হেরোইন উদ্ধার মামলা : পাকিস্তানি নাগরিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

আগের সংবাদ

রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষণ নেই, নির্বাচনের প্রস্তুতি ইসির : ডিসি এসপিদের নিয়ে ইসির বৈঠক > ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় মাঠ প্রশাসন

পরের সংবাদ

শুধু বায়োপিক নয়, একটানে দেখার মতো সিনেমা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : ‘কখন আসবে কবি?’

স্বাধীনতার ডাক দেয়া ৭ মার্চ নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের সেই বিখ্যাত কবিতার মতই বাঙালি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল, কখন বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক শ্যাম বেনেগালের ছবিটি মুক্তি পাবে বিশাল ক্যানভাসে। প্রত্যাশার পারদ ছিল চরমে। কারণ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ছবিটি নির্মিত হয়েছে। যখন প্রত্যাশা বেশি থাকে তখন প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনার আশঙ্কাও বাড়তে থাকে।
তবে শ্যাম বেনেগাল আমাদের হতাশ করেননি মোটেই। প্রায় আড়াই ঘণ্টার সিনেমাটি চোখের পলকে যেন শেষ হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায় মাঝে মাঝেই। আর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক দৃশ্যে যখন শেষ হয় সিনেমাটি তখন অশ্রæ আর বাঁধ মানে না। পুরো সিনেমায় ধৈর্যচুতি বা অতিরঞ্জিত মনে হয়নি কোথাও। ইতিহাসের পাশাপাশি মানবিক ছোট ছোট দিকগুলোও ফুটিয়ে তুলেছেন অনুপমভাবে। আছে মুজিব-রেনুর ভালোবাসার খুনসুটির নান্দনিক উপস্থাপন।
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি শাসিত হয়েছে কখনো মুঘল, কখনো পাঠান, কখনো বেনিয়া ইংরেজ বা হানাদার পাকিস্তানিদের দ্বারা। বাঙালিকে সেই পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন শেখ মুজিব।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি এনে দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। হাজার বছরের সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে কে অভিনয় করবেন সেটি নিয়েও আমাদের আগ্রহের কমতি ছিল না। শুনেছিলাম উপমহাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন করবেন বঙ্গবন্ধু চরিত্রটি। শেষ পর্যন্ত এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের তরুণ অভিনেতা আরিফিন শুভ।
শুভ কেমন করবেন, শুভ কেমন করতে পারেন, তার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু ভরসার জায়গায় ছিলেন শ্যাম বেনেগাল। তিনি যখন বঙ্গবন্ধু চরিত্রে শুভকে কাস্ট করেছেন, নিঃসন্দেহে বুঝে-শুনেই করেছেন। আদতেও তাই হয়েছে। দু-একটি জায়গা বাদে সিনেমাজুড়ে ভালোই করেছেন শুভ। মেকআপ অসাধারণ। পরিণত বয়সের বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায়।
ছবির শুরুটা হয় ১০ মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য দিয়ে। স্টোরি ট্রেলিংয়ের মতো ফ্লাশব্যাকে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব রেনু। রেনুর ভূমিকায় অভিনয় করা তিশার কণ্ঠে সে বর্ণনাও ছিল বেশ ভালো। সিনেমাটিতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব রেনুর জীবনের অনেক অজানা কাহিনি উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বিয়ের দৃশ্যটি গ্রামীণ আবহে খুব সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে। শ্যাম বেনেগাল ভিনদেশি হলেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। শুধু ইতিহাস না, সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শক পুরোপুরি ‘সিনেমার ফিল’ই পাবেন।
দাম্পত্য জীবনের বেশির ভাগ সময়ই জেলে জেলে কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। ঘরের ভেতর কেমন ছিলেন তিনি, খুব বেশি জানার সুযোগ হয়নি আমাদের। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া কিছু বক্তব্যে অনেক সময় উঠে এসেছে মুজিব-রেনু সম্পর্কের কথা। সেসব দৃশ্যই যেন সংযোজিত হয়েছে ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকারে’। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছিল, তখন জেলগেটে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে এসেছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। করাচিতে যখন বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন টেলিফোনে তা প্রত্যাখ্যান করতে বলেন বঙ্গমাতা। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন গৃহবন্দি অবস্থায় ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবার, তখন যে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বন্দি করে রেখেছিল, মমতা দিয়ে পাকসেনাদের মনও জয় করেছিলেন বঙ্গমাতা। এটি উঠে এসেছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মের পর পাকসেনাদের মিষ্টি ও বাদাম দেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের পরও বঙ্গবন্ধু পরিবার মুক্ত হয়নি, পাকিস্তানি সেনারা তাদের তখনো বন্দি করে রেখেছিল। ভারতীয় মেজর অশোক তারা যখন তাদের মুক্ত করতে যান, পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে পরিস্থিতি জানিয়ে অশোক তারা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বললেও পাকিস্তানি সৈন্যরা বিনা রক্তপাতে আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বলিষ্ঠতা দেখান ফজিলাতুন নেসা মুজিব। মায়ের মতো আদরে এবং শাসনে বঙ্গমাতার কাছে অস্ত্রসমর্পণ করেন পাকিস্তানি সৈন্যরা। বঙ্গমাতার চরিত্রের এমন নানা দিক উঠে এসেছে সিনেমাটিতে। আর রেনু চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য নুসরাত ইমরোজ তিশাকে অভিনন্দন জানাতেই হবে। পাইপ হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি অন্যরকম একটা অভিব্যক্তি দেয় জাতির পিতাকে। কিন্তু তিনি কখন থেকে, কীভাবে পাইপ হাতে নিলেন সে গল্প আমাদের অনেকেরই অজানা। সে প্রসঙ্গ এসেছে এই বায়োপিকে। অসুস্থ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেখতে লন্ডনে যান শেখ মুজিব। তখন সোহরাওয়ার্দী পুত্রস্নেহে শেখ মুজিবকে পরামর্শ দেন সিগারেট ছেড়ে পাইপ ধরতে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকির আহমেদ। সিনেমাজুড়ে শুরু থেকেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ফারিয়া।
সিনেমাজুড়ে নজর কেড়েছে ইতিহাসের ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে জড়িত খন্দকার মোশতাকের চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবুর অনবদ্য অভিনয়। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে মানিক মিয়ার চরিত্রটিকে আরো সাবলীল করেছেন তুষার খান। বঙ্গবন্ধুর বাবা লুৎফর রহমানের মধ্যবয়সি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী ও বৃদ্ধবয়সী চরিত্রে খাইরুল আলম সবুজ সাড়া ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধুর মা সায়রা খাতুনের মধ্যবয়সি চরিত্রে সঙ্গীতা চৌধুরী ও বৃদ্ধবয়সে দিলারা জামানের অভিনয় অনবদ্য। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। ‘লাল হুজুরের’ চরিত্রটিকে তিনি অন্যরকম বলিষ্ঠতা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হয়েও ভাসানীর বাড়িতে মাটিতে বসে মাটির থালায় খাবার দৃশ্যটিও অনবদ্য। তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিয়াজ। তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে লুক যেমন মানিয়েছে, তেমনি অভিনয় করেছেন খুব ভালো। এভাবেই প্রায় প্রতিটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন শ্যাম বেনেগাল।
খুব ছোট ছোটভাবে বঙ্গবন্ধুর মানবিক দিকগুলো উঠে এসেছে। নির্বাচনের সময় গ্রামের সেই বৃদ্ধ বুড়িমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা, তার ঘরে বসে এক গøাস দুধ ও একটি পান খাওয়া এবং নির্বাচনে খরচের জন্য তার সর্বস্ব চার আনা দেয়ার ঘটনা শেখ মুজিবের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে এই সিনেমায়। সিনেমায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সহযোগিতার প্রসঙ্গ বলিষ্ঠভাবে। ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু প্রশিক্ষণই দেয়নি, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব জনমত গড়তে যে ভূমিকা রেখেছেন তাও আছে এখানে। ইন্দিরা গান্ধীর একটি ইন্টারভিউর কিছু অংশ দেখা যাবে সিনেমাটিতে। আড়াই ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের সব ঘটনা তুলে আনা সম্ভব না। শ্যাম বেনেগালও সেটি চাননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠতার কোনো অংশ বাদও যায়নি এই জীবনীভিত্তিক সিনেমাটিতে। ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে সিনেমাটিক ভাষা ব্যবহার করেছেন যথার্থভাবে, এটাই তার মুন্সিয়ানা। দেখতে দেখতে কখনোই মনে হয়নি জোর করে তিনি আমাদের কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। মনে হচ্ছিল টাইম মেশিন করে ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ সালে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সিনেমার শুরুতে ‘অচিন মাঝি’ গানটি দিয়ে বাংলাদেশের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির যথার্থ ব্যবহার হয়েছে অন্তত দুবার। লোকজ বিয়ের গানটিও অসাধারণ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন গোপালগঞ্জের স্কুল ভিজিট করতে এসেছিলেন সেখানেও গ্রামীণ নাচের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন শেখ মুজিব এবং তার সহপাঠীরা। এর পরপরই স্কুল সংস্কারের দাবির কথা জানান শেখ মুজিব। শিল্পীতভাবে সে প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এই সিনেমায়। সিনেমায় আছে শেখ হাসিনার বিয়ের প্রসঙ্গটিও। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকতেই ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে অনাড়ম্বরভাবে বিয়ে হয় শেখ হাসিনার। শেখ কামাল এবং শেখ জামালের বিয়ের অনুষ্ঠানিকতাও দেখা যায় চলচ্চিত্রটিতে। সেখানে জিয়াউর রহমানের চরিত্রটিও উপস্থিত ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে ভারতীয় হাইকমিশনার বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেন, ইন্দিরা গান্ধী বার্তা পাঠিয়েছেন : একদল পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। বিশাল হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু এতে কান না দিয়ে বলেন, ‘কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে না’। সিনেমায় দেখা যায় খন্দকার মোশতাক এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আছে এখানে। দুটি দৃশ্যে জিয়াউর রহমানকে দেখানো হলেও তার কোনো সংলাপ নেই।
সিনেমার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য ১৫ আগস্ট। সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের খবরে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেন, তখন তার বাড়িতেও অতর্কিত আক্রমণ শুরু হয়। ঘাতক মেজর নূর স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে জাতির পিতার বুক। রেহাই পায়নি শিশু রাসেলও। বঙ্গমাতাসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে খুন করে ঘাতকরা। সিনেমাটি শেষ হয়ে যায় ১৫ আগস্টের নির্মমতার ভয়ংকর দৃশ্য দিয়েই।

অনিমেষ কর : সাংবাদিক ও সংগঠক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়