ফেসবুকে প্রেম করে ধর্ষণের মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

দাম নির্ধারণের তোয়াক্কা নেই : সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না তিন পণ্য. ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে জরিমানা

পরের সংবাদ

স্মরণে : সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সৈয়দ মুজতবা আলী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা। তিনি তার ভ্রমণকাহিনির জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধে পরিপুষ্ট। তার গল্প বলার ভঙ্গি, তার মেজাজ, তার শৈলী, তার ঐশ্বর্য অননুকরণীয়। তিনি পরিশীলিত ভাষার চর্চাকারী, রবীন্দ্রনাথের ভাষা তিনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন অনেক সাধনায়, তার অধিকারে ছিল ভাষার অহংকারী সব নির্মাণ ও ভাষার লিখিত রূপের মেধাবী প্রকাশ। কিন্তু সেই তিনিই অবলীলায় বিচরণ করতেন কথ্য ভাষার অলিগলিতে, মৌখিক সাহিত্যের পথে-প্রান্তরে। ফলে তার ‘বলা’ ছিল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
মুজতবা আলী অনেকগুলো ভাষা জানতেন, কিন্তু ভাষার পাণ্ডিত্য দেখানো ছিল তার প্রবৃত্তির বাইরে। ভাষা শিখে তিনি যা করেছেন : ওই সব ভাষার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বয়ানগুলো অভিনিবেশ নিয়ে পড়েছেন। এক ভাষার লেখা সাহিত্যের সঙ্গে অন্য ভাষার সাহিত্যের তুলনা করেছেন; ভাষার প্রাণ ও ভাষার অন্তর্গত গান খুঁজে বেড়িয়েছেন; ভাষার মানুষি আদলটি পরম যতেœ উন্মোচিত করেছেন। চিহ্নিত করেছেন ভাষার ভেতরের শক্তিকে, ভাষার প্রতিরোধ-প্রতিবাদের ক্ষমতাকে।
এ জন্য সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলা ভাষা নিয়ে তার সক্রিয়তা। তাকে কেউ ভাষাসংগ্রামী বলে ডাকেনি, ডাকলে সেই অভিধা তাকে কিছুটা আমোদই দিত, যেহেতু তিনি বলতেন, যে ভাষায় সংগ্রামের ইন্ধন নেই, প্রাণের প্রাচুর্য আর সুধা নেই, সেই ভাষায় কোমল-মধুর গান গাওয়া যায় কিন্তু জীবনের কথাগুলো বলিষ্ঠভাবে বলা যায় না। বাংলা ভাষার ‘আঞ্চলিক-লৌকিক-প্রমিত-পরলৌকিক’ সব রূপ দেখেছেন বলে তিনি গর্ব করতেন (পরলৌকিক? হ্যাঁ, তিনি বলতেন, পরকালের কথা বয়ান করতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজের ভাষার ওপর একটুখানি গোলাপজল না হয় গঙ্গাজল ছিটিয়ে পরিশ্রæত করে নেয়)। সেই বাংলার মর্যাদার প্রশ্নে তিনি লড়লেন, পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল হলেন ও দেশান্তরে গেলেন!
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ সিকন্দর আলী ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার।
পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। বিশ্বভারতীর প্রথম দিকের ছাত্র ছিলেন তিনি। সেখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিশ্বভারতী থেকেই ১৯২৬ সালে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ সালে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডিফিল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৪-৩৫ সালে তিনি মিসরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানকার বিশ্বভারতী নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখেন। তিনি বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি। এই ভ্রমণকাহিনির জন্য তিনি বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এছাড়া লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
তার চাকরিজীবন শুরু হয় কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক হিসেবে। ১৯৩৫ সালে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি আট বছর কাটান। এরপর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব¡ পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছুদিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৬১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।
অনেকের মতে, ১৯৫০-৬০ দশকে মুজতবা আলী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো :
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’
মুজতবা আলীর লেখালেখিতে রম্য ও রসের যে উপস্থিতি, তা কখনো মাত্রাতিরিক্ত নয়। কোন কথায়, কতটা কথায়, কোন প্যাঁচে কে কতটা হাসবে এবং হাসতে হাসতে ভাববে, নিজেকে মাপবে, সেই রসায়ন তিনি জানতেন। তার এই পরিমিতিবোধ ছিল অসামান্য। তিনি বলতেন, মোনালিসা যে এত অবিস্মরণীয় এক চিত্রকর্ম, তার পেছনে দা ভিঞ্চির আঁকিয়ে-হাতের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তার পরিমিতিবোধ। ব্রাশের একটা অতিরিক্ত সঞ্চালন ছবিটির রহস্য কেড়ে নিত। একজন রম্যলেখকেরও থাকতে হবে সেই জ্ঞান, তালে-ঠিক কোনো মদ্যপায়ীর মতো, ঝানু জুয়াড়ির মতো।
বাংলা সাহিত্যে মুজতবা আলীর পাকাপোক্ত স্থান রম্যলেখক হিসেবে। কিন্তু এটিই তার একমাত্র পরিচয় নয়। মুজতবা-গবেষক নূরুর রহমান খান (মুজতবা-সাহিত্যের রূপবৈচিত্র্য ও রচনাশৈলী, ঢাকা ২০১০) সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন এভাবে : ক. হাস্যরস-প্রধান গল্প, খ. করুণ রসাত্মক গল্প, গ. বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক গল্প, ঘ. প্রণয়মুখ্য গল্প, ঙ. অমøমধুর গল্প, চ. ভয়ংকর রসের গল্প। ভয়ংকর রসের গল্প অবশ্য মাত্র একটি, ‘রাক্ষসী’, যেখানে এক বৃদ্ধার মৃতদেহের বর্ণনা সত্যিই ভয়ংকর। মুজতবা আলীর গল্পগুলোর কাহিনি ও বিস্তার এবং এদের অন্তর্গত জগৎটি বিচিত্র। এই বৈচিত্র্যের একটি কারণ তার ঋদ্ধ অভিজ্ঞতা। নানা দেশে গিয়েছেন তিনি, অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার সামনাসামনি হয়েছেন, বিচিত্র সব মানুষজন দেখেছেন, শুনেছেন তাদের গল্প। ফলে তার সাহিত্যের জগৎ হয়েছে বহু স্তরে বিন্যস্ত, বহু রেখায় নির্ণিত। আমাদের সীমিত অভিজ্ঞতার কম্পাস সে জগতের হদিস করতে পারে না।
সৈয়দ মুজতবা আলী গল্প-উপন্যাস লিখতেন, কিন্তু বলতেনই আসলে। ছোটগল্পগুলোর কথা না হয় তোলা থাক, সেগুলোতে বলার মেজাজটা সহজেই ধরা যায়। কিন্তু যে চারটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন, তার তিনটিতেই তো এক অসাধারণ কথনভঙ্গির কারুকাজ। শেষ উপন্যাস তুলনাহীনা প্রথম তিনটির তুলনায় কিছুটা বিক্ষিপ্ত, যেহেতু এর ঘটনাপ্রবাহ ১৯৭১-এর পটভূমিতে স্থাপিত, যা ছিল ঘটনাবহুল-বীরত্ব আর কাপুরুষতা, হত্যা ও মৃত্যুঞ্জয়ী আত্মত্যাগের বিপরীতধর্মী ঘটনায় পূর্ণ। কিন্তু প্রথম তিনটি উপন্যাস ঠাসবুনটে লেখা।
তুলনাত্মক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক মুজতবার ধর্মদর্শন নিয়ে বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী মন্তব্য করেন :

তার (মুজতবা আলীর) সাহিত্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। কিন্তু তার এই উদারতার জন্য গোঁড়া স্বধর্মীরা তাকে কোনোদিন ক্ষমা করেননি।
সৈয়দ মুজতবা আলীর মোট বইয়ের সংখ্যা ৩০টি। এর মধ্যে ভ্রমণকাহিনি : দেশে বিদেশে, জলে ডাঙায়; উপন্যাস : অবিশ্বাস্য, শবনম, শহরইয়ার; ছোটগল্প : চাচাকাহিনী, টুনি মেম; রম্যরচনা : পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকণ্ঠী, গল্পমালা, রাজা-উজির, ধূপছায়া, বেঁচে থাক সর্দি-কাশি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্যের জন্য তিনি ১৯৪৯ সালে ‘নরসিংহ দাস পুরস্কার’, ১৯৬১ সালে ‘আনন্দ পুরস্কার’ এবং মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুজতবা আলী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক বিষয়ে লিখেছেন, অনেক কিছু করেছেন। বিচিত্র তার অর্জন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন গল্পের মানুষ হিসেবে। গল্প বলেছেন এত কুশলতায়-রসে-রঙ্গে-প্রেমে পূর্ণ সে বলার জাদু একটা মোহের বিস্তার ঘটায় প্রতিটি পাতাজুড়ে। আড্ডায়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, বক্তৃতায়, সাক্ষাৎকারে, লেখালেখিতে ছিল তার সেই জাদুবিস্তারী প্রতিভার ছোঁয়া।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়