নীরব-মজনুসহ বিএনপির ৪৭ নেতাকর্মীর কারাদণ্ড : নাশকতার তিন মামলা

আগের সংবাদ

অপশক্তিকে রুখে দেয়ার অঙ্গীকার : বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

পরের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের ক’জন শহীদ স্মরণে : স্বগতোক্তি-খেদোক্তি অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরতের পড়ন্ত রোদে আমাদের ক্যাম্পটাকে মনে হচ্ছিল নীরব, নিস্তেজ, নিথর, অনেকটা নিঃসঙ্গ। একটা তাঁবুতে আমি একা। কিছু আগে আগরতলা থেকে ফিরে এসেছি। আজ সেখানে একটা সভা ছিল। মনি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কঠোর ভাষায় বাংলাদেশ সরকারের একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছি। মনি ভাইয়ের বক্তব্য ছিল- দেশটা আমাদের; তাকে শত্রæমুক্ত করতে যত রক্তের প্রয়োজন তা আমরা দেব। স্পষ্টই যৌথ কমান্ডের ব্যাপারে আমাদের অসম্মতি ছিল। আমাদের থলেতে যুক্তি ছাড়াও আবেগ ছিল প্রচুর। সে কারণে দুদিন আগে বেতারে সংকেত পেয়েছি। ‘তোমাদের লাশ শকুন খাবে’ সপক্ষের এমনি উক্তি বুকে কম্পন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। বিষণ্নতা নিয়ে নিঃসঙ্গ তাঁবুতে বসে থাকতে থাকতে একটা ছায়া অবলোকন করলাম। দেখলাম কুচকুচে কালো একটা চেহারা যাকে স্কুলে তার বাবার সহকর্মী শিক্ষকরা নিগ্রোর বাচ্চা বলত। তার চুল আমাদের চেয়ে কালো ছিল ঠিকই তবে কোঁকড়ানো ছিল না। ঝাঁকড়া ছিল তবে চিরুনি চালাতে অসুবিধা হতো না। সেদিন মুখে তার দাড়ি ছিল, তবে কালো মানুষের কালো দাড়ি ছিল মানানসই। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি তার ঝকঝকে দাঁত কটি ঠোঁট ঠেলে বের হলে তার মুখের বিষণ্নতা মিলিয়ে যেত। যিনি এলেন এবং যার কথা বলছি তার নাম মোজাম্মেল হক, ডাক নাম আবু; বি কম পাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম প্রথম পর্বে ভর্তির সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছিলেন। তবে ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার আগেই ক্লাস ছেড়ে যুদ্ধে চলে এসেছেন। আবুর আসল নামটা আর আমার আসল নাম অর্থাৎ বাবার দেয়া নামটা একই ছিল। আমার আসল নাম জানা থাকলে তার নাম মোজাম্মেল হতো না। সে আমার বছর দুয়েকের ছোট। বলতে গেলে আমরা পিঠাপিঠি। এক সঙ্গে বড় হয়েছি। একই স্কুলে পড়েছি। ছোটবেলায় ৫ জনে এক রিকশায় চড়ে স্কুলে গিয়েছি, খেলাধুলা করেছি, রাতে হাডুডু খেলায় কিংবা যাত্রা দেখতে এক সঙ্গে গিয়েছি। আর কত কী! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাক্কালে তার আসল নাম জেনেছি কিন্তু তার মনে যে এত আগুন তা জেনেছি আরো পরে। আবু আমাদের মতো ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। ষাটের দশকে আমরা ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা; তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি, জিন্না মিয়ার পাকিস্তান- আজিমপুরের গোরস্তান’ এবং সত্তরের নির্বাচনের কালে ‘নৌকা মার্কায় ভোট দিন, স্বাধীনতা শপথ নিন’ বা আরো পরে ‘কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, জাতীয় সেøাগানে রাজপথ কিংবা জনপথ মুখরিত রেখেছিলাম। আবু যে কাছে দাঁড়িয়ে এসব আত্মস্থ করছিল বা ওইসবে নিজকে একান্ত সঁপে দিচ্ছিল তা তখন চোখ মেলে দেখার

তেমন সুযোগ পাইনি। ২৫ মার্চের রাত থেকে এপ্রিলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এক সঙ্গে থেকে একটু বেশি রকম বুঝতে শুরু করেছিলাম। তার হৃদয়ে যে বারুদ আছে এবং বারুদের মতো সময়মতো জ¦লে ওঠার বাসনা আছে তা জেনেছি তখনই, যখন সে স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে গেরিলা যুদ্ধে ট্রেনিংয়ে গেল। ট্রেনিং শেষে ইনডাকশনের জন্য তার ব্যাকুলতা থেকে তার মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম দরদ, পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও দেশকে শত্রæমুক্ত করার দৃঢ়তা লক্ষ করেছি। ইনডাকশনের সময় নির্দেশ ছিল নিজকে মাত্রারিক্ত আড়াল করে রাখার, জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার, নতুন যোদ্ধা তৈরি করার, হিট ও রানের মাধ্যমে শত্রæকে নাস্তানাবুদ করার এবং পরবর্তী মোক্ষম সময়ের নির্দেশ ব্যতিরেকে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হওয়ার। দেশকে দ্রুত স্বাধীন করার ব্যাকুলতায় বা সহযোদ্ধাদের শত্রæর সাঁড়াশি আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আগস্টের শেষ দিকে আবুরা মনি ভাইয়ের শেষ নির্দেশটি অমান্য করেছিল। অধিনায়ক মনি ভাইয়ের তলব পেয়েই সে আজ এসেছে। তবে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখির জন্য নয়, আরো অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিতে। আমি আবুকে মনি ভাইয়ের মনোভঙ্গির কথা বললাম এবং তার যে কোর্ট মার্শাল হতে পারে তাও জানালাম। কতটা শৃঙ্খলা সচেতন হলে সহযোদ্ধাকে কোর্ট মার্শালে ঠেলে দেয়া যায় এবং যুদ্ধটা আমাদের কত নির্মম ও নির্দয় করে তুলেছে তা অনুভব করলাম। তবে সান্ত¡না ছিল যে যুদ্ধটা ভাড়াটে সৈন্যের যুদ্ধ ছিল না বা পররাজ্য গ্রাসের যুদ্ধ ছিল না, তা ছিল দস্যু, তস্কর, দুর্বৃত্তের হাত থেকে মা ও মাতৃভূমিকে উদ্ধারের লড়াই, ধর্মব্যবসায়ী ও ফতোয়াবাজদের কবল থেকে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে স্বকীয়তায় সংস্থাপনের লড়াই, অন্নের লড়াই, বস্ত্রের, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রাপ্তির লড়াই। তাকে যে কোর্ট মার্শাল করা হতে পারে তা সে জানত। মনি ভাই এলেন এবং কী পরিস্থিতিতে আবুরা সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল তা ব্যাখ্যা করলাম। আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ পাকিস্তান হানাদার আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের বিপন্ন দেখে নিষেধ সত্ত্বেও আবুদের দলটি সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রাণহানি না ঘটলেও প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হারানো গিয়েছিল। ব্যাখ্যা গৃহীত হলেও মনি ভাই আবারো চেগুয়েভারার কথা স্মরণ করিয়ে বললেন, ‘একজন প্রকৃত গেরিলা কখনো মরে না’।
একটু পরে আবু গোলাবারুদের একটা দীর্ঘ তালিকা পেশ করল। বয়ে নেবার কষ্ট বিবেচনা করে নতুন ইনডাকশন ইচ্ছুকদের নিয়ে সেও ফিরে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। আমার সঙ্গে অন্তত দুটি দিন কাটাবার ইচ্ছা থাকলেও চিফের আদেশ অমান্য করে তার থাকার জো ছিল না।
আজকের বিকালটার সবাই অন্যত্র ব্যস্ত। যে ব্যক্তিটির ট্রেনিং শেষে হয়েছে তাদের আজ অস্ত্র দেয়া হয়েছে, নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। কুরিয়াররা এসে গেছেন। উদ্বুদ্ধকরণসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হয়ে গেছে। রাতে তারা চলে যাবে। সে রাতে আবু, সাফু, মেহরাব, পাখী, মোমিন ও অন্য এক আবুসহ সবাই চলে গেল। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে তাদের দলটি অতর্কিতে পাকিস্তান সেনা আক্রমণের সম্মুখীন হলো। মৃত্যুকালে আবু কী বলেছিল জানি না। তবে আমি তার মাঝে ১১ সেপ্টেম্বর এক অন্য আবুকে দেখেছিলাম। মনে হয় এই পৃথিবী বা এই গ্রহের সে কেউ নয়, কোন এক দূর গ্রহের বিষণ্ন নাবিক। খবর এলো আবু আর নেই। শুধু আবু নয়, কেনু মিয়ার ভাই আরেক আবু, সাইফুল (সাফু)ও শহীদ হয়েছেন। সাফু একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল, কেনু ভাইয়ের ছোট ভাই আবু কুমিল্লা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণির ফার্স্ট বয় ছিল। মেধাবী ও অল্প বয়স্ক গরিবের সন্তান বলে আমরা দ্বিতীয় আবুকে ট্রেনিংয়ে পাঠাতে চাইনি। অনেকটা আমাদের অজান্তে বয়স ও ক্লাস লুকিয়ে আবু ট্রেনিংয়ে চলে গেল। ট্রেনিংয়ে অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে আমরা মানে চিফসহ সবাই তার ইনডাকশনের ব্যাপারে তেমন আপত্তি করেনি। এখন গøাস ফ্যাক্টরির আমাদের বেস ক্যাম্পে শোকের ছায়া। কারো মুখে কথা নেই। পাতা পড়ার শব্দটিও শোনা যাচ্ছে। আমার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। একটি অস্পষ্ট কান্না কণ্ঠ ভেদ করতে গিয়ে থেমে গেল। আসল কথা বললে অন্যদের নৈতিক বল বা মনোবল ভেঙে যাবে। একজনের কাঁধে ভর দিয়ে গøাস ফ্যাক্টরির তাঁবু থেকে বেরিয়ে কোনোভাবে কলেজ টিলায় পৌঁছলাম। অসময়ে আমাকে দেখে কেনু ভাইয়ের কলিজায় মোচড় দিল। মুখের ভাব দেখে বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে। ঘরে ঢুকলাম, মাটিতে পাতা বিছানার মাথায় দুটি হাত রেখে বসে গেলাম। দেহের ভার সইতে না পেরে দেহটাকে মেঝেতে এলিয়ে দিলাম। কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় ভেসে উঠল ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা কে বলে আজ তুমি নেই’ গাইতে গিয়ে চোখে বাঁধ ভাঙা জোয়ার নামল। কেনু ভাই জিজ্ঞেস করলেন- স্যার কী হয়েছে? যুদ্ধকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার ছিলাম। তাই কেউ কেউ আমাকে স্যার বলতেন। তবে মনি ভাইয়ের নির্দেশক্রমে আমি আমার পরিচিতি বরাবর গোপনই রেখেছিলাম। শুধু কেনু ভাইসহ গুটিকয়েক আমার পরিচয় জানত। কেনু ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে বললাম, ‘আবু মারা গেছে।’ মুহূর্তে মাথায় দুহাত রেখে কেনু ভাই মাটিতে বসে পড়লেন; পৃথিবীটা তার চোখের সামনে দোল খাচ্ছিল। অঝর কান্নার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, কোন আবু?’ আমি বললাম মজিদ স্যারের ছেলে আবু, তখনো বলতে পারছিনে যে তার ভাই আবুও আর নেই। বিড়বিড় করে বললাম, ‘হয়তো আসিব ফিরে এই বাংলায় মানুষ কিংবা শঙ্খচিল বেশে।’ দুজনের কান্নায় অনেক সময় চলে গেল। আমি কেনু ভাইকে শক্তভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কান্নার বেগ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পোড়খাওয়া মানুষ কেনু ভাই বুঝে নিলেন। বললেন, ‘স্যার লুকাচ্ছেন কেন, আমার ভাইটিও বুঝে নেই?’ কী জবাব দেব, চোখের জল কথা বলে দিল।
বড্ড ভেঙে পড়েছি। আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য নেই। প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আসছে, আহত হচ্ছে অনেকেই। হানাদার পাকিস্তানি কিংবা কুলাঙ্গার জামায়াত ছাত্রসংঘসহ অন্য পাকিস্তানপন্থিদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। নিজের জীবনটাকে আগের মতো এত মূল্যবান মনে হচ্ছে না। সে যা বলুক আমি আবুদের সঙ্গে মিশে যাবার কথা ভাবছি। মনি ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম, আমাকে আত্মঘাতী দলে অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তু না, মনি ভাই অবিচল, দৃঢ় ও শীতল। দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও রাগারাগির এক পর্যায়ে মনি ভাই আমাকে কোর্ট মার্শাল করবেন বলে ধমকে দিলেন। আমি বললাম, ‘আপনিত আবুকেও কোর্ট মার্শাল করতে চেয়েছিলেন, পারলেন কই?’ হঠাৎ মনি ভাই স্বর খুব নিচে নামিয়ে আনলেন, বাম হাতে সিগারেট ধরে ক্রমাগত টান দিচ্ছেন আর ডান হাত দিয়ে আমার কাঁধ আঁকড়ে ধরে ছোট ছোট পদে হাঁটতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘দেখ মান্নান, দেশ সহসা স্বাধীন হবে, এই যুদ্ধে তোমার যা করণীয় তা করেছ, পরের যুদ্ধে তোমাদের প্রয়োজন হবে ঢের বেশি। আমি তোমাকে হারাতে পারি না। তা ছাড়া তোমার পরিবার সম্পর্কে আমার সব জানা, আমি তোমার বিধবা মায়ের বুক ভেঙে দিতে পারব না। আমরা চাটগাঁয়ে যাচ্ছি। শিগগিরই একখণ্ড স্থায়ী ভূখণ্ড আমরাই দখল করে সেখানে আমাদের সরকারকে নিয়ে বসাব। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় করব। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। সেক্টরের দায়িত্ব তোমার রইল। একটা সমন্বয় কমিটি হয়েছে, তুমি তাতে মুজিব বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করবে। সময়মতো চাটগাঁয়ে ডাকব।’
মনি ভাইয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমি রয়ে গেলাম। তার ইচ্ছানুযায়ী দেশ গড়ার সুযোগ কোনোদিন পাইনি। যুদ্ধ শেষে অপবাদ পেয়েছি প্রচুর। ‘ষোড়শ ডিভিশন’ বা নকশাল হয়ে গেছি; ছেলেদের মাথা খাচ্ছি বা জাসদ হয়ে গেছি বলেও অপবাদ মাথায় ঝুলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলে যাওয়া চাকরিটা পুনরুদ্ধার করতে বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছিল। তারপরে নিঃশব্দে একা পথ চলা, বৃত্তি পেলাম। দেশ ছাড়লাম। দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ল না। ৩১ জুলাই ১৯৭৫ সালে দেশে ফিরে এলাম। মনি ভাই এবারে একটা বড় দায়িত্ব দিলেন। ১৫ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। নিহত হলেন মনি ভাইসহ আরো অনেকে। ড্রাগনের নিঃশ্বাস আমাদের গায়েও লাগল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কারণে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপিত হলো। বহু নির্যাতন আর লাঞ্ছনার পর আবারো দেশ ছাড়লাম। এবারে চাকরি নিয়ে, সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায়। সেখানে আরাম আর আরাম, গাড়িতে, বাড়িতে, অফিসে এয়ারকন্ডিশন, মাসে বড় অঙ্কের মাসোহারা, সম্মান, সমীহ ‘বিগ বসের’ কত আদর, কত কদর। না, শান্তি-স্বস্তি আর রাতের ঘুম আমাকে ছেড়ে গেছে। রোজ রাতে কী সব স্বপ্ন দেখি, থরথর করে কাঁপতে থাকি। ঘামে গা ভিজে যায়। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। বাকি রাত বিনিদ্র কাটিয়ে দেই। প্রতিরাতে ওরা আসে। মোজাম্মেল, আবু, সাফু, আবু তাহের, মতিন মাস্টার, নজরুল, কিবরিয়া, স্বপনরা আসে। মরে গেছে বলে তারা স্বীকার করে না, কেউ বলে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম, কেউ বলে ছুটিতে গিয়েছিলাম, কেউ বলে তোমাদের কাছ থেকে ক্ষণিকের জন্য সরে গিয়েছিলাম; কেউ বলে অপারেশনে গিয়েছিলাম। রক্তাক্ত ঝাঁঝড়া বুক, মস্তকবিহীন ধড়, কাটা হাত বা কাটা পা নিয়ে সামনে দাঁড়ানো মাত্রই অস্থির হয়ে যেতাম। কান্নায় বা চিৎকারে আমার স্ত্রীর ঘুম ভেঙে যেত। দেশে থাকাকালীন অবস্থায় এমনটা হতো। তবে সময়টা ছিল পঁচাত্তরের আগস্টের পর। যে সময় ভাবতাম পালিয়ে গেলে তারা আর পিছু তাড়া করবে না। এখন দেখছি হায়েনাদের তাড়া খেয়ে তারা ক্রমাগত আমাদের দিকেই ফিরে আসছে। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দিলাম। দেশে ফিরে স্বপদে সহসা যোগদান করতে পারলাম না। স্বজনরা বা সহযোদ্ধারা সংকট বাধিয়ে দিয়েছে। আবারো ঘুম নেই। আবারো তারা আসছে। হঠাৎ আন্দোলনের ডাক। ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। নিজকে জড়িয়ে নেই, না, নাম ফুটাবার জন্য নয়, জনপ্রিয়তা দিয়ে সংসদ বা মন্ত্রিত্বের জন্য নয়, শুধু একটু শান্তির ঘুম ঘুমাতে। আমরা ল²ীর বরপুত্র হতে চাইনি, অমরাবতীর পুত্র-কন্যা হবার অভিলাষ আজো আমাদের আছে। আবুরা বেশ কিছুদিন হলো আসে না। শিগগিরই আসতে শুরু করবে হয়তো। তখন বিকালের নরম রোদে দেহের লোমগুলোর উষ্ণতা দিয়ে শীতার্ত আবুদের অবসন্নতা ঘুচাতে পারব কি?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়