নির্বাচন নিয়ে ডিএমপির সঙ্গেমার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক : মধ্যাহ্নভোজ করালেন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন

আগের সংবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে তিন চ্যালেঞ্জ : ভোটার উপস্থিতি, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা, প্রার্থীদের বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

মানজুর মুহাম্মদের বিহঙ্গ ও কবিতাভুবন : জন্মদিন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিগত কুড়ি শতকের নব্বইয়ের দশকে একটি স্বচ্ছ মন ও মননের দ্যুতি নিয়ে সাহিত্যের ভুবনে আসেন মানজুর মুহাম্মদ। সেই সময় থেকে বাংলাদেশের মনন ও সৃজনশীলতার আকাশে তিনি মুক্তপক্ষ বিহগসম সদা উড্ডীন। তার সাহিত্যচেতনার পরগনায় কাব্যচর্চা, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ ও গল্পের সম্ভার মিলিয়ে বেশ একটা ফুল্ল প্রতিভাস রচিত হয়েছে ইতোমধ্যে। সম্প্রতি তার অন্তর্দেশে অতীব নিরীহ অথচ সুবিমল আনন্দের আদি-অন্তহীন উৎস বিশ্বের আকাশে বিচরণরত পক্ষিপ্রজাতির পক্ষে ভাবঘন, অমায়িক ও দূরচারী অন্য ধরনের এক আর্কেডিয়া গড়ে উঠেছে। যা আমাদের অনেকের মনেও প্রভূত আনন্দের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। পাখি মানে যেখানে শিকারের বস্তু, ভূরিভোজনের কাপালিক উৎসব, পাখি মানে যেখানে খাঁচার ভেতরে অকারণ বিলাসিতায় বন্দি প্রাণের ছটফটানি, মানজুর সেখানে প্রতিবাদী, সংবেদী ও অশ্রæসজল পথিক।
নৈসর্গিক অভয়ারণ্যের ভরসালুপ্ত বিশ্বব্যাপী পাখির জীবনচরিত প্রধানত দিগি^দিকশূন্য পরিযায়িতায় নির্ধারিত হলেও কিছু রঙদার, উচ্ছল-উজ্জ্বল পাখিবিশেষ সর্বধা আমাদের বাঙালভূমির সমতলী জলাশয়-জলাভূমির গেরস্থালি জায়গাগুলোতে নিত্য পাখা বিস্তার আর বিচিত্র, মধুময় কাকলি মুখরতা দিয়ে আমাদের মরম ও কল্পনার পরিসরকে নিত্য নাড়িয়ে ও রাঙিয়ে চলেছে সেই আবহমানকাল থেকে। আমাদের কেচ্ছা-কাহিনি, লোকগান ও সুরে আর কবিতার চরণে-চরণে এসব পাখির কত না অনিন্দ্য সুন্দর গাথা বিজড়িত। এ তো গেল পুরাকালের কথা। এখন? নানা পারিপার্শ্বিক ও বৈষয়িক দ্বৈপায়নবৃত্তিক আচরণে কুণ্ডলিত আমাদের ভেতরের সেই পাখিপ্রীতিময় মনটি সুপ্ত হয়ে থাকতে বাধ্য হলেও আমাদেরই সবার ভেতরের দৃষ্টি ও মনটি কিন্তু আদতে ভাবকল্পনার গতিকে পাখিপ্রবণ ও পাখিকেন্দ্রিকই। সেটি শৃঙ্খলমুক্ত আত্মার প্রতীতি বা সৌন্দর্যপ্রীতির প্রতি পক্ষপাতহেতু কিবা কৌতূহলমুখী মনোবৃত্তি, যে-কারণেই হোক না কেন। পুরাকালে রাজরাজন্য থেকে মানব- সবার নানা দেশীয় শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবাধে পাখিশিকার ও তার মাংসভক্ষণের পৈশাচিক ঘাতকতার কথা না- হয় আপাতত উহ্যই রইল! কেননা শোনা যায়, মানবকুলের শিক্ষিত-সজ্জন তথা মানবীয় বোধ আর পরিবেশ-প্রতিবেশ চেতনা যে আগের চেয়েও বেশ ‘ডেভেলপ’ করেছে!
বঙ্গীয় মনুষ্যসমাজের ‘আমার কেবল ইচ্ছে করে নদীর কাছে থাকতে/ বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে পাখির মতো ডাকতে’ এই অবদমিত আকাক্সক্ষা পক্ষিকুলের রঙের বাহারে, তাদের চালচুলোহীন আহার ও বিহারে, তাদের অতি অনিশ্চিত বেঁচে থাকা, আবাসন ব্যবস্থা, আবার তাতে মানবশিশুর নির্দোষ হামলে পড়ার শঙ্কা, মানজুরের সুধী চিত্তটাকে বিচলিত ও করুণার্দ্র করেছে, তা বেশ মালুম হয়। আপাতত এমনতো বুঝে নিতে-নিতে আমার মন শান্ত হয়েছে মানজুর মুহাম্মদের পাখিমহলের সদর-অন্দরে পরিভ্রমণ করতে-করতে। পাখি নিয়ে ভাবা, পাখি নিয়ে গবেষণা- এও পাখির মতোই ভারি এক শৌখিন ও সুবেদী পরিযায়ী বৃত্তি বটে। মানজুরের পক্ষে এ যেন জীবিকার চাপে জবুথবু, নিত্য বিচলিত আমাদের মতো বঙ্গসন্তানের পক্ষ হয়ে আমাদেরই জড় ও কুটিল মনটাকে একটু অন্য তালে, একটু অন্যভঙ্গিতে খুঁচিয়ে দেয়া এবং তা তারিয়ে-তারিয়ে দূর থেকে দেখা!

দুই.
মানজুর মুহাম্মদের পাখিবিষয়ক এক অনন্য গ্রন্থ ‘পঞ্চাশ পাখির গল্প’ (২০২২)। এটির প্রকাশনায় আমাদের সময়ের পাখিবিষয়ের ধ্যানধারণায় এক নতুন কোষগ্রন্থের আগমন, সন্দেহ নেই। গ্রন্থটি কিশোর-কিশোরী পাঠকের উপযোগী করে লিখিত হলেও আমার মতো বয়স্ক কিশোরেরও ওতে মন মজেছে আনন্দের ব্যাপক আঞ্জাম একেবারে হাতের কাছে পেয়ে। বাংলাদেশের চিরসবুজ নিসর্গের ভাঁজে-ভাঁজে এই পাখিরা রয়েছে বড় হেলায়ফেলায় সে কতকাল হলো! আমি-আমরাই বা এই বিহঙ্গবিতানের পরিধি ও সুলুকের কতটুকু জানি! মানজুর ঠিক এখানেই এসে যেন আমাদের হাতটি ধরে নিয়ে গেলেন পাখিদের অসীম, উল্লসিত, চিরসুখময় কনসার্টে। যেখানে অভাব-অপ্রাপ্তির কোনো চোখরাঙানো অভিযোগ নেই, যেখানে তাদের প্রতি নির্বিচার অবহেলা ও ততধিক নিষ্ঠুর অপকর্ম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চরব নেই। শুধু খড়কুটোর ভাঁজে সুচিক্কন চঞ্চু ডুবিয়ে পোকামাকড়ের গতর টেনে-টেনে উদরপূর্তি আর উড়ে-ঘুরে গোস্ত-লোলুপ মানুষ-হায়েনার দৃষ্টি এড়ানোর পালিয়ে বেড়ানো ভঙ্গি ছাড়া।
এমনকি যেখানে মাঝেমধ্যে নিরালা নীড় থেকে সন্তানহরণ বা বাস্তুচ্যুতকরণের বিরুদ্ধে মানবজাতির বিরুদ্ধে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের কোনো মেনিফেস্টোও নেই। মানুষের তৈরি বিজ্ঞ দায়রা জজের আদালতের সামনে সংক্ষুব্ধ পক্ষিসমাজের ব্যানার-ফেস্টুন নেই। মানজুর আমাদের এখানে দাঁড় করিয়ে দিলেন যেন এই মানুষজন্মে পাখিজন্মের বেদনা যথামাত্রায় অনুধাবনের জন্য।
‘পঞ্চাশ পাখির গল্প’ বইটিতে মানজুর মুহাম্মদের কৃতিত্ব এই যে, তিনি এখানে পাঠকের ঘাড়ে গতানুগত পাখিবর্ণনার নিষ্প্রাণভার চাপিয়ে দিতে উপস্থিত হননি। এখানে উপস্থাপিত পাখির প্রাণবন্ত, স্বপ্নছাওয়া, বেশ নান্দনিক দৃষ্টিলুব্ধক স্কেচের সঙ্গে একটি করে অনুপম গল্প রয়েছে। ছবির সঙ্গে গল্পের অনুপম চলনের সাযুজ্য থাকায় এক অনবদ্য আলেখ্য ঝিলিক দিয়ে যায় নয়ন সমুখে। এক অপরূপ পাখির রূপের বৈভবে মন মজে যাওয়া কাঠবিড়ালির ছানার গল্প হাজির করি এখানে একটি দৃষ্টান্তরূপে।
কাঠবিড়ালির ছানাটি ওই রূপসি পাখিটাকে এক নজর দেখবে বলে প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নানা ছুুঁতোয় মাকে বলে তাদের বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। নিচে খেলতে যাচ্ছে বলে নেমে এলেও সে আসলে চোখভরে দেখতে চায় ওই নীলপাখিটার রূপৈশ্বর্য ও তার নিটোল গরিমা। কাঠবিড়ালির ছানার এ এক গোপন, প্রলুব্ধ, দুর্নিবার ইচ্ছে। লেখকের বর্ণনা : ‘পাখিটা কাঠবিড়ালির ছানাকে মুহূর্তে দেখে ফেলল। দেখামাত্র সে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে গেল। ঝোপের ভেতর লুকিয়ে যাওয়ার পরও কাঠবিড়ালির ছানার মুগ্ধ চোখে পাখিটার গায়ের রং ভাসছিল। পাখিটার গায়ে এত্তগুলো রং! পৃথিবীর সব রঙেই যেন সে রাঙা। কোন রং নেই তার গায়ে? সাদা কালো লাল সবুজ হলুদ বাদামি নীল- সব রংই আছে ওর দেহে। সবচেয়ে সুন্দর হলো পেটের তলাটা। দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন সেখানে টাটকা সিঁদুর লাগিয়ে দিয়েছে। সিঁদুরের ওপর যেন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে লাল মিহি গুঁড়ো। চোখে কে যেন মোটা করে কাজল পরিয়ে দিয়েছে’। (লাজুক নীলপাখি, পৃ. ১৪)।

তিন.
আগেই বলেছি, মানজুর মুহাম্মদ কবিতার এক পরগনার রাজন। তার কবিতা জীবনের মিরাসি আনন্দ-বেদনার এক কুঞ্জলতা। তার কবিতায় আছে সুবেদী, তীক্ষè কালচেতনা ও বয়ে চলার এক উল্লাসধ্বনি। যে জীবন যাপিত হচ্ছে বিশ্বচরাচরের আনাচেকানাচে সেই জীবনের অন্তর্গত ভাঙন, তার নিভৃত ক্ষয়, তার পরিপাটি বিন্যাসের নানা রঙ, নব্যগড়ন আর বদলে যাওয়ার দৃশ্যগুলো এই কবির বোধে ও চোখে যেন নিত্য ভেসে বেড়াচ্ছে শারদাকাশে শাদা মেঘের উদ্বেল উদাসীনতাভরা ভেলার মতো। তার ভাবনার মিহি তন্তুতে সেলাই করা সেসবের কেমন এক উজ্জ্বল ছায়াপথ উঠে আসছে শব্দের ঘরে, অক্ষরের সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে :
‘বোতামে মন্ত্রের নাচ, গোপনে খুলে পড়ে সব
নিমিষে, চিচিং ফাঁক।
ধ্যানের ঋষির জপ নেই স্বপ্ন ছুঁতে, স্বর্গ পেতে।
তাবিজ-কবজ, ডাকের চিঠি, সোনার কাঠি,
রুপোর চাবি
প্রাচীন এন্টিক এখন।

বোতামের চাপে খুলে পড়ে আকাশের
বুকের ফিতে
কবুতরের নরম পালকের খাঁজে
রোদের শহর।
বাতাসের কপোলে নিরন্তর খেলে
তেজী অশ্বের উড়ন্ত কেশর।

ভার্চুয়াল ধ্যানে ক্রিস্টাল ভালোবাসার বসবাস

বোতামের চাপে খসে পড়ে পৃথিবীর অন্তর্বাস
এক … দুই … তিন …’
(সাইবার সুখের ভার্চুয়াল ভাঁজ, ‘শাঁখ’, আগস্ট ২০১৪, পৃ. ১৯)।

এই একুশ শতকের প্রারম্ভিক কাল থেকে সূচিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিস্তার ও সূ²াতিসূ² প্রভাব বলয় নির্মাণের ক্রমপ্রসারণ মানুষের জীবনযাপনকে কীভাবে উড়ন্ত, ভাসন্ত, ত্রস্ত, অস্থির ও বলয়িত করে তুলছে বিদ্যুৎগতিতে- এ শব্দমালা যেন তারই জ¦লজ¦লে এক ক্যানভাস।

‘ধ্যানের ঋষির জপ নেই স্বপ্ন ছুঁতে, স্বর্গ পেতে,
তাবিজ-কবজ, ডাকের চিঠি, সোনার কাঠি, রুপোর চাবি
প্রাচীন এন্টিক এখন।
মৃত্যুঘুমে পৃথিবীর সব যাদুঘর।’

এই বাস্তবতা বিশ শতকের মধ্যপর্ব বা তার কিঞ্চিত পরের জাতক পাঠককুলের অন্তর্তলে কিছু অলৌকিক বিষণ্নতা এনে লেপে দিতে বাধ্য। কেননা কালের দুরন্ত বদলে যাওয়া গতিবেগ তাদের শ্লথ করেছে। তারা অনেকেই এ তালের ভঙ্গবিভঙ্গে ঠিকঠাক তাল মেলাতে অপারগ বইকি। বিপরীতে এই তো হলো নতুন সাইবার পৃথিবীর আগামী অবয়ব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়