মোস্তাফা জব্বার : সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তারেকের বক্তব্য সরানো শুরু

আগের সংবাদ

হাসিনা-মোদি বৈঠকে ‘ফলপ্রসূ’ আলোচনা : তিন সমঝোতা স্মারক সই, স্থিতিশীলতা ও সম্পর্কে গুরুত্ব

পরের সংবাদ

মিলনকে নিয়ে সামান্য কথা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক ‘সংবাদ’ চার মাস বিরতির পর পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল। চার মাস ‘সংবাদ’ প্রকাশিত হয়নি। এই চার মাস বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে কত ঘটনাই না ঘটেছে! বিমূঢ় বিস্ময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীর একাংশের অশুভ তৎপরতা, আস্ফালন এবং বাঙালি জাতিসত্তায় আচ্ছাদন, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এবং দেশ ও জাতিকে পশ্চাদমুখী করার প্রবণতা। এই পটভূমিতে ‘সংবাদ’ যখন বেরোল, আমাদের অনেকেরই স্কন্ধে দেশের জন্য কর্তব্যবোধ থেকে কিছু করার দায় বর্তেছিল। ‘সংবাদ’ কর্তৃপক্ষও নবীন বিন্যাসে ও অঙ্গীকারে ‘সংবাদ’ প্রকাশ শুরু করেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিকে আমল দেয়নি ‘সংবাদ’ কর্তৃপক্ষ। এই সময়ে জহুর হোসেন চৌধুরী এবং আবু জাফর শামসুদ্দীন কলাম লেখা শুরু করেন। অচিরকালের মধ্যে তাদের দুজনের কলাম খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মধ্যে এই অঞ্চলের মধ্যবিত্ত বাঙালির বিভিন্ন প্রশ্নের দোলাচল এবং ১৯৫৮ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন সামরিক শাসকরা কোন পরিপ্রেক্ষিতকে অবলম্বন করে বাঙালিকে শোষণ ও বঞ্চনা করেছে, তা প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। কোন ঐতিহাসিক পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা কেন আবশ্যক, তাদের বিশ্লেষণে প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল। ‘সংবাদ’ পত্রিকার এই অঙ্গীকার ক্ষমতাসীনদের অপ্রসন্ন করে তুলেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অঙ্গীকার থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল রাষ্ট্রকে। সমাজে অসাম্যের প্রতিষ্ঠা ও সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে ধর্মান্ধতাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশকে পশ্চাদমুখী করার আকাক্সক্ষা ও অভিলাষ নিয়ে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রের নীতিগুলো গৃহীত হচ্ছিল। সৃজনশীল শিল্পী, সাহিত্যিক ও মননজীবীদের জন্য খুব আনন্দও সুখের সময় ছিল না। এ ছিল দেশের মানুষের জন্য দুঃসময়।
১৯৭৩ সাল থেকে ‘সংবাদ’ সাময়িকী বিরতিহীনভাবে এমন সব লেখা প্রকাশ করছিল, যা নবীন লেখক, কবি ও শিল্পীদের খুবই উদ্দীপিত করেছিল। সদ্য স্বাধীন দেশের সাহিত্য ও শিল্প নবীন বোধ ও বিন্যাস নিয়ে আলোকদীপ্ত হবে- এমনই ভাবনা ছিল।
‘সংবাদ’ প্রকাশনা বন্ধের পর ১৯৭৬ সালে যখন পুনঃপ্রকাশিত হলো এই বোধ আরো সম্প্রসারিত হলো এই পত্রিকার সাহিত্যের পাতায়। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তা যে কোনো সৃজনশীল মানুষের জন্য ছিল মর্মঘাতী ও হƒদয়বিদারক। কেননা বাঙালির অর্জন ও পরবর্তীকালের সমাজবিন্যাস ও বাংলাদেশবিরোধীদের সমাজে প্রতিষ্ঠা এই সময়কালে শুরু হয়েছিল। চিন্তা ও লেখনীর স্বাধীনতা খর্ব হওয়ায় লেখকের মনোগহনকে দগ্ধ ও বিক্ষত করছিল।
এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব বর্তাল ‘সংবাদ’ সাময়িকীর ওপর। সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায় নিয়ে সাময়িকী বিভাগটিকে বাংলাদেশের হƒদয় যন্ত্রণার দর্পণ করে গড়ে তোলার অভিপ্রায় নিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে এমন কিছু গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, যা তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারের কাছে নীতিবিরুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়েছিল। বিশেষত জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে একক ও নিঃসঙ্গ এক সংগ্রাম চালিয়েছিল সাময়িকী বিভাগ। শিল্পী কাজী হাসান হাবিব সাহিত্য পাতার সচিত্রকরণ ও অক্ষরবিন্যাসে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং পরিশীলিত বোধ নিয়ে সাময়িকী বিভাগটিকে বিন্যস্ত করছিলেন। সারা সপ্তাহ আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতাম। গল্প ও কবিতার সচিত্রকরণে কীভাবে নবীন মাত্রা সঞ্চার করা যায় এ নিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিনিময় হতো। তিনি আমার সুপারিশ কিংবা পরিকল্পনা শ্রদ্ধার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতেন। এই ভাবনায় কতভাবে যে পরিসর নিয়ে, অক্ষরবিন্যাস নিয়ে নিজের সৃজনকেও সমৃদ্ধ করেছিলেন তিনি! নিত্যদিন আমরা এই বিভাগকে মনোগ্রাহী করা যায় কীভাবে, সে নিয়ে কথা বলতাম। লেখা সংগ্রহ ও বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করার জন্য সম্পাদক হিসেবে আমারও চিন্তার অবধি ছিল না। প্রতি বুধবার সাময়িকীর কাজ চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করার পর সেদিন সন্ধ্যায় চার পাতা সাময়িকী প্রেসে চলে যেত। অধিক রাতে মুদ্রণের অনুমতি দিতে হতো। সামরিক শাসনজনিত কারণে অতিরিক্ত সতর্কতারও প্রয়োজন ছিল।
১৯৭৬ সালে ‘সংবাদ’ সাময়িকীর কাজ যখন চলত, প্রায় প্রতি বুধবার বিকালে ইমদাদুল হক মিলন চার বন্ধুর একটি দল নিয়ে হাবিবের সঙ্গে আড্ডা দেবেন বলে ‘সংবাদ’ অফিসে চলে আসতেন। চারজনেরই ছিল সাহিত্যে অন্তপ্রাণ, কিন্তু পেশাগত দিক দিয়ে কেউ তেমন থিতু তখনো হননি। স্বভাবে কিছুটা বোহেমিয়ান, জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত; কিন্তু সাহিত্য ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোনো প্রেম নেই।
হাবিবের কাজ শেষ হলেই এরা বেরিয়ে যেতেন। আরো বৃহত্তর আড্ডা ওদের টানত। পরে শুনতাম, ওদের কথা ফুরাত না। যৌবনের ধর্ম বোধ করি এমনই। মধ্যরাত অবধি তর্ক আর আড্ডা তাদের স্বভাবধর্ম হয়ে উঠেছিল। ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে এই সময়ই আমার আলাপ। একদিন হাসান হাবিব ইমদাদুল হক মিলনের একটি গল্প পড়তে দিলেন। পড়ে মুগ্ধ হলাম। এমন নির্ভার, মেদহীন, আড়ম্বরহীন গদ্যে তিনি এক গল্প নির্মাণ করেছেন, যাতে গ্রাম ও শহরজীবন এবং এক উš§ূল যুবকের বেঁচে থাকার আর্তি এবং নারীর শরীরের জন্য আকুলতা নবীন মাত্রা নিয়ে উšে§াচিত হয়েছিল। গল্পটি প্রকাশিত হলো ‘সংবাদে’। সারস্বত সমাজ এক সম্ভাবনাময় তরুণের আবির্ভাবকে স্বাগত জানাল। এক সম্ভাবনাময় গল্প লেখকের সব সম্ভাবনা আমি দেখেছিলাম এই গল্পে। কাজী হাসান হাবিব প্রাণমন দিয়ে সচিত্রকরণ করলেন, বেশ বড় স্পেস নিলেন এবং সচিত্রকরণটি চরিত্র অনুযায়ী কখনো ভাঙলেন। বন্ধুরা এত ভালো সচিত্রকরণের জন্য এ নিয়ে হাবিবের সঙ্গে পরিহাসও করেছিলেন। ইমদাদুল হক মিলন ও তার বন্ধুদের তখন বয়স কত? সেই যুবা বয়সের কথা ভেবেই তাদের মানস গঠন পর্ব এবং পঁচাত্তর-উত্তর সমাজবিন্যাস ও আবহ প্রসঙ্গে কিছু কথা উল্লেখ করছি। মিলনের সৃজন উৎকর্ষ, বিষয় উপলব্ধির জন্য এই যে পঁচাত্তর-উত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের দোলাচল ও প্রবণতা এবং বিকাশমান মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণা আকাক্সক্ষা-উপলব্ধির জন্য এই সময় পরিধির কথা উল্লেখ করলাম। সেই সময়টা তাদের রুচি গঠনের বয়স এবং স্বপ্ন দেখার। অথচ দেশের অরাজক পরিস্থিতি ও সামরিক শাসন কি রুচি ও যৌবনের স্বপ্নে কোনো মাত্রা যোগ করেছিল? হয়তো বিরুদ্ধ প্রতিবেশ ছিল বলেই তাদের মানসযাত্রা খরপ্রবাহিনী হয়েছিল। সেই যে শুরু হয়েছিল ‘সংবাদে’ গল্প লেখা, তা আর থামেনি। ‘সংবাদে’ বিশেষ সংখ্যাগুলোতে ইমদাদুল হক মিলনের গল্প না হলে আমার মন ভরত না। তিনি যে চারজন বন্ধু নিয়ে প্রতি বুধবার আড্ডা দিতে আসতেন, তারা সবাই গল্প লিখতেন; এদের বেশ কয়েকটি গল্পে জীবনের উত্তাপ ছিল এবং প্রচলিত গল্পের ধারা থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করার অন্তর্মুখী এক চাপ তাদের গল্প রচনায় উদ্বুদ্ধ করছিল। এদের মধ্যে পরবর্তীকালে প্রবাসী হলেন মুহাম্মদ জুবায়ের। প্রবাসে আর্থিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছিলেন। আকস্মিকই একসময় সামান্য রোগভোগের পর আমেরিকায় মুহাম্মদ জুবায়ের প্রয়াত হলেন। তার বেশ কয়েকটি গল্প পত্রস্থ হয়েছিল ‘সংবাদ’ পত্রিকায়। যে অমিত সম্ভাবনা দেখেছিলাম তার গল্পে, তার অকালবিয়োগে সত্যিকার অর্থেই আমি ব্যথিত হয়েছিলাম। মিলনের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম ভিন্নধর্মী কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন তখন এবং সুনামও অর্জন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা, অর্থ- সবকিছুই পেয়েছিলেন। পেশায় তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। আর্থিক দুর্গতি নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। তার গল্পও ছিল প্রথাবিরোধী। নব্বইয়ের দশক থেকে লেখা ছেড়ে দিলেন। এদের দুজনের কথা যখন মনে পড়ে, মন বিষণ্ন হয়ে যায়। ঝড়বৃষ্টি বা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এদের আড্ডার বিরাম ছিল না।
প্রতি বুধবার ‘সংবাদ’ অফিসে এদের আড্ডা ও কথোপকথনে উপলব্ধি করেছিলাম, কথাসাহিত্যে এই নবীন লেখকরা নতুন কিছু করার ব্রত নিয়েছেন। এদের পঠন-পাঠনেও ছিল জিজ্ঞাসার ছাপ। ব্যাপ্তিও বিশাল। আমি এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন এদের সাহিত্যবোধ ও রুচি নবীন পথ নির্মাণে উš§ুখ। কার গদ্যে জীবনের রূপায়ণ কীভাবে উšে§াচিত হচ্ছে, এ নিয়ে তর্ক ও মতবিনিময় করতেন তারা। আমি ছিলাম শ্রোতা। বুঝতে অসুবিধা হতো না কী তাদের প্রবণতা; শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার দারুণ ভক্ত ছিলেন তখন তারা। এবং এদের কোনো গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তারা কেমন করে যেন খবর পেতেন, বিলম্ব না করে বইগুলো সংগ্রহ করতেন, মতবিনিময়-তর্কে মেতে উঠতেন। কখনো-সখনো অনুপুঙ্খ ঘটনা এবং এই লেখকদের জীবনযাপন তাদের যে কতভাবে দীপিত করত, তাদের আলাপচারিতায় তা বোঝা যেত। ভিন্নধর্মী অমিয়ভূষণ মজুমদার কিংবা দেবেশ রায় নিয়েও তাদের প্রবল আগ্রহ ছিল। এই লেখকদের লেখার কালিক চেতনা, সময়ের বিস্তার নিয়েও তারা কথা বলতেন। দুর্বোধ্য কমলকুমার মজুমদার তখনো সর্বার্থে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হননি। তবু তার সৃজন সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন। এমনকি কমলকুমার মজুমদারের জীবনযাত্রা, ধর্মবোধ, সিগনেট এবং ডিকে- সবকিছু নিয়ে কথা বলতেন তারা। হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হকের লেখা এরা অভিনিবেশ-সহকারে পাঠ করতেন এবং কোথায় এই লেখকদের শক্তিমত্তা ও সীমাবদ্ধতা, তা নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি এই কথোপকথনে উপলব্ধি করেছিলাম, এরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন নতুন কিছু করবার, প্রথা ভেঙে গল্প লিখবার ও জীবনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করার।
এরা যে রাজনীতিবিমুখ সমাজবহির্ভূত চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলেন, তা-ও না। স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এ দেশের বাঙালির জীবন যে কতভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, এ নিয়েও তাদের ভাবনার অন্ত ছিল না।
এভাবেই চলছিল দীর্ঘদিন। তারপর একদিন আকস্মিকই বোধ করি ইমদাদুল হক মিলন জার্মানি চলে গেলেন। কয়েক বছর বাদে মিলন যখন ফিরলেন, তখন বিস্তর জীবন অভিজ্ঞতা। জীবনসংগ্রাম তাকে সাহিত্যের ভুবনে প্রতিষ্ঠিত করার পথ দেখাল। লিখলেন ‘পরাধীনতা’ উপন্যাস। এক কথায় অসামান্য। নতুন বৃত্ত, নতুন পৃথিবী, নতুন মানুষ ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তাকে সাহিত্যের ভুবনে বৃহৎভাবে প্রতিষ্ঠিত করল। বাঙালির প্রবাসজীবন নিয়ে এ উপন্যাসটি শুধু সার্থক নয়, অসামান্য। প্রবাসজীবনের নিঃসঙ্গতা, সংগ্রাম, বাঁচার আর্তি, দেশের জন্য হƒদয়যন্ত্রণা, সর্বোপরি শিকড়হীন মানুষের এক হাহাকার নিয়ে পরাধীনতাবোধের, জিজ্ঞাসার এক মূর্ত প্রকাশ হয়ে উঠল ‘পরাধীনতা’ উপন্যাস।
আমি তার উšে§ষ পর্বের সাক্ষী ছিলাম এবং দেখলাম, একজন আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য কতভাবেই না পরিশ্রম করছেন! ‘নূরজাহান’ উপন্যাস তিন খণ্ড আরেক মিলনকে চিনিয়ে দিল। বৃহত্তর এই উপন্যাস কত বড় পরিসর নিয়ে জীবনযুদ্ধকে উপলব্ধি করাল। বাস্তবতা, অতিবাস্তবতা এবং সমাজের বিন্যাসের এক বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠল ‘নূরজাহান’ তিন খণ্ড।
‘কালি ও কলম’ যখন বারো বছর আগে বেরোল, কার উপন্যাস ধারাবাহিক ছাপব, এ নিয়ে যখন কথা উঠল, আমি দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে মিলনকেই অনুরোধ করলাম। মিলন ‘পর’ নামে একটি উপন্যাস লিখলেন। ধারাবাহিক উপন্যাসটিতে তিনি সমাজ, জীবন ও প্রেমের এমন এক মানবিক বৃত্ত রচনা করলেন দেশ বিভাজনের অনুষঙ্গকে ধারণ করে, যা শুধু মনোগ্রাহী নয়, সুখপাঠ্য ও নবীন ভাবনার দ্যোতক। ঠাকুরদা ও নাতনির জীবনদৃষ্টিতে জীবন ধারণায় দুস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও শাশ্বত ও পবিত্র হয়ে উঠল ‘পর’ উপন্যাস। উপন্যাসের বিষয় ছিল একটি স্কুলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে আগত ঠাকুরদা ও নাতনির দীর্ঘদিন ধরে লালিত দেশত্যাগী এক পরিবারের গল্প। ঠাকুরদা চলে গেছেন কলকাতায় দেশ বিভাজনের সময়; নাতনি কেবল গল্প শুনেছেন। এই গল্পের সঙ্গে মিলনের রচিত মানবিক বোধ আমাদের বিশ্বাসের জমিনকে দৃঢ় করে। তারপরও তো মিলন থেমে থাকেননি। অদম্য মিলন; গল্প লিখছেন, উপন্যাস লিখছেন এবং বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায়ের হƒদয়ের মণি হয়ে উঠছেন। জনপ্রিয় তো বটেই, বহুল পঠিত। কত বিচিত্র তার লেখার বিষয়! মানুষের মনের অন্ধকার ছায়া ও গলিঘুঁজিও তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিষয়। ভাবা যায়, তার এখন দুই-শতাধিক গ্রন্থ। তিনি লিখেই চলেছেন বিরতিহীন সাধনায় ও চর্চায়। কত অধ্যবসায়, জীবনে শৃঙ্খলা না থাকলে এই ষাট বছর বয়সে এসে এত লেখা কি সম্ভব হতো! শত ব্যস্ততা, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি লিখছেন এবং কোনো দিক থেকে অতিপ্রজজনিত কারণে শিল্পগুণ ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে হয় না। লঘু নয়, চটুল নয়, যৌনতার বাড়াবাড়ি নেই বিবরণে। এ ক্ষেত্রে মিলন বড় লেখকের মতো সীমাজ্ঞানকে মান্য করেন। তার সৃজনে জীবনের রূপায়ণ আছে। তিনি যে গদ্য নির্মাণ করেন, তা ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে মৌলিকত্বে। হয়ে উঠে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। সরল অথচ লাবণ্যময় স্বতঃস্ফূর্ততায় নির্মিত গদ্য ও রচিত জীবন আমাদের সাহিত্যে তার আসনকে দৃঢ় করেছে। হয়ে উঠেছেন তিনি বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। তার বর্ণিত চরিত্রে এবং আবর্তে আমাদের জীবনই প্রতিফলিত হয় বলে আজও তার সৃজন সজীব ও প্রাণের আবেগে দীপ্ত। নির্ভার মেদহীন গদ্যে তিনি জীবনযন্ত্রণার কথা বলে চলেছেন। সেখানে সমাজ, এই অঞ্চলের বাঙালির জীবন উপেক্ষণীয় নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়