সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

আগের সংবাদ

নেতৃত্বে শীর্ষে সংখ্যায় কম

পরের সংবাদ

রেইনকোটে মোড়ানো লাশ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তোমার যে ভুলো মন! আস্তে-ধীরে সব কিছু ঠিকঠাক করে নিও। এমনি পাহাড়ি এলাকা, তার ওপর দুর্গম সব স্পট। কোনো কিছুর ঘাটতি হলে তা না-ও পাওয়া যেতে পারে। সবকিছু গোছানোর সময় রাজ তার স্ত্রী বন্যাকে এভাবেই বলেছিল কথাগুলো। এতসব কথার মধ্যে শুধু একবার আড় চোখে বন্যা তার প্রাণের প্রিয়তম রাজের দিকে তাকিয়ে ছিল, যা মুচকি হাসির সঙ্গে মিশে যায়। এবার স্ত্রীসহ রাজের টিম যাচ্ছে বান্দরবান গভীর পাহাড়ি অরণ্য চিম্বুক রেঞ্জের সাইংপ্রা অভিযানে। সাইংপ্রা একটি বুনো ঝরনা। জয় করতে হলে পাড়ি দিতে হবে দুর্গম সব পাহাড় আর কঠিন ঝিরিপথ।
‘আমরা ঘুরি বাংলাদেশ’ ট্রাভেল গ্রুপের অ্যাডমিন রাজ। ফেসবুকে এই ইভেন্ট গ্রুপের কারণে রাজ এখন ভ্রমণপিপাসুদের মাঝে খুবই জনপ্রিয়। এ যাত্রায় সাইংপ্রা যাচ্ছে ১৯ জনের একটি গ্রুপ। আলিকদমের খেমচং পাড়া থেকে স্থানীয় একজন গাইড নিয়ে ২০ জনের দলসহ এগিয়ে যাচ্ছে রাজ। সাইংপ্রা ঝিরিতে পৌঁছে গ্রুপটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১১ জনের গ্রুপটি সাইংপ্রা অভিযান শেষ করে খেমচং পাড়ার দিকে রওনা দিয়েছে। রাজ ও বন্যাসহ ৮ জনের দলটি পেছনে পড়ে যায়। সাইংপ্রায়ের অনেকগুলো ধাপ। দ্বিতীয় ধাপের শেষের দিকে নামার সময় হঠাৎ পা পিছলে প্রায় সত্তর থেকে আশি ফুট নিচে পড়ে যায় রাজ। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সবাই তাড়াহুড়া করে রাজের কাছে এসে দেখে মাথায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে, শরীরের বিভিন্ন অংশ কাটা-জখম হয়েছে। চোখ দুটি মিটমিট করে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকের চোখের কোণে পানি ছলছল করছে।
ঝিরির দুই পাশে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃস্তব্ধ পাহাড়গুলো আকাশ অবধি পৌঁছে গেছে। যেন বড় বড় পাহাড়ি গাছগুলো ক্রমশ বন্যার ওপর ভেঙে পড়ছে। দিগি¦দিক ছুটতে থাকে বন্যা। ছবি ও ভিডিও করার জন্য হাতেই ছিল ফোনটি। কিন্তু কোনোক্রমেই নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা রাজকে রেইনকোটে মুড়িয়ে ঝিরি পথে রওনা হয় বন্যাসহ সঙ্গীরা। এমন অবস্থায় অন্যদের সঙ্গে স্বামীকে কাঁধে নিয়ে এগোতে থাকে বন্যা। এর মধ্যে শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। সূর্যের আলোও কমে আসছে। ঝিরির একপ্রান্তে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সবাই। ঘড়িতে তখন বিকাল পাঁচটা। এভাবে হবে না, পাহাড়ি লোকদের সহযোগিতায় রাজকে উদ্ধার করা এবং বিষয়টি সবাইকে জানাতে হবে। তাই একজনকে সঙ্গে নিয়ে বন্যা ছুটতে থাকে খেমচং পাড়ার দিকে। হাঁটতে গিয়ে কয়েকবার মাটিতে বসে পড়ে বন্যা। দুই-তিনবার রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়েও পড়ে যায় সে। এক’পা এগোতেই মনে হচ্ছে দু’পা পেছনে ফিরে যাচ্ছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অসংখ্য জোঁকের কামড় খেয়ে ঝোপঝাড় পেরিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পর রাত ৮টায় দুজন খেমচং পাড়ায় এসে পৌঁছে।
আকাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন। চারদিক স্তব্ধ হয়ে আছে। ঝিঁঝিপোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রেইনকোটে মোড়ানো রাজ। তার চারপাশে ছয়জন লোক। সবার মুখের শব্দ বন্ধ হয়ে আছে। ইচ্ছা করলেও কেউ এখান থেকে এক পা এগোতে পারছে না। সময় যত যাচ্ছে প্রত্যেকের ভেতরে অজানা আতঙ্ক ভর করছে। কোনো খাবার-দাবার নেই। খিদে নিবারণের জন্য একমাত্র বৃষ্টির পানিই হচ্ছে শেষ ভরসা।
খেমচং পাড়ায় পৌঁছে বন্যা পাড়ার লোকজনসহ আগে আসা সদস্যদের রাজের আহত হওয়ার খবরটি জানায় এবং তাকে উদ্ধারে পাহাড়িদের সহযোগিতা চায়। বন্যার কান্নাকাটিতে খেমচং পাড়া ভারি হয়ে ওঠে। যে কোনো মূল্যে তার স্বামীকে বাঁচাতে হবে। কিছু দিন হয় তাদের বিয়ে হয়েছে। দুজনই ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সমস্ত ভাবনাগুলো কান্নায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মহাজনের কথায় পাড়া থেকে ৮ জন পাহাড়ি লোক শেষ পর্যন্ত রাত ১২টায় সাইংপ্রা ঝিরিতে রাজের কাছে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে অবস্থান করা ৬ জনকে তারা খেমচং পাড়ায় পাঠিয়ে দেয়।
যখন পাহাড়ি লোকজন নিশ্চিত হয় রাজের মৃত্যু হয়েছে, তখন তারা বিপাকে পড়ে যায়। তারা মুরং জাতিগোষ্ঠীর লোক। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী রাতের বেলায় তারা লাশ স্পর্শ করে না এবং পাড়ায়ও রাখে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, জন্তু-জানোয়ারের থাবা থেকে রক্ষা করতে রেইনকোট দিয়ে পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে লাশ ঝুঁলিয়ে তারা পাড়ায় ফিরবে।
রাত ২টা। একমাত্র রাজ ছাড়া সকলে খেমচং পাড়ায়। বন্যার কান্নাকাটিতে ফিরে আসা পাহাড়ি লোকজন রাজের মৃত্যুর খবর আড়াল করে জানান, জোঁক আর বৃষ্টির কারণে কোনোভাবে রাজকে আনা যায়নি। একটি জুমঘরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় রাজকে রাখা হয়েছে। তখন বন্যা রাজের কাছে যাওয়ার জন্য সবার কাছে আকুতি-মিনতি করে। কিন্তু গভীর রাত, বৈরী আবহাওয়া, দুর্গম পাহাড়ি পথ, তার ওপর সবাই ক্লান্ত হওয়ায় কেউ তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়নি।
এদিকে পাড়ার মহাজনের মাধ্যমে রাজের মৃত্যুর খবর অনেক জায়গায় পৌঁছে যায়। খবর পেয়ে মেনিকিউ পাড়ার সেনা ক্যাম্প থেকে চারজন সদস্য গভীর রাতেই বের হয় খেমচং পাড়ার উদ্দেশে। ভোর ৫টায় গিয়ে তারা খেমচং পাড়ায় পৌঁছে। তখন বন্যা আঁচ করতে পারে রাজ আর বেঁচে নেই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বন্যা। সেনা সদস্য ও পাড়ার লোকজনসহ ১৬ জনের একটি টিম রওনা হয় রেইনকোটে মোড়ানো রাজের লাশ উদ্ধার করতে।

:: নাজমুল করিম ফারুক : কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়