নার্ভাস নাইনটিতে সবজির দাম

আগের সংবাদ

তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় এনে দেশকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে

পরের সংবাদ

গণ্ডি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আশুলিয়ার জমিতে একাকী রাত কাটাতে এসে মজিদ শিকদার দুটো অচেনা শব্দ কানে শোনে; একটা ফুস্ আরেকটা ফস্।
কষ্টিপাথরের কালোরাত ভেদ করে মজিদের সাহস হয় না দরজা খুলে শব্দের উৎস বের করতে।
ভবঘুরে বাতাসের বুক ফুঁড়ে সে সময় চেনা শব্দেরাও তরঙ্গ তোলে, যেমন শিরীষ গাছের পাতার শব্দ, ঝাউগাছের শোঁ-শোঁ, রাতের আঁধারে পথ হারিয়ে ফেলা বিভ্রান্ত কাকের কা-কা।
অচেনা শব্দ তো বটেই, চেনা শব্দেও দরজার হুড়কো খোলে না মজিদ সরকার। তার কারণ তার মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রীর ভেতরে কে যেন এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে- জায়গাটা খারাপ। দিনের বেলার চেয়ে রাতের বেলা আরো খারাপ। কারণ রাতে মানুষ বা প্রকৃতি কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না।
মজিদ জমি কেনার ব্যাপারে ভীষণ অনভিজ্ঞ ছিল বলে এই বিরান জায়গায় জমি কেনার আগে নির্জনতার কিছু ভয়াবহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে সম্যক অবগত ছিল না। বা কেউ তাকে এ বিষয়ে কিছু বলেও দেয়নি।
জমিটা কেনার পরও কেউ তাকে এসব বুঝিয়ে বলেছে কিনা সন্দেহ। বা সে সময় বুঝিয়ে বললেও সে তা ঠিকমতো হৃদয়ঙ্গম করতে পারত কিনা তা নিয়ে দ্বিমত আছে। কিছু মানুষ আছে যারা আবাল্য নিজেরাই বুকের ভেতরে নির্জনতার মাঠ তৈরি করে বড় হয়। হই-হল্লা, হট্টগোল, যা বড় বেশি বাস্তব ভাষায় কথা বলে সেসব থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে চায়। তারা কথা বলে কম, ভাবে বেশি এবং সেসব ভাবনার ভেতরে কোনটা যে বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব সবসময় বুঝে উঠতে তারা নিজেরাও যেন পারে না।
মজিদ হয়তো তাদেরই একজন।
সেই মজিদই ভাগ্যের ফেরে এক মহা ফাজিল দালালের খপ্পরে পড়ে আশুলিয়ার জঙ্গলের ভেতরে দুটি চতুষ্কোণ জমি ও এক টুকরো তেকোনা বন্ধ্যা জমির পাশে পাঁচ কাঠা জমি কিনে ফেলেছিল।
ব্যাপারটা ঘটেছিল গত বছরের মাঘ মাসে এবং ঘটেছিল হঠাৎ।
একদিন আশুলিয়ার বড় রাস্তা ছাড়িয়ে, মাঠ ঘাট ভেঙে, ডোবা, নালা, খানাখন্দ পেরিয়ে বন্ধ্যা জমিটার মরা শুকনো ঘাসগুলো পায়ের উড়ন্ত গতিতে বাতাসে ছত্রখান করে দিয়ে মজিদ সিকদার এসে দাঁড়িয়েছিল দালাল কথিত জমিটার ঠিক মাঝখানে।
‘এই হ’তিছে সেই জমি’, আঙুল তুলে চারপাশে এক ঘূর্ণি দিয়ে বলেছিল দালাল। তার আগ পর্যন্ত দালাল লোকটিকে ভালো করে চোখ তুলেও দেখেনি মজিদ। জমির মাঝখানে দাঁড়াবার পর দালালকে সে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছিল। সরু ছুঁচালো একটা মুখ। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নাক যেন বাজপাখি। চোখ দুটোও তাই, অর্থাৎ বাজপাখির মতোই তীক্ষè এবং ক্ষুধার্ত।
দেখে তখন ভালো লাগেনি মজিদের।
কিন্তু তাতে কিছু এসে যায়নি। কারণ এসব কিছু দেখার আগেই মজিদ দেখে ফেলেছিল আসলে যা দেখার।
আর সেটা হলো একটা তালগাছ। মজিদের চোখের সামনে বুক ফুঁড়ে সটান দাঁড়িয়েছিল গাছটা। আর সেই তালগাছে ঝুলে ছিল অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা। বাসাগুলো যেন লম্বা লাউয়ের শুকনো খোলোর মতো বাদামি খড়ে আবৃত হয়ে শূন্যে ঝুলছিল। কখনোবা বাতাসে দুলছিল মৃদু মৃদু।
অজস্র রোদ উঠেছিল সেদিন। রোদের ভেতরে কোত্থেকে যেন কুরচি ফুলের গন্ধ ভেসে এসেছিল।
এখন কি কুরচি ফুল ফোটার সময়?
মনে মনে তখন ভেবেছিল মজিদ। নাকি গন্ধটা ছিল তার মনের ভেতরে, তার চৈতন্যের গভীরে, যা তখন সে জানত না?
কিন্তু তাতে কিছু এসে যায়নি।
কারণ ততক্ষণে সে মনস্থির করে ফেলেছিল যে এই জমিটাই সে কিনবে। এরকম এক জমির স্বপ্নই সে দেখেছিল তার ছেলেবেলা থেকে; যে জমিতে দাঁড়িয়ে থাকবে একটা তালগাছ। তালগাছের শেকড়ে থাকবে বহু পুরনো দিনের গন্ধ। অতীত, অতীতের অতীত এবং তারও অতীত বাহুলগ্ন হয়ে শুয়ে থাকবে মাটিতে, যে মাটির ভেতরে মজিদের হাজার বছরের পূর্বপুরুষরা তাদের গায়ের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, স্বপ্নের গন্ধ, তাদের জমি হারাবার হাহাকারের গন্ধ বড় নিবিড়ভাবে ফেলে রেখে চলে গেছে দূর অচেনার দেশে।
স্বপ্নাভূত চোখে মজিদ কিছুকাল জমির ওপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে দালালের দিকে তাকিয়েছিল সেদিন। সে দৃষ্টিতে কী ছিল- দালাল যেন তা মুহূর্তে বুঝে ফেলে হাতের পাঁচ আঙুল একটার পর আরেকটা মটকে নিয়ে বলেছিল, তা’লি জমিওয়ালার সঙ্গে এখুন কথা বলতি হয়!
তো হলো কথা বলা। সেটা ছিল মাঘ মাস। একেবারে শেষের দিকে। বাতাসে ছিল ফাল্গুনের গন্ধ। জমির আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কতিপয় বৃহৎ বৃক্ষের ডালপালায় কিসের যেন এক আনন্দ উচ্ছ¡াস ক্রমাগত এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কিম্ভূতকিমাকার সব শব্দ করে আলোড়িত করে তুলেছিল বাতাস। হালকা শীতের আমেজে বড় রহস্যময় দেখাচ্ছিল তখন জমিটাকে। আর মজিদ সিকদারের কাছে মনে হয়েছিল, পুরো ব্যাপারটা বুঝি অতীন্দ্রিয় কোনো জগতের ভেতরে ক্রম প্রবিষ্ট হয়ে যাওয়া।
জমি কেনার পর রাশিদা, সুমন আর টাবলু এসেছিল জমি দেখতে। গোড়ালির ওপর কাপড় তুলে, রোদের তাপে মাথায় হালকা ঘোমটা টেনে, এবড়োখেবড়ো মাটির ঢেলা ভাঙতে ভাঙতে রাশিদা যখন জমির ওপরে পা রেখেছিল, তখন শীত প্রায় শেষ, গ্রীষ্মও তার মাঝপথ প্রায় পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। গরমে নাকের পাতা, কপাল, ঘাড় ও গলা ঘেমে গিয়েছিল রাশিদার। বড় ক্ষুণ্ন এবং অনিচ্ছুক হয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে বলে উঠেছিল, তোমার কি মাথা খারাপ? এতগুলো টাকা লোন নিয়ে কেউ এ রকম জায়গায় জমি কেনে? সদর রাস্তায় ওঠার জন্য এ জমির পাশে রাস্তা কই?
রাশিদার প্রশ্নের উত্তরে বন্ধ্যা জমিটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মজিদ বলেছিল, কেন, এই জমির ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে আলপথে পড়ে তারপর চৌকো জমি দুটো পার হলেই তো সদর রাস্তা!
তার কথা শুনে একটু থমকে গিয়ে বড় বড় চোখ করে রাশিদা বলেছিল, তুমি কি ভাবছ যাদের জমি তারা তোমার সুবিধার জন্য নিজের জমি থেকে রাস্তা কেটে তোমার চলাচলের ব্যবস্থা করে দেবে? হায় রে অবোধ!
রাশিদার কথা শুনে মনে মনে ভীষণ রাগ হয়েছিল সেদিন মজিদ সিকদারের। ভেবেছিল, যখনই সে জীবনে নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে গেছে তখনই যেন পেছন থেকে তার জামা টেনে ধরেছে রাশিদা নাম্নী এই নারী। মজিদ এ ধরনের সম্পর্কে বিশ্বাস করে না, যেখানে সম্পর্কটাই একটা শিকলের মতো পা জড়িয়ে পড়ে থাকে চিরকাল; নড়তে চড়তে দেয় না, ইচ্ছেমতো ভাবনা-চিন্তা করতে দেয় না, এমনকি ইচ্ছেমতো স্বপ্ন দেখতেও দেয় না!
আর রাগ হলে মজিদ তখন ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব। সে গুটিয়ে যায় নিজের ভেতরে। কেন্নোর গোটানোও তখন মজিদের গোটানোর কাছে সোজা!
এরপর সেদিন আর কোনো কথোপকথন ছিল না স্বামী স্ত্রীর ভেতরে। সুমন আর টাবলুই সেদিন মুখর করে রেখেছিল পরিবেশ। জমির খোলা মাঠে ছোটাছুটি করে কাদাপানি মাখিয়ে ফেলেছিল জুতো জামায়। তারপর মায়ের কানমলা খেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে চেঁচাতে চেঁচাতে বন্ধ্যা জমি পায়ে মাড়িয়ে আলপথ ভেঙে, চতুষ্কোণ জমি দুটো পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে বাসের অপেক্ষা করতে দাঁড়িয়েছিল ক্রন্দনরত মুখে।
পেছনে ছিল তাদের মূক ও গম্ভীর বাবা মা।
এর পরের ইতিহাস ছিল সংক্ষিপ্ত। মজিদ সিকদার ব্যাংকের কাছ থেকে লোন নিয়েছিল, একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকেও নিয়েছিল এক ভারী অঙ্কের লোন। সেই লোনের টাকায় আশুলিয়ার ইটখোলা থেকে ইট কিনে নিয়ে নিজের জমিতে ফেলেছিল মজিদ। ট্রাকে নয় ঠেলাগাড়ি করে ইট কিনে নিয়ে এসেছিল সে। ঠেলার পর ঠেলা। এক ঠেলা ইট জমিতে পৌঁছে গেলে আরেক ঠেলা। এতে করে ট্রাক ভাড়ার খরচ কিছুটা বেঁচেছিল তার। জমিতে ইট ফেলে ফেলে ইটের স্তূপ করে ফেলেছিল মজিদ। তারপর ফেলেছিল বালু ও সিমেন্ট। এরপর ডেকে এনেছিল তিন সাগরেদসহ একজন রাজমিস্ত্রি।
রাজমিস্ত্রির পরণে ছিল জিন্সের ফুলপ্যান্ট, হাতে কালো ব্যান্ডের ঘড়ি, চোখে কালো রোদ চশমা। তার প্যান্টের পকেটে ছিল একটা নয় দু-দুটো মোবাইল। সে এক ভীষণ চোখ ধাঁধানো অবস্থা।
মজিদ তখন শঙ্কিত হয়ে ভেবেছিল তাকে দিয়ে রাজমিস্ত্রির কোনো কাজ আদৌ হেেব কিনা।
কিন্তু মজিদকে বোকা বানিয়ে রাজমিস্ত্রি কাজ করেছিল ফার্স্টক্লাস। নকশামাফিক সে গড়ে তুলেছিল একটা ঘর। ওপরে টিনের চাল দেয়া লম্বা একটা একচালা। সামনে পৈঠার মতো উঁচু করে তৈরি করা একটা বারান্দা। ঘরের শেষপ্রান্তে বসিয়েছিল দেশি পায়খানা। আর উঠোনে বসিয়েছিল টিউবওয়েল।
সব মিলিয়ে ব্যবস্থাটা খারাপ ছিল না। এমনকি তেমন অবস্থা হলে ঢাকার ভাড়াবাসা ছেড়ে এখানেও বসবাস করতে পারবে পরিবারসহ এ কথাও ভেবেছিল তখন মজিদ।
কিন্তু মনে ভাবলেও মজিদের প্ল্যানমাফিক সবকিছু হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। বাড়ি তৈরির সময় মাঝে মাঝে রাশিদা দেখতে এলেও এখানে সে বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় মশার কামড় খেতে খেতে রাত কাটাবে কোনোদিন, এরকম মনোভাব কোনো দুর্বল মুহূর্তেও সে দেখায়নি। তবে নিজেরা না থাকলেও যে এখানে ভাড়াটে বসানো সম্ভব এ কথা একেবারে নাকচ করে দেয়নি রাশেদা।
ভাড়াটে বসাতে মজিদ রাজি ছিল না। নিজের মনের মতো করে ঘর তৈরির পর সেখানে ভাড়াটে বসানো ব্যাপারটা মন থেকে সে মানতে পারেনি। আর এ কারণেই রাশিদার ওপর কিছুটা রাগ করেই গতকাল বিকালে আশুলিয়ায় চলে এসেছিল সে।
অফিস ছুটির পর সোজা সে চলে এসেছিল তার জমিতে। বৃহস্পতিবার বলে একটু সকাল করে সে রওনা দিয়েছিল। পথে কলা, পাউরুটি, চিনি, দুধ আর চা পাতা কিনেছিল। এগুলো তার রাতের খাবার। ক’দিন আগে সে এক ঠোঙা চিড়ে কিনে রেখেছিল ঘরে। সুতরাং খাবারের অভাব ছিল না। সঙ্গে চার ব্যাটারির বড় টর্চও রেখেছিল একটা। রেক্সিনের ছোট একটা ব্যাগে টর্চটা যতœ করে সে ভরে নিয়েছিল।
তবে জমিতে আসার আগে রাশিদার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিল বলে মন একটু ক্ষুব্ধ ছিল তার। একটু বা বিভ্রান্তি ছিল মনে। জমিতে একবার পা দিয়ে প্রথমে ভেবেছিল একবার রাশিদাকে মোবাইল করে জানায় যে সে আশুলিয়ায় চলে এসেছে। আজ এখানেই সে রাত কাটাবে এবং সেই সঙ্গে আগামীকালের রাতও। পরশু এখান থেকেই চলে যাবে সোজা চলে যাবে অফিসে। অফিসের জামাকাপড় তার সঙ্গেই আছে। সন্ধে হলে এগুলো সে খুলে লুঙ্গি গেঞ্জি পরে নেবে। বাতাসে শুকিয়ে নেবে জামাকাপড়গুলো, যেন পরদিন পরে অফিসে যেতে বেশি অসুবিধে না হয়।
এটা ছিল তার রীতিমতো একটা প্ল্যান।
কিন্তু মজিদ মোবাইল করেনি। বদলে সে ঘরে ঢুকে খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে টিউবওয়েলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে আবার বেরিয়ে পড়েছিল বাইরে। তারপর বন্ধ্যা জমি পায়ে মাড়িয়ে, আলপথ ভেঙে, চতুষ্কোণ ক্ষেত দুটো ডিঙি মেরে মেরে পার হয়ে দেখা করতে গিয়েছিল এক প্রতিবেশীর সঙ্গে। এখানে বাড়ি তৈরি করার সময় সে দূর থেকে টিনের দোচালা বাড়িটা তাকিয়ে দেখত। কিন্তু কোনোদিন সুযোগ হয়নি সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করার। এ বাড়িটাই হলো তার বাড়ির সবচেয়ে কাছে। বাড়িটাকে ঘিরে প্রচুর গাছ-গাছালি। এমন সব গাছ মজিদ যাদের চেহারা আগে কোনোদিন দেখেনি বা যাদের নাম সে জানে না। মজিদ আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল- এসব গাছ চেনে এবং ইতোমধ্যেই তার বাড়ির সীমানা ঘিরে চারাগুলো পুঁতে ফেলেছে। সীমানার চারদিকে বাঁশের চটার বেড়াও দিয়ে ফেলেছে সে। এরপর সে চটার গায়ে লতিয়ে দিয়েছে লতানো ফুলের কিছু কিছু ডাল।
প্রতিবেশীর বাড়িতে যখন সে গতকাল সন্ধ্যায় ঢুকেছিল তখন চারপাশে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। আজান পড়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। বাড়িটার চৌহদ্দি ছিল বেশ বড়। মজিদের হাঁকডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল একজন মাঝবয়সি লোক। মুখে তার কাঁচাপাকা দাড়ি। পরনে লুঙ্গি আর দলামোচড়া একটা পাঞ্জাবি। চোখে মুখে একটা বিরক্তির ভাব নিয়ে মজিদ কে আধো অন্ধকারে যেন আগাগোড়া জরিপ করে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কী চাই?
শহুরে মানুষদের মতো গ্রামের মানুষের ব্যবহার দেখে মনে মনে চমকিত হয়েছিল মজিদ। একটু আমতা আমতা করে বলেছিল, কিছু চাই না ভাই সাহেব, এই প্রথম আপনাদের এলাকায় রাত কাটাতে এলাম, তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।
উত্তরে লোকটা কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলে মজিদ আঙুল তুলে দূরে দেখিয়ে বলেছিল, ওই যে জমিটা দেখছেন, ওটা আমার জমি। ঘর তুলেছি একটা কিছুদিন হলো।
জানি, উত্তরে লোকটা যেন নিরুত্তাপ গলায় বলে উঠেছিল।
তারপর ঘরের দাওয়ায় হাতলভাঙা চেয়ারটা টেনে নিয়ে এসে বলেছিল, এখানে বসেন, আমি মোনাজাতটা সেরে আসি।
আরে ছি, ছি, আপনি নামাজ পড়ছিলেন, আমি বুঝতে পারিনি ভাই সাহেব, মাফ করবেন।
মজিদ তাড়াহুড়ো করে কথাটা বলেই ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে লোকটা বলেছিল, আরে না, না, তা কি হয়। আপনি বসেন।
তার কথা শুনে আস্বস্ত হয়ে বসেছিল মজিদ। বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেছিল। পাতলা অন্ধকার কত দ্রুততার সঙ্গে হার মানছিল গাঢ় অন্ধকার রাতের কাছে, সেটা তাকিয়ে দেখে একটু উদ্বিগ্ন হয়েছিল যেন তার মন। সে নিজের হাতের রেক্সিনের ব্যাগে টর্চলাইটটা একবার হাতিয়ে দেখেছিল ঠিক আছে কিনা। দাওয়ার এক কোণে জ্বলছিল একটা হারিকেন। এদিকে বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। কিন্তু বিদ্যুতের পিলার গাঁথা হয়েছে মেইন রোডের দু’পাশে। হয়তো আর কিছুদিনের ভেতরে বিদ্যুৎ এসে যাবে। চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে তখন এসব ভেবেছিল মজিদ। আর লোকটার নামাজ শেষ করে ফিরে আসার অপেক্ষা করছিল। বাড়ির ভেতরে আর কারও নড়াচড়ার আওয়াজ পাচ্ছিল না মজিদ। বাচ্চাদের হইচই বা কোনো কান্নাকাটির আওয়াজ নয়, মনে হয়েছিল লোকটা ছাড়া আর কেউ যেন বাড়িটাতে গতকাল ছিল না।
কিছুক্ষণ বাদে লোকটা তার মুখে হাত বুলোতে
বুলোতে ফিরে এলে মজিদ উসখুস করে বলেছিল, আমার নাম মজিদ সিকদার। আপনার নামটা কি জানতে পারি?
আমি সোলেমান মণ্ডল। লোকটা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল।
আপনি কি ভাই সাহেব এখানে একা থাকেন? কৌতূহল চাপতে না পেরে বলে উঠেছিল মজিদ।
না, আমার ভাইঝি আর ভাইঝি-জামাই থাকে। তারা বাইরে গেছে।
উত্তরে বলেছিল সোলেমান মণ্ডল।
এটা কি আপনার বাড়ি? এবার আচমকাই জিজ্ঞেস করে বসেছিল মজিদ।
মজিদের প্রশ্নে লোকটা কেমন যেন এক ভাঙাচোরা চেহারা নিয়ে তাকিয়েছিল শূন্যে, যেখানে তখন রাতের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখার ছিল না।
সেখান থেকে একটু পরই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মজিদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, না, আমার বাড়ি না। তবে এককালে এই বাড়ি আমার ছিল, এখন আর নাই। এই জমিও ছিল আমার। এখন আমার কোনো জমি নাই।
আমার কোনো জমি নাই! কথাটা শুনে বুক যেন ধক করে উঠেছিল মজিদের। তখনই যেন উপলব্ধি করেছিল যে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সময় প্রতিটি মানুষের একখণ্ড জমির বড় প্রয়োজন। সেই জমির ওপর গাছ গাছালি পোঁতার বড় প্রয়োজন। পৃথিবী ছাড়ার আগে পৃথিবীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বড় প্রয়োজন। নিজের অস্তিত্বকে এভাবে ছাড়া আর কীভাবে মানুষ উপলব্ধি করবে?
এরপর যেন আপন মনে সোলেমান মণ্ডল বলেছিল, গত বৈশাখ মাসে আমার স্ত্রী মারা গেছে।
লোকটার কথা শুনে চুপ করে গিয়েছিল মজিদ। একটু যেন হতাশ হয়েছিল মনে মনে। যেন কী একটা আশা করে এসেছিল সে। কিন্তু সেটা কী যে তা যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না। যেন এই পরিবেশে একটা সুখী দাম্পত্য জীবনের ছবির কল্পনা তার মনের ভেতরে অজান্তেই উঁকি দিয়ে উঠেছিল পরিচয় হবার আগে।
ক্রমে একটা নিরানন্দ ভাব ঘিরে ধরেছিল তাদের। মজিদ কোনো কথা না বলে চেয়ারে বসে হঠাৎ পা দোলাতে শুরু করেছিল।
একটু পরে সোলেমান মণ্ডল তার দিকে ফিরে বলেছিল, ঢাকায় থাকেন?
হ্যাঁ, উত্তরে বলেছিল মজিদ। তারপর বলেছিল, ভবিষ্যতে এখানে এসে বাস করার ইচ্ছ আছে। আশা করি ততদিনে এখানে বিদ্যুৎ এসে যাবে।
মজিদের কথা শুনে সোলেমান মণ্ডল মাথা নেড়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে মাথা নেড়ে বলেছিল, না, আসবে না!
কী বলেন, বিদ্যুৎ আসবে না? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মজিদ।
না। আবার বলেছিল সোলেমান।
কিন্তু বিদ্যুতের খাম্বা তো পোঁতা হয়ে গেছে? বলেছিল মজিদ।
আজ পাঁচ বছর ধইরা পোঁতা আছে ওইগুলো। বলেছিল সোলেমান।
কী বললেন, পাঁচ? কানে হাত দিয়ে যেন ভালো করে কথাটা শোনার চেষ্টা করেছিল মজিদ।
জি, হ্যাঁ।
পাঁচ বছর?
হ্যাঁ।
সোলেমানের কথা শুনে যেন বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল মজিদ। ওর তখন মনে পড়েছিল, দালাল জমি বিক্রি করতে গিয়ে দাম একটু বেশি হেঁকেছিল, যেহেতু সদর রাস্তা ছাড়িয়ে একটু ভেতরের দিকে কিছু জায়গায় বিদ্যুতের খাম্বা বসানো ছিল।
সোলেমান মণ্ডল পরে বলেছিল, কিংবা তারও বেশি, আমার ভাইজি-জামাই ঠিক বলতে পারবে।
বলেন কি? শুনে যেন হতভম্ব হয়ে বলে উঠেছিল মজিদ।
সোলেমান মণ্ডল বলল, শুনি, শুধু খাম্বা পোঁতার কামই ছিল সেইখান। খাম্বা পুঁইতাই হাজার হাজার ট্যাকা কামাইছিল সরকারের পেয়ারের লোক। বিদ্যুৎ দিবার অছিলায় কামটা করছিল। বিদ্যুৎ দেয় নাই।
তা হয়তো হবে! কথাটা বলে নিরাশ হয়ে মাথা নেড়েছিল মজিদ। হঠাৎ করে তার বুকের ভেতরে একটুকরো অন্ধকার নেমে এসেছিল যেন। এই বর্তমানের পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষ কীভাবে বাঁচবে? কিন্তু এ চিন্তার কথাটা সে সোলেমানকে বলেনি। শুধু আমি তাইলে এবার যাইগা ভাই সাহেব, আজ আমি প্রথম নিজের জমিতে রাত্রিবাস করব, দোয়া করবেন। এই বলে বিদায় নিয়েছিল।
সোলেমান মণ্ডল সে বিদায় নেবার আগেই অবশ্য মাথা নেড়ে বলেছিল, দোয়া করলাম। তবু আপনে সাবধানে থাকবেন। এর আগে তো কয়েকবারই ওই জমি হাতবদল হইছিল জানি। কাগজপত্রে কী জানি সব ঝামেলা আছে। একবার তো রক্তারক্তি হইয়া গেল!
কী বললেন? সোলেমান মণ্ডলের কথা শুনে মজিদ চলে যাবার আগে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
হ্যাঁ, কী সব ঝামেলা ছিল শুনেছিলাম। মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছিল। তবে সেসব নিশ্চয় ফয়সালা হয়ে গেছে?
সুলেমানের মুখে এবার পরিষ্কার বাংলা শুনে দৃঢ় স্বরে মজিদ বলে উঠেছিল, হ্যাঁ, নিশ্চয় এতদিনে ফয়সালা হয়ে গেছে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
কথাটা বলার পরপরই মজিদ হাঁটতে শুরু করেছিল। মাথাটা হেলিয়ে রেখেছিল হাঁটার সময়। যেন একটা একরোখা ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল বিদায় নেবার আগে আগে। তাছাড়া জমি বায়না করা থেকে রেজিস্ট্রি পর্যন্ত তার কোনো ঝামেলা হয়নি। কেউ তাকে ইশারা করেও বলেনি যে তার জমিতে কোনো ঝামেলা আছে।
আবার চৌকো জমি পেরিয়ে আলপথ ভেঙে ধীরে ধীরে মজিদ ফিরে এসেছিল তার জমিতে। টর্চ জ্বেলে পথ চলেছিল সে। ফিরে আসার পথে দু-একজনের সাক্ষাৎও পেয়েছিল। কিন্তু তাদের মুখ সে দেখতে পায়নি বলে কুশলবার্তাও হয়নি।
মাত্র একজন তাকে আলপথ ধরে হাঁটতে দেখে একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল। মজিদ তখন নিজ থেকেই বলে উঠেছিল, আমি ভাই সাহেব, ওই যে ওই জমির বাসিন্দা।
কথাটা বলে সে অন্ধকারে হাত তুলে তার জমি দেখিয়েছিল।
ওঃ, বলে উঠেছিল লোকটা। তারপর দ্রুত পায়ে সরে গিয়েছিল।
জমিতে গিয়ে যখন পৌঁছেছিল মজিদ সিকদার তখন চারপাশে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ফুটফুট করে জোনাকি জ্বলছিল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! এরকম মনে হয়েছিল মজিদের। এরও আগে সে মিস্ত্রিদের দিয়ে ঘর তোলার সময় রাতের জোনাকিদের দূরের বাঁশবাগানে দেখেছিল। যতবার দেখেছিল ততবার তার মনে এই কথাটাই উঠেছিল, কী অপূর্ব দৃশ্য।
জোনাকিদের মৃদু স্বপ্নময় আলোয় কাল রাতে সে টর্চ না জ্বালিয়েও দিব্যি কলপাড় পর্যন্ত পৌঁছে হাত-পা, মুখ ও গলা আবার ভালো করে পরিষ্কার করেছিল। কারণ বিকালবেলা একবার পরিষ্কার করলেও আবারো মনে হচ্ছিল যেন পরিষ্কার করা দরকার।
এরপর ডিঙি মেরে উঠোন পার হয়ে ঘরের পৈঠায় উঠে ঘর খুলে প্রথমে মোমবাতি জ্বালিয়েছিল। তারপর জ্বালিয়েছিল হারিকেন।
হারিকেন জ্বালাবার পর মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছিল সে।
জমিতে কাজ চলার সময় সে চারখানা হারিকেন কিনেছিল। সম্প্রতি সে দুটো হারিকেন ঢাকার বাসায় রেখে এসেছিল। সেখানে দিনে রাতে চার-পাঁচবার করে লোডশেডিং হয়। রাতে মোম জ্বালিয়ে সরকারের বিদ্যুৎ খাতকে গালি দিতে দিতে সংসারের কাজ সারে রাশিদা।
হারিকেন দুটো হাতে পাওয়ায় রাশিদার সুবিধে হয়েছিল।
এরপর নিজের ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেলেছিল মজিদ। দেয়ালের রং এখনো সামান্য ভিজে আছে। মেঝেটা কালো আর শাদা সিমেন্টের মিশেলে তৈরি। ঘরের এককোণে সেমিডবল একটা চৌকি। আগে এই চৌকিতে রাতের বেলা একজন মিস্ত্রি ঘুমাতো। সে চলে যাবার পর খাটের ওপর নতুন পাটি পেতেছিল মজিদ। তার ওপরে পেতেছিল হাতে কাচা পরিষ্কার চাদর। এখানে রাত্রিবাস করবে বলে বেশ কিছু সপ্তাহ ধরে মজিদ মনে মনে প্রস্তুত হয়েছিল। খুব ভালো লাগত যদি রাশিদা আর ছেলে দুটো আজ তার সঙ্গে থাকত। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হতো না। চাল-ডাল-আলু-তেলের ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিল মজিদ। কেরোসিনের চুলো আর চারটে হাঁড়িকুড়ি ইতোমধ্যেই কিনেছিল। তাছাড়া কিনেছিল রান্নার জন্য দরকারি কিছু জিনিস। জিনিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল মেঝেতে। একজোড়া মমতাভরা মেয়েলি হাতের জন্য তারা যেন অপেক্ষা করছিল।
কিন্তু সে মেয়েলি হাত তখন পর্যন্ত এসে পৌঁছেনি।
বিছানার ওপর বসে সম্মুখে দুপা মেলে দিয়েছিল মজিদ। সে তখন ভাবছিল। কিন্তু সে ভাবনার কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ছিল না। তার চোখের সামনে ছিল খোলা জানালা। ঘরের দুদিকে দুটো জানালা। ছেঁড়া পর্দার ফাঁক দিয়ে জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছিল অন্ধকার। দেখা যাচ্ছিল জোনাকি। পর্দা মাঝে মাঝে দোল খাচ্ছিল বাতাসে। তখন দেখা যাচ্ছিল আবারো অন্ধকার এবং আবারো জোনাকি।
ঘরের জলন্ত হারিকেন বাইরের অন্ধকারকে প্রভাবিত করতে পারছিল না। উল্টে কীভাবে যেন বাইরের অন্ধকারই আক্রমণ করে বসেছিল ঘরের আলোটাকে। আশ্চর্য, পৃথিবীতে তাহলে এমন ঘটনা ঘটে যখন অন্ধকার আক্রমণ করে আলো, এইকথা ভেবেছিল তখন মজিদ। আর ভেবেছিল তার মোবাইলের কথা। রাশিদাকে মোবাইল করবে কী না, এই কথা।
কথাগুলো আবছা ভাবে ভাবতে ভাবতে মজিদ গুছিয়ে তুলেছিল ঢাকা থেকে কিনে আনা খাবারগুলো। বাড়ি তৈরি হবার সময় বুদ্ধি করে ঘরের দেয়ালে সিমেন্টের কয়েকটা তাক কেটেছিল সে। মিস্ত্রি দিয়ে কাটিয়েছিল। সেখানে খাবারগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে নিজেকেই প্রশংসা করল সে। তাক না থাকলে এসব খাবার সে কোথায় গুছিয়ে রাখত? এইসব সাধারণ ভাবনার প্রক্রিয়ার ভেতরেই মজিদের মোবাইল বেজে উঠেছিল।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে হ্যালো বলতে রাশিদা ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠেছিল, তুমি কোথায়? মোবাইল অন করলেই এই প্রশ্নটা রাশিদা তাকে সবসময় করত। শুধু রাশিদা কেন মোবাইলের যুগ শুরু হবার পর থেকেই মানুষের মনে প্রথম যে প্রশ্নটা জাগত, সেটা হলো, তুমি কোথায়। রাশিদা তাদেরই একজন ছিল। তাই তার প্রশ্ন শুনে মজিদ রাগ করত না। উত্তরে মজিদ বলেছিল, আমি আশুলিয়ায়, আমাদের বাড়িতে।
‘আমাদের বাড়িতে’ কথাটা বলতে পেরে মনে মনে খুব গর্ব বোধ করেছিল মজিদ। অথচ রাশিদা যেন কথাটা ভালো করে কানে শোনেনি এমনি ভাব করে বলেছিল, তুমি ভালো আছো তো? ঠিক আছো তো? রাশিদার এই অহেতুক উদ্বিগ্নতা মজিদকে বড় প্রীত করেছিল। সকালের বাকবিতণ্ডা ভুলে গিয়ে মজিদ বলেছিল, হ্যাঁ, ভালো আছি। রাশিদা তখন বলেছিল, তোমার ছেলেরা তুমি আজ জমিতে রাত কাটাবে শুনে বায়না ধরেছিল তোমার সাথে যাবে বলে। কথাটা শুনে খুশি হয়েছিল মজিদ। খুশির চোটে সে বলে উঠেছিল, জানো, আজ এখানে একজন আমাকে কী বলল?
‘কী?’ জিজ্ঞেস করেছিল রাশিদা।
‘বলেছিল আমাদের এই জমিটাতে নাকি’- কথাটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল মজিদ। জানত এরকম কথা শুনে মোটেও খুশি হবে না রাশিদা।
মোবাইলে কথা শেষে রাশিদা বলেছিল, সাবধানে থেকো। অচেনা একটা জায়গায় একা একা রাত কাটানো আমার মোটে পছন্দ নয়।
‘আমি সাবধানেই থাকব।’ বলেছিল মজিদ।
‘রাতে ঘুমোবার আগে ঘরের দরজা ভালো করে বন্ধ করে রেখো।’ বলেছিল রাশিদা।
আর তার উত্তরে এ-প্রান্তে মাথা হেলিয়ে মজিদ বলেছিল, আচ্ছা।
এরপর রাতের খাওয়া সারা ছাড়া আর কিছু যেন করার ছিল না মজিদের।
দুধ দিয়ে চিড়া ভিজিয়ে খেয়ে এক কাপ লাল চা পান করে মজিদ এরপর বিছানায় এসে পা তুলে বসেছিল। ঢাকা ছেড়ে আসার সময় ভুল করে হাতে কোনো নিউজ পেপার বা ম্যাগাজিন সঙ্গে আনেনি। সুতরাং হারিকেন নিভু নিভু করে আপন মনে এলোমেলো চিন্তা করা ছাড়া আর কিছু সে মুহূর্তে তার করার ছিল না।
এভাবেই চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল মজিদ। ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখেছিল তাকে ছারপোকা জাতীয় কিছু কামড়াচ্ছে। সে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে দেখেছিল সত্যি তার বিছানায় ছোট ছোট এক ধরনের পোকা ঘুর ঘুর করছে। তাদের হাত দিয়ে সরিয়ে বিছানা ঝেরে আবার নতুন করে পেতে সে ঘুমিয়েছিল। তখন আবার তার স্বপ্নের ভেতরে কে যেন হ্যাচং হ্যাচং করে টিউবওয়েল টিপতে শুরু করেছিল। আর সেই শব্দ শুনে সে ঘুমের ভেতরেই ‘আরে, এতরাতে টিউবওয়েল টেপে কে’ বলে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে পড়েছিল। তারপর তড়িঘড়ি করে চৌকি থেকে নেমে ঘরের জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখনো ঘরের জানালায় পর্দা ঠিকমতো লাগানো হয়নি। ছেঁড়া ও তালি দেয়া পুরনো কাপড়ের দুটো পর্দা ঢাকার বাসা থেকে এনে কোনোরকমে জানালার আব্রু রক্ষা করা হয়েছে। আর দুটো জানালা খোলাই পড়ে আছে। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধে নেই। কারণ ঐ দিকে কোনো লোকালয় নেই।
পর্দা সরিয়ে মজিদ তাকিয়েছিল বাইরে। কিন্তু বাইরেটা ছিল থম মেরে নিস্তব্ধ। টিউবওয়েল জাতীয় কোনো কিছুর শব্দ তখন কোথাও ছিল না। তার বদলে সে আকাশের দিকে কাত হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল অসম্ভবভাবে ক্ষয়ে যাওয়া একটা চাঁদ। আর তার পাঁশুটে আলোয় কারা যেন পিলপিল করে তার জমির চৌহদ্দির ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে! তারা নড়ছে, ক্রমাগত নড়ছে, নড়তে নড়তে তারা ছড়িয়ে পড়ছে যেন চতুরপার্শ্বে। এবং এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তারা যেন কিছু একটা করার চেষ্টা করছে।
কিছু একটা করার চেষ্টা করছে! কারা যেন মজিদের জমির ভেতরে ঢুকে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। অসম্ভব! বোগাস! কথাটা ভেবে মজিদ জানালার কাছ থেকে সশব্দে সরে এসে তার বিছানায় ফিরে এসেছিল।
আর ঠিক তার পর মুহূর্তে তার কানে বেজেছিল বিজাতীয় দুটি শব্দ। একটা ফুস্, আরেকটা ফস্। আগে ফুস্ তার একটু পরে ফস্। ফুস্-ফস্।
এতদিন ধরে এই জমিটার ওপর মজিদ শিকদার কাজ করেছে। রাজমিস্ত্রি ও কামলা খাটিয়েছে। কত রাত অবধি নিজে তাদের সাথে থেকেছে। যদিও তখন রাত কাটায়নি। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোয় ঢাকার সংসার ফেলে রেখে সারাদিন জমিতে কাটিয়েছে। কিন্তু কোনোদিন এ ধরনের কোনো শব্দ সে কানে শোনেনি। কথাটা ভেবে মনে মনে আশ্চর্য হয়েছিল মজিদ।
কিন্তু কেন কানে শোনেনি?
এই ভাবনার ভেতরেই তখন হঠাৎ সন্ধ্যেবেলার কথা মনে পড়েছিল মজিদ শিকদারের। সোলেমান মণ্ডলের কথা মনে পড়েছিল।
‘সাবধানে থাকবেন’ কথাটা বলেছিল সোলেমান মণ্ডল।
কথাটার আসল মানেটা কী ছিল? কেন সে হঠাৎ কথাটা বলেছিল অচেনা এক মজিদ সিকদারকে?
কী ছিল তার উদ্দেশ্য?
ভাবতে গিয়ে মাথার ভেতরে কেমন যেন গরম একটা হাওয়া উঠেছিল। বুকের ভেতরে ধড়ফড় করে উঠেছিল।
লোকটা আরো বলেছিল, ‘জমিটা ঝামেলার, কয়েকবার হাতবদল হয়েছে। একবার রক্তারক্তিও হয়েছিল।’
উরেব্বাস, রক্তারক্তি!
কথাটার গুরুত্ব যেন এতখানি সময়ের ফারাকে সেই প্রথম উপলব্ধি করেছিল মজিদ।
আরে, ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? এ জমি কি তাহলে তারও হাতছাড়া হয়ে যাবে? আবার একবার হাতছাড়া? কথাটা ভেবে তার শরীর অবস হয়ে এসেছিল।
জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে! জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে!
হঠাৎ করে যেন বিলাপ শুরু হয়ে গিয়েছিল মজিদ সিকদারের ভেতরে।
তার রক্ত জল করা পয়সায় কেনা এই জমি। তার ব্যাংক লোনের টাকায় কেনা জমি, যে লোন শোধ করতে তার বিশ বছর লেগে যাবে, সেই লোনের টাকায় কেনা পাঁচ কাঠার এই জমি; আশুলিয়ার বাজার ছাড়িয়ে, সদর রাস্তা ছাড়িয়ে, চতুষ্কোণ ক্ষেত, আলপথ এবং বন্ধ্যা জমি মাড়িয়ে ছোট্ট যে জমিটার ওপরে এতদিন ধরে, এত মাস ধরে মজিদ তার নিজের, পূর্ব পুরুষের ইতিহাসের ও চেতনার স্বপ্ন বুনে দিয়েছে, সেই জমি থেকে তাকে উৎখাত করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে কি কেউ?
এতদিন পরে যখন জমির ওপরে তার অগাধ মায়ার একটা স্বপ্নজাল তৈরি হয়ে গেছে, তখন সেই জমি তার হাতছাড়া হয়ে যাবে?
কথাটা ভাবতে গিয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল মজিদের। ভয় এসে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছিল শরীরে। বমি ঠেলে উঠেছিল তার তার গলার খোড়ল থেকে। তালগাছ, জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তার তালগাছে, রোজ সন্ধ্যেয় যেখানে বাবুই পাখিরা তাদের লাউয়ের শুকনো খোলের মতো ঝোলানো খড়ের ঘরে ঢোকার আগে তুলকালাম বাধায়, তাদের কিচির মিচিরে যেখানে সন্ধ্যার বাতাস বড় অস্থির হয়ে রোজ দুলতে থাকে, যেখানে মজিদ তার অতীতের উৎসের সন্ধান করেছে, সেই জমি থেকে তাকে উৎখাতের চেষ্টা করাটা কি চাট্টিখানি কথা হলো? কথাগুলো মজিদের মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল।
হ্যাঁ? মজিদ এখন তাহলে কী করবে, হ্যাঁ?
সেসব এখন অতীত। এখন আর ভয় এসে মজিদকে কাবু করতে পারছে না। মজিদ সারাটা রাত অনেক ভয় পেয়েছে। অনেক দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ভুগেছে। কিন্তু সেসব এখন অতীত। হয়তো আর কিছুক্ষণ বাদে আজান দেয়া শুরু হয়ে যাবে। রাগে মজিদের শরীর এখন ফুঁসে উঠছে মাঝে মাঝে। সেই রাগে কিছু না ভেবেই ঘরের হুড়কো খুলে ফেলল মজিদ। বাইরের পাতলা অন্ধকারে পৈঠায় এসে দাঁড়াল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল।
একটা নিথর স্তব্ধতা। এরকম স্তব্ধতার কারণ কী? সে আকাশের দিকে এখন চোখ তুলে তাকাল।
সেখানে মাছের আঁশের মতো মরা একটা চাঁদ। তারপর নিচে চোখ ফেলে তাকিয়ে দেখল চারদিক। তাকাতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বাঁশের চটা দিয়ে মজিদ সিকদার তার জমি ঘিরেছিল এই তো কয়েক মাস আগে। কিন্তু বাঁশের চটা আর আর কোথাও তার বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে নেই! বস্তুত বাঁশের কোনো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়