ডিএমপির আদাবর থানা : ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামি পালিয়েছে হাজতখানা থেকে

আগের সংবাদ

নাশকতার জবাব ভোটে দিন : ঢাকায় নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

প্রায়শ্চিত্তের মৃত্যু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩ , ১১:১৩ অপরাহ্ণ

লোকটা বুঝে গেছে মৃত্যু তার নাকের ডগায় ভোরের শিশির কণার মতো ঝুলে আছে। এখনই উড়ে যাবে জীবনের শেষতম শ্বাসটুকু। সে হয়ে যাবে লাশ। আর কোনো দিন নিতে পারবে না নিঃশ্বাস। করতে পারবে না কারো সর্বনাশ। অন্তিম এই মুহূর্তে বউ, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ভিড় করে আছে প্রতিবেশী ও পথচারীরা। লোকটা আর ১০ জনের চেয়ে একটু ভিন্ন প্রকৃতির মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে বলেই এই অতিরিক্ত ভিড়।
স্বাধীনতার পরপরই লোকটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। থেমে যায় চলাচল। কমে আসে শরীরের বল। অসুস্থ চোখের পর্দায় ভাসত রক্তের ঢেউ। বধির হতে চলা কানে আসত মৃত্যু চিৎকার। ভয়ে হেমন্তের সজনে পাতার মতো কেঁপে উঠত তার পাষাণ হৃদয়। কেমন যেন চুম্বকের সঙ্গে আটকে যেত লোহার মতো শক্ত পা দু’খানা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিলাপ করতো- আমাকে বাঁচাও। আগুন থেকে বাঁচাও। আমাকে পোড়ায়ে মেরো না। কাশিনাথ বাবু আমাকে ক্ষমা করে দিন।
অসুস্থ এই মানুষটাকে দেখে কারো মনে সামান্য সহানুভূতিও নাড়া দিত না। বরং ঘৃণার তীর্যক রশ্মি ছড়িয়ে পড়ত তার অস্তগামী মুখের ওপর। সবার চোখে ভেসে উঠত একাত্তর সালের এপ্রিল মাসের লোমহর্ষক এক বর্বরতার ছায়াচিত্র।
গ্রীষ্মকাল। গাছে গাছে আমের থোকা ঝুলে আছে।
বকুল তলায় পড়ে আছে অজ¯্র ঝরাফুল। বুনো ফুলের মহুয়া ঘ্রাণ নেচে বেড়াচ্ছে বাতাসে বাতাসে। কিন্তু আম গাছের নিচে নেই শিশু-কিশোরদের ভিড়। কেউ গাঁথছে না বকুল ফুলের মালা। কারো নাকে যাচ্ছে না মহুয়ার ঘ্রাণ। সবার মুখে আতঙ্কের ছাপ। পরাণের প্রকোষ্ঠে বাসা বেঁধেছে মৃত্যু ভয়। এই বুঝি পশ্চিমা আর্মির গাড়ি চলে আসবে। মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে ঝাঁজরা করে দেবে সুন্দর বুক। ধূসর মাটিতে আঁকবে রক্তের আলপনা। নবগঙ্গার জলে ভেসে যাবে ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ। উলঙ্গ দেহ খুঁচে খাবে ক্ষুধার্ত কাক। হবে না কারো সৎকার।
সত্যি একদিন সকালে কচুবাড়িয়া গ্রামে আর্মি এলো। ব্রাশফায়ার করল। অগ্নিসংযোগ ঘটাল। দেশীয় পশুদের দিয়ে লুটতরাজ চালাল। আদিম বর্বরতায় মেতে উঠল। ঝোপ ঝাড়ে খুঁজতে থাকল হিন্দুদের। যাকে পেল তাকেই মেরে ফেলল। দুপুরের দিকে আর্মির গাড়ি যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে চলে গেল। এতেও মারা গেল বেশ কিছু মানুষ ও গবাদিপশু। আর্মির গাড়ি চলে গেলেও রয়ে গেল দেশীয় পশুরা। মনের আনন্দে লুটতরাজ চালাতে থাকল তারা। এমন সময় একটা ঘরের মধ্যে কাশের গাদার মধ্যে পেয়ে যায় কাশিনাথ বাবু ও তার শিশু কন্যাকে। কোনো কথা নেই। আজকের এই অসুস্থ লোকটাকে ঘরের শিকল আটকায় আগুন ধরিয়ে দিল। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাশিনাথ বাবু কত কাকুতি-মিনতি করল। চিৎকার করল।
কিন্তু পাষণ্ডের মন গলল না। জ¦লতে থাকল আগুন। ফুটতে থাকল ঘরের বাঁশের গিরা। আস্তে আস্তে ক্ষীণ হতে থাকল কাশিনাথ বাবুর আর্তচিৎকার। একসময় ফুটে উঠল কাশিনাথ বাবুর মাথার খুলিটা, তার আগে তার শিশু কন্যার।
এই পৈশাচিক কাজের বছরখানেকের মধ্যে লোকটা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরে আগুন! আগুন! বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। অসাড় দেহে শুয়ে থাকত। কাছে কোনো মানুষ পেলে তার পা জড়িয়ে ধরে বলত- কাশিনাথ বাবু আমাকে মাফ করে দিন। আমি বড় অন্যায় করেছি। কারণে-অকারণে বিলাপ করত।
দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। লোকটার চিৎকারে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, পথচারীদের পদভারে ছোট্ট উঠানখানা ভরে গেছে। বউ, ছেলে-মেয়েরা বসে আছে পাশে। হঠাৎ করে লোকটা চিৎকার আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল- আগুন! আগুন! কাশিনাথ বাবু আমাকে বাঁচান। দ্বিতীয়বার আর বলতে পারল না। এরই মধ্যে লোকটার চোখ দুটো দোনালা বন্দুক থেকে যেভাবে গুলি বের হয়ে দ্রুতগতিতে শিকারের দিকে ছুটে যায়, ঠিক তেমনইভাবে ছুটে গিয়ে ঘরের চালার সঙ্গে আঘাত খেল। সবার কানে এলো বজ্রপাতের আওয়াজ। চোখের কর্ণিয়ায় চমকে উঠল বিদ্যুতের ঝলক। কেউ তেমন কান্না কাটি করল না। কয়েকজন যুবক লাশটাকে উঠানে এনে উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুইয়ে রাখল। এক ঝাঁক কাক ঘৃণা ভরে কা কা করতে করতে গাছ থেকে মাঠের দিকে উড়ে চলে গেল।
সৌরভ দুর্জয় : গুহ লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর
সদর, ফরিদপুর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়