নার্ভাস নাইনটিতে সবজির দাম

আগের সংবাদ

তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় এনে দেশকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে

পরের সংবাদ

নজরুলের ‘মহামায়া’

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুর্গাপূজা সারা বাংলায় অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই পূজার ব্যাপকতা সম্পর্কে নজরুলের স্বদেশ বন্দনা, ‘শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া / শিউলি ছোপানো শাড়ি পরে ফেরো আগমনী গীত গাহিয়া।’ নজরুলের রচনা দেবী দুর্গাকে জানতে সহায়ক। পুরাণের উপাখ্যানে দক্ষের কন্যা সতী বিবাহ করেন শিবকে। পিতৃগৃহের অনুষ্ঠানে জামাতা শিব নিমন্ত্রিত না হওয়ায় সতী অভিমানে আত্মহত্যা করেন এবং পুনরায় জন্ম গ্রহণ করেন হিমালয়ের কন্যা পার্বতী (উমা) নামে। তপস্যা করে উমা পুনরায় শিবকে পতি হিসেবে পান। শিবের বসবাস দূর গিরি পর্বত কৈলাসে- তিনি গিরিরাজ। দেবী দুর্গা কৈলাস হতে মাতৃগৃহে আসেন আবার কৈলাসে ফিরে যান- দুর্গাপূজার অন্যতম প্রতিপাদ্য এই। ত্রেতা যুগে সীতাকে উদ্ধারের জন্য শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে শ্রীদুর্গার বোধন করেন। নজরুলের কবিতায়, ‘এমনি শরৎ সৌরাশ্বিনে / অকাল-বোধনে মহামায়ার /যে পূজা করিল বধিতে রাবণে / ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার’, সেই সময়ের স্মরণে শরৎ কালে করা হয় সর্বজনীন দুর্গাপূজা। কিন্তু যে প্রতিমা গড়া হয় সেই প্রতিমায় দেবী দুর্গার দশ হাতে অস্ত্র, তিনি সিংহ-বাহনে আরুঢ়া, মহিষকে সংহাররতা, রণরঙ্গিনী। এই প্রতিমা মারকণ্ডেয় পুরাণের আখ্যাননির্ভর। যখন দেবতাদের নিধনের অভিপ্রায়ে অসুররা আগ্রাসী ছিল তখন সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি আবির্ভূতা হন জ্যেতির্ময়ী নারীরূপিণী চণ্ডিকা/অম্বিকা রূপে, যার জ্যোতিতে আকাশমণ্ডল আলোকে উদ্ভাসিত হয়; তিনি প্রচণ্ড শক্তিতে অসুরদের পরাজিত ও অসুরদের প্রধান মহিষকে (মহিষ নামক অসুরকে) বধ করেন। (মারকণ্ডেয় পুরাণ, অধ্যায় ৭৯-৮২) মারকণ্ডেয় পুরাণের এসব অধ্যায় থেকেই মহালয়ায় চণ্ডীপাঠ। দুর্গাপূজার প্রতিমা মহিষাসুর মর্দিনী রণরঙ্গিণী, শ্বশুরালয় থেকে আগতা কন্যার বেশো নয়। নজরুল লেখেন, ‘অসুর বাড়ির ফেরৎ এ মা, / শ্বশুর-বাড়ির ফেরৎ নয়।/ দশভুজার করিস পূজা / ভুলরূপে সব জগৎময়।’ মহিষাসুর মর্দিনীর (দনুজ-দলনীর) প্রতিমাকে নজরুল আখ্যায়িত করেন রূপক হিসেবে, ‘মহিষাসুর ক্রোধের প্রতীক। ক্রোধই অশান্তি, অতৃপ্তি, বিরোধ, হিংসা, দ্বেষ, দ্বিধা, সন্দেহ প্রভৃতি অকল্যাণের হেতু। … এই ক্রোধরূপী মহিষাসুর নিধনপ্রাপ্ত হইলেই অতৃপ্তি, অশান্তি, বিরোধ, হিংসা, কলহ প্রভৃতি জগতের সমস্ত অকল্যাণ বিদূরিত হয়। উহারাই মহিষাসুরের সেনাবৃন্দ। ক্রোধরূপী পশুকে হত্যা করেন বলিয়া দেবী পশুরাজ-বাহিনী।’ (নজরুলের গীতি আলেখ্য ‘দেবীস্তুতি’)
দেবী দুর্গার অনেক নামের মধ্যে নজরুল পঞ্চাশের মতো নাম ব্যবহার করেছেন- শ্যামা, দুর্গা (দুর্গম, অপরাজেয়), চণ্ডী (প্রচণ্ড), ব্রাহ্মী, পরব্রহ্মরূপিণী, মহাবিদ্যা, আদ্যাশক্তি, পরমেশ্বরী, মহামায়া, চণ্ডিকা, অম্বিকা, মহেশ্বরী, ইচ্ছাময়ী, তারা, কালী, উমা, পার্বতী, শিবানী, ভবানী ইত্যাদি। অতি সংক্ষিপ্ত কথায় দেবীর পরিচয় দিয়েছেন কবি, ‘ব্রহ্মময়ী পরাৎপরা ভব ভয় হরা / … জগত-জন-জননী / দনুজ-রিপু দলনী / … মহিষাসুর মর্দিনী / ত্রিভুবন পালিনী / অশিব নাশিনী /অয়ি শিব স্বয়ম্বরা \ … সৃজন-প্রলয় পায়ে / যুগল নূপুর পরা \’
শিব-স্বয়ম্বরা হৈমবতী উমার পূজারিণীর আর্তির মাঝে রণরঙ্গিনী মহামায়ার রূপও বর্ণিত নজরুলের শ্যামাসংগীতে, ‘আমার উমা কই গিরিরাজ! / কোথায় আমার নন্দিনী। / এ যে দেবী দশভুজা / এ কোন রণরঙ্গিনী \ / মোর লীলাময়ী চঞ্চলারে ফেলে, / এ কোন দেবীমূর্তি নিয়ে এলে। / এ যে মহিয়সী মহামায়া বামা মহিষ-মর্দিনী \ / … কে এলি মা দনুজ-দলিনী বেশে।’ প্রতিমা পূজারির আকুতি তার গানে, ‘তোর বিগ্রহ কি মায়া জানে / (আমি) যত দেখি তত কাঁদি ঐ রূপ দেখি মা সকল খানে \ / ওমা রাত্রে নিতুই ঘুমের ঘোরে দেখি বুকের কাছে / যেন প্রতিমা তোর মায়ের মত জড়িয়ে মোরে আছে।’ মাটির প্রতিমা মৃন্ময়ী (মাটির তৈরি) কিন্তু তার ওপারে অবিনশ্বর মহাশক্তি চিন্ময়ীর (চেতনাময়ী) তিনি আবাহন করেন, ‘মা গো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়। / মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা, / তাই দুর্গতি কাটিল না, হায়! / যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন, / অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ, / মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী- / সেই দুর্গারে দেশ চায় \’ ‘মন্দিরে মন্দিরে মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা খালি! / শক্তিরে খুঁজি পটুয়ার পটে, মাটির মুরতি মাঝে / চিন্ময়ী শ্রীচণ্ডিকা তাই প্রকাশ হলো না লাজে।’ এবং ‘খড়ের প্রতিমা পুজিস রে তোরা, / মাকে তো তোরা পুজিস নে। /… মাটির প্রতিমা গলে যায় জলে, / বিজয়ায় ভেসে যায়, / আকাশ-বাতাসে মা-র স্নেহ জাগে /অতন্দ্র করুণায়।’ মাটির প্রতিমা জলে ভেসে যায়; কিন্তু প্রতিমার অন্তরালে যে সত্তা বিরাজ করেন তার স্নেহ করুণা সর্বব্যাপী সদা ব্যাপ্ত।
শ্যামাসংগীত নজরুল রচনা করেছিলেন গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রয়োজনে। কিন্তু তার শ্যামাভক্তির একটি গান, ‘ফিরিয়ে দে মা ফিরিয়ে দে / ও মা দে ফিরিয়ে মোর হারানিধি! / তুই দিয়ে নিধি নিলি কেড়ে / মা তোর এ কোন নিঠুর বিধি \ / বল মা তারা কেমন করে / নয়ন-তারা নিলি হরে, / দিলি মা হয়ে তুই শিশুর বুকে / নিঠুর মরণ-সায়ক বিঁধি \ / তরু যেমন শিকড় দিয়ে তাহার মাটির মা’কে / জড়িয়ে ধরে থাকে স্নেহের সহস্র যে পাকে; / মা গো তেমনি করে তাহার মায়া / আঁকড়ে ছিল আমার কায়া, / তারে নিলি কেন মহামায়া / শূন্য করে আমার হৃদি \’ গানটি তার পুত্রশোক মনে করিয়ে দেয়; এ গানে এই মৃত্যু হেনেছেন মা মহামায়া, জন্মও দিয়েছেন মা তারা বা মহামায়া। কবি নজরুল তার মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী দেবীকে একটি ব্যক্তিগত পত্রে লেখেন (১৯৩৫), ‘আমি এখন … কারুরই কোনো পার্থিব উপকার করতে পারি নে। … সংসারের যেটুকু কাজ মহামায়া করিয়ে নিচ্ছেন, তা সে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা …। … আমার পাপ-পুণ্য সকল কিছু নিবেদন করেছি মা অম্বিকার শ্রীচরণে।’ নজরুলের এই মহামায়া অম্বিকার স্বরূপ কেমন? পরবর্তী আলোচনায় সেই স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টা করা যাবে।
নজরুলের এই মহামায়া দৃষ্টিগ্রাহ্য সীমাবদ্ধ কোনো জড় জীব নয়। নজরুলের মহামায়া
মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা।
পরমা প্রকৃতি জগদম্বিকা, ভবানী ত্রিলোক-পালিকা \ …

কোটি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মা মহামায়া, তব মায়ায়
সৃষ্টি করিয়া করিতেছ লয় সমুদ্রে জলবিম্ব-প্রায়।
অচিন্ত্য পরমাত্মারূপিণী …।’ (দেবীস্তুতি)
হিন্দু শাস্ত্র মতে, ব্রহ্ম হচ্ছেন আদি শক্তি, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর। সৃষ্টি কর্ম সম্পাদনের সময় তার নাম ব্রহ্মা, সৃষ্টির স্থিতির ভূমিকায় তার নাম বিষ্ণু এবং এই সৃষ্টির প্রলয় কর্মে তার নাম রুদ্র। কথাটি অন্যভাবেও উপস্থাপন করা হয় যে, সৃষ্টির কাজের জন্য ব্রহ্ম সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মাকে, স্থিতির জন্য বিষ্ণুকে এবং প্রলয়ের জন্য রুদ্রকে। নজরুলের মহামায়া অচিন্ত্য (অকল্পনীয়) পরমাত্মারূপিণী সেই সত্তা, যিনি ব্রহ্মা বিষ্ণু ও রুদ্রকে সৃষ্টি করেন, শুধু একবার নয় কোটি বার। অর্থাৎ মহামায়া সব কিছুর স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। নজরুলের বিদ্যাপতি নাটকে এই শক্তির পরিচয়,
জয় জগজ্জননী, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-বন্দিতা, জয় মা ত্রিলোকতারিণী।
জয় মা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী নন্দনলোক-নন্দিতা
জয় দুর্গতিহারিণী \ …
তুমি শাশ্বতি, সৃষ্টি-স্থিতি, তুমি মা প্রলয়কারিণী \
এই মহামায়া এমন সত্তা যাকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর (রুদ্র) বন্দনা করেন; তিনিই সবেসর্বা, তিনি শাশ্বতি (অনুৎপন্না, অবিনশ্বর), তিনিই স্রষ্টা তিনিই পালনকারিণী এবং তিনিই প্রলয়কারিণী। দেবীভগবত পুরাণ গ্রন্থের টিকোপক্রমণিকায় কথিত, ‘এই … মহামায়াই এই সমস্ত বিশ্বজগতের সৃষ্টি, পালন ও সংহার করিয়া থাকেন’ (বরদাপ্রসাদ বসু সম্পাদিত শ্রীমদদেবীভাগবতম)। শ্রীমদদেবীভাগবতম পুরাণের প্রথম স্কন্দ চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সেই শক্তির (অর্থাৎ মহামায়ার) প্রদত্ত শক্তি বলে ব্রহ্মা সৃজন, বিষ্ণু পালন ও রুদ্র সংহার করেন; সকলে সেই আদ্যাশক্তিরই অধীন, সে জন্য তারা সেই ব্রহ্মরূপিণী মহাশক্তির ধ্যান করেন। সেই ভগবতীর পাদপদ্ম ভজনা করেন।’ (শ্রীমদদেবীভাগবতম প্রথম স্কন্দ চতুর্থ অধ্যায় ৪৮-৬৪)।
ফলত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের স্ত্রীবাচক নাম ‘মহামায়া’- মাতৃরূপিণী পরমেশ্বরী। নজরুলের শ্যামাসংগীতে এই ‘(মায়ের) অসীম রূপ-সিন্ধুতে রে / বিন্দুসম বেড়ায় ঘুরে, /কোটি চন্দ্র সূর্য তারা / অনন্ত এই বিশ্ব জুড়ে \’ কবি বলেন, ‘মা কবে তোরে পারব দিতে / আমার সকল ভার। / ভাবতে কখন পারব মা গো / নাই কিছু আমার \ / (কারেও) আনিনি মা সঙ্গে করে, / রাখতে নারি কারেও ধরে / তুই দিস, তুই নিস মা হরে- / কোথায় অধিকার / আমার কোথায় অধিকার \ / হাসি, খেলি, চলি, ফিরি ইঙ্গিতে মা তোরই, / তোর মাঝে মা জনম লভি, তোরই মাঝে মরি। / পুত্র মিত্র কন্যা জায়া / মহামায়া তোর এ মায়া, / মা তোর লীলার পুতুল আমি।’ আবার ‘আমায় যারা দেয় মা ব্যথা, আমায় যারা আঘাত করে, / তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী। /আমায় যারা ভালবাসে, বন্ধু বলে বক্ষে ধরে / তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী \ / আমায় অপমান করে যে / মা গো তোরই ইচ্ছা সে যে, / … আমার ক্ষতি করতে পারে অন্য লোকের সাধ্য কি মা, / দুঃখ যা পাই তোরই সে দান, মা গো সবই তোর মহিমা।’ জগৎ সংসারে যা কিছু ঘটছে তা সেই ইচ্ছাময়ী মায়ের নির্ধারিত বিধিতেই ঘটছে। (অবশ্য নারীবাচক শব্দে ঈশ্বরকে প্রকাশ করার প্রচলন কম।)
নজরুল বলেন, এই মাকে মানুষ নানা নামে ডাকে, ‘আমার মা আছে রে সকল নামে, / মা যে আমার সর্বনাম।/ … ভালোবেসে আমার শ্যামা মাকে / যার যাহা সাধ সেই নামে সে ডাকে, / … নিরাকারা সাকারা সে কভু, / সকল জাতির উপাস্য সে প্রভু, / নয় সে নারী নয় সে পুরুষ, /সর্বলোক তাহার ধাম \’ নারীবাচক শব্দে প্রকাশ, কিন্তু তিনি নারী নন, নরও নন।
‘দেবীস্তুতি’ গীতি আলেখ্যে (১৯৩৮) নজরুল তার আপন ভাষ্যে পরব্রহ্মরূপিণী দেবী আদ্যাশক্তির (জগৎ সৃষ্টির আদি কারণ) পরিচয় দিয়েছেন, ‘তন্ত্রে শ্রীমহাকাল বলিতেছেন : মা ব্রহ্মময়ী! তুমি চিন্তার অতীত … কেবলমাত্র অনুভবের সামগ্রী। মা! তুমি পরব্রহ্মরূপিণী! যিনি আদ্যাশক্তি তিনিই পরমাত্মা। … আদিঅন্তহীন কালের বক্ষে লীলা করেন বলিয়া তিনি কালী। বিশ্বের সকল কিছুকে আকর্ষণ করেন বলিয়া তিনি কৃষ্ণ। … বিশ্বের সকল জড়-জীব বিভিন্ন নামে তাঁহাকেই উপাসনা করে। সকল নামের নদী- ঐ পরমাত্মারূপিণী মহাসাগরে গিয়া মিলিয়াছে- এক কথায় তিনি সর্বনাম। যিনি নির্গুণা, নিরাকারা, চৈতন্যরূপিণী, কেবল অনুভব-সিদ্ধা, তাঁহাকে কোন নামে ডাকিব? তিনিই আদি পিতা, তিনিই আদি মাতা, অথচ তিনি পুরুষও নন, নারীও নন। জীব যখন তাঁহাকে পিতা, স্বামী, সখা পুত্র-রূপে উপাসনা করে, তখন তিনি পুরুষরূপে দেখা দেন। যখন মাতা বলিয়া, কন্যা বলিয়া স্তুতি করে, তখন তিনি নারীরূপে আবির্ভূতা হন। যে যোগী অরূপের পিয়াসী, তাহাকে তিনি দেখা দেন জ্যোতিরূপে, চিন্ময়রূপে। … এই আদ্যাশক্তি যখন সৃষ্টি করেন, তখন তাহার নাম ব্রহ্মা, যখন পালন করেন তখন তিনি বিষ্ণু, যখন সংহার করেন তখন তিনি রুদ্র। আবার যখন তিনি নিত্য রাস-লীলা করেন তখন তিনি কৃষ্ণ। যখন কিছুই করেন না, তখন নিরাকার নির্গুণ পরব্রহ্ম। … তিনি সকল জাতির উপাস্য প্রভু। বিশ্বের সকল জড়-জীব, প্রাণী, এই পৃথিবীর সকল ধর্ম, সকল জাতি, তাঁহার সৃষ্টি, তাঁহারই লীলার প্রকাশ। … তিনি ইচ্ছা করিলে সকল মানুষ একদিনেই এক-ধর্মাবলম্বী হইয়া যাইত। … ঐকান্তিক আগ্রহে, একনিষ্ঠ তপস্যা দিয়া যে তাঁহাকে যেই নামে ডাকে তিনি তাহার কাছে সেই নামে সাড়া দেন। তিনিই পরমাত্মা, পরব্রহ্মরূপিণী আদ্যাশক্তি। … তিনি নিত্যা তিনি উৎপন্না হন না।’ এই সেই মহামায়া (অম্বিকা), বিরজাসুন্দরী দেবীকে লেখা চিঠিতে যে মহামায়ার শ্রীচরণে নজরুল তার সকল পাপ-পুণ্য নিবেদন করেছেন।
নজরুলের ভাষায় এই মহামায়া বা দেবী দুর্গা বা আদ্যাশক্তি নারীও নন পুরুষও নন। কিন্তু ‘মা’ নারীবাচক শব্দ। যিনি নারীও নন নরও নন সেই ঈশ্বরকে যদি পুরুষবাচক ‘পিতা’ সম্বোধন করা যায় তবে নারীবাচক ‘জগজ্জননী’ কল্পনা করা কি দূষণীয়? বাইবেলে যিশু ঈশ্বরকে ‘পিতা’ বলেছেন; ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে পিতা শব্দে অভিহিত করেছেন- ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোন শোন পিতা’; কিংবা ‘আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃত সদনে চল যাই।’ নজরুলের কবিতায়, ‘আদি পিতা ভগবান’ (কবিতা ফরিয়াদ)। ভগবান যদি পিতা হয়ে থাকেন, মাতাই বা হবেন না কেন? ভারতের প্রাচীন ঋষিগণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে জ্যোতির্ময়ী করুণাময়ী জগজ্জননী হিসেবে কল্পনা করেছেন। নজরুলের এই মা মহামায়া বা অম্বিকা ‘সকল জাতির উপাস্য সে প্রভু’- কোনো এক জাতি বা এক ধর্মের নয়; ‘সর্বলোক (অর্থাৎ বিশ্বচরাচর) তাহার ধাম’। মহামায়া, তারা, অম্বিকা নামের আড়ালে সেই এক বিধাতাই অভীষ্ঠ।
ত্রিপুরা শঙ্কর সেন (সেনশাস্ত্রী) লিখেছেন, ‘দেবীস্তুতিতে নজরুল মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবসপ্তবতীর ওপর নতুন আলোকপাত করেছেন। তিনি মধু-কৈটভ, মহিষাসুর, শুম্ভ-নিশুম্ভ প্রভৃতির রূপক ব্যাখ্যা করেছেন, মহাকালী, মহাল²ী ও মহা-সরস্বতীর প্রচলিত ব্যাখ্যাও তিনি গ্রহণ করেননি।’ নজরুলের ‘দেবীস্তুতি’ বইয়ের ভূমিকা লেখক ড. গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় নজরুলকে ‘শক্তিতত্ত্ব বা মাতৃস্বরূপের নবভাষ্যকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নির্মলেন্দু ভৌমিক লিখেছেন, ‘মূলত দুর্গা এবং তার পরে কালীকে অবলম্বন করে তিনি (নজরুল) এক মহাশক্তিকে লক্ষ করেছেন- যার বিস্তার নিখিল জগদ্ব্যাপী। কল্পনাটি অবশ্য প্রাচীন ভারতেরই একটি পরিচিত কল্পনা। … কল্পনার দিক থেকে এতে অভিনবত্ব কিছু নেই।’ (নির্মলেন্দু ভৌমিক; নজরুলের ভক্তিগীতি)। অর্থাৎ নজরুলের মহামায়া, অম্বিকা প্রাচীন ভারতের ঋষিগণের অচিন্তনীয়-অকল্পনীয়-অদ্বিতীয় এক ঈশ্বর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়