হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

নারীনেত্রীদের দৌড়ঝাঁপ

পরের সংবাদ

সর্বমানবিক স্বদেশ চাই

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সর্বমানবিকতার মানবিক উৎস হচ্ছে মানবিকতা। মানবিক শব্দটি থেকেই মানবিকতার উৎপত্তি। অন্য আরো অনেক ধারণাবাচক (পড়হপবঢ়ঃঁধষ) শব্দের মতো এটি একটি পশ্চিমি শব্দ বা পরিভাষা (ঃবৎসরহড়ষড়মু)। এই পরিভাষার ভাবচ্ছবি মনের মধ্যে মূর্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, প্রথাবিরোধী প্রখ্যাত ফরাসি লেখক ও দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্রের একটি বইয়ের শিরোনাম- ‘অস্তিত্বই মানবিকতা’ (খ’বীরংঃবহঃরধষরংসব বংঃ ঁহ যঁসধহরংসব)। এই অস্তিত্ব ব্যক্তিমানুষের, যে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার সামগ্রিক পরিপার্শ্ব।
কী বলছেন সার্ত্রে? তার কথায় মানবিক সচেতনতাই হচ্ছে অস্তিত্ব। মানুষ সচেতন প্রাণী, ফলে মানুষেরই রয়েছে অস্তিত্ব। মানুষ নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে আত্মসত্তা কীভাবে কতটা রক্ষিত হলো তারই নিরিখে। এই আত্মসত্তা আবার অপরাপর সত্তার সঙ্গে যুক্ত বা বিজড়িত। স্বদেশের কথা যখন বলব, তখন স্বদেশ একটি বিমূর্ত ধারণা, যা মূর্ত হয় স্বাদেশিক জনমণ্ডলীর মাধ্যমে। জনমানুষই স্বদেশ, স্বাদেশিকতার অর্থও জনমানুষ। ফলে আমার বলার বিষয়টি মানবিকতা ও জনমানসের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
বাংলা অভিধানে ‘মানবিক’ শব্দটির উৎস খুঁজতে গিয়ে আমি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ শব্দটি পাইনি। বিস্ময়কর হলেও বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক অভিধানে’ও পৃথক ভুক্তি হিসেবে শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ‘মানব’ থেকে ‘মানবীয়’ বলা হচ্ছে, যেখানে মানবীয় শব্দের দুটি অর্থ পাচ্ছি – একটি ‘মনুষ্যেচিত’, আরেকটি ‘মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক (মানবীয় গুণ)’। কিন্তু ‘মানবিক’ বলতে যে প্রগাঢ় অনুভূতি আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে, সে রকম কোনো ব্যাখ্যা তাতে নেই। এই যে অনুভূতির কথা বললাম, মানবিক শব্দটির সঙ্গে যে অনুভূতির সম্পর্ক নিবিড়, অনেক আগেই রামমোহন রায় তার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন তার সতীদাহ প্রথা রদ করবার আন্দোলনের কালে। ‘মানবিকতাকে’ যদি আরো বিস্তৃত করে ব্যাখ্যা করি তাহলে এর অনুষঙ্গে ‘মনুষ্যত্ব’ কথাটিও চলে আসে। রামমোহন থেকে প্রসারিত হয়ে পরবর্তীকালে এই মনুষ্যত্বের বোধ বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও প্রাধান্য পেয়েছে। তারা দুজনেই সাহিত্য-সৃষ্টির ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন মনুষ্যত্ব বা মানবিকতার আদর্শে। বাংলাদেশের সাহিত্যেও এর প্রতিফলন আমরা দেখব।
বিস্ময়কর নয় যে, ‘মনুষ্যত্ব কী’ এই জিজ্ঞাসাটা ‘আস্তিত্বিক’। পাশ্চাত্য দর্শনের অন্দরমহলে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, এই হিতবাদী বিষয়টি বহুকাল ধরে আলোচনার বিষয়আশয় হয়ে আছে। কান্ট, হেগেল, হুসের্ল, হাইডেগার প্রমুখ মনীষীর চিন্তায় সমৃদ্ধ এবং ফ্রেডেরিক নিচের একান্ত নিজস্ব ধারণার প্রভাবে ঋদ্ধ এই দর্শনের বিস্তার এতই বহুমুখী ও বহুবিধ যে, সারা বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান ক্ষেত্রে ভাবুকদের কাছে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সেই আঠার শতক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রায় তিনশ বছর ধরে। এই দার্শনিকদের লেখায় আলাপে-অনুলাপে, তর্ক-বিতর্কে, বিচার-বিবেচনায় সমৃদ্ধ। এরই প্রভাবে হাইডেগারের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হয়ে-ওঠা’, যার জার্মান নাম ‘সাইন উন্ড ৎসাইট’ (ঝরহব ঁহফ তবরঃ), ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ইবরহম ধহফ ঞরসব। খুব কি বিস্ময়কর লাগছে যখন এর সঙ্গে সার্ত্রের ‘ইবরহম ধহফ ঘড়ঃযরহমহবংং’-এর মিল দেখতে পাই?
মনুষ্যত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাইডেগার যে কথাগুলো বলছেন সেটা হলো, এটি মূলত মানবসত্তা বা মানবিকতার আস্তিত্বিক ধারণার সঙ্গে যুক্ত। ফলে ‘আমিত্ব’কে এখানে আমরা সাংসারিক অবস্থাবিশেষ, প্রাত্যহিকতার মধ্যে সত্রিয় ও সতেজ দেখি, যা অন্যান্যর সঙ্গে একত্রিত মৈত্রীবন্ধনে বৈরিতাকে নির্বিকার উদাসীনতায় দূরে সরিয়ে রাখে। তবে নৈকট্যে হোক বা দূরত্বেই হোক অন্য মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ ছাড়া নিখিল সামগ্রিকতার আদর্শ তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। সুতরাং মনুষ্যত্ব বা মানবিকতা কী? এই অনুসন্ধিৎসাই আসলে আমিত্বের চেষ্টা। পৃথিবীর পথে সহযাত্রী অপরাপর আমিগুলোর সঙ্গে একত্রে পা চালিয়ে সে বেঁচে থাকে। এই আমিত্ব আর অপরত্বের দার্শনিক দিক আছে। সেটা হলো- এক. হিতকারিতা (পধৎব), দুই. হিতৈষণা (পড়হপবৎহ), আর তিন. সামীপ্যবোধ (ফবফরংঃধহপরহম)। সর্বমানবিক স্বদেশের আলোচনা মূলত এখান থেকেই শুরু হতে পারে।


সর্বমানবিকতার কথা ভাবতে গিয়ে ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা আরো এগিয়ে বলেছেন ‘মানকেন্দ্রিকতার’ (ধহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মরংস) কথা। এই শব্দটির উৎস হচ্ছে গ্রিক ধহঃযৎড়ঢ়ড়ং। ইতালীয় রেনেসাঁস থেকে একেবারে আলোকনপর্ব (ঊহষরমযঃবহসবহঃ) পর্যন্ত দেরিদা লক্ষ করেছেন মানবিকতার দিকটি সমর্পিত ছিল ‘মানব-ঐক্যে’র প্রতি। ‘মানব’-এর ধারণা না গড়ে উঠলে ‘মানবীয় বিজ্ঞানে’র উন্মেষ হতো না। জাঁ-পল সার্ত্রে এই ভাবনার ওপর নির্ভর করেই রাজনীতিতে নৈতিকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করেছেন। দেরিদার মতে অস্তিত্ববাদীরাই প্রথম যারা ‘মানুষের অর্থ কী’ তার উত্তর খুঁজেছেন। দর্শনের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যাবে মানুষ, মানব, ব্যক্তিমানুষ, মানবিকতা- এসবের অর্থ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন বেশ কিছু দার্শনিক, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হানা আরেন্ট, হাবেরমাস ও দেরিদা। তারা পুরুষ বনাম নারী, মানবিক বনাম অমানবিক, মানুষ বনাম প্রাণী, যৌক্তিক বনাম অযৌক্তিক, সংস্কৃতি বনাম প্রকৃতি- ইত্যাদি নানা পরস্পর প্রতিস্পর্ধী ধারণার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনার কথা বিবেচনা করলে সর্বমানবিকতার ধারণাটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মনুষ্যত্বই হচ্ছে মূলত মানবিকতা, পরিব্যাপ্ত পৃথিবীতে যাবতীয় প্রাণকে অনুভব করা, সংরক্ষণ করা এবং লালন করাই সর্বমানবিকতা। যা কিছু মঙ্গলময়, সর্বমানবিকতার পরিসর তাতেও বিস্তৃত। সবকিছুর অস্তিত্ব অনুভব করা ও রক্ষা করার সঙ্গে সর্বমানবিকতার সম্পর্ক। মানুষের ইতিহাস তাই মনুষ্যত্বের আস্তিত্বিক ইতিহাস ও তার আত্মবিকাশের কাহিনি। অস্তিত্বমাত্রই অন্যান্য মানুষ ও প্রাণের সঙ্গে একত্রে বেঁচে থাকা। এর মাধ্যমেই মানুষ অপরত্ববোধের বোধ ও জ্ঞান অর্জন করে।
হাইডেগার এ প্রসঙ্গে একটা পৌরাণিক গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। গল্পটি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন জার্মান পণ্ডিত কে বুর্ডাখের প্রবন্ধ ফাউস্ট উন্ড্ ডি সর্গে থেকে। গ্যেটে এই পুরাকথাটি নতুন করে সাজিয়ে লেখেন তার ফাউস্ট গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে। গল্পটি এবার বলি :

একদা মিসেস হিতকারিতা একটা নদী পেরোচ্ছিলেন। নদীর ধারে কিছুটা কাদামাটি তার চোখে পড়ল। তিনি কী ভেবে সেই মাটির খানিকটা তুলে হাতে নিয়ে কিছু একটা বানিয়ে ফেললেন। জিনিসটা কী বানালেন তাই যখন ভাবছেন, এমন সময় দেবরাজ জুপিটার সেখানে এসে হাজির। হিতকারিতা তাকে বললেন, আপনি ওকে চৈতন্য (ঝঢ়রৎরঃ) দিন। জুপিটার সানন্দে সে অনুরোধ রক্ষা করলেন। কিন্তু যখন কথা উঠল ওই সচেতন সত্তাটির নাম কী হবে এবং হিতকারিতা তার নিজের নামে নামকরণ করতে চাইলেন, জুপিটার তাতে সম্মত না হয়ে দাবি করলেন যে নাম দেয়া হবে তারই নামে। এই নিয়ে দুজনের তর্কাতর্কি যখন চলছে, তখন মৃত্তিকা মাটি ফুঁড়ে উঠে এসে বললে যে এত বাগ্বিতণ্ডায় কাজ কী? নামটা তারই নামানুযায়ী হোক, কেননা এই জীবটি তো তৈরি হয়েছে তারই শরীরের উপাদান দিয়ে। শেষমেশ তারা এই বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য স্যাটার্নের কাছে গেল। স্যাটার্ন সব কিছু বিচার করে এই রায় দিলেন, যা তারা সবাই ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নিল :
“তুমি জুপিটার যেহেতু এর প্রাণ দিয়েছ, তুমি সেই প্রাণ ফিরে পাবে এর মৃত্যুতে; আর তখনই তুমি এর শরীরটা পাবে, কারণ তুমিই তাকে শরীর দিয়েছ। কিন্তু যেহেতু হিতকারিতাই প্রথমে এ জীবটিকে গড়েছিল, তাই এটি তারই হবে যতদিন সে বেঁচে থাকে। আর যেহেতু তোমাদের মধ্যে এত ঝগড়া এর নাম নিয়ে, আমার মতে এর নাম হওয়া উচিত ‘হোমো’, কেননা এটা তৈরি হয়েছে ‘হুমুস্’ (মাটি) দিয়ে।”
এই কাহিনির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাইডেগার লিখেছেন, এর উদ্দেশ্য শুধু এ কথাই বলা নয় যে, মানবিক অস্তিত্ব সবসময় হিতকারিতার জিম্মায় থাকবে। কেননা এখানে আরো দেখানো হচ্ছে যে হিতকারিতার গুরুত্ব এই যে, তা মানুষকে ‘শরীর (মৃত্তিকা) ও প্রাণের সমাহার রূপে’ ব্যাখ্যা করে। এই সত্তার ‘উৎপত্তি’ তার হিতকারী অস্তিত্বেরই মধ্যে। অর্থাৎ হিতকারিতাই সাংসারিক অস্তিত্বের স্বভাবগত। আর মানুষ (যড়সড়, হোমো) নামটাও মূলত তার প্রাকৃতিক উপাদান যে ‘হুমুস’ (যঁসঁং), তারই প্রকাশ। বিচারকের ভূমিকায় স্যাটার্নের প্রাধান্যও অর্থবহ। কেননা স্যাটার্ন (জার্মানে, সাটুর্ন) সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই মনুষ্যত্ব বা মানবিকতার মর্ম যা এই পুরাকাহিনির বৃত্তে বিবৃত হয়েছে তা গোড়া থেকেই জগৎসংসারে অস্তিত্বের কালযাত্রার বিবরণ।


বোঝাই যাচ্ছে, হিতৈষেণা বা সর্বমানবিকতা হচ্ছে বহুত্ববাদ। নৈকট্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সামীপ্যের মধ্যেই মিলবে এর স্বার্থকতা। আমরা যে সর্বমানবিকতার কথা বলছি, তা মূলত দেশকাল ছাড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী ব্যাপ্ত। সত্য, সুন্দর, প্রেম, সাম্য, স্বাধীনতা, অধিকার, সামাজিক শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ, সততা, গণতান্ত্রিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ইতিবাচকতা, নান্দনিকতা, দায়িত্বশীলতা, সংহতি, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ, শুদ্ধাচার অবধি ব্যাপ্ত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা এই গুণাবলির অধিকাংশই আমরা লক্ষ করেছি বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে। একে আরো আগে দার্শনিক ভাবনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। উল্লিখিত মানবিক দিকগুলোর প্রায় সবকিছুর ব্যাখ্যা মিলবে- কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংগীত অর্থাৎ তার সব ধরনের রচনায়। আমি এখানে তার গদ্য থেকে দু-একটা উদ্ধৃত দিচ্ছি :
‘মনুষ্যত্বের অপমান হয় তাহা কখনোই উন্নতির পথ হইতে পারে না।’ (ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬৯৪)

“‘আমি’কে যে যত দূরে সরাইয়াছে জগতের মধ্যে সে ততই সাম্য দেখিয়াছে। যেখানে যত বিবাদ, যত অনৈক্য, যত বিশৃঙ্খলা, ‘আমি’টাই সকল নষ্টের গোড়া, যত প্রেম, যত সদ্ভাব, যত শান্তি, আমার বিলোপই তাহার কারণ।” (সপ্তদশ খণ্ড, পৃ. ৫৭৪)

‘আমরা সংহতিকে অধিকার করিয়া ব্যাপ্তিকে জিতিব- মনুষ্যত্বের এই সাধনা।’ (প্রাগুক্ত, ৫৭৫)

‘যেখানেই মানুষ প্রেম রোপণ করে, দেখিতে দেখিতে সেই স্থান প্রেমের শস্যে আচ্ছন্ন হইয়া যায়। মানুষ চলিয়া যায় কিন্তু তাহার প্রেমের পাশে পৃথিবীকে সে বাঁধিয়া রাখিয়া যায়।’ (প্রাগুক্ত, ৫৬৯)

সাহিত্য হচ্ছে সেই মাধ্যমে যেখানে এই সর্বমানবিকতার কথা খুব ভালোভাবে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সাহিত্যেও, আগেই বলেছি, এর বহুমাত্রিক প্রতিফলন, প্রতিসরণ লক্ষ করব।


সমকালীন বাংলাদেশের কথা যদি ভাবি, জনমানুষের ভৌগোলিক বাংলাদেশকে, তাহলে লক্ষ করব মনুষ্যত্বের অপমান আমাদের ঘিরে আছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে বন্ধন, প্রীতি ও মৈত্রীর সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন তার বিলুপ্তি ঘটছে। ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহর, শিক্ষিত-নিরক্ষর মানুষের শ্রেণিবিভাজন, হিংস্রতা প্রকট। আর্থিক দুর্নীতি, ক্ষমতার দম্ভ, অহংবোধ ক্রমশ বাড়ছে। নারী-পুরুষের বৈষম্য আজো ঘোচেনি, বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে সম্মান করবার উদারতা এখনো দৃশ্যমান নয়। দারিদ্র্য যদিও ধীরে ধীরে ঘুচে যাচ্ছে, তবু এখনো বহু মানুষ দারিদ্র্যের অবমাননা সয়ে জীবন নির্বাহ করছে। এর সবই অমানবিক, সর্বমানবিক হয়ে উঠবার পথে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। কিন্তু কীভাবে এর অবসান হতে পারে? কী করে আমরা একটা সর্বমানবিক স্বদেশ পেতে পারি? আগে আমি যে মানবিক ও অমানবিক পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছি, তারই আলোকে বলা প্রয়োজন, যা কিছু অমানবিক তার অবসান হওয়া দরকার, আর যা কিছু মানবিক, চাই তার চর্চা ও বিকাশ। এটি শুরু হয়েছে বলতে পারি, গত পনেরো বছরে এমন কিছু জনবান্ধব কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ সর্বমানবিকতার পথে যে অগ্রসর হচ্ছে সে কথা বলা যায়।

সর্বমানবিকতার প্রসঙ্গে রামমোহনের সমাজ সংস্কারের কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ চমৎকার একটি উপায় নির্দেশ করেছেন। রণজিৎ দেখেছেন, সনাতন শাস্ত্রানুরাগীদের প্রবল বিরুদ্ধতার মধ্যেও রামমোহন যে সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে পেরেছিলেন, তা তার মানবিক ‘অনুভূতি’র কারণে। একেই ইংরেজিতে বলে এমপ্যাথি। মানুষের মধ্যে এই অনুভূতির ঝোঁক না থাকলে সে কখনো মানবিক হতে পারে না। পোস্টমর্ডানিস্ট ফরাসি তাত্ত্বিক জাঁ-ফ্রাঁসোয়া লিওতার বলেছেন, এই ঝোঁকটা হচ্ছে সুখ বা দুঃখের অনুভূতিতে কল্পনা ও বোধের দ্বৈতলীলার ফল। কান্টও বলেছেন এই অনুভূতির কথা। তিনি মনে করেন, মনুষ্যপ্রকৃতিতে এক ধরনের সহজাত অনুভূতি আছে নৈতিকতা, যার অন্যতম উপাদান। এই নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে কর্তব্যবোধ, আত্মানুভূতি ও সহানুভূতি। আধুনিক কালে আমাদের সময়ে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে এসবেরই নতুন করে উদ্বোধন হওয়া প্রয়োজন, তাহলেই আমরা এমন একটি দেশ পাব, যা মূলত হয়ে উঠবে সর্বমানবিক। এই মানবিকতার পরিসরে, দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রাণী, তৃণলতা, বৃক্ষ, সবকিছুই এমনভাবে সমীকৃত থাকবে যাতে মানুষের জীবন হয়ে উঠতে পারে কল্যাণকর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়