, পানি বিল, অনলাইনে দেয়া যাচ্ছে। অনলাইন নিবন্ধন, কর প্রদান, পরীক্ষার ফলাফল, যাতায়াতের টিকেট, অর্থ আদান-প্রদান, গ্রামীণ ব্যাংকিং সুবিধা ও শিক্ষার জন্যে ই-প্লাটফর্ম, ই-লাইব্রেরি, সরকারি কর্মকাণ্ড, ডিজিটাল পাসপোর্ট, আইডি, ভোটিং, ল্যান্ড সার্ভে ভূমি উন্নয়ন, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, ভর্তি, শিক্ষা ও মূল্যায়ন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান।
ইউনিয়ন পর্যন্ত এসব অনেক সেবা যথা- কৃষি তথ্য, টেলিফোন ও ব্যাংকিং, অনলাইন মার্কেটিং, আউট সোর্সিং, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, টিন বা কিশোর পোর্টাল, ই-লার্নিং প্লাটফর্ম, মুক্তপথ, প্রতিযোগিতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি এখন দৃশ্যমান।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার, সার্ভিস ইনোভেশন, ফান্ডিং, ইমপেথি ট্রেনিং, টিসিভি এবং এসডিজি ট্রেকারস এর সার্ভিস। ফলত এ সবই আমাদের অর্থনীতি, উন্নয়ন, বিশ্বায়ন, সরকার পরিচালনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, গেøাবাল সাপ্লাই চেইন, মানব উন্নয়ন, কৃষি শিল্প, যোগাযোগ, চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও সচেতনতার অভাব, মূলধনের অভাব, অবকাঠামোগত স্বল্পতা, দক্ষ মানব শক্তির অভাব এবং কতিপয় সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা আমাদের কিছু টেনেছে।
এই সময়ের মধ্যে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সহজলভ্য করা ছাড়াও আইটি ভিলেজ স্থাপন, হাইটেক পার্ক স্থাপন, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব নির্মাণ, ৫জি নেটওয়ার্ক নির্মাণ, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার নির্মাণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদান কার্যক্রম, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, আর্থিক সহায়তা দান, কমনরুম, ডিবেট ক্লাব গঠন ও পূর্ণ গঠনের মাধ্যম বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করা, মননশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটানো হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে সরকার হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। এই সব পার্কে বিভিন্ন ধরনের হাইটেক শিল্প ও ব্যবসা, পরিবেশ বান্ধব তথ্যপ্রযুক্তি, সফটওয়্যার টেকনোলজি, বায়ুদূষণ, রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট, শিল্প স্থাপন ও পরিচালনা করছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রম পর্যায়ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর মনমানসিকা, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতার জন্ম দান করা, ভবিষ্যতে প্রযুক্তির ডিভাইস ও উদ্ভাবনে আগ্রহী করে তোলা এবং সে সবের বাণিজ্যিকরণের সুযোগ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে উপলব্ধি সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং পাঠ্যবস্থায় প্রণোদনামূলক শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ দান করা হচ্ছে।
বিদ্যালয় সমূহে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম, গ্রামীণ পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য তৈরি করা হচ্ছে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, স্কুল অব ফিউজার। অতি সাম্প্রতিক তথ্যে অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্ম দিনে জানা যায় যে, এযাবৎ শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ৯০০১টি, সৌদি আরবে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ১৫টি, শেখ রাসেল ডিজিটাল ক্লাশরুম ১৬০টি, শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউজার ৩০০টি সমাপ্ত হয়েছে, বেসিক আইটি ট্রেনিং দেয়া হয়েছে ৮৭০ জনকে এবং ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে ৩৯টি বিদেশি ভাষায় ১০২৪ জনকে।
বাংলাদেশ বর্তমানে ৭ম বৃহৎ তথ্য কেন্দ্র, যা শুধু তথ্য কেন্দ্র হিসেবে নয়, দেশের ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করছে। সারাদেশে প্রায় ৯ হাজার তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণ তিন হাজারের অধিক সেবা পাচ্ছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এসব সম্প্রসারিত হচ্ছে না। একজন দিনমজুর বা রিক্সাওয়ালা হতে শুরু করে তথ্য প্রযুক্তির প্রতি আপাতত অতি বিরূপ ব্যক্তি বা সংগঠন তার উপকারভোগী হচ্ছে। আমাদের বর্তমান মাথাপিছু আয় প্রায় ২৫৭৮ ডলার যা ২০৪১ সালের মধ্যে ১৫ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ভবিষ্যতে মোবাইল ফোন, সুপার কম্পিউটার, চালকহীন গাড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত রোবট, নিউরো প্রযুক্তির ব্রেন, জেনেটিং এডিটিং, উৎপাদন বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনা, ই-গর্ভনেন্স প্রাধান্য নিয়ে আবির্ভূত হবে।
বাংলাদেশ যেখানে আশির দশকে তৃতীয়

শিল্প বিপ্লবকে বরণ করে নিতে পারত, নেতৃত্বের শূন্যতা, ক্ষমতাসীনদের অনীহা কিংবা অবিমৃশ্যতার কারণে তা দৃশ্যমান হয় ১৯৯৬ সালে। সে সালেই ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকার প্রতিপক্ষের বিরূপ ও অমাননাকর মন্তব্যের সম্মুখীন হন। সুখের বিষয় বেধে দেয়া সময়সীমার বহু আগেই ডিজিটাল বাংলাদেশ সারাদেশ ও সারা বিশ্ব অবলোকন করেছে।
এক সময়ে একটি মোবাইল ফোন কিনতে ৭২ হাজার টাকা লাগত এখন তার দাম ৩০০ টাকা। দেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন গ্রামীণ পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে নগদবিহীন সমাজের ভিত্তি তৈরি হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০ ভাগ সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে পৌঁছাবে ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় ই-ব্যবস্থা প্রবর্তনে অহেতুক বিড়ম্বনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। টেকসই উন্নয়ন, উৎপাদিকা বৃদ্ধি, আয়-উপার্জন বৃদ্ধি, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন ও দাম সংকোচন, নারীসহ প্রতিটি নাগরিকের ক্ষমতায়ন, মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ হ্রাস এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ তার কতিপয় সুফল।
২০৩০ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার দাঁড়াবে। এটা শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবদান হবে। প্রবৃদ্ধি হার হবে বছরে ১.২ শতাংশ। এর ফলে বিশ্বে ৭.২ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে। তবে আগামী দশ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে ১০ মিলিয়ন। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, টিকেট চেকিং, চিকিৎসা খাত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রচুর কর্মসংস্থান হবে, অনলাইন শিক্ষা বা ঘরে বসে শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো স্থানে বসেই প্রশিক্ষণ ও লেখাপড়া করা যাবে। মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি, সহজলভ্য ইন্টারনেট, ৩জি ইন্টারনেট থেকে ৫জি, দ্রুত গতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা উপকৃত হচ্ছে না। টেলিকনফারেন্স ত পুরনো দিনের কথা; জুম বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম পড়াশোনার অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্মার্ট আ্যাপস কোম্পানি গড়ে উঠেছে, তথ্যভাণ্ডার তৈরি, ব্যাংকিং সেবা, সফটওয়্যার তৈরির মাধ্যমে আয় উপার্জনের বিস্তৃতি ঘটছে। দর্শনীয়ভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতা দৃষ্টিনন্দন।
তাছাড়া শিশু ও তারণ্যে ইতিবাচক প্রবণতা ও মনোভঙ্গির তৈরিতে জেলা-উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বহু কর্মশালা বিজ্ঞান-বিষয়ক সেমিনার, কুইজ প্রতিযোগিতা, ব্যবহারিক প্রদর্শনী ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন, রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং কার্যক্রম, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংকস, মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনসহ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি বা চালিকা শক্তিগুলোর জনপ্রিয় করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শিল্প বিপ্লবের সাথে পরিচিতি এবং তার ধারণাগুলোর সাথে পরিচিত করে তোলার পরই প্রোগ্রামিং ইমেজ প্রসেসিং, ওয়েব ডেভলপিং বা আউটসোর্সিং সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির পদেক্ষপ নেয়া হয়েছে।
সহজভাবে বলতে গেলে ডিজিটালাইজেশনের চূড়ান্ত রূপ বা বৈপ্লবিক রূপান্তরই হচ্ছে স্মার্ট টেকনোলজির সর্বজনীন ব্যবহার তার কারণে যে দেশটি চিন্তার পর্ব থেকে দৃষ্টিপটে আবির্ভূত হবে তাকেই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ হলো একটি ধারণা, একটি প্রতিশ্রæতি, একটি উন্নয়ন কৌশল যা ডিজিটালাইজেশন বিপ্লব ঘটিয়ে ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০২২ সালের দিকে প্রথম এই প্রতিশ্রæতি ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ’। তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে অনেক আগে। এই ডিজিটাল বিপ্লবের সহায়ক হিসেবে জাতীয় ব্লকচেইন কৌশল বাংলাদেশ, ২০২০, জাতীয় ইন্টারনেট অব থিংস কৌশল বাংলাদেশ, ২০২০, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কৌশল বাংলাদেশ, ২০২০, বাংলাদেশ মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইন সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ কৌশল ২০২০, রোবটিক্সবিষয়ক জাতীয় কৌশল, ২০২০। ন্যানোটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস ইত্যাদি ক্ষেত্র সম্প্রসারণ, প্রচারনা, ব্যবহার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানে সক্ষম দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
তারপরে গঠিত হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স। অতি সম্প্রতি তার নামকরণ হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স। এই টাস্কফোর্স অগ্রসরমান প্রযুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবে। পাশাপাশি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রমকে স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। রপ্তানির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নেও কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার সঙ্গে স্মার্ট সরকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক বিধিবিধান প্রণয়নে দিকনির্দেশনা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আর্থিক খাতের ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ বাস্তবায়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান করছে এই টাস্কফোর্স। প্রধানমন্ত্রী এই টাস্কফোর্সের প্রধান এবং তারই যোগ্য সন্তান তার উপদেষ্টা হিসেবে স্মার্ট বাংলাদেশের ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবায়ন করছেন। এছাড়া এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল আ্যান্ড স্পেস হরাইজন প্রতিষ্ঠা এবং ব্লেন্ডেড এডুকেশন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ফাইভ-জি সেবা চালুর পরবর্তী সময়ে ব্যান্ডউইথের চাহিদা বিবেচনায় চতুর্থ সাবমেরিন ক্যাবলে সংযোগের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছে টাস্কফোর্স। এসবের কারণেই উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে অর্জনের কৌশল হিসেবে স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণাটির জন্ম দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগেই বলেছি ডিজিটাল টাস্কফোর্সকে স্মার্ট টাস্কফোর্স নামকরণ করা হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গর্ভনেন্স ও স্মার্ট সোসাইটিকে ভিত্তি ধরে স্মার্ট বাংলাদেশের শুভযাত্রা লক্ষণীয় হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক, জয় সিলিকন টাওয়ার, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল জাদুঘর ও সিনেফ্ল্যাক্স, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের যাত্রা এমনকি অতি সাম্প্রতিক এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা বাস্তবায়ন হচ্ছে।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ভিশন ২০২১ এর মূল ভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন। সে লক্ষ্য তার আগেই অর্জিত হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কিন্তু ক্ষুদ্রার্থে ফাইভ জি ইন্টারনেট, শতভাগ স্মার্ট ফোন ব্যবহার, আরো দ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং একশভাগ ক্যাশবিহীন লেনদেন ধারণাকে বুঝায়, তবে অপেক্ষায় থাকতে হবে সেদিনের জন্য যে দিন সব কিছুতে শতভাগ ডিজিটালাইজেশনসহ উৎপাদন যোগাযোগ, চিন্তাচেতনা, মনোভঙ্গিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের। তখন শিক্ষায় আসতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

স্মার্ট বাংলাদেশ উপযোগী জ্ঞান, দক্ষতা ও গবেষণা
স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির অনুকূল আবহ ও প্রস্তুতিপর্ব শেষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে তার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ছে। এই জন্যে বিশেষত মেশিন তৈরি, মেরামত, নবায়ন, প্রয়োগ বা দাপে দাপে উন্নয়নের জন্য যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মানব সম্পদ প্রয়োজন। ইউজিসি ও আ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল প্রণীত পদক্ষেপগুলো অবলোকন করলে প্রস্তুতির ধারণাটি বুঝা যাবে। বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল ১০ স্তর বিশিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুমোদন দিয়েছে যার ১ হতে ৬ স্তর পর্যন্ত সাধারণ, এসএসসি এবং এইচএসসিকে ধারণ করলেও মূল ফোকাসটা হচ্ছে ঃবপযহরপধষ বীঢ়বৎঃ বা ঞবপযহড়ষড়মরংঃ তৈরির ওপর। ৭ম স্তর থেকে ১০ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষার ভিত্তি ধরে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর, ৪ বছর বা ৫ বছর মেয়াদী স্নাতক শিক্ষা ও স্নাতক ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে।
তারপর রয়েছে উচ্চ মার্গের ঞবপযহড়ষড়মরংঃ শিক্ষার ব্যবস্থা। এই স্তরে উচ্চতর, উচ্চতম ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেয়া হবে। তার পরের স্তরে আছে, থিসিস কিংবা পরীক্ষা কিংবা উভয়ের মিশ্রণের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির ব্যবস্থা, পরের এবং শেষ ধাপটি হলো পিএইচডি ডিগ্রি যা শুধুমাত্র গবেষণা কিংবা গবেষণা ও কোর্স ওয়ার্কের সংমিশ্রণে করা যাবে। তবে কোনো বিষয়ে এসব ডিগ্রি করা যাবে তা কিন্তু উল্লেখিত হয়নি। ধারণা করছি স্মার্ট বাংলাদেশের চাহিদা মোতাবেক ঝঞঊগ, মানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অঙ্কের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হবে। উপরের দিকে উঠতে গেলে জড়নড়ঃরপং, অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব ইত্যাদিতে উচ্চতর ডিপ্লোমা প্রোগ্রামের প্রসার ঘটাতে হবে।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গণে ব্রিটেনের অনুকরণে ঙঘউ বা মধ্য মেয়াদী ঐঘউ ডিগ্রি প্রবর্তন করা যেতে পারে; বিষয়গুলো হতে হবে- নেটওয়ার্কিং সার্ভার, সার্ভার নিরাপত্তা, ডাটাবেজ, প্রোগ্রামার বা ডেভেলপমেন্টের দক্ষতা অর্জনের জন্য স্বল্প মেয়াদী ট্রেনিং ব্যবস্থা, ডাটা সায়েন্স, বিগডাটা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ারকিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স ও সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা। প্রতিটি বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি প্রদানের কথাও চিন্তা করা যেতে পারে যা রাজশাহী শুরু করে দিয়েছে। একটি ইন্সটিটিউট গড়া যায় যা হবে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ইন্সটিটিউট। সরকারি কি বেসরকারি পর্যায়ে গঠিতব্য এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এনালগ থেকে ডিজিটালে সামগ্রিক রূপান্তর।
স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রয়েছে বিবিধ দক্ষতার সংমিশ্রণ। এসবে সামাজিক দক্ষতার প্রয়োজন কমে গেলেও কারিগরি দক্ষতা ও ধারণাগত দক্ষতাসম্পন্ন বহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎং এর পাশাপাশি ওহঃৎধঢ়ৎবহবঁৎং সৃষ্টিতে গধহধমবসবহঃ ঊফঁপধঃরড়হ কে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো বটেই, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পরিমাণ বিজ্ঞান, কৃষি শিক্ষা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সেগুলো স্মার্ট বাংলাদেশের জন্যে পর্যাপ্ত নয়। এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে কম বরাদ্দ পশ্চাৎগামীতার লক্ষণ। ভবিষ্যতে মানবসম্পদের ধরন হবে বিচিত্র্য। সুদক্ষ কারিগর, মেশিন প্রস্তুতকারক, মেরামতকারী বা নতুন মেশিন প্রস্তুতকারক, প্রোগ্রামার, গবেষক, শিক্ষক এবং এসবের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সফলতার জন্য থাকতে হবে উদ্যোক্তা এবং উদ্যোক্তার জ্ঞান, দক্ষতাসম্পন্ন ম্যানেজার বা ইন্টারপ্রেনিয়ার। সংখ্যা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে সংখ্যাটা চাকুরি হারানোদের চেয়ে কম হবে না। দ্রুত চাহিদা মিটাতে এবং প্রযুক্তির প্রতি অতি অনুকূল মনোভঙ্গী সৃষ্টিতে কুমিল্লার ন্যায় সর্বত্রই কারিগরি দক্ষতা সৃষ্টির মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে। মাধ্যমিক স্তরে আরো অধিক পরিমাণে ঝঞঊগ বপন করতে হবে।
এসবে উৎসাহিত করার জন্যে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। কোভিড বেসরকারি শিক্ষাকে কাবু করেছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি বিশেষত ইউজিসির পদক্ষেপ প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষাতে শিক্ষকের শিক্ষা বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ দানের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। আরো প্রশংসনীয় হবে শিক্ষক স্বল্পতা দূরীকরণে গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ। এমফিল বা পিএইচডি পর্যায়ে অতি বিশেষায়িত গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রাপ্তদের ওহঃৎধঢ়ৎবহবঁৎং হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন পদগুলো ছাড়াও অন্যান্য পদে নিয়োগে প্রযুক্তি পিপাসুদের কথাও মনে রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রচলিত ৪টি স্তরকে ভেঙে ১২ কি ১৩টি স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে। তাতে শিক্ষকগণ তাদের সময়ের ফলপ্রসূ ব্যবহারসহ আত্মরক্ষার পথ খুঁজে নিতে পারবে। প্রশাসনিক কাঠামোতে যোগ্য ব্যক্তি বসাতে হবে এবং তাদের প্রণোদনার যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাদের পদ-পদবিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে উচ্চ শিক্ষায় পরিবর্তন এসডিজি লক্ষার্জনসহ স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এমনকি তা হবে শতবর্ষী পরিকল্পনার ভিত্তিমূল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্নে ফোকাস ছিল ব্যবসায় ও বাণিজ্য শিক্ষা অর্থাৎ বাজারমুখী চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা। তারপর এসবে এমন কিছু শিক্ষার্থীর আবির্ভাব ঘটে যাদের লক্ষ হচ্ছে একটি সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে চাকুরিতে নিয়োগ কিংবা চাকুরির প্রমোশনের দর কষাকষির ক্ষেত্র প্রস্তুত। সে কারণে লিবারেল বিষয় ও অনলাইনে পড়তে অনেক শিক্ষার্থী বেশি আগ্রহী। এরই সাথে সংগতি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনে অর্থাৎ উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে লিবারেল শিক্ষিতদের সংখ্যা বাড়ছে। নিয়োগকারীগণ তাদের নিম্ন বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাতে পাচ্ছে। ফলত অতীতের দিনের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ পদে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা ব্যবসায় প্রশাসনে শিক্ষিতদের চাহিদা কমছে, প্রাপ্তিতাও কমছে কেননা তারা তাদের সমগোত্রীয়দের চেয়ে কম বেতনে কাজ করতে অনাগ্রহী। লিবারেল শাস্ত্রে অধ্যয়নকারীরা স্বগোত্রীয়দের টানতে বেশি আগ্রহী। ফলে ঐধাব-হড়ঃং এর সংখ্যা বাড়ছে এবং আমাদের উন্নয়নশীল অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়গুলো ভাবিয়ে তোলার মতো। আমাদের যেখানে প্রয়োজন টেকসই উন্নতি যার কৌশল হবে স্মার্ট বাংলাদেশ, সেখানে আমরা বিপরীত ধারার শিক্ষা প্রবর্তন করে এবং তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে জড়তা কিংবা নিম্নগামিতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি কিনা ভেবে দেখতে হবে। শিক্ষিত বেকারগণ জঙ্গীবাদ ও পশ্চাদমুখীতার নেতৃত্ব দিয়ে সমাজটাকে পেছনে ঠেলে দেবে কিনা বা টেনে নামিয়ে দেবে কিনা তাও বিবেচ্য।

সমাজে একটা ভয়ংকর প্রবণতা দৃশ্যমান
আজকাল দোকানপাট, খাবারের হোটেল রেস্তোরাঁয়, বিমানবন্দরে গিয়ে ধর্মীয় পোশাক বা লেবাজ পরিহিত পুরুষ-মহিলা ও তাদের সন্তানাদিকে দেখছি। তাদের চেহারায়, পরিধেয় বস্ত্রে ও গহনায় বিত্ত-বৈভব বা স্বাচ্ছন্দের চাপ দেখছি। এখন এ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ব্যতিরেকে এত স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখা কঠিন অর্থাৎ তারা তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের তথা স্মার্ট প্রযুক্তিসমূহ ব্যবহার করছেন। শুভ লক্ষণ নিঃসন্দেহে। এই সব লোকেরাই আবার এমন সব শিক্ষায় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে যেগুলো টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়, উন্নত জীবনের অন্তরায় ও স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সতর্ক না হলে তা স্বল্প দক্ষতা, স্বল্প বেতন বনাম উচ্চ দক্ষতা উচ্চ বেতন কাঠামোর বিভাজন সৃষ্টি করবে, সংঘাত হানাহানি ও জঙ্গীবাদের পথ খুলে দেবে।

সংক্ষিপ্ত সার ও একটি উপসংহার
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা ২০১১ সালে হয়েছে এবং সেটা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে দেশে বিদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে শুধু সময়মতো স্বাগতই জানাননি, এই বিপ্লবের উপযোগী মনোভঙ্গি, চেতনা, গ্রহণযোগ্যতা ও অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টি করেছেন বা করে চলেছেন, যা স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণায়। কারণে-অকারণে বিপ্লবের সাথে সাংঘর্ষিক সামাজিক বাধাসমূহ সৃষ্টি হচ্ছে তবে এ কথাও ঠিক যে বিপ্লবকে ধারণ করা এগিয়ে নেয়া ও টেকসই রূপ দেবার জন্যে দক্ষতা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়