গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

সরকারের তিন অগ্রাধিকার

পরের সংবাদ

সাহিত্যের ছোটোকাগজ ‘অগ্নিশিখা’ সম্পর্কে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নানা মাত্রায় বিকশিত হয়। একটা জাতি দীর্ঘদিনের অনুশীলনের মাধ্যমেই তার স্বকীয়তা মজবুত করে। বাঙালি জাতির মননে এ অঞ্চলের সাহিত্যচর্চা বড়ো প্রভাব বিস্তার করে আছে। মানুষের অস্তিত্বের যে যন্ত্রণা তা উসকে দিতে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে ছোটোকাগজ। ছোটোকাগজ কেবল বিকল্প চিন্তা নয় একটি আন্দোলনও। অগ্নিশিখা’র জন্ম ১৯৮৭ সালে। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কেবল দানা বাঁধতে শুরু করেছে। রাজনীতির মাঠে প্রতিবাদের আগুন জ্বলছে। ঠিক তখন একঝাঁক প্রতিশ্রæতিশীল তরুণ লেখক প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিল লিটলম্যাগকে। বের করল অগ্নিশিখা, সাহিত্যের ছোটোকাগজ। গ্রামসুরমা প্রেস (কবি ও সাংবাদিক মহিউদ্দিন শীরুর মালিকাধীন, সুরমা মার্কেট, সিলেট) থেকে সুমন বনিকের সম্পাদনায় তিন ফর্মার অগ্নিশিখা প্রকাশিত হলো। সেই থেকে যাত্রা শুরু। জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের আশীর্বাদধন্য অগ্নিশিখা। বরেণ্য কবি সুফিয়া কামালের কবিতা অগ্নিশিখায় ছাপা হয়েছে ১৯৯০ সালে। পরবর্তীতে তার স্বহস্তলিখিত কবিতাটি এবং আশিসবাণী হুবহু অগ্নিশিখায় পুনর্মুদ্রিত হয় ২০২০ সালে। অন্যান্য ছোটোকাগজের মতো অগ্নিশিখার জার্নি মোটেই সুখকর ছিল না। গতি রুদ্ধ হয়, দীর্ঘ একটা সময় অগ্নিশিখা প্রকাশিত হয়নি। তবে অগ্নিশিখার অকালমৃত্যুতে কোনো শোকসভা হয়নি। কারণ একটা চেতনা, অদৃশ্য তাড়না সবসময়ই পোকার মতো ওঁদের মগজে কামড়িয়েছে। তাই প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়া অগ্নিশিখা আবারো প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং সব ঝড় ঝঞ্জা ঝেড়ে ফেলে নবোদ্যমে অগ্নিশিখা এখন নিয়মিত। অগ্নিশিখার বিষয়ভিত্তিক সংখ্যাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। স¤প্রতিকালের তাদের কয়েকটি সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। অগ্নিশিখার কবিতা ও কবিতাবিষয়ক ভাবনা সংখ্যা, করোনাকালের শোকগাথা, লোকমহাজন সংখ্যা, হাওরপারের লোকগান সংখ্যা ইত্যাদি সংখ্যাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা এবং এগুলো গবেষকদের গবেষণা কর্মের রসদ বলে মনে করি। প্রসঙ্গত অগ্নিশিখার ২০২৩ এ প্রকাশিত হাওরপারের লোকগান সংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। যা থেকে ‘অগ্নিশিখা’র বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশের গুরুত্ব অনুধাবন করা যাবে। এবং তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা পেতে পারি :
‘বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা- এই সাতটি জেলার প্রায় কোটি মানুষ হাওরপারের বাসিন্দা। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার নাম হাওরজীবন। এত-এত দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও স্বপ্ন আর আশার যুগপৎ মৌতাতে মগ্ন হাওরবাসী। হাওরের মানুষ জীবনের রং ছড়াতে মেতে ওঠে বারো মাসে তেরো পার্বণে। প্রকৃতিজ হাওরপারের বাউল-ফকির মরমের তত্ত্ব-তালাশে গানবাঁধে, হাওরের লিলুয়া বাতাসে ভেসে ভেসে সেই সুর ঘুরে বেড়ায় বিশ্বচরাচরে। ঘাটুগান, উরিগান, ফকিরিগান, মালজোড়া গান, ঢপযাত্রা, পুঁথিপাঠ, কিচ্ছা, মনসা পালা, ধামাইল, কীর্তন কী নেই হাওরপারের রতœভাণ্ডারে!
হাওরপারের এসব লোকগান নিয়ে অগ্নিশিখার এবারের সংখ্যা বের হলো। এবারের সংখ্যাটি দুটি পর্বে সাজানো হয়েছে, আছে হাওরপারের বাউল আবদুর রহমানের সাক্ষাৎকার। প্রথম পর্বে হাওরপারের লোকগানের বিষয়-আশয় নিয়ে লিখেছেন বিদগ্ধ লেখকগণ। তাদের মূল্যবান লেখাগুলো লোকগানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট/সঙ্গতিপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক।
ডক্টর মোস্তাক আহমাদ দীন মরমিকবি/বাউলের সান্নিধ্যে এসে উপলব্ধি করেছেন, ‘কঠিন জগৎ ছেড়ে হঠাৎ একদিন মানুষেরা বিদায় নেন, কিন্তু ঠিক কোথায় যান, কোথায় হারিয়ে যান জানি না। কারণ লোকসমাজে লুকিয়ে-থাকা মানুষরতনের সঙ্গে আমাদের একটু-আধটু জানাজানি হয় মাত্র, কিন্তু বহু কানাকানি বাকি থেকে যায়।’ কী নিগূঢ় তত্ত্বকথা!
‘পূর্ববঙ্গ গীতিকায় হাওরের গান’ প্রবন্ধে ডক্টর তপন বাগচী লিখেছেন, ‘গীতিকা নিজেই লোকসংগীতের গর্বিত আঙ্গিক। কিন্তু এই গীতিকার কাহিনীর ভেতেরও রয়েছে স্থানীয় সংগীতের কথা। এ সকল কাহিনির চরিত্রেরাও গান গায়। গানের ভেতরে এই যে গান, তা এই হাওর অঞ্চলেরই লোকসংগীত।’ তপন বাগচী পালাগান, বারোমাসি গান, সারিগান ইত্যাদি লোকগানের উদ্ভব, বিকাশ ইত্যাদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তার লেখা পাঠককে গভীরে তলিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করবে। আহমেদ স্বপন মাহমুদের লেখাটি দুটি অংশে ভাগ করা। লেখার ভূমিকা অংশে তিনি বাংলার ভাবচর্চার নিগূঢ় তত্ত্ব আলোচনা করেছেন। আহমেদ স্বপন মাহমুদ তার লেখায় বলেছেন, ‘বাংলার ভাব ও ভাবচর্চার জায়গা কাব্য ও দর্শনের মাঝে কোনো ভেদরেখা ও সীমারেখা বেঁধে এগিয়ে যায়নি। সীমারেখা নাই-ও। আদতে বাংলার ভাব ও মরম বাংলার ভাবুক-বাউল-সাধকদের দর্শনচর্চারই একটি রীতি।’ তার লেখা পাঠককূলকে বাউলের তত্ত্ব-তালাশে উদ্বুদ্ধ করবে। আহমেদ স্বপন মাহমুদ অগ্নিশিখার ‘হাওরপারের লোকগান’ সংখ্যাটিকে ‘হাওরপারের কাব্য’ বা ‘হাওরপারের লোককাব্য’ হিসেবে দেখার অভীপ্সা ব্যক্ত করেছেন। তার অভিমতকে মান্য করি। হাওরপারের গানের একাল-সেকাল তুলে ধরে সুমনকুমার দাশ লিখেছেন, ‘ছোটোবেলা থেকেই নানা উৎসব-পার্বণ উপলক্ষ করে মেতে ওঠা হাওরবাসীর নির্মোহ আনন্দ-উচ্ছ¡াসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড়ো হয়েছি। তাই আমি ভালো করেই জানি বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে বুক চিতিয়ে চলা ভাটির মানুষের কণ্ঠে গান অনেকটা আপনা-আপনিই ধ্বনিত হয়। শুকনো মরসুমে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানখেতে ভোরের আলোয় স্নাত কৃষক মনের আনন্দে সুর ভাঁজেন। অঞ্চলজুড়ে যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান, কীর্তন, গাজীর গান, ভাটিয়ালি, ধামাইলগান, মালসিগান, বারোমাসি, সূর্যব্রতের গানসহ কত ধরনের গানের প্রচলন রয়েছে।’ সুমনকুমার দাশের লেখায় হাওরপারের চিরায়ত রূপ দর্শন করি। তার মৃত্তিকাসংলগ্ন জীবন ঘনঘনিষ্ঠ অভিব্যক্তিতে হাওরপারের শাশ্বত রূপ আমরা অবলোকন করতে পারি।
হাওরপারের বিভিন্ন লোকগানের রতœগর্ভ থেকে মণি-কাঞ্চন তুলে এনে অগ্নিশিখার জন্য প্রবন্ধ/গদ্য লিখেছেন ফকির ইলিয়াস, ডক্টর জফির সেতু, মোহাম্মদ সুবাস উদ্দিন, সজল কান্তি সরকার, পার্থ তালুকদার, সঞ্জয় সরকার, নিরঞ্জন দে। দীর্ঘকাল লোকগবেষণায় তারা নিবিষ্ট/নিমগ্ন। ডক্টর জফির সেতু ঘাটুগান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্মসম্পাদন করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি ঘাটুগানের আদ্যোপান্ত তুলে ধরে একটি মহার্ঘগ্রন্থ রচনা করেছেন। লোকসংস্কৃতির অন্বেষক পার্থ প্রতিম নাথ, অসীম সরকার, শেখ মোবারক হোসাইন সাদী। তাদের লোকচর্চার পরিধিও বেশ বিস্তৃত। পাঠককূল লেখাগুলো পড়ে আবিষ্ট হবেন, ঋদ্ধ হবেন। বিদগ্ধজনদের লেখা-থেকে হাওরপারের লোকগানের বর্ণিল-বিচিত্র ভাব ফুটে উঠেছে। যা ভাবুক পাঠককূলের মরমে স্পর্শ করবে। অগ্নিশিখা, হাওরপারের লোকগানের বিশাল রতœভাণ্ডার থেকে লোকগানের গুটিকতক হীরে-পান্না-জহরত কুড়িয়েছে মাত্র। তবে আমাদের প্রচেষ্টায় মমতামাখা ছিল, ছিল অকৃত্রিম দায়িত্ববোধ।
হাওরপারের নিভৃতচারী বাউল আবদুর রহমান। বাউল শাহ আবদুল করিমের অন্যতম প্রধান শিষ্য। বাউল রহমান ভাইয়ের সঙ্গলাভে বাউলতত্ত্ব/ মরমের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেছি। কিভাবে আবদুর রহমান বাউল হয়ে উঠলেন, সেই জার্নিটাও সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে। (অগ্নিশিখা, হাওরপারের লোকগান সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০২৩)। সম্পাদকের বয়ান থেকে আমরা এই লিটলম্যাগের রুচিবোধ এবং কমিটম্যান্ট সম্পর্কে কিছু ধারণা অর্জন করি। তাদের মৌলিক সাহিত্যকর্ম সত্যিই প্রশংসনীয়।
অগ্নিশিখার প্রতিটি সংখ্যায় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদের লেখাও ছাপা হচ্ছে। লিটলম্যাগের মূল কাজটিই হচ্ছে, নতুন লেখক সৃষ্টি করা। অগ্নিশিখা পরম যতেœ এবং দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজটি করে যাচ্ছে। ওরা একটা কমিটমেন্টের জায়গা থেকে কাজ করছে। সেই কমিটমেন্টটি হচ্ছে- শুদ্ধ সাহিত্যচর্চাকে উসকে দেয়া, সত্য-সুন্দর, মৃত্তিকাসংলগ্ন সাহিত্যচর্চার পথে এগিয়ে যাওয়া। কিছুটা নীরবে-নিভৃতে অগ্নিশিখা সাহিত্যচর্চার এবড়োখেবড়ো পথে হাঁটছে। কখনো কখনো হোঁচট খেয়েও দমে যায়নি। অর্থ সংকটের টানাপড়েন সহ্য করেও অগ্নিশিখা প্রকাশিত হচ্ছে। লিটলম্যাগ প্রকাশে অর্থের অভাব একটি বড়ো বাধা। সুমন বনিক সম্পাদিত অগ্নিশিখা, সেই বাধা মোকাবিলা করেই এগিয়ে চলছে। ছোটোকাগজ আন্দোলনে অগ্নিশিখা তার পথ খুঁজে পেয়েছে, এখন কেবল এগিয়ে যাওয়া। স¤প্রতি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বগুড়া লেখক চক্র কর্তৃক লিটলম্যাগ সম্পাদনায় অগ্নিশিখা সম্পাদক সুমন বনিক পুরস্কৃত হয়েছেন। এই অর্জন সাহিত্যের ছোটোকাগজ হিশেবে অগ্নিশিখাকে উজ্জ্বল করেছে নিঃসেন্দহে। জয়তু ‘অগ্নিশিখা’।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়