খালেদার গুলশান কার্যালয়ে পুলিশের তল্লাশি

আগের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হোক মূলমন্ত্র : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

পরের সংবাদ

নজরুলের বাংলাদেশ মুজিবের নজরুল

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির-মধুর।/বুকে নিরবধি বহে শত নদী/চরণে জলধির বাজে নূপুর \’ বাংলাদেশের এই যে ছবি কবি এঁকেছেন সে তো আমাদের এই বাংলাদেশ- ‘এই দেশ মাটি জল ও ফুলে ফলে,/যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,/এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে/ঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর \’ চির ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন তিনি এ বুকেই। ‘বাংলাদেশ’ নামটা নজরুলের, ‘এই আমাদের বাংলাদেশ এই আমাদের বাংলাদেশ।/যেদিকে চাই ¯িœগ্ধ শ্যামল চোখ জুড়ানো রূপ অশেষ\’ ‘পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা-বিধৌত পূর্ব-দিগন্তে/তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী অন্তে।/ঊর্মিছন্দা শত-নদী¯্রােত-ধারায় নিত্য পবিত্র-/সিনান-শুদ্ধ-পূর্ববঙ্গ/ শক্তি-প্রবুদ্ধ পূর্ববঙ্গ।’ এই পূর্ববঙ্গে তিনি খুঁজে পান তার প্রেম-ভালোবাসা, ‘ও পদ্মারে! ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো,/মোর বধুয়ার রূপ তেমনই ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।’ ‘পাইবে যে দেশে কুন্তল সুরভী বকুল ফুলে/আমার প্রিয়া কাঁদে এলায়ে কেশ সেই মেঘনা কূলে।’ কিম্বা ‘ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলী তোদের ভাটির ¯্রােতে/নিয়ে যা আমার না-বলা কথাগুলি ধুয়ে মোর বুক হ’তে।’ অজয়ের কুলের মানুষ, পূর্ববঙ্গের নদী জল ফুলে ফলে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন- ভালোবেসেছিলেন এর গণমানুষকে। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দুর্গতিতে ছিলেন বিচলিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘বাংলার মুসলমানকে উন্নত করার মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এদের আত্মজাগরণ হয়নি বলেই ভারতের স্বাধীনতার পথ আজ রুদ্ধ।’ বাঙলার মুসলমানকে জাগাতে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুরে নানা সমাবেশে মিলাদে মহফিলে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, জাগরণী গান গেয়েছেন। এমনই এক সমাবেশের আয়োজকদের একজন ছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান; ফরিদপুরে (জেলা মোছলেম) ছাত্রলীগের সম্মেলনে (১৯৪১) তারা আমন্ত্রণ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে, সাথে আরো দু’চারজন। ১৪৪ ধারা জারি করে সে সম্মেলন পণ্ড করা হয়, তবু কাজী নজরুল গান শোনান ঘরোয়া জমায়েতে। বক্তৃতা করেন মসজিদে।
অতি গৌরবের আমাদের এই যে ভাষা আন্দোলন তার ভীত রচনাকারীদের একজন ছিলেন কাজী নজরুল। স্যার আব্দুর রহিম মুসলমানদের বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা শিক্ষা করতে বললে ১৯২৬ সালে নজরুলের লাঙল পত্রিকায় লেখা হয়, ‘স্যার আব্দুর রহিম বলেছেন, বাংলা ভাষা যদি শিক্ষার বাহন হয় তাহলে বাঙালি মুসলমানের সর্বনাশ হবে। মাতৃভাষার মধ্যবর্তিতায় সব প্রকারের উচ্চ শিক্ষা লাভ করা যে একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত উপায় তার মতো উচ্চ শিক্ষিত লোক একথা খুব ভালো করেই জানেন। তা সত্ত্বেও তিনি মুসলমানদের জন্য কানা গরুর পৃথক বাথান সৃষ্টি করতে চান। বাংলাদেশের আলেমগণ আব্দুর রহিমের অবৈজ্ঞানিক অভিমতের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।’ চট্টগ্রামে কাজী নজরুল ভাষণ দেন (১৯৩২), ‘বাংলার সকল চিন্তাশীল মুসলমানের অনুরোধ করছি, যদি পারেন মাতৃভাষায় আপনাদের সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস-সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভূমি যেখানে হোক প্রতিষ্ঠা করুন। তা না পারলে অনর্থক ধর্ম ধর্ম বলে ইসলাম বলে চিৎকার করবেন না।’ এই প্রতিবাদ এই আহ্বান এক সময় পরিণত হয় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে।
কবি নজরুল মুসলিম জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ তার ছিল না। এ বিষয়ে মুজিব তার ভাবশিষ্য। নজরুল বলেন, ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’ “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাঙলা’- সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙলাই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। …বাংলার জয় হোক!” এই যে ‘বাংলার জয় হোক’ বা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি- নজরুলই তার উদ্গাতা (১৯৪২)।
নজরুল সর্বাগ্রে বাঙালি মুসলমান, তারপর বাঙালি তারপর ভারতীয়। শেখ মুজিবও একই ধারার। চল্লিশের দশকে শেখ মুজিব ছিলেন প্রবলভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদী, পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সংগঠক (দ্রষ্টব্য তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃ. ২৩।)
সে সময়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল চরম পর্যায়ে। নজরুল লিখেছেন, ‘হিন্দু মুসলমানকে ছুঁইলে তাহাকে ¯œান করিতে হইবে, মুসলমান তাহার খাবার ছুঁইয়া দিলে তাহা তখনই অপবিত্র হইয়া যাইবে, তাহার ঘরের যেখানে মুসলমান গিয়া পা দিবে সে-স্থান গোবর দিয়া(!) পবিত্র করিতে হইবে, তিনি যে আসনে বসিয়া হুকা খাইতেছেন মুসলমান সে আসন ছুইলে তখনই হুকার জলটা ফেলিয়া দিতে হইবে- মনুষ্যত্বের কি বিপুল অবমাননা!’ এই অবমাননার শিকার স্বয়ং শেখ মুজিব নিজে; সে বিবরণ আছে তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। মুসলমান তখন অধিকার-বঞ্চিত নিগৃহীত। তাদের মর্যাদা ও অধিকার পুনরুদ্ধারের কৌশল হিসেবে উত্থিত হয় পাকিস্তান প্রস্তাব- ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে একাধিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। ফজলুল হক লাহোরে যে পাকিস্তান প্রস্তাব পাঠ করেন সেই প্রস্তাব অনুযায়ী অভিক্ত বাংলা এবং আসাম মিলে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন দেশ হওয়ার কথা। নজরুল সোৎসাহে এই চেতনার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ ধীরে ধীরে মূল প্রস্তাব থেকে বিচ্যুত হয়ে এক পাকিস্তান নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে এবং বাংলাকে ভাগ করার চিন্তা হয়। ফজলুল হক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং এর তীব্র বিরোধিতা করেন। নজরুলও এই পাকিস্তানকে ফাকিস্তান বলে বিদ্রুপ করেন। বলেন, ‘বাংলাদেশকে ভাগ করা মানে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া- বাঙালির সভ্যতা সংস্কৃতি শুধু হিন্দুরাও গড়েনি, মুসলমানরাও গড়েনি- এই দুই সম্প্রদায় এক সঙ্গে বাঙালি জাতিকে তৈরি করেছে। একে ভাগ করবেন কি করে? একটা সাময়িক ব্যাপার টেনে যদি তা করা হয়, তাহলে আমাদের সবার যে কি সর্বনাশ হবে তা পরে বুঝবেন।’ একাত্তরে বাঙালি রক্ত দিয়ে তা বুঝেছে।
উনিশশ ছেচল্লিশের নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ মুজিব তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুসারী। সাতচল্লিশে মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং কংগ্রেসের শরৎ বসু একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন যে, অবিভক্ত বাংলা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নার এতে সম্মতি ছিল। শেখ মুজিব এই মতের সমর্থক ছিলেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ. ৭৪)। কিন্তু তা হয়নি, বাংলাকে দু’ভাগ করে পূর্ববঙ্গকে ঠেলে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী চলে যান করাচি। উনিশশ ঊনপঞ্চাশে ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়, কারাবন্দি শেখ মুজিব হন যুগ্ম সম্পাদক। তেপ্পান্নর মে মাসে তিনি করাচি যান। সোহরাওয়ার্দীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গী-সাথীরা মুজিবের কাছে নজরুলের কবিতা শুনতে চান। শেখ মুজিব শুনিয়ে দেন তার প্রিয় কবির কবিতা- ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ আরো কয়েকটি কবিতার অংশ। মোগলটুলির আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যালয়ে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলের সংগ্রামী জীবন ও বিপ্লবী কবিতা এবং গান নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করে নতুন ইতিহাস তৈরি করেন। …প্রবন্ধটি পাঠ করেন মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। ইত্তেফাকে লেখা হয় (১৯৫৩ ১৮ জ্যৈষ্ঠ), ‘এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি কবি নজরুল ইসলামের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্রোহী জীবনযাত্রার এক নিখুঁত আলোচনা …বর্তমান শোণিত লোলুপ জগতের অত্যাচার ও অবিচারের কণ্ঠরোধের জন্য কবির বৈপ্লবিক জীবনাদর্শ ছাত্র-যুবক ও জনগণের কতখানি প্রয়োজন তাহাই প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয় (অনুপম হায়াৎ)।’
উনিশশ বিয়াল্লিশ সালে, অসুস্থতা দেখা দেয়ার সময়, কবি নজরুল থাকতেন কলকাতার শ্যামবাজারে একটি দোতলা বাড়িতে। ভাড়া বাকি পড়ায় সে বাড়ি ছাড়তে হয়। তারপর চটকলের শ্রমিক বস্তিতে। তারপর বাদুড়বাগানে সরকারের রিকুইজিশন করা বাড়িতে, সেখান থেকেও তিনি উৎখাত হন। আশ্রয় নেন রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিটের দুর্গন্ধময় গলিতে একটি গোয়ালের ছাদে, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে যেতে হতো সেখানে; পরিবারের স্থান সংকুলান হতো না। কবির দুর্দশায় কাতর তার গুণগ্রাহী আব্বাস উদ্দীন আহমদ ঢাকা থেকে প্রমীলা নজরুলকে লেখেন (২৩/২/৫১), ‘আমার পরম আরাধ্য কাজিদার কাছে আমার দেহের প্রতিটি লোমকূপ পর্যন্ত আমরণ ঋণী …কাজীদাকে নিয়ে যদি আপনারা ঢাকায় চলে আসেন তাহলে আপনাদের চিকিৎসা থেকে আরম্ভ করে যত রকম সুখ সুবিধার বন্দোবস্ত করার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব। …আপনাদের দুজনের চিকিৎসার জন্য দুনিয়ার যে প্রান্তে সব চাইতে ফলপ্রসূ চিকিৎসালয় আছে সেখানে পাঠাবার বন্দোবস্ত দেশবাসী করবে।’ করাচিতে নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে (১৯৫০) উচ্চারিত হয়, ‘নজরুল পাকিস্তানের জাতীয় কবি। নজরুল পাকিস্তানের কোথাও এলে তাকে আর ফিরে যেতে দেয়া হবে না। তিনি পাকিস্তানেই থাকবেন। আমরা তাকে মাথার মণি হিসেবে তার থাকা খাওয়ার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।’ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বড় ভাই শাহেদ সরওয়ার্দী সভাপতিত্ব করেন এ অনুষ্ঠানে। ঢাকার পত্রিকায় লেখা হয়, ‘নজরুলকে বাঁচাইতে হইলে …নজরুলকে পাকিস্তানে আনা বিশেষ দরকার।’ ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার কলকাতা গিয়েছিলেন। কবি পরিবারের সাথে তার দেখা হয়। তিনি নজরুল পরিবারকে ঢাকায় আনার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। কিন্তু কবি পরিবার তখন দেনায় আকণ্ঠ ডুবে আছেন। দেনা শোধ না করে কলকাতা ত্যাগ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কবি পরিবারের প্রত্যাশা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে কবির উপযুক্ত কদর হবে। কায়েদে আযম ত্রাণ তহবিলের নিকট কাজী সব্যসাচী দরখাস্ত করেন (১/৩/১৯৫০) ‘আমার পিতা দীর্ঘ ৯ বছর কলকাতায় মারাত্মক অসুখে ভুগছেন। আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা ও আহারের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। বর্তমানে আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস পশ্চিম বঙ্গ সরকারের মাসিক ২০০ টাকা সাহিত্য ভাতা। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পেনশন ১৫০ টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। আমাদের সংসার চালাতে গিয়ে বহু ঋণ হয়ে গেছে। সম্প্রতি আমাদের ১৬ রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিটে চলে আসতে হয়েছে। ভাড়া একশ টাকা- এখানে ছাদের ওপর ছোট্ট একটি কুঠুরীতে থাকতে হচ্ছে যা বাবা মার স্বাস্থের জন্য হানিকর। বাবার চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে হবে। এসব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করার পূর্বে আমাদের সম্পূর্ণ ঋণ শোধ করতে হবে যেজন্য ৫০০০ টাকা প্রয়োজন।’ এই ৫০০০ হাজার টাকার জোগাড় সম্ভব হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে আসাও হয়নি। আর্থিক অনটনে ছেলেদের লেখাপড়া থেমে যায়। কায়েদে আজম রিলিফ ফান্ড থেকে কোনো অনুদানের ব্যবস্থা তো হয়নি বরং তারা নজরুল ইসলাম কাফের হিন্দু ইত্যাদি বলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান। পাকিস্তানে এমন মতবাদও ছিল যে, পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন নজরুল সুতরাং মুসলমান সমাজ থেকে তিনি কোনো সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নন। কবি নজরুলের নামে ঢাকার রাস্তার নামকরণের প্রস্তাবও নাকচ হয়ে যায় নজরুল পাকিস্তানবিরোধী এবং তিনি ভারতীয় নাগরিক এই অজুহাতে। বাষট্টি সালে কলকাতায় কবিপুত্র সব্যসাচী একটি ভাড়া বাসা পান। সেখানে কবিকে নিয়ে যান- ‘ঘুপচি গলিতে দুটো ছোট ছোট ঘরের সে ফ্লাটে থাকতেন সব্যসাচী… (একটা ঘর সব্যসাচী আবৃত্তির পাঠশালা ও অন্য কাজে ব্যবহার করতেন) আর ছোট দশ বাই আট ঘরে সিঙ্গেল চৌকির ওপর শুয়ে কবি নজরুল… তার পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে কোনোমতে ঘুমিয়ে খিল খিল আর মিষ্টি। নিচে মেঝেতে শিশু বাবুলকে নিয়ে উমা, পাশের কারখানার শব্দ আর বস্তির হৈ হল্লা।’ এমন পরিবেশে বাঁচতে হয় কবিকে। কবিপুত্রদের লেখাপড়া থেমে যায় অর্থাভাবে। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব যখন কলকাতা যান তখন কবির বাসায় যেয়ে কবিকে দেখে আসেন, সালাম করেন, ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
পূর্ব বাংলা একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ অর্জন করে। আকাশ বাতাস মুখরিত হয় গানে গানে- ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ’। ১০ জানুয়ারি বাহাত্তরে শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কলকাতা যান। কবি পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রস্তাব দেন কবি নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসার। কোনো সাধারণ মানুষের প্রস্তাব নয়- বাংলাদেশ সরকারের সরকার-প্রধানের প্রস্তাব। সশস্ত্র যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশে তখন শত-সহ¯্র সমস্যা; সমস্যার বারুদ-গোলার উপরে আসীন শেখ মুজিব। তবু কবিকে তিনি ভোলেননি, তার জন্য তার প্রাণের আকুতি তাকে প্রেরণা দিয়েছে। নজরুলের কত বড় অনুরাগী হলে এমনটা সম্ভব! তিনি কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। কবির জন্য ঢাকায় বাড়ি ঠিক করা হয়- দূরে গুলশান বনানীতে নয়, মুজিবের বাড়ির খুব কাছেই ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডে। বাড়িটি নতুনভাবে সজ্জিত করা হয় কবি থাকবেন বলে। আসবাবপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ফ্রিজ, গ্যাস, ফোন, সোফা সবকিছুই দেয়া হয়েছিল। ‘কবি থাকবেন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে। বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হবে প্রতিদিন কবির সম্মানে।’ কবি এলেন ২৪ মে ১৯৭২। বিমানবন্দরে মানুষের ভিড়- সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা, সরকারি কর্মকর্তা, আপামর জনতা কবিকে বরণ করে আনতে। ভিড় এড়িয়ে অতি কষ্টে কবিকে আনা হলো ধানমন্ডি। সাথে কবির পুত্র পুত্রবধূগণ, পৌত্র পৌত্রী আরো কয়েকজন। কবিকে ঢাকায় আনার জন্য অতীতে অনেক কথা, অনেক বক্তৃতা বিবৃতি হয়েছে, পশ্চিম বঙ্গ থেকে তাকে ছাড়া হবে না এমন আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র ছ’ মাসের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাকে নিয়ে এলেন। তাকে ঢাকায় আনার জন্য উৎসাহী অনেকইে ছিলেন, মূল চালিকাশক্তি ছিলেন শেখ মুজিব।
কবির জন্য গাড়ি বরাদ্দ হয়েছিল। কবির স্বাস্থ্যের যতœ নেয়ার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠিত হয়েছিল, ছিল পরিচর্যার লোকজন। ৩০ বছর দুর্বিষহ পরিবেশে যে করুণ জীবন কবি যাপন করতেন তার অবসান হলো। স্বাচ্ছন্দ্যময় বাড়ি পেলেন, সবুজ আঙিনা পেলেন। পেলেন প্রতিদিন অগণিত ভক্তের সারি। শেখ মুজিব মাঝে মাঝে যেতেন কবির পাশে। কবি শুয়ে আছেন চৌকিতে। মাথার কাছে নিচে বসে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন কবির মাথায়- রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি শেখ মুজিব।
কবির স্ত্রী পুত্র পরিজন দীর্ঘ ৩০ বছর সন্বিতহারা কবির সেবা শুশ্রƒষা করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের এই আদর যতেœ তারা বিমোহিত হয়েছিলেন, আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদেরও জীবন জীবিকার বিষয় ছিল। তারা একে একে ফিরে যান, কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধ চুয়াত্তর সালের গোড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে উমা কাজী ঢাকায় অন্যত্র সংসার পাতেন। তার সন্তানরাও কলকাতা চলে যান। শেখ মুজিব ব্যথিত হন। সব্যসাচীকে প্রস্তাব করেন কবিকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু সব্যসাচী দ্বিধান্বিত ছিলেন। এমন অবস্থায় শেখ মুজিব পিজি হাসপাতালের মহাপরিচালককে ডেকে পাঠান। পঁচাত্তরের ২২ জুলাই কবিকে পিজি হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রফেসর নুরুল ইসলাম লেখেন, ‘বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন কবি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন যেন হাসপাতালেই কাটাতে পারেন। ১৯৭৫-এর ২৩ জুলাই কবিকে স্থানান্তর করা হয় কেবিনে। হাসপাতালে কবিকে সবাই অতি আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মাঝে-মাঝে কেবিনের ভেতর পায়চারি করতেন তিনি। কখনো কেবিনের বারান্দায়। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ কবির আরোগ্য লাভের আশায় পিজি হাসপাতালে কবির জন্য মিলাদ হয়, ২৭ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে কবি জ¦রে আক্রান্ত হন, শনিবার বোঝা গেল ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া, জ¦র ১০৫, মেডিকেল বোর্ড দেখলেন, (পরদিন ২৯ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে কবি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, আরো ১০ মিনিট পর ঘুমিয়ে পড়েন চিরতরে।
পশ্চিম বঙ্গের লেখক সাংবাদিক জিয়াদ আলী লিখেছেন, কবির মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কবির প্রতি যে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়, কলকাতায় মারা গেলে সেই সম্মানে ভূষিত হতেন না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তখন গাছ হয়নি। কবির নামাজে জানাজায় অগণিত মানুষ। কবির শোকে শোকাহত। অগণিত ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আকুতিতে বিশ্ব-বিধাতার করুণা কি বর্ষিত হয়নি কবির আত্মাতে! বাংলাদেশে কবিকে যারা দেখাশোনা করেছেন, চিকিৎসা করেছেন, সেবাযতœ করেছেন- তারা চাকরি মনে করেননি। একান্ত আপনার জনকে, একটা বিরাট মানুষকে, সেবা করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন নজরুলের ভক্ত অনুরাগী সকলে, আপামর জনগণ। জনগণের কবিকে জনগণের কাছে এনে দিয়ে গেছেন তার অনুরক্ত ভক্ত শেখ মুজিব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়