ফেসবুকে প্রেম করে ধর্ষণের মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

দাম নির্ধারণের তোয়াক্কা নেই : সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না তিন পণ্য. ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে জরিমানা

পরের সংবাদ

আহমদ রফিক : নানামুখী গুরুগম্ভীর চিন্তাশীল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আহমদ রফিক ধারণ করেন বহুবিধ পরিচয়; কর্ম ও সৃজন উভয় বিচারেই। দীর্ঘ জীবনে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি চলেছেন, ভাগ্যের অমোঘ টান তাকে কখনো স্থিতি দেয়নি, যদিও বাহ্যিকভাবে তাকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। বাইরে তিনি সদা পরিপাটি স্থিতধী তুষ্ট ব্যক্তিত্ব, ভেতরে তার উত্তাল মেঘনা। ১৯২৯ সালে মেঘনা-তীরের শাহবাজপুর গ্রামে সম্পন্ন গ্রামীণ পরিবারে তার জন্ম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এই অঞ্চল হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি-সাধনায় ছিল সমৃদ্ধ। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলের পাশাপাশি অমিলের জায়গাও ছিল, তবে সংঘাত কখনো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। শিক্ষা-দীক্ষায় হিন্দু সমাজ ছিল এগিয়ে, পেশার কারণে নগরবাসী হয়েছেন তারা অনেকে, কিন্তু গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেনি। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে তারা বয়ে এনেছিলেন বাইরের অভিঘাত, আর মুসলমান সমাজে ছিল সংগীতের মধ্য দিয়ে মরমি ভাব প্রকাশের আকুতি, যা মুর্শিদি-মারফতি, বাউল-ভজনে রূপায়িত হয়েছিল। উভয়ের মিলিত সাধনার প্রতীক ছিলেন মনমোহন সাধু ও ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ এবং তাদের ‘মলয়া’ গান। বাল্যকালে গ্রামে খুব একটা থাকা হয়নি আহমদ রফিকের, কিন্তু বাল্যস্মৃতি কখনো মুছে যায়নি তার স্মৃতি থেকে। আর তাই মনে করতে পারেন গ্রামের মিয়াবাড়িতে মারফতি গানের আসরে গায়ক মঞ্জুর হোসেন তাকে দিয়েছিলেন স্বরচিত গানের বই ‘মারফত সোপান’। সেই গানের কিছু পঙ্ক্তি তিনি ভোলেননি, পরিণত বয়সে লেখা জীবনকথায় উদ্ধৃত করেছেন গানের মধ্য দিয়ে জানা রঙিলা খোদার লীলা, ‘জাউল্যা হইয়া জাল পাতিলি/ মৎস্য হইয়া ধরা দিলি/ ভোগী হইয়া পরমসুখে খাইলি রে।’
নিজে বস্তুবাদী হলেও বস্তুবাদীদের মতো ভাবসংগীতকে সরাসরি নাকচ করে দিতে পারেননি আহমদ রফিক। একেবারে বাল্যে তার অন্তরে কীভাবে অনুরণন তুলেছিল এই সুরগান, সেই ব্যাখ্যাদান দুষ্কর। পরে তিনি লিখেছেন, ‘বিষয় চেতনহীন মরমি ভাবনার পেছনে ভক্তিবাদী প্রভাব প্রধান হলেও নদীমাতৃক প্রকৃতির প্রভাবও হয়তো ছিল। ভাটিয়ালি গানের জীবনচেতনার পাশাপাশি এর অন্যান্য শাখায় পরম-চেতনার প্রকাশ গ্রামীণ ধারার দুই বিপরীতকেই বোধহয় তুলে ধরে। এর উৎস যে ঠিক কোথায়, তা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সহজ নয়। অন্তত আমার তা স্পষ্ট করে জানা নেই।’
বাল্যেই তার পারিবারিক জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়, বাউলিয়ানা ও দুর্ঘটনা মিলেমিশে জন্ম দেয় ট্র্যাজেডির। আহমদ রফিক বাউল সত্তার নিরিখেই দেখেছেন পরিবারে মরমি-চিন্তার টান এবং তার পিতার মৃত্যু। লিখেছেন- ‘গ্রামীণ মানুষের মধ্যে বিরাজমান মরমি বাউল চেতনা এক ধরনের সর্বজনীন সত্য, হয়তো তাই আমাদের বৃহত্তর পরিবারে ক্ষুদ্র ভূস্বামী চরিত্রের অবাঞ্ছিত উপস্থিতি সত্ত্বেও কারো কারো মধ্যে ওই মরমি চেতনা ও বাউল উদাসীনতার প্রকাশ ঘটেছে। তা না হলে আমার পিতাই-বা মধ্যবয়সে বৈষয়িক চেতনাকে পাশ কাটিয়ে মেঘনার ওপারে মারফতি গানের মাহফিলে যোগ দিতে যাবেন কেন, তাও মাকে না জানিয়ে। আর সে জন্য জোর করে ওই রাতেই ফেরার তাগিদে মেঘনার প্রবল ঝড়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ দিতে হয় তাকে। তৈরি হয় পারিবারিক ট্র্যাজেডি।’
আহমদ রফিকের বড় ভাই তখন ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়েন। মেজো ভাই শ্যামগ্রাম স্কুলের ছাত্র, আর আহমদ রফিক পাড়ার কানাই পালের পাঠশালা ছেড়ে সবে ভর্তি হয়েছেন এক মাইল দূরের নাসিরাবাদ স্কুলে। পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর বড় ভাইকে ধরতে হয় সংসারের হাল, লেখাপড়ায় ক্ষান্তি দিয়ে তিনি চাকরি নেন যশোর জেলার দুর্গম নড়াইল মহকুমায় জেলা বোর্ডের কনিষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে। ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি গ্রামের পাঠ চুকিয়ে গোটা পরিবার স্থান পাল্টে ঠাঁই নেয় নড়াইল শহরে। এ এক ধরনের উদ্বাস্তুতাই, বলা যেতে পারে দেশাভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হওয়া, যে উদ্বাস্তু অভিজ্ঞতা থেকে আহমদ রফিকের কখনোই মুক্তি ঘটেনি। তবে শাহবাজপুর ছেড়ে নড়াইলে বালকের স্থিত হতে সময় লাগেনি। তিনি নড়াইলে এসে পেয়েছিলেন উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ, বই পড়ার এন্তার সুযোগ এবং উত্তাল চল্লিশের বামপন্থার সঙ্গে পরিচয়।
নড়াইলে স্কুল-বালক আহমদ রফিক চল্লিশের দাঙ্গার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, পাকিস্তানের জন্য মুসলমানদের ঘোর উন্মাদনাও প্রত্যক্ষ করেন। এসব কারণে ম্যাট্রিক পরীক্ষার তারিখ ক্রমাগত পেছাতে থাকে। শহরতলিতে মাস্টার মশাইয়ের বাড়ির দাওয়ায় মাদুরে বসে তিন শিক্ষার্থীর অলস সময় কাটে পরীক্ষার প্রতীক্ষায়। আহমদ রফিক, দেবু, পাশের বাড়ির পরীক্ষার্থী জ্যোৎস্না। তাদের মাস্টার মশাই রবীন্দ্রভক্ত, শেলি-শেকসপিয়রেরও। তার আলোচনায় সাহিত্যের কথাই থাকে বেশি। সম্প্রীতির শহর নিস্তরঙ্গ নড়াইলের বাইরে অন্ধ তামসিকতায় দেশ তখন দুলে উঠছে। বড়দা এরই মধ্যে বদলি হয়েছেন ঝিনাইদহে, পরীক্ষার পর আহমদ রফিক যখন ফিরে এলেন নড়াইলে মার্কশিট তুলবেন বলে, ততদিনে দেবুদের আশ্রয় হয়েছে শিয়ালদার কাছে তস্য গলিতে দেড় কামরার চিলতে আবাসে, গাছপালা ঘেরা চওড়া উঠানের বাড়ি ছেড়ে জ্যোৎস্নাদের ঠাঁই হয়েছে দূষিত নর্দমার ধারে ঘিঞ্জি পতিতুণ্ডি লেনে। মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল ছাত্রের, তিনি সবকিছু ‘ডেসটিনি’ বলে মেনে নিয়েছিলেন। আহমদ রফিকের মনে হয়েছিল, ‘না নিয়ে উপায়-ই বা কী ছিল? শেকসপিয়র পড়া সাহিত্যরসিক শিক্ষকের করুণ হাসি এখনো চোখে ভাসে।’
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার প্রবল বাসনা মনে পোষণ করেছিলেন আহমদ রফিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে যে ফলাফল তিনি অর্জন করেছিলেন, তাতে এটা স্বাভাবিকভাবে ঘটবার ছিল। কিন্তু ভবিতব্য বা ডেসটিনি তাকে নিয়েও খেলছিল। দেশভাগের পর প্রেসিডেন্সির পথ বন্ধ হয়ে যায় পূর্ব বাংলার মুসলিম ছাত্রের জন্য। তার সামনে উচ্চশিক্ষার পথ খুব বেশি খোলা ছিল না, ঝিনাইদহে ভালো কলেজ নেই, থাকার অসুবিধার কারণে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়বার উপায় নেই। অবশেষে তাকে আশ্রয় নিতে হয় মেজো চাচার কর্মস্থল মুন্সীগঞ্জে, দেশভাগের কারণে তিনি সবে বসিরহাট থেকে কর্মস্থল বদল করে এসেছেন মুন্সীগঞ্জে। কলেজে পড়ার জন্য চিত্রা তীর ছেড়ে তাকে আসতে হয় ধলেশ্বরী তীরে, মায়ের দেবরের বাড়িতে। আবার তিনি উদ্বাস্তু হলেন কৈশোর ও উদ্গত যৌবনের স্মৃতিময় শহর নড়াইল থেকে, এলেন মুন্সীগঞ্জে। একই দেশের দুই মহকুমা শহর বটে, তবে আহমদ রফিকের মনে ফারাক তৈরি হয়ে যায় বিস্তর। দেশত্যাগী উদ্বাস্তুর মতো তার আর নড়াইল ফেরার কোনো উপায় ছিল না, সেই বাসনাও ছিল না। কিন্তু নড়াইল-স্মৃতি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে যেভাবে জড়িয়ে রেখেছে, সেখান থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ তার ছিল না।
স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন- ‘অবশেষে বিষণ্ন মনে নড়াইল ছেড়ে আসি। শেষবারের মতো অতিচেনা শহরটাকে দেখে নিই। নদীর ধার, স্টিমারঘাট, নীলকুঠি, বকুলতলা, খেয়াঘাট, খেলার মাঠ পেরিয়ে প্রিয় স্কুলবাড়ি, পাশে বিমলেশদের বিশাল খড়ের ঘর, সামনে দেবদারুর ছায়াঘেরা সড়ক, উল্টোদিকে সহপাঠী কালিকাপ্রসাদের জীর্ণ দালান। ওর বাবা কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর মশাই চমৎকার জাদুখেলা দেখাতে পারতেন, দেখিয়েছেনও ডাকবাংলোয় ঘরোয়া আসরে। সেসব স্মৃতির সঞ্চয় নিয়ে সাতচল্লিশে সেই যে নড়াইল ছেড়ে চলে আসি, স্কুলজীবনের স্বাদগন্ধভরা স্বপ্নের ওই শহরে আর কখনো যাইনি। যাওয়ার কথা দু-একবার মনে হলেও যে পরিবেশ ছেড়ে এসেছি, তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না ভেবেই যাত্রা থেকে বিরত থেকেছি। থেকেছি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার মর্মকথা ভেবে।’
জীবনে উন্মুল হওয়ার প্রক্রিয়া আহমদ রফিকের শুরু হয়েছিল একেবারে বাল্যে, যখন পিতৃহীন বালক আট বছর বয়সে মা-ভাই-বোনসহ শাহবাজপুর গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় পেয়েছিলেন বড় ভাইয়ের সংসারে নড়াইল শহরে। অচেনা এ শহর নানাভাবে আপন করে নিয়েছিল দূরাগত বালককে। শহরে বেড়ে ওঠা তার কৈশোর ঝলমলিয়ে উঠেছিল নড়াইলের প্রকৃতি, নদী ও মানুষের কল্যাণে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর শহরত্যাগী বালক আবার যখন ফিরেছিল শহরে, ততদিনে দেশভাগের অভিঘাতে নড়াইল পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত শহরে। এই ভূতুড়ে শহর ছেড়ে প্রায় যেন ছুটে পালিয়েছিলেন আহমদ রফিক, জীবনে আর ফেরেননি এখানে। যদিও ফেরার অনেক অবকাশ তৈরি হয়েছিল স্বাভাবিকভাবে।
নড়াইল ছেড়ে উন্মূল বালক উদ্বাস্তু যুবকে পরিণত হয়েছিলেন। তার নিজের ইচ্ছা-বাসনা বিসর্জন দিতে হয়েছিল অভিভাবকদের মতামতের কাছে। যে অভিভাবকদের সামনেও খুব বেশি সুযোগ উন্মুক্ত ছিল না। বাধ্যত তাকে আসতে হয় মুন্সীগঞ্জে, মেজো চাচার পরিবারের আশ্রয়ে। কেননা এখানে থাকলে হরগঙ্গা কলেজে পড়ার সুবিধা হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই বিক্রমপুরবাসী হয়েছিলেন আহমদ রফিক। তবে যৌবনের সেই উত্তাল বয়সে দুঃখ-বেদনা জয় করে জীবনের সাধনায় মগ্ন হওয়ার শক্তি থাকে অনেক বেশি। আর তাই বিক্রমপুরে কলেজের পাঠকালে নানা রকম অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন আহমদ রফিক, বাম মতাদর্শ তথা কমিউনিজমে তার দীক্ষাও এখানে ঘটে। যদিও তিনি পার্টির আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। পাকিস্তানি পীড়নের সেই কৃষ্ণ সময়ে পার্টি পুলিশ-তাড়িত সন্ত্রস্ত ভূতলজীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। নতুন সদস্যপদ দেওয়ার মতো সুযোগ তারা নিতে পারেনি,
পার্টি-অনুগামী কিংবা কর্মী পেলেই ছিল সন্তুষ্ট।
আহমদ রফিক স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই বরণ করেছিলেন বামপন্থি মতাদর্শ। সেই সঙ্গে ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তার টান, সেটা প্রায় যেন স্বভাবগত। এভাবে অন্তরে বাউল এবং বাস্তবে উদ্বাস্তু এক যুবক পা বাড়িয়েছিল জীবনের পথে। মুন্সীগঞ্জে কলেজের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি আসেন ঢাকায়, ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে, আপাতদৃষ্টিতে সফলতার সোপানে পা রাখলেন বটে, কিন্তু নিরাশ্রয়ী হয়ে রইলেন আগের মতোই, শুরু হলো তার ভাষায় ‘ঠিকানাবিহীন ঢাকায় বোহেমিয়ানের’ জীবন।
১৯৪৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যারা ভর্তি হয়েছিলেন, জীবন তাদের বৃহত্তর এক সমৃদ্ধির জোগান দিয়েছিল। কেননা পূর্ব বাংলার জনজীবনে তখন তৈরি হচ্ছিল ভিন্নতর আলোড়ন এবং বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সবকিছু, জন্ম দিয়েছিল প্রায় যেন এক নতুন পৃথিবীর। সে আলোড়ন স্রোতের কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেল আহমদ রফিককে। একই সঙ্গে অসাধারণ সব জীবনাভিজ্ঞতায় তিনি পুষ্ট হলেন। নাচোলে কৃষক বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কারাগারে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েও তেজোদীপ্ত রাজবন্দি হিসেবে যখন হাসপাতালের রোগশয্যায় শায়িত, তখন চিকিৎসা শাস্ত্রের তরুণ ছাত্র আহমদ রফিক হয়েছেন তার সহায়, পুলিশের চোখের আড়ালে স্বামী কমিউনিস্ট নেতা রমেন মিত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থাকারী। তবে গোপন পার্টির অনেক কাজের নির্ভর হলেও দলে তার অবস্থান কুণ্ঠিত, তিনিও তা ঘোচাতে অনাগ্রাহী। রাজনীতি সম্পৃক্ততা নিবিড় হয়ে উঠেছিল এর আগে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে, যখন ইতিহাসের বিচিত্র গতিধারা ঢাকা মেডিকেল কলেজকে করে দিয়েছিল আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহমদ রফিকের শিক্ষাজীবন বিঘিœত হয়েছিল বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কারণে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রভাব ঠেকাতে কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে প্রদেশের শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং দেশবাসীর ওপর নেমে আসে নিপীড়নের খড়ক। আহমদ রফিক কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কোনো পদধারী ছিলেন না, তবে তিনি ছিলেন মেডিকেল কলেজের বামপন্থি উজ্জ্বল তরুণ শিক্ষার্থী। এর দায়ভার তাকে পোহাতে হয় এবং হুলিয়া মাথায় নিয়ে গ্রেপ্তারি এড়াতে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। এ অভিজ্ঞতাও বাস্তুচ্যুতির আরেক উদাহরণ। যদিও সেটা এককভাবেই ব্যক্তিকে পোহাতে হয় তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে। এমন ক্ষেত্রে সাধারণভাবে দল সহায় হয় ব্যক্তির, তবে আহমদ রফিকের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। দল তার সংকট-মোচনে কোনোভাবে সহায়ক হয়নি। উপরন্তু সম্পত্তি ক্রোকের শঙ্কা এড়াতে শাহবাজপুরের গ্রামে পৈতৃক সম্পত্তিতে পুত্র আহমদ রফিকের অংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন তার মা। স্মৃতিভাষ্যে এর উল্লেখ করেছেন আহমদ রফিক খুব স্বাভাবিকভাবে। এর ফলে পিতৃপুরুষের ভিটামাটির সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক যোগ ছিন্ন হয়ে যায়, বৈষয়িক যোগের পাশাপাশি এর এক আত্মিক দিকও রয়েছে, বিষয়-উদাসীর মনে তার কোনো ছাপ রয়ে যায় কে জানে। তবে শাহবাজপুরের প্রতি তার টান তো জন্মের মাটির সঙ্গে যোগ, সেটা ছিন্ন হতে দিতে সম্মত ছিলেন না আহমদ রফিক। আর তাই দেখি পেশায় কিছুটা স্থিত হওয়ার পর ষাটের দশকের মধ্যভাগে আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে তিনি শাহবাজপুরে গ্রাম-উন্নয়নের সমবায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রূঢ় বাস্তবতা তার এই প্রয়াসে সফলতা বয়ে আনেনি, নিজগ্রামের সঙ্গে বন্ধনও তিনি কোনোভাবে গড়ে তুলতে পারেননি।
ব্যক্তিজীবনে এমনি নানা টানাপড়েনের মধ্যে চলেছেন আহমদ রফিক, পাশাপাশি সাহিত্যে সৃজনে তিনি খুঁজে ফেরেন মুক্তি। রাজনীতি তাকে যে-মুক্তি দেয়নি, তা তিনি খুঁজে পান সাহিত্যে; জীবনভর যে সাহিত্য সাধনায় তিনি নিমগ্ন রয়েছেন এবং বিস্তার ও গভীরতার অনন্য উদাহরণ মেলে ধরছেন। তার সৃজনসাধনার দিকসমূহ যে কাউকে বিস্মিত করবে এবং নানা পরিচয়ে তাকে আমরা এখানে পাই। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তিনি রচনা করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীর মমত্ব এবং গবেষকের নিস্পৃহতা নিয়ে। ফলে এতদ্বিষয়ক তার রচনা একান্ত ব্যতিক্রমী ও আলোকসম্পাত। সমাজ-ইতিহাস বিশেষত দেশভাগ হয়েছে তার অধ্যয়নের অবলম্বন। নিজে তিনি দেশভাগের শিকার নন, কিন্তু দেশত্যাগী মানুষদের বেদনা নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেন নিজ উদ্বাস্তু জীবনপ্রবাহ থেকে। তার দেশভাগবিষয়ক পর্যালোচনা গ্রন্থ তাই সমষ্টির যাতনার সঙ্গে ব্যক্তির বেদনা মূর্ত করে তোলে, কখনো যেন শ্রæত হয় এক হাহাকার, প্রবন্ধ-গ্রন্থে সচরাচর যা মেলে না, যেমনটা প্রবন্ধ আহরণ করে উপন্যাসের ভাষারূপ।
বামপন্থার আঁটোসাঁটো চিন্তাকাঠামোয় তিনি কখনো আবদ্ধ থাকেননি। আর তাই ভাষা আন্দোলন কিংবা দেশভাগ বিচারকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার গুরুত্ব তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন। মার্কসবাদী পণ্ডিতেরা যখন পাশ্চাত্যের ফর্মুলায় ফেলে জাতীয়তাবাদকে হেয় ও বাতিল হিসেবে দাখিল করতে সক্রিয়, তখন তিনি বাংলার সংঘাতের ইতিহাসের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির শক্তি হিসেবে দেখেন জাতীয়তাবাদকে, ইতিহাস ও বাস্তবতার সৃষ্টিশীল বিচার তাকে করে তোলে বিশিষ্ট। একই বিশিষ্টতা আমরা দেখি তার রবীন্দ্রবিচারে, রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রতায় দেখবার ক্ষেত্রে তিনি অনন্য সব প্রবন্ধ আমাদের উপহার দিয়েছেন। অন্যদিকে পতিসর ঘিরে কর্মী রবীন্দ্রনাথকে সবার সঙ্গে পরিচিত করে দিয়েছেন তিনি। নানামুখী গুরুগম্ভীর চিন্তাশীল গ্রন্থসমূহের রচয়িতা এই মানুষটি আবার লেখেন কবিতা, বাউল মাটিতে পড়ে থাকে তার মন। জীবন তাকে করেছে উদ্বাস্তু, আর জীবনভর চলেছে তার সাধনা মাটির গভীরে শেকড় জাড়িত করার, জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংলগ্ন হওয়ার। আমরা বুঝি জীবনের সমগ্রতা তিনি ধারণ করতে চান, আর সেই সমগ্রতার ছাপ মেলে তার রচনা সম্ভারে। বঞ্চনার হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন তিনি, বাইরে তুষ্ট সদাশিব ব্যক্তি, অন্তরে বেদনার ঝড়, যেন ঝড়ো মেঘনায় তিনি বেয়ে চলেছেন জীবনতরী, শক্ত হাতে ধরেছেন হাল, পিতার জলরেখা অনুসরণ করে, পিতাকে ছাপিয়ে, কখনো পরাভব না মেনে।
এটাই বুঝি ব্যক্তি, কর্মী, প্রাবন্ধিক ও কবি আহমদ রফিকের বৈশিষ্ট্য। আর এখানেই তিনি অনন্য।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়