ফেসবুকে প্রেম করে ধর্ষণের মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

দাম নির্ধারণের তোয়াক্কা নেই : সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না তিন পণ্য. ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে জরিমানা

পরের সংবাদ

আলিম সাহেবের এক সন্ধ্যা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আলিম সাহেব লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পেছনে আমিনা বেগমও দাঁড়িয়ে আছে। হায়দরাবাদে তিনি চিকিৎসার জন্য বছরে দু-একবার আসেন। মিতালি আর তার বর এই বিল্ডিংয়ের ন তলায় থাকে। এখানে এসে মিতালির বাড়ি না গেলে সে মনে ভীষণ কষ্ট পাবে। মিতালি তার কোনো আত্মীয় নয়, বন্ধুর মেয়ে। বিয়ে হয়ে এদেশে এসেছে।
আমিনা বেগম তাড়া দিল, ‘কি গো লিফট দেখি আসে না?’
আমিনা বেগমের কথা আজকাল তার আর সহ্য হয় না। সব কিছুতেই সে ধৈর্যহারা হয়ে যায়। আলিম সাহেব কর্কশ স্বরে বললেন, ‘আমি কি লিফট যে, নিচে মানুষ দেখলেই নেমে আসব?’
-‘সেজন্যই তো এখানে বোতাম টিপতে হয়। তুমি তো কিছুই টেপনি।’
আমিনা বুড়ো বয়সে প্রচণ্ড চালাক হয়ে উঠেছে।
কিছুই তার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। লক্ষণ ভালো নয়। আলিম সাহেব সত্যিই কোনো বোতাম টিপেননি। আসলে লিফটে তার একা চড়তে খুব ভয় হয়। হঠাৎ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেলে বিপদ। সাধারণত হয় না শুনেছেন। কিন্তু যন্ত্র বলে কথা। বিকল তো হতেই পারে।
একটা লোক এদিকে আসছে। কানে হেডফোন লাগানো। কথা বলতে বলতে মুখের নানা ভঙ্গি করছে। লোকটা এসেই লিফটের বোতাম টিপল। আলিম সাহেব তার সঙ্গে লাফ দিয়ে লিফটে উঠলেন। আমিনাও উঠেছে। লোকটা পাঁচে টিপেছে। আলিম সাহেব আবার দুশ্চিন্তায় পড়লেন। এই লোকটা পাঁচ তলায় নেমে গেলে বাকি চার তলা তার পক্ষে একা যাওয়া কি ঠিক? একা যদিও তিনি নন, সঙ্গে আমিনা বেগম আছে; কিন্তু তাকে তো গুনতিতে ধরে লাভ নেই। যদিও তিনি ন তলার বোতাম টিপে নামতে পারবেন এ বিশ্বাস আছে। কিন্তু ভুলবশত যদি অন্য কিছু করে বসেন। আর লিফটটা একেবারে ছাদে এসে থামে। নির্জন নিঃসঙ্গ ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাদ! দূরে জোনাকির মতো মিটিমিটি আলোয় মায়াবী এক শহর। ওপরে একটা রাতের বিমান বিকট শব্দে খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায়? ভাবতেই ভীষণ ভয় হচ্ছে তার।
পাঁচ তলায় লিফট থামতেই আলিম সাহেব লাফ দিয়ে নেমে গেলেন। ঘুরে দেখেন সর্বনাশ! লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে সেটা ওপর দিকে উঠছে। লোকটা নামেনি। সে নামুক বা না নামুক সেটা বড় কথা নয়। আমিনা বেগমও যে নামেনি! অসম্ভব আহাম্মক ভদ্রমহিলা। আলিম সাহেবকে নামতে দেখেই তো তার লাফ দিয়ে নামা উচিত ছিল। তার তো আলিম সাহেবকে অনুসরণ করার কথা। পই পই করে তাকে ফলো করার কথা আমিনাকে বাড়ি থেকে বুঝিয়ে এনেছেন।
আলিম সাহেব ‘আমিনা আমিনা’ বলে চিৎকার করতে করতে পাঁচ তলা থেকে ছ তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। লিফট আরও ওপরে উঠছে। আলিম সাহেব শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে সিঁড়ি ভাঙছেন। পায়ের রগগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুকের ধরফরটা খুব বেড়েছে। মনে হচ্ছে এখনই মাটিতে পড়ে যাবেন। সিঁড়ির রেলিংয়ে সজোরে ধরে সিঁড়ি ওঠার চেষ্টা করছেন। তার চিৎকারে কেউ দরজা খুলছে না। কোথাও কোনো লোক নেই। করিডোরগুলো খালি। সন্ধ্যারাতেই এ অবস্থা! গভীর রাতে কাউকে কুপিয়ে খুন করলেও তো কেউ এগিয়ে আসবে না!
সেই লোকটাও নির্ঘাত এতক্ষণে আমিনাকে খুন করার চেষ্টা শুরু করছে। আমিনা বেগমের গলায় মোটা সোনার চেন আছে। ব্যাগে কয়েক হাজার টাকাও। গলার চেন ধরে টানলে আমিনা কিছুতেই সেটা দিতে চাইবে না। লোকটা তখন তার শ্বাসনালী চেপে ধরবে। ব্যাগে ধরে টানলে সে দুহাতে ব্যাগটাকে বুকে আঁকড়ে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার করবে। বন্ধ লিফটে এমন চিৎকার নিরর্থক। কিন্তু আহাম্মকরা এরকমই করে। লোকটা তখন আমিনার মুখ বন্ধ করার জন্য বাধ্য হয়েই পেটে ছোরা ঢোকাবে। মূর্খামির জন্য আমিনা মরবে।
একটা ফোন করা দরকার। কিন্তু আমিনার ফোনটা বাজলে লোকটা ফোন ধরতে দেবে না। বরং সে ফোনটাই ছিনিয়ে নেবে। মিতালিকে বরং ফোন করে সব বলা দরকার এক্ষুনি। পকেটে হাত দিতেই তার খেয়াল হলো ফোনটা আমিনার ব্যাগে রাখা। পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবি পরে বেরিয়েছিলেন আজ। এমন পাঞ্জাবির পকেটে মোবাইল রাখলে সেটা ঝুলে থাকে। তাই আমিনাকে দিয়েছিলেন।
পাকা ক্রিমিনাল লোকটা। আলিম সাহেবকে একা নামতে দেখেই সে হয়তো দশ বা বারো তলার বোতাম টিপে দিয়েছে। আমিনা বেগম হয়তো নামার চেষ্টা করেছিল। লোকটা পেছন থেকে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে কাজটা করেছে বদমাশটা।
আলিম সাহেবের পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। আর উঠতে পারছে না। এ মুহূর্তে কোন তলায় দাঁড়িয়ে আছেন কে জানে। এগিয়ে গিয়ে বেলকনি দিয়ে নিচে দেখতেই মাথা ঘুরে গেল। পোকামাকড়ের মতো কিলবিল করছে শহরটা। এমনিতেও বেশি উপর থেকে নিচে দেখলে তার বুক কাঁপা শুরু হয়। বাড়িতে দোতলার ছাদে যতক্ষণ রেলিং দেয়া হয়নি ততক্ষণ তিনি ছাদেই ওঠেননি। মিস্ত্রিরা তাকে অনেক ডেকেছিল রেলিংয়ের মাপজোক দেখার জন্য। হাঁটুতে ব্যথা বলে ওঠেননি।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পেছনে একটা খট করে শব্দ শুনলেন। ঘুরে দেখেন লিফটটা থেমেছে। দুজন লোক থেকে একজন নামছে। আমিনা লিফটে নেই। ছুটে লিফটের পাশে আসতে আসতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এটা এবার নিচের দিকে নামছে। যে লোকটাকে নিয়ে লিফট নেমে যাচ্ছে তাকে এক ঝলকেই খুব চেনা চেনা মনে হয়েছে। কোথায় যেন দেখেছেন। কিন্তু কোথায়?
ব্রেনে বেশি চাপ দিতে হলো না। হালকা চাপেই সব ছবির মতো ভেসে উঠল। এই সেই লোক যে আমিনাকে নিয়ে একটু আগে উপরে গিয়েছিল। কাণ্ড ঘটিয়ে এবার তড়িঘড়ি পালিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে যে করেই হোক পাকড়াও করতে হবে। লোকটাকে এখন অনেক বেশি হিংস্র মনে হয়েছে। খুনের পর তার মধ্যে হিংস্রতার রেশ থেকে গেছে।
আলিম সাহেব ঝড়ের বেগে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এলেন। এর মধ্যে দুবার হোঁচট খেয়ে পড়েছেন। কিন্তু সত্তরের আশপাশের এক বুড়ো আর এক যন্ত্রের মধ্যে দৌড়। যন্ত্র তো জিতবেই। লিফট আলিম সাহেব নামার আগেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে গেছে। লোকটা তার মানে এইমাত্র লিফট থেকে নেমে সামনের বড় রাস্তার ভিড়ে মিশে গেছে। এ জনসমুদ্রে তাকে খুঁজে পাওয়া তো অসম্ভব।
কেউ কি দেখেছে লোকটাকে নামতে? আলিম সাহেব এদিক ওদিক দেখলেন। একটা ছেলে চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। সম্ভবত সিকিউরিটি গার্ড হবে। গায়ে ইউনিফর্ম আছে। আলিম সাহেব ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এইমাত্র যে লোকটা লিফট থেকে নেমেছে সে কোন দিকে গেছে?’
ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলিম সাহেব চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘বল হতভাগা তাড়াতাড়ি বল।’
ছেলেটা ছুটে লিফটের কাছে এলো। আলিম সাহেব আরও ক্ষেপে গেলেন, ‘এখানে নয় হতচ্ছাড়া। এখান থেকে নেমে কোন দিয়ে গেছে সেটা বল।’
ছেলেটা নিরীহ গোবেচারা সাজার চেষ্টা করছে। আলিম সাহেব নিশ্চিত হলেন যে এর মুখ থেকে সঠিক উত্তর এভাবে পাওয়া যাবে না। তাকে রূপ বদলাতে হবে। কারণ এই ছেলেটিই একমাত্র আই উইটনেস। সে জানে কালপ্রিট কোন দিকে গেছে। এবার আলিম সাহেব ঝানু দারোগার মতো সজোরে তার গলা টিপে ধরলেন, ‘বল শালা বদমাশ খুনি কোন দিকে গেছে বল। না হলে তোকে এখানেই আস্ত পুঁতে ফেলব।’
ছেলেটার মুখ দিয়ে গো গো শব্দ বেরোচ্ছে। ধস্তাধস্তি দেখে বেশ রাস্তার কজন মানুষও এখানে জড়ো হয়েছে। সবাই হয়তো তার কথা বুঝতে পারছে না, তবে তিনি যে খুব বিপদে পড়েছেন এটা তারা অনুমান করতে পারছে। এদের মধ্য থেকে একটা চেনা মুখ দেখে আলিম সাহেব হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। মিতালির বর শুভেন্দু। শুভেন্দুর গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে আলিম সাহেব বললেন, ‘মুহূর্তে কাণ্ডটা ঘটে গেছে বাবা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্রিমিনালটা সব শেষ করে দিয়ে গেছে।’
আলিম সাহেব যত দ্রুত ঘটনাটা বলা যায় শুভেন্দুকে বললেন। শুভেন্দু আলিম সাহেবকে জড়িয়ে ধরে আছে। আলিম সাহেব বললেন, ‘তোমার ফোনটা থেকে পুলিশে একটা ফোন কর বাবা।’
শুভেন্দু বলল, ‘আপনি শান্ত হোন। ঘরে চলুন আগে। সেখানে গিয়ে না হয় ফোন করব।’
-‘ঘরে গিয়ে কী হবে বাবা, আগে ছাদে চলো। মনে হয় বডিটা ছাদে ফেলে গেছে।’
শুভেন্দু আলিম সাহেবকে নিয়ে লিফটে উঠল। আলিম সাহেব লিফটের ভেতরটা ভালো করে দেখলেন। পেছনের দিকে তাকিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন। আমিনার মাস্কটা কোনায় পড়ে আছে। তার অনুমানটাই ঠিক। আমিনাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছে পশুটা। ধস্তাধস্তিতে মাস্কটা খুলে পড়েছে। মাক্সে কি খুনির হাতের ছাপ পাওয়া যাবে? মাস্কটা তুলতে গিয়ে আলিম সাহেবের হাত কাঁপছে।
লিফটটা থেমেছে। শুভেন্দু আলিম সাহেবকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। মিতালি এগিয়ে এসে আলিম সাহেবকে ধরে সোফায় বসাল। ঘরে অখণ্ড নীরবতা। শুধু ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওদের বসিয়ে রেখেই মিতালি এক গøাস জল নিয়ে এলো। পেছনে পেছনে আরেক মহিলা আসছে। তার হাতেও একটা ট্রে। খুব পরিচিত চলার ধরন। মুখের দিকে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো লাফ দিয়ে উঠলেন আলিম সাহেব।
আমিনা বেগম!
আলিম সাহেব কিছু বলার আগেই আমিনা বলল, ‘তোমার দেরি দেখে দামাদকে পাঠালাম খুঁজে আনতে। তা কি করছিলে এতক্ষণ?’
আলিম সাহেব একটা অকথ্য গালি দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। সামনে কন্যাসম মিতালি আছে।
রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘তুমি এখানে এলে কী করে?’
আমিনা উল্টো প্রশ্ন করল, ‘তুমি পাঁচ তলায় নেমে গেলে কেন, আমাদের তো ন তলায় আসার কথা ছিল। তাই না?’
আলিম সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, আসলে ওই লোকটা পাঁচ তলায় টিপে দিল বলে আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
-তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? সে পাঁচে টিপুক বা দশে! এ জন্যই লোকে বলে তুমি বেকুব।
আলিম সাহেব কোনো জুতসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। যার জন্য এত দৌড়লেন সে এখন তাকে বলছে বেকুব!
আমিনা চা তে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘লোকটা মনে হয় ভুলে পাঁচ তলায় টিপেছিল। তুমি নেমে যেতেই সে দ’শে টিপল। আমি ন তলায় নামব বলায় সে আমাকে ন তলায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। মনে হয় কোনো রেস্টুরেন্টের ডেলিভারি বয়। কোন ফ্লোরের লোক অর্ডার করেছিল তা খুঁজে পাচ্ছিল না।
আলিম সাহেব ভেংচি কেটে কিছু একটা বলতে যেতেই আমিনা মিতালিকে বলল, ‘জানো মিতালি আমার শ্বশুরেরও এমন রোগ ছিল। শেষ বয়সে তো প্রায় পথে পথে…’
আলিম সাহেব রে রে করে ওঠলেন, ‘চুপ, একদম চুপ। আমার মরা বাপের নামে একটা কথাও না।’

মিতালি আর শুভেন্দু মনে হয় যা বোঝার তা এতক্ষণে বুঝে গেছে। তাই মিতালি আলিম সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ কথাটা এখানেই থাক কাকা, আমি পাঁঠার মাংস করেছি। এবার লুচি আর বেগুনভাজা করব। এই মেনুটা তোমার খুব প্রিয় তাই না?’
আলিম সাহেব হাসতে গিয়েও হাসতে পারলেন না। সামনের আয়নাতে তার মুখটা বনের বাঁদরের মতো দেখাচ্ছে। দাঁত বের করায় মনে হচ্ছে বুড়ো বাঁদর ভেংচি কাটছে। তাড়াতাড়ি দাঁতের পাটি বন্ধ করে ফেললেন। বহু চেষ্টা করেও কেন জানি না এখন আর শুভেন্দুর দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না। ছেলেটা তাকে নিয়ে কী ভাবছে কে জানে!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়