গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

সরকারের তিন অগ্রাধিকার

পরের সংবাদ

নেকবান্দা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আবুল মিয়ার বুকের ভেতর যেন বাদ্য বাজছে। সে তার নিজের হার্টবিট যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ। রহিম চাচাকে অনেক বলার পর আজ সে মসজিদের বড় হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পেয়েছে। তা না হলে তার মতো মানুষের পক্ষে উনার সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব ছিল না। উঠানের বাইরে বড় বেঞ্চটাতে এক কোনায় বসে বসে ভাবছিল বড়লোকদের বাড়িতে ঠাণ্ডা মেশিনে ঠাণ্ডা পানি, বরফ থাকে। যদি এক গøাস ঠাণ্ডা পানি দিত কেউ ভাবতেই আবুল মিয়ার তৃষ্ণা আরো বেড়ে গেল। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। কখন যে হুজুর দয়া করে তাকে ডাকবে কে জানে। ঘণ্টা দুই পর তার ভেতরে ডাক পড়ল।
আবুল মিয়া সালাম দিয়ে হুজুরের দিকে তাকাতেই তিনি কঠিন এক ধমক দিলেন। রহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, এইটা কারে নিয়া আসছ? এই ব্যাটাতো ভালো কইরা সালাম দিতেই পারে না। আবুল এবার ভয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। বড় হুজুর এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো? তোমাকে খুব একটা মসজিদে দেখেছি বলেতো মনে হয় না।’
এবার সে জবাব দিল, জি হুজুর আমি মসজিদেই নামাজ আদায় করি। আমরা কয়জন সবসময় পিছের সারিতে বসি, তাই আপনার নজরে পড়ি নাই মনে হয়।’
এবার বড় হুজুর গলা খাঁকারি দিয়ে কঠিনভাবে বলে, ‘মসজিদের উঠান পরিষ্কার করা, অজুখানা সাফ করা হবে তোমার কাজ। মসজিদের ভেতরে খবরদার তুমি আসবা না। এ কাজের জন্য আলাদা নেক লোক নিয়োগ আছে। তবে দুই মাস পরে তুমি কাজ পাইলে পাইতে পার।’
আবুল খুব নিরাশ হয়ে ভাবছিল, তার বউটা পোয়াতি। ঘরে একমুঠ চাল নেই। যদি কাজটা পায় তাহলে সে বেঁচে যায়। মসজিদে প্রায়ই মিলাদ হয়। তাই জিলাপি, বিন্নি, বাতাসা আবার কেউ খাবার প্যাকেটও দেয়। যদি সে একটু পায় তাহলে তাদের দুজনের খাবার অভাব হবে না। আর মসজিদ কমিটি থেকে মাস গেলে হাজার চারেক টাকা মন্দ না। রহিম চাচা এবারে বললেন হুজুর এই ছেলেটার স্বভাব-চরিত্র ভালো। বড়ই অভাবী। তাই বলছিলাম অন্য কিছু যদি এখনকার জন্য করতে পারে। বড় হুজুর ভ্রæ কুঁচকে আবুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি তুমি গজল জান? সুর করে হামদ নাত শোনাতে পার? যদি পার তাহলে রমজানের সময় তোমাকে একটা কাজ দেয়া যায়। সেহেরির সময় মানুষের ঘুম থেকে সজাগ করা তোমার কাজ। রাত দুইটা থেকে পুরা গ্রাম হাঁটবা আর জোরে জোরে গজল গাইবা। এতে তোমার অনেক নেকি হবে। কি মিয়া পারবা না?’
আবুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। বলে, ‘আমি অনেক জোরে আওয়াজ করতে পারি।’ বড় হুজুর বিরক্ত হয়ে রহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এইটা কারে আনছো? এ দেখি কিছুই পারে না।’
যাই হোক আবুলের রমজানের সময় রাতের চাকরিটা হয়ে গেল। সে প্রতি ভোর রাতে মুমিনগণ সেহেরি খাওয়ার সময় হয়েছে এবার ঘুম থেকে উঠুন এভাবেই সবাইকে ডাকতে থাকে। তার ডাক শুনে গ্রামের মানুষ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সেহেরির আয়োজন করে। আজ দিয়ে সাত দিন আবুল এই কাজ করছে।
তার বউটা পোয়াতি হবার পর থেকেই শুধু এটা-সেটা খাওয়ার বায়না ধরে। আজ বলল রোজায় সবাই ছোলা, পিঁয়াজু, মুড়ি দিয়ে ইফতার করে। আমরাও একদিন তেমন কইরা ইফতার করি। পাশের বাড়িতে দেখলাম তরমুজ কাটছে। ভেতরে টকটকে লাল। এরপর লজ্জানত হয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবদারের সুরে বলে, ‘একদিন তরমুজ আইনেন।’
আবুল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারও যে এসব খেতে মন চায়। সে মনে মনে ভাবল বউকে নিয়ে সে একদিন এ রকম ছোলা, পিঁয়াজু আর তরমুজ দিয়ে ইফতার করবে। প্রতিদিন সেহেরিতে থেকে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে রেখে ইফতারে তারা দুজন মিলে সেই পানিভাত খায়।
পরের দিন চেয়ারম্যান সাব মসজিদের ইমামসহ বড় হুজুর আর মসজিদের খাদেমদের জন্য ইফতার পাঠান। মসজিদের উঠানে থেকেও সেই খাবারের সুঘ্রাণ টের পাচ্ছিল সে। সারাদিনের রোজার পর তার ক্ষুধা যেন অনেক গুণ বেড়ে গেল। তার মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস নেই। বড় হুজুর বললেন শোন মিয়া, ‘ইফতারের পর আইসা সব সাফ সুতারা করবা।’
সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
আবুল যেন তক্কে তক্কে ছিল। সবার খাবার শেষ হলে সে সবার অগোচরে উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো একটা পলিথিনে সযতেœ তুলে রাখে। তারপর সে দ্রুত হাতে পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে যায়।
বাড়ি গিয়ে বউয়ের হাতে পলিথিন তুলে দেয়। বউ পলিথিন উপুড় করে ঢালতেই একসঙ্গে মুড়ি, ছোলা, পিঁয়াজু, জিলাপি দেখতে পায়। তার দীর্ঘদিনের ক্ষুধা যেন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সে পরিতৃপ্তি নিয়ে গোগ্রাসে খেতে থাকে। আবুল মিয়া বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে আহা বউটারে সে ভালো-মন্দ খেতে দিতেও পারে না। বউয়ের উচ্ছ¡াস দেখে তার চোখে পানি চলে আসে। কিছুক্ষণ পর বউ তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনে খাইবেন না?’
আবুল তাড়াতাড়ি চোখের পানি লুকায়, বলে, ‘বউ আমি খাইয়া আসছি। আমারে হুজুর এত্ত এত্ত ইফতারি দিছিল বলে সে বউকে দেখাতে মিথ্যা ঢেঁকুর তুলে।’
সেইদিন রমিছা দাই বলছে সময় হইয়া আসছে এই ঈদের পর পরই তার ব্যথা উঠতে পারে। সেই হিসাবে এই মাসেই তার সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা। আজ ছাব্বিশ রোজা। কাল সাতাশ রোজার দিন তারাবির পর মসজিদে বিরাট ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থা করেছেন গ্রামের চেয়ারম্যান সাব। পুরো গ্রামে যেন সাজ সাজ রব। মসজিদের সামনের খোলা মাঠে বিশাল শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে মুসল্লিদের বসার জন্য। আজ আবুল মিয়ারও অনেক দায়িত্ব সে সবার ফাই ফরমাস খাটছে। মসজিদের চারপাশের রাস্তা সে ঝাড়– দিয়ে সুন্দর সাফ করে দিয়েছে।
দুপুরে বাড়ি যেতেই বউয়ের কান্নার আওয়াজ কানে আসে। বউ তার মাছের মতো মাটিতে গড়াগড়ি করে কাতরাচ্ছিল। এক দৌড়ে গিয়ে সে রমিছা দাইকে ডেকে আনে। আবুল মিয়ার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই আজ। তার আজ কত কাজ, অথচ বউটার কিনা আজই ব্যথা ওঠল। সে বাড়ির উঠানে অনবরত পায়চারী করছিল। এদিকে বড় হুজুর তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।
ঘণ্টা দুয়েক পর রমিছা দাই মুখ কালো করে বেরিয়ে আসে, বলে বাচ্চা উপরের দিকে। তোমার বউ অনেক কাহিল। আমি পারতেছি না। তুমি গঞ্জে থিকা ডাক্তার নিয়া আস। আবুল দৌড়ে রহিম চাচার কাছে যায়। রহিম চাচার থেকে কিছু টাকা নিয়ে সে ডাক্তার ডাকতে ছুটে। ডাক্তার এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলে রোগীকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান। উনার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নয়।
আবুল মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বড় হুজুরের কাছে যায়। তাকে দেখেই হুজুর তেলেবেগুনে রেগে যান। বলেন, ‘তুমি কাজ ফেলে কই ছিলা এত বেলা? এইদিকে কত শত কাজ। তুমি মিয়া বড়ই ফাঁকিবাজ।’
এইবার সে অনুনয়-বিনয় করে বলে, ‘আমারে এই মাসের বেতনডা দিয়া দেন। সঙ্গে যদি কিছু অগ্রিম দেন তাইলে বড় উপকার হয়।’ বলে হুজুরের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বড় হুজুর পা ছাড়িয়ে নেন। বলেন, ‘কর কী! আমার অজু নষ্ট হইব। তোমার নাপাক হাতে খবরদার আমাকে ছুঁইবা না। মাস শেষ না হইতেই বেতন চাও কোন আক্কেলে? সবকিছুর একটা নিয়ম-নীতি আছে না।’
সে তার বউয়ের অসুস্থতার কথা বলতেই হুজুর বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘গ্রামের সব মেয়েছেলের দাইয়ের হাতে বাচ্চা হয় তোমার বউ কোন লাটসাহেব যে তার হাসপাতালে যাইতে হবে। আমি কিছু করতে পারব না। মসজিদ কমিটির প্রধান চেয়ারম্যান সাব তারে বইলা দেখতে পার।’
অনেক অনুনয়ের পর চেয়ারম্যান সাবের দেখা পেল আবুল। সে তার বউয়ের চিকিৎসার কথা বলতেই তিনি রেগে যান। বলেন, ‘আজ আমার কত কাজ। গাড়ি পাঠিয়ে ইমাম সাহেবকে আনতে হবে। তার জন্য বিশেষ খানাপিনার আয়োজন আছে। আর মসজিদ কমিটির সব টাকা বড় ওয়াজ মাহফিলের জন্য বরাদ্দ। এখান থেকে তোমাকে টাকা দেবার কোনো নিয়ম নেই। তুমি অন্য ব্যবস্থা কর।’
আবুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তার শেষ আশা চেয়ারম্যান সাব যদি না দেয় তাহলে সে কী করবে।
আজ সারা গ্রামে যেন উৎসবের আয়োজন। মসজিদের কাছে বড় মাঠে ছাউনি টানিয়ে লাকড়ির চুলায় বড় ডেকচিতে গরুর মাংস, খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। আজ সব নেকবান্দা সারারাত ইমাম সাহেবের ওয়াজ শুনবে, তারপর সবাই একসঙ্গে সেহেরি করবে। সবাই চেয়ারম্যান সাব আর বড় হুজুরের গুণগান করছে। আহা চেয়ারম্যান সাবের দয়ার শরীর। এই আয়োজন তিনি নিজেই তদারকি করছেন। সামনে ইলেকশন। তিনি সবার হাসিমুখ দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। না; তার জয় এইবারও কেউ ঠেকাতে পারবে না।
আবুল মিয়া তার বাড়ির পথে রওনা দেয়। রাতে দূর থেকে ইমামের গুরু গম্ভীর গলায় ওয়াজের শব্দ ভেসে আসে। পরকালে নেকবান্দার জন্য কত আয়োজন তা নিয়ে সুর করে বলছেন। শুনতে শুনতে সব মুমিন মুসল্লিদের চোখের পানিতে জায়নামাজ ভিজে যায়। ওদিকে আবুল মিয়ার বউ জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। আবুল মিয়া অসহায়ের মতো কাঁদছে। শুধু তাদের পাশে কেউ নেই। তাদের চোখের পানি কাউকে স্পর্শ করতে পারল না।

(এইবার আমাদের এলাকায় একজন ভোররাত থেকে ‘সেহেরি খাবার সময় হয়েছে সবাই উঠুন’ এই বলে সারা এলাকায় ঘুরেছেন। সাধারণত আগে কাউকে গজল গাইতেই শুনতাম। এইবার ভিন্ন। উনার ডাকেই আমার ঘুম ভেঙেছে। এই কণ্ঠ শুনেই আমার আবুল মিয়া চরিত্রটি কল্পনায় আঁকা।)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়