নির্বাচন নিয়ে ডিএমপির সঙ্গেমার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক : মধ্যাহ্নভোজ করালেন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন

আগের সংবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে তিন চ্যালেঞ্জ : ভোটার উপস্থিতি, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা, প্রার্থীদের বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

দ্বাবিংশতিতম লেখক দিবসের ডাক : প্রবন্ধ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ বছর বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ঘোষিত আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের দ্বাবিংশতিতম বর্ষ; আমাদের এবারের স্লোগান ‘শান্তির পৃথিবী চাই, সর্বমানবিক স্বদেশ চাই’। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ যখন উদযাপিত হয়, সে বছর ছিল আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের বিংশতিতম বর্ষ; মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছিল- ‘শান্তির স্বদেশ চাই, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চাই’; পরবর্তী বছর, অর্থাৎ একবিংশতিতম বর্ষের মূল প্রতিপাদ্য হয়- ‘শান্তির পৃথিবী চাই, সদাচারী স্বদেশ চাই’। লেখক দিবসের গুরুত্ব বুঝতে হলে বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ঘোষিত আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের স্লোগানের মর্ম উপলব্ধি করা আবশ্যক। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সমার্থক বলেই আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের স্লোগানগুলো প্রতি বছর মিলে যায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনার সঙ্গে। তার আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের কথা মাথায় রেখেই স্লোগানগুলো স্থির করা হয়; তার সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত থাকে ‘শান্তির পৃথিবী চাই’। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে চাই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার অবদানের জন্যই বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন শান্তি পুরস্কার ‘জুলি ও কুড়ি’। দেশ ও জাতির প্রতি একজন সৎ সাহিত্যকর্মীর দায়িত্ব বিবেচনা করেই বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে পা রেখে পথ চলেছে। মোটা দাগে যদি বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের স্লোগানগুলো বিবেচনায় আনি, তাহলে বলতে পারি আমাদের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পরিপার্শ্ব’ এবং ‘মানুষ’। পরিপার্শ্বের বিস্তৃত অনুষঙ্গের নাম হতে পারে ‘সমাজ’ আর ‘মানুষ’ হচ্ছে অমীয় সম্ভাবনা এবং জটিলতম অনুষঙ্গের আকর। ‘সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সাধারণের মুক্তিচিন্তা জনমনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও লেখক দিবস’ শীর্ষক কাক্সিক্ষত আলোচনার গ্রন্থি উন্মোচন করে অনুচ্চারিত দুই প্রসঙ্গে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সহাবস্থানের ধারণার ওপর ‘সমাজ’ শব্দটির সৃষ্টি। সমাজের আবার বহুমুখী বিন্যাস লক্ষ করা যায়। সমাজ গঠনে নানান উপাত্ত এবং প্রেক্ষিত থাকাটা সঙ্গত। সমাজের পরিচয়ও হতে পারে বহুমাত্রিক। ভাষাভিত্তিক সমাজ যেমন হতে পারে তেমনি ধর্মভিত্তিক সমাজও হতে পারে; পেশাভিত্তিক সমাজ যেমন হতে পারে তেমনি লিঙ্গভিত্তিক সমাজও হতে পারে। আবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রাণিবৈচিত্র্যভিত্তিক সমাজও হতে পারে। আমাদের আলোচনা মানব সমাজ নিয়ে। যে সমাজে আছে বৈচিত্র্য, আছে জটিলতা, আছে বহুমুখী বিন্যাস; এবং সে বৈচিত্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে মানব সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয়। যদিও সমাজের আদর্শরূপটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ আছে, পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠার সঙ্গে আদর্শ সমাজের রূপরেখা নির্ণয় অসম্ভব বলেও মনে হয় না। সঙ্গত কারণেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ‘আদর্শ সমাজের রূপরেখা’ ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে। গ্রহণীয় মানব সমাজ বিনির্মাণে যুগে যুগে প্রাগ্রসর মানুষ অবদান রেখে গেছেন বলেই পৃথিবী আজো বসবাস উপযোগী আছে- সভ্যতা আজো টিকে আছে। আর আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে আছে বঙ্গজনপদের সংগ্রামের ইতিহাস। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার সমস্ত জীবনের সাধনায় বাঙালিকে ১৯৭১-এ সংঘবদ্ধ করেছিলেন; সমস্ত জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষায় বাঙালি জাতির চোখে স্বশাসিত হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। নিরস্ত্র বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ‘যার যা-কিছু আছে’ তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে একনদী রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন করেছিল স্বদেশ। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও বাঙালি তার স্বপ্নের উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি; ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর চেষ্টা চলেছে আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নিতে। সেই থেকে আমাদের নতুন সংগ্রাম। সঙ্গত কারণেই গত বছর আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রতিপাদ্য হয়েছে- ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে লেখক দিবসের গুরুত্ব’। সামাজিক অগ্রযাত্রায় যাদের নাম সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হয় তাদের অবদানের ফসল হিসেবেই আজকের এই শ্রমবিভাজিত মুনাফাভিত্তিক বিশ্বগ্রামের ধারণা আমাদের সামনে এসেছে। যদিও এ ধারণায় পৃথিবীর বৃহত্তর সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ আমাদের নজরে পড়েনি। সুতরাং পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ কামনা করে মানুষকে সুসংস্কৃত হয়ে ওঠায় মনোযোগী হতে হবে। তা কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী-গোত্র-ধর্ম-রাষ্ট্রের কথা বিবেচনা না করেই। সমাজ যদি সুস্থ-স্বাভাবিক-কল্যাণকামী হয়ে ওঠে, মানুষ যদি সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠে তখন শান্তি-সম্প্রীতির জন্য ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব হবে না। তবে সমস্ত আলোচনার গোড়াতেই এ কথাটি আমাদের চিন্তা ও চেতনায় ধারণ করতে হবে- ১৯৭১-এ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রধানত সংস্কৃতির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু সে স্বপ্নের কথাই শুনিয়েছিলেন তার ৭ মার্চের ভাষণে। সমাজের কল্যাণের প্রয়োজনেই একজন সমাজ সংস্কারককে হয়ে উঠতে হয় একজন আদর্শ সংস্কৃতিকর্মী। সংস্কৃতিকর্মীর পরিচয় অনেক বিস্তৃত। সংস্কৃতি সব সময়ই প্রাগ্রসর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে তার আচরণে, তার ব্যবহারে, তার সৃষ্টিশীলতায়-উদ্ভাবনে-প্রাগ্রসরতায়, তার শিষ্টাচারে-নম্রতায়, তার মননে-মনীষায়, তার ব্যক্তিত্ব ও বিনয়ে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য চাই সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠার প্রয়াস ও সাফল্য। সংস্কৃতিমান না হলে কেউ শিষ্ট হতে পারে না, সংস্কৃতিমান না হলে কেউ নম্র-বিনয়ী-ব্যক্তিত্ববান হতে পারে না, সংস্কৃতিমান না হলে কেউ সৃষ্টিশীল হতে পারে না; সংস্কৃতিমান না হলে কেউ সহিষ্ণু হতে পারে না, সংস্কৃতিমান না হলে কেউ চলিষ্ণু হতে পারে না; কেন না সংস্কৃতি মানেই প্রগতি-সংস্কৃতি মানেই প্রাগ্রসরতা। মানুষের সেই অপার সম্ভাবনার কথা স্মরণে রেখেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির চোখে সংস্কৃতির স্বপ্ন তুলে দিয়েছিলেন। আমরা যদি সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধান করতে পারি তাহলেই আমরা হয়ে উঠতে পারি সম্পন্ন মানুষ; আর ১৯৭১-এ ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। কেননা মানুষের মানুষ হয়ে ওঠা, আর মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গেই আছে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পূর্ণতা দিতেই এর স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে বারবার।
সংস্কৃতি বিষয়ক অসাধারণ গ্রন্থ ‘সংস্কৃতি-কথা’য় মোতাহের হোসেন চৌধুরী যখন বলেন, ‘ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম্ম’ তখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সমাজতাত্ত্বিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী ধর্মকে সংস্কৃতির চেয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছেন, মনে হতে পারে ধর্মকে কিছুটা পশ্চাদপদ বিবেচনা করেছেন তিনি; প্রকৃতপ্রস্তাবে ধর্ম তো সংস্কৃতির বাইরে কিছু নয়, কিন্তু ধর্ম যখন ‘অর্থডক্স’ হয়ে যায়, ধর্ম নিজেই যখন সমাজের বোঝা হয়ে পড়ে, তখন সেই ধর্মের আদ্যোপান্ত বদলে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে মানুষের সংস্কৃতিমান থাকার স্বার্থেই। পৃথিবীতে তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিভিন্ন সমাজে বারবার হয়েছে। সমাজে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-সংস্কার-রীতি-নীতি যখন মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তেমন পরিস্থিতি থেকে সমাজকে নতুন পথের দিশা দিতে যিনি বা যারা এগিয়ে আসেন তিনি বা তারা সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিতি পান এবং সমাজ-সংস্কারক মনীষীরা যতক্ষণ সমাজকে এগিয়ে নেবার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তার সে সময়ের কাজটিই সংস্কৃতিকর্মীর কাজ।
পৃথিবীর ধর্মমতগুলোতে ভ্রাতৃত্ববোধ চর্চার সংকট দেখি না। যে আদর্শ সমাজ মুহাম্মদ (দ.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তার সময়ে, সেই আদর্শ সমাজের পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে মানুষ এবং সভ্যতার স্বার্থেই। সংরক্ষণশীল ক্যাথলিক শীর্ষ পর্যায়ের মণ্ডলীর ১৯৬৫-এর মহাসভা সব ধর্মমতকে সম্মান জানিয়ে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মহাভারতে পাণ্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের যে দৃষ্টান্ত দেখা যায় তা অসাধারণ; সহজিয়া বৌদ্ধরীতিতে অহিংসা ও সহিষ্ণুতাকে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করে ক্ষমতাবলে বিজয় যতটাই দুরূহ হয়ে উঠেছে, প্রেম ও ক্ষমার শক্তি প্রতিটি দূরকে নিকটবর্তী করে দিয়েছে ততটা সহজেই। লোকবাংলার সাধারণ মানুষকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উদ্বুদ্ধ করার কারণ দেখি না, লোকবাংলার মানুষ জানে, ‘নানান বরণ গাভিরে ভাই একই বরণ দুধ/জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।’ এবং ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।’ কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নানান স্বার্থচিন্তা নিজেদের বাঙালির এসব শাশ্বত বাণী থেকে সরিয়ে এনেছে বলেই আজকের প্রেক্ষাপটে নানান সংকট, নানান টানাপড়েন সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেদের স্বোপার্জিত এইসব সংকট থেকে মুক্তির জন্য, নিজেদের বিজ্ঞানমনষ্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধসম্পন্ন করে তোলার কোনো বিকল্প দেখি না।
মানবজীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচন সাহিত্যের অন্যতম লক্ষ্য; যে গূঢ় সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে পাঠকের নানাবিধ প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি মানবহিতের বিষয়টিকে নিশ্চিত করাও এর কাজ। আর সত্যের সঙ্গে আছে জ্ঞানের যোগ, যে কারণে সাহিত্যকে জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেয়ারও প্রয়োজন পড়ে। জ্ঞানকে আবার কর্মে-ভাবে-আধুনিকতায় ও বিজ্ঞানের তুল্যমূল্যে বিকশিত হওয়া আবশ্যক। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকগণ নিজেদের রচনার মাধ্যমে মানবহিতের বিষয়টি নিশ্চিকরণে সচেষ্ট থাকেন। সুতরাং বিশ্বের লেখককুল যখন আন্তর্জাতিক লেখক দিবস আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় শুরু করেন, সঙ্গত কারণেই প্রাগ্রসর মানুষের প্রত্যাশা থাকে, লেখককুল মানবমুক্তির প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন।
বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ‘আন্তর্জাতিক লেখক দিবস’র ধারণাটি উচ্চারণ করেছিলেন। যে আয়োজনে তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন ‘শান্তির পৃথিবী চাই’ সেøাগানটি, বারবার আয়োজন করেছেন ‘শান্তির পদযাত্রা’। পৃথিবীর দু’চারটি দেশে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক লেখক দিবস পালনের সংবাদ পাওয়া গেছে। এ বছর উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের দ্বাবিংশতিতম বর্ষ। ত্রয়োদশ বর্ষের সেøাগান ছিল ‘শান্তির পৃথিবী চাই/ সম্প্রীতির স্বদেশ চাই’। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ঘোষিত আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের সেøাগানগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখবো, প্রতিটি লেখক দিবসের সেøাগানে আবশ্যিকভাবে উচ্চারিত হয়েছে ‘শান্তির পৃথিবী চাই’ পঙ্ক্তিটি এবং এর সঙ্গে কখনো যুক্ত হয়েছে, ‘হিং¯্রতার বিনাশ চাই, সৃষ্টিশীলতার বিকাশ চাই’, ‘সৃষ্টিশীলতার বিনাশ নাই’, কখনো ‘সন্ত্রাসমুক্ত স্বদেশ চাই’, কখনো ‘গণতান্ত্রিক সদাচার চাই’, কখনো বা ‘গণতন্ত্রে ব্যক্তির সঠিক স্বীকৃতি চাই’, কখনো ‘গণমানুষের সুদিন চাই’, আবার কখনো ‘গণমানুষের গণতন্ত্র চাই’, কখনো বা ‘সমৃদ্ধ স্বদেশ চাই’, কখনো আবার ‘এক-পৃথিবীর স্বদেশ চাই’ ইত্যাদি; বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে যেমন নির্বাচন করা হয়েছিল- ‘শান্তির স্বদেশ চাই, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চাই’। এসব সেøাগান কেবল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই নয়, বিশ্ব-প্রেক্ষিতেই লেখক দিবসের তাৎপর্যকে বাক্সময় করে তুলেছে। আর বঙ্গবন্ধু যেহেতু সারাজীবন শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, সুতরাং তার চিন্তা-চেতনা আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের স্লোগানে পড়বে সেটাই যৌক্তিক। গতবারের প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্য ছিল- ‘শান্তির পৃথিবী চাই, সদাচারী স্বদেশ চাই’। এই যে ‘সদাচার’ শব্দটির সঙ্গেই আছে- সংস্কৃতি আর প্রাগ্রসরতার যোগ; এবারের স্লোগান আরো মাঙ্গলিক- ‘শান্তির পৃথিবী চাই, সর্বমানবিক স্বদেশ চাই’। এভাবেই আন্তর্জাতিক লেখক দিবস আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে বাঙালির স্বাপ্নিক মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা।
মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে, যখন মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমাচ্ছে, যখন গোটা পৃথিবীকে বলা হচ্ছে ‘গেøাবাল ভিলেজ’; প্রযুক্তি যখন পলকে পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষকে সংযুক্ত করছে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার যখন অজ¯্র প্রচলিত মূল্যবোধকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে; ঠিক তখন কিছু ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূক ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সরলপ্রাণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, উগ্র মৌলবাদ এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর আক্রমণ করতে প্ররোচিত করছে। এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের মানুষের ওপর পৈশাচিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন পৈশাচিকতা আমরা বাংলাদেশেও প্রত্যক্ষ করেছি। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ পৈশাচিকতা অনেক বেশি নৃশংস।
আমরা দেখেছি পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ হত্যা-নৈরাজ্য-যুদ্ধ এবং রক্তপাত বিরোধী। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যখন পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত, তখন খোদ পাকিস্তানেও মানুষ প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমেছে-মিছিল করেছে, কারাবরণও করেছে; পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা কি সামান্য কমেছে? কমেনি। ইঙ্গ-মার্কিন হামলায় যখন পুড়ছে ইরাক তখন খোদ আমেরিকাতেও যুদ্ধবিরোধী মিছিল হয়েছে, কিন্তু হত্যাযজ্ঞ থামেনি ইরাকে। প্যালেস্টাইনে যখন নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবিতে লড়ছে মানুষ, ইসরায়েলি বাহিনীর অনৈতিক যুদ্ধকে কখনো প্রকাশ্যে কখনো পরোক্ষে সমর্থন করেছে আমেরিকা। মিয়ানমারে যখন নির্মম গণহত্যা চলছে, যখন অসহায়-বিপন্ন মানুষ প্রাণরক্ষার্থে দলে দলে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে, তখনো বিশ্ব মোড়লেরা থেকেছে নিশ্চুপ। নিরস্ত্র-বঞ্চিত মানুষ কখনো কোন পরাশক্তির সমর্থন পায়নি।
আফগানিস্তান-প্যালেস্টাইন-মিয়ানমার-ইরাক-সাদ্দাম-ইয়াসির আরাফাত-বাংলাদেশ-শেখ মুজিবকে নিয়ে কবিরা কবিতা লিখেছে, শিল্পীরা গান বেঁধেছে, নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র; কিন্তু যুদ্ধ থামেনি, থামেনি রক্তপাত; আগ্রাসন থামেনি, থামেনি কান্নার রোল। এই সভ্যতা-এই অগ্রগতি নিয়ে আমরা বড়াই করি! বিশ্বের প্রতিটি মায়ের অশ্রæ, প্রতিটি বোনের আর্তনাদ, প্রতিটি শিশুর চিৎকার বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তোলে না? নিশ্চয়ই জাগিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে বলেই কবি-লেখকরা প্রতিবাদ করেন।
অজ¯্র নষ্ট এবং অযোগ্য- অন্ধের ভিড়ে যেন হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববিবেক, তখনো মানুষ মূল্যায়নে বসে স্তুতি করতে বাধ্য হচ্ছে নষ্টদের; কারণ অযোগ্যরা- নষ্টরা মূল্যায়ন শুনতে রাজি নয়, তারা কেবল স্তুতি শুনতে চায়। নষ্ট-অযোগ্যের ভিড়ে বিশ্ববিবেক যেন অসহায়। এমন দুঃসহ অবস্থা থেকে মানুষকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। তার জন্য চাই দেশে দেশে সচেতনতা। প্রতিটি দেশের বিবেকবান মানুষকে সংগঠিত হতে হবে, সংঘবদ্ধ হতে হবে সুস্থচেতনার স্বাধীনতাকামী মানুষকে। দেশে দেশে যদি মানুষ অনাচার-স্বৈরাচার-যুদ্ধবাজ-রক্তলিপ্সুদের রুখে দাঁড়াতে পারে, তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে সম্প্রীতির বিশ্ব; যা সম্প্রীতির স্বদেশ পাওয়ার পূর্বশর্ত। যখন ‘সম্প্রীতির স্বদেশ চাই’ বলে সেøাগান দিই, তখন সম্প্রীতির বিশ্ব পাবার আকাক্সক্ষাকে স্মরণে আনতে হবে। কেন না আজকের তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো অর্জনই সম্ভব নয়। এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সম্ভবত ‘আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছিল ‘সম্প্রীতির স্বদেশ চাই’। শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য এ সদিচ্ছার পরম্পরাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে কে? সে ভাবনা ভাবতে হবে সংবেদনশীল লেখককেই। আর লেখক যদি পরম্পরা এগিয়ে নেবার দায়িত্ব পালন না করেন, তবে লেখক দিবসের যে আহবান তা যে তিমিরে আছে সে তিমিরেই হাবুডুবু খাবে, সেকথা বলাই বাহুল্য। একজন লেখকই তো উপলব্ধি করেন- ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’
এসব কল্যাণ সৌহার্দ্যরে কথা ঔদার্য ও ত্যাগের কথা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে মনোযোগী হতে হবে সবাইকে; এ কথা স্মরণে রেখে দ্বাবিংশতিতম আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রাক্কালে সৃষ্টিশীল-উদার লেখকদের কাছে পরমতসহিষ্ণুতা-মানবিকতার পক্ষে, কূপমণ্ডূকতা-ধর্মান্ধতার বিপক্ষে সংঘবদ্ধ হবার প্রত্যাশা করাটা নিশ্চয়ই অমূলক নয়। দ্বাবিংশতিতম আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের মঞ্চ থেকেও আসুন আমরা আহ্বান জানাই ‘শান্তির পৃথিবী চাই সৃষ্টিশীলতার বিনাশ নাই’, ‘শান্তির স্বদেশ চাই, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চাই’ ‘শান্তির পৃথিবী চাই, সদাচারী স্বদেশ চাই’ ‘শান্তির পৃথিবী চাই, সর্বমানবিক স্বদেশ চাই’! আমাদের আহ্বান ছড়িয়ে যাক বিশ্বের প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের কাছে। বিশ্ব হয়ে উঠুক অস্ত্রমুক্ত-বিশ্ব হোক যুদ্ধমুক্ত-সন্ত্রাস-রক্তপাতহীন। ঘরে ঘরে বয়ে যাক শান্তির সুবাতাস। মানুষের মুক্তিচিন্তায় বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই আছে সাধারণের মুক্তি। আসবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, অন্ধতা-কূপমণ্ডূকতা-অনাচার-দুঃশাসন-দুর্নীতি-ধর্মান্ধতা-অনৈতিকতা থেকে মুক্তি এবং আসবে সাংস্কৃতিক মুক্তি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়