ধরা পরে কানের দুল গিলে ফেলল ছিনতাইকারী

আগের সংবাদ

ইসিকে কঠোর হওয়ার তাগিদ

পরের সংবাদ

আমার পাশে রাতুল ছিল

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জরুরি কাজে আমাকে এখনই ঢাকায় ফিরতে হবে। বসের নির্দেশ। আগামীকাল সকাল সাড়ে ৯টায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। আমি চেয়েছিলাম জুমে মিটিংয়ে সংযুক্ত হব। কিন্তু তা হবে না। আমাকে সশরীরে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে হবে।
তিন দিনের একটা কর্মশালায় এসেছিলাম পঞ্চগড়ে। দুদিন শেষ না হতেই হেড অফিসের ফোন। অফিসের গাড়ি রেখে রাত ১০টার বাসে টিকেট কাটতে বললাম। আবহাওয়া বেশি ভালো না। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। ইচ্ছা ছিল সার্কিট হাউসের বারান্দায় বসে সবাই মিলে আড্ডা দেব। তা আর হলো না। বৃষ্টিস্নাত রাতের আঁধারে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বাসে বসে ঝিমাতে হবে। এটা ভাবতেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার মোবিন ভাই অনেক চেষ্টা করেছিল আমার জন্য দুটি সিটের টিকেট কাটতে। কিন্তু পারেনি। অন্য একজন তার টিকেট ক্যানসেল করায় টিকেটটা পাওয়া গেছে। আর কিছুক্ষণ আগে স্যারের ফোন এলে ট্রেনে যেতাম।
চোখে ঘুম ঘুম ভাব। একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করছে, পাশের সিটে কেমন মানুষ বসবে আল্লাহই জানেন। সুপারভাইজারের কাছ থেকে জেনেছি, পাশের সিটের যাত্রী সামনে থেকে উঠবেন। সেই সামনে যে কখন আসবে! আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু অপরিচিত মানুষের পাশে বসে ঘুমালে তো চলবে না। আমার ভেতরে
ভাবনার প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করে।
দিনের জার্নি আমার কাছে খুব ভালো লাগে। বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সময় শেষ হয়ে যায়। সবুজ গাছ-পালা, ফসলের মাঠ কেমন বিলি কেটে কেটে গাড়ি সামনে এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পেছনে সরে যাওয়া প্রকৃতি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাতের জার্নি আমার কখনই ভালো লাগে না। আজ বৃষ্টির কারণে বাসের জানালা, লাইট বন্ধ। কেমন গুমোট একটা ভাব। এসব একদম ভালো লাগে না।
সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগল। এই সুগন্ধ আমার অনেক দিনের পরিচিত। চেনা-জানা। হুঁ সাদা রংয়ের ফুল। কিন্তু কিছুতেই এই ফুলের নাম মনে করতে পারছি না। এই ফুল একজনের খুব প্রিয় ছিল। আমি তেমন বেশি ফুল চিনতাম না। সেই মানুষটি আমাকে অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন।
সেই ফুলের গন্ধে আমার ভেতরে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার খুব কাছের কোনো মানুষের কাছ থেকে সেই ফুলের, সেই মানুষের গন্ধ পাচ্ছি। যে মানুষ অনেক বছর আগে আমার জীবন থেকে চলে গেছে, আজ কেন তার কথা মনে পড়ছে? যাকে ঘিরে আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে, সে কেন বারবার ভাবনায় চলে আসে?
আমি চোখ মেলে দেখি পাশের ভদ্রলোককে। তিনি কখন এসেছেন টের পাইনি। ফুলের গন্ধ ওনার কাছ থেকেই আসছে। চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বলে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য বাসের লাইট বন্ধ, চাদর না থাকলেও চেহারা বোঝা যেত না।
আমি মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই ভদ্রলোক বললেন, ঋতু, আমাকে আর তোমার মনে পড়ে না! তাই না?
আমি চমকে উঠলাম! রাতুল! তেইশ বছর সাত মাস একুশ দিন পর রাতুল আমার পাশে! আমার খুব রাগ হচ্ছে, আবার কান্নাও পাচ্ছে। আবার একদিকে ভালোও লাগছে। এটা ভেবে যে, আমার পাশে রাতুল আছে।
রাতুল খুব আদুরে গলায় বলল- ঋতু, আমার সঙ্গে কথা বলবে না?
– নাহ! তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। তোমার জন্য আমার সাজানো-গোছানো জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
– আমার জন্য! আমি আবার কী করলাম?
– থাক সেসব কথা। এখন বলো, এত বছর কোথায় ছিলে? এখন কোথায় আছ? বিয়ে করছ? ছেলেমেয়ে ক’জন? সেদিন কেন এলে না?
– একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেব? একটু থামো।
– সেদিন তো আমি তোমার কাছেই আসছিলাম…
ঋতু আর কোনো কথা শুনতে পায় না। ওর মুঠোফোন বেজে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলছে।
বাসের সব যাত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঋতুর চোখে কোনো ঘুম নেই। রাতুল ওর পাশে বসে আছে! এটা ভাবতেই ভালো লাগছে। একদিন এই ছেলেটির সঙ্গেই সংসার গড়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন যে সেদিন রাতুল আসেনি সেটা অজানা থেকে গেল। আজ আর তা জানতেও ইচ্ছা করছে না। এটাই শান্তি যে এত বছর পর রাতুলের সঙ্গে দেখা হলো। ঋতুর বদ্ধমূল ধারণা ছিল- এ জীবনে আর ওর সঙ্গে দেখা হবে না।
তেইশ বছর সাত মাস একুশ দিন পর রাতুলের সঙ্গে দেখা! এই মাঝখানের এত বছরে ওর সঙ্গে আমার কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিল না। অথচ ওকে ঘিরেই আকাশের মনে সন্দেহ জাগে! মিথ্যা সন্দেহবাজ মানুষের সঙ্গে সংসার করার চেয়ে একা থাকা অনেক সুখের। তাই তো সন্তানের হাত ধরে আকাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সন্দেহপ্রবণ মানুষ মারাত্মক হয়, সে প্রমাণ আকাশ দিয়েছে। এই রাতুলকে নিয়ে দিনের পর দিন অশান্তি করেছে। শারীরিক-মানসিক দুদিক থেকেই অত্যাচার চালানো হতো ঋতুর ওপর। খুব নোংরা নোংরা কথা শুনতে হতো ঋতুকে।
হ্যাঁ, একটা সময় রাতুলের সঙ্গে ঋতুর গভীর সম্পর্ক ছিল। ওরা বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিয়ে তো ওদের হয়নি। বিয়ের দিন রাতুল আসেনি। সেই থেকে ঋতুর ভেতরে অভিমান জমা হতে শুরু করে। তাই ও আর রাতুলের কোনো খবর নেয়নি বা ওর সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেনি। পাঁচ বছর পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আকাশকে বিয়ে করে। মন দিয়ে সংসার করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।
রাতের নিস্তব্ধতা শুধু সাক্ষী রাতুলের জন্য ঋতুর চোখের জল কতটা ঝরেছে। বুকের গভীর গোপন দীর্ঘশ্বাস তোলা ছিল শুধু রাতুলের জন্যই।
ওর নাকে এসে লাগে বেলি ফুলের তীব্র ঘ্রাণ। মনে হয়, রাতুলের পুরো শরীরটা বেলি ফুলে মোড়ানো! ঋতুর খুব ইচ্ছা করে রাতুলের হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মুখে ছোঁয়াতে। কিন্তু পারে না ইচ্ছা পূরণ করতে। কত বছরের জমানো কষ্ট চোখের নদী বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
বাসের একটা ঝাঁকুনিতে সবাই জেগে ওঠে। গাজীপুরের বনের ভেতর দিয়ে বাস চলছে। ফজরের নামাজের আজান পড়বে এখনি। বেলি ফুলের ঘ্রাণ মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি পাশে তাকিয়ে দেখি, রাতুল আমার পাশে নেই! কোথায় গেল? বাসে যখন ঝাঁকুনি দিল তখন কি ও নেমে গেল? একবার বলে গেল না! আবারো একরাশ অভিমান জমা হলো রাতুলের ওপর।
– শেখ শামীমা নাসরীন পলি : লালবাগ, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়