নির্বাচন নিয়ে ডিএমপির সঙ্গেমার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক : মধ্যাহ্নভোজ করালেন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন

আগের সংবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে তিন চ্যালেঞ্জ : ভোটার উপস্থিতি, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা, প্রার্থীদের বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

চৈতালির বিয়ে : গল্প

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চৈতালির অসুস্থ বাবা সারাক্ষণই কপালের ভাঁজ নিয়ে বসে থাকে বারান্দায়। চিন্তা আর চিন্তা। অতিরিক্ত মাত্রায় চিন্তা এলে মাঝেমধ্যে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! চৈতালির সব বান্ধবী ও ছোটবোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তার এখনো হচ্ছে না।
কেমনে অইতো? আইজকাল হিন্দু সমাজো ফুরি অইয়া জন্ম নেয়া নু পাপ! কথাগুলো চৈতালির মা তার ভাই নিলয়কে শুনিয়েই বলছিল।
নিলয়তো রেগেমেগে আগুন!
ও মা তুমি এমনে কও কেনে! দিদি হুনলেনু কষ্ট পাইব… যেম্নে কও, মনে অয় দিদি হারাজীবন তোমরার বোঝা অইয়া থাকব।
– অইছে অইছে তোর লেচকার বন্ধ কর, আর ভাল্লাগে না। কিচ্ছুতো করতে তো ফারস না, হারাডাদিন খালি বাদাইম্মার মতো বইয়া বইয়া খাস! শরম করে না?
নিলয় রেগেমেগে ঘর থেকে বের হয়ে যায়… এভাবে কত মায়ের ছেলে, কত বাবার ছেলে, কত বোনের ভাই জেদ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তার কোনো হিসেব-টিসেব নেই। কেউ সফল হয়ে বাড়ি ফেরে। কেউবা হতাশ হয়ে, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। কেউবা লাশ হয়ে। কেউ উজ্জ্বল আলো হয়ে কেউবা রাতের অন্ধকার। আলো আর অন্ধকার মিলেইতো মানুষের জীবন। পরম আদর আর অভিমানে সন্তানদের বুকে আগলে রাখেন মায়েরা। তবুও কেন জানি মানুষের জীবন বড় রহস্যময়।
আর এইদিকে চৈতালির বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তার চিন্তা একটাই; চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর বিয়ে করবে। সমাজের কে কী বলল, এইসব গায়ে মাখে না চৈতালি। চৈতালি খুব ভালো ছাত্রীও বটে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করা মেয়ে। কপালের কী লিখন, একটা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি হচ্ছে না তার। আজকাল সরকারি চাকরি পেতে হলে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। চৈতালিরা মধ্যবিত্ত। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। অভাবের সংসার, দিন আনে দিন খায়। এভাবেই চলে।
তবুও চৈতালি কোনোদিন থেমে থাকে না। ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী মানুষ, কর্মঠ মেয়ে। পরিশ্রম ছাড়া কিচ্ছুই বুঝে না। ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করার পরই টিউশনি করায়। দু-একজন ছাত্র বাসায় এসে পড়ে যায়। মাস শেষে যা পায় সংসারে খরচে করে। আজকাল অভাবী সংসারে মেয়েদের অবদানের একটি অংশ টিউশনি।
টিউশনি না থাকলে কি যে হতো একমাত্র উপরওয়ালা জানে! দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো নিজেকেই শুনাচ্ছিল চৈতালি।
আজ চৈতালি এক মাসের টিউশনির সব টাকা দিয়ে বাবার জন্য লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য দুটি শাড়ি, ছোট ভাইয়ের জন্য শার্ট-প্যান্ট, রান্নার জন্য বড় মাছ আর সবজি কিনে বাড়ি ফিরেই তার বাবার সঙ্গে দেখা। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। এ যেন বাবার প্রতি চৈতালির অসাধারণ অনুভূতি।
অতকিছু কেনে আনলিরে মা? আমরা তো ডাইল, ভাত, আলুভর্তা খাইয়াই চলতাম পারি। আর ব্যাগের মইধ্যে কিতারে মা?
– তোমাদের সবার কিছু কাপড়চোপড় আনলাম।
– নিজের জন্য কী আনলি?
– আমার কিচ্ছু লাগবে না বাবা, আমার যেগুলো আছে ঢের। হয়ে যাবে, এ নিয়ে তুমি একদম ভেবো না। বাদ দাওতো ওইসব! ঘরে চলো…
বিছানায় বসিয়ে চৈতালি তার বাবার পাঞ্জাবি খুলে দেয়। গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে। শরীর ও মাথায় সরিষার তেল দিয়ে দেয়। আবার অন্য একটা পাঞ্জাবি পরিয়ে বাবার মাথা আঁচড়িয়ে দেয়। মুখে তুলে তুলে ভাত খাইয়ে দেয়। এ বড় মায়া। মহামায়া। মা হবার আগেই চৈতালি পালন করে মায়ের দায়িত্ব। বাবার মতো আপন কেউ নেই চৈতালির। মায়ের সঙ্গে মান-অভিমান হয় মাঝেমধ্যে। মেয়েরা বাবার জাত।
বাবাকে বিছানায় শুইয়ে মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল চৈতালি। হাত,পা ও পিঠ টিপে দিচ্ছিল। ততক্ষণে ঘুমিয়েও পড়লেন চৈতালির বাবা।
হঠাৎ ঘরের ফোনে কে জানি কল করল! অপরিচিত নম্বর। চৈতালি রিসিভড করে হ্যালো বলল।
– সমর দাদা বলছিলেন? আমি মোহনগঞ্জ থেকে গোপাল বলছিলাম।
– বাবাতো অসুস্থ, এখন ঘুমিয়ে আছেন। আপনি আমার কাছে বলতে পারেন, আমি সকালে মনে করে বাবার কাছে আপনার কথা বলব।
– শুধু বলো, আমরা কয়েকজন তোমাদের বাড়িতে আগামীকাল আসব।
– কয়েকজন!! (মনে মনে) আচ্ছা ঠিকাছে, আমি বলব।
ফোন রেখে চৈতালি মহাচিন্তায় পড়ে গেল। কয়েকজন আসবে! কী করব, কী খাওয়াব কিছুই বুঝতে পারছি না। হাতে একটা টাকাওতো নেই এখন! ভাবতে থাকে চৈতালি। পরেরদিন সকালে আমতা আমতা করে এক ছাত্রীর বাবার কাছে অগ্রিম বেতনের আবদার করে বসে! অবশেষে পেয়েও গেল। পাবেই না বা কেন? চৈতালি নম্রতা ও বিনয়ের জন্য সবার কাছেই প্রশংসনীয়।
টিউশনি সেরে চৈতালি বাড়িতে ফিরতেই দেখে ঘরভর্তি মানুষ! বারান্দায় চারজন চেয়ারে বসে বসে পা দোলাচ্ছে। বাইরে তিনজন কী নিয়ে যেন কানে কানে কথা বলছে। ঘরে চারজন মুরুব্বি চৈতালির বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বিয়ের কথা! চৈতালির বিয়ে। অভাবের সংসার হলেও চৈতালির বাবা এবার মনে খুব আশা পুষেছে। মেয়ের বিয়েটা যেন হয়ে যায়।
চৈতালি দেখতে ফর্সা। সুন্দর ও বিনয়ী মেয়ে। সাধারণের মাঝেই অতি অসাধারণ। গুণবতী ও বুদ্ধিমতি মেয়েও বটে। শিক্ষিত তো আছেই। তাকে সাজিয়ে ছেলেপক্ষের এত মানুষের সামনে বসিয়ে রাখা হলো শীতল পাটিতে। একজন একজন করে জটিল সব প্রশ্ন করে চৈতালিকে। চৈতালিও একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। কেউ তার চেহারার প্রশংসা করছে, কেউবা গুণের, কেউ জ্ঞানের। ছেলেপক্ষের সবার কাছে প্রশংসায় ভাসছে চৈতালি। এ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচা।
চৈতালির বাবা ও তার আত্মীয়রা এগোতে থাকে বিয়ের আলোচনায়; এখানেই। ছেলে নাকি বিদেশে থাকে। দুবাইয়ে। পড়াশোনা তেমন নেই। টেনেটুনে নাকি ম্যাট্রিক পাস করেছিল! বয়সে কম হলেও চৈতালির চেয়ে দশ বছরের বড়। কী আর করা? চৈতালির বাবা গরিব। যৌতুকের অভাবে সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে পারছে না চৈতালিকে। এ নিয়ে বাবার দুঃখের শেষ নেই। আর্থিক অবস্থা ও বিদেশের কথা বিবেচনা করে ওই ছেলের সঙ্গে চৈতালির বিয়ে দিতে আপত্তি নেই তার বাবার। কারণ যৌতুক ছাড়াই বিয়ে করবে চৈতালিকে।
চৈতালির একটা সুন্দর মন আছে। চাহিদা আছে, আছে তার পছন্দও। পরিবারের অভাব ও সুখের কথা ভেবে সব সুখ, চাহিদা, পছন্দ ও আশা-আকাক্সক্ষা চোখের জলে বিসর্জন দিল চৈতালি। বিয়েতে তার কোনো আপত্তি নেই, চৈতালি জানিয়ে দেয় তার বাবাকে। মিথ্যা স্বপ্নগুলো শিমুল তুলার মতো উড়িয়ে দেয় পৃথিবী নামক নাট্যমঞ্চের আকাশে-বাতাসে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়