ইসলামী আন্দোলন : নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা

আগের সংবাদ

কুরবানির পশুর দাম বেশি যে কারণে > আফতাবনগর হাট : এখনো জমেনি হাট গরুও উঠেছে কম

পরের সংবাদ

বঙ্গ বাহাদুরের বিদায়

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আসামের আবাসস্থল ছেড়ে কোন কুলক্ষণে সে পথে বেরিয়েছিল জানে না হাতিটির জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কেউ। তার খেয়ালই ছিল না সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃদেশীয় আতিথেয়তায় আদর-আপ্যায়নে সম্মান-সমীহে সমস্যা বিস্তর। সার্কভুক্ত দেশের একজনকে এভাবে বন্যার তোড়ে পাহাড়, দেশ, নদী সাঁতরে ঘুরে বেড়াতে হবে, সে ভাবেনি। তার ভিসা ছিল না ঠিকই কিন্তু সীমান্ত পাড়ি দিতে সমস্যা হয়নি। সে ভেবেছিল একই ভূমিতে তার যাতায়াতে বাধা হবে কেন। র‌্যাডক্লিফ সাহেব কী খেয়ে যে মাতালের মতো ভারতবর্ষের দেশ ও মাটিকে ভাগ করেছিলেন! মুহূর্তের মধ্যে নিজের দেশ পর হয়ে গেল। আজ বিদেশ বিভুঁইয়ে হাতিটিকে বিদায় নিতে হলো প্রবাসীর পরিচয়ে। অথচ এই জামালপুর জেলায় এমনকি এই সরিষাবাড়ীতে তার পূর্ব পুরুষরা আগে এমনি বেড়াতে আসত। এমনকি একবার নতুন জামাই হয়ে। র‌্যাডক্লিফ সাহেব এসব বুঝতে চাননি, তাহলে আজ এমনভাবে ডোবায় পড়ে, চেতনানাশক ওষুধ খেয়ে (হয়তোবা) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সহস্রজনের কৌতূহলের মাথায় মারা যেতে হতো না তাকে।
সুন্দরবনের বাঘ, বানর, হরিণ ও কুমির (বাবাহকু) পর্ষদের কেন্দ্রীয় প্রচার দপ্তর থেকে সেদিন সন্ধ্যায় একটি প্রেস নোটে উপরোক্ত কথাগুলো বলা হয়। কচিখালিতে প্রচার মন্ত্রকের শীর্ষ কর্মকর্তা হরিণা হাপানের স্বাক্ষরে প্রেস নোটটিতে লোকালয়ের একটি মফঃস্বল গ্রামে বঙ্গ বাহাদুর খ্যাতিপ্রাপ্ত একটি আন্তর্জাতিক হাতির অকালমৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। বাবাহকুর প্রেসিডিয়াম প্রধান সুন্দর মিয়া সে সময় কটকায় তার বর্ষা অবকাশ কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। বার্তা সংস্থা উবিসসের সঙ্গে এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রাণিসম্পদ সম্প্রদায়ের এই বর্ষীয়ান নেতা ‘বঙ্গ বাহাদুরের’ মৃত্যুতে ‘তার সমাজ ও সংস্কৃতি একজন প্রজ্ঞাবান পরিব্রাজক হারাল’ বলে মন্তব্য করেছেন। ইতিহাসের সূত্র টেনে সুন্দর মিয়া বলেন, ‘সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বনেদি সিল্ক রুট নামে খ্যাত পথেই বেড়াতে বেরিয়েছিলেন বঙ্গ বাহাদুর। তিনি লোকালয়ে বিশেষ করে কয়েক দিন আগে আসামে, লোকালয়ের রাজধানীতে, পাশের জেলার উৎসব সম্মেলনের প্রাক্কালে যে জঙ্গি আক্রমণ হয়, সম্ভবত তার উত্তেজনা প্রশমনে কিংবা কৌতুকপ্রদ আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দুর্গম পথ যাত্রা (রোড মার্চ) শুরু করেছিলেন’। সুন্দর মিয়া শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘বাবাহকু পর্ষদের প্রভাবশালী ঐরাবত গ্রুপের সম্মানীয় সদস্য ‘বঙ্গ বাহাদুর’ প্রজ্ঞাবান ও ইতিহাস সচেতন ছিলেন। ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাঙের একজন অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন তিনি। আসামের পাহাড় থেকে অসম্ভব পানি গড়িয়ে কিংবা ফারাক্কার পানি লোকালয়ের ভরাট হয়ে যাওয়া নদনদীগুলো উপচে ছাপিয়ে চারদিকে যে বন্যা ও বেদনার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তা দেখতে, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ এবং জামালপুরে পা রেখেছিলেন তিনি। একসময় মহামতি গৌতমবুদ্ধও এ লোকালয়ে এভাবে একাধিকবার পা রেখেছিলেন। এ ধরনের সংকটময় মুহূর্তে মহাত্মা গান্ধী ভারতবর্ষ চষে বেড়াতেন।
বঙ্গ বাহাদুর ক্ষুদ্রস্বার্থে কিংবা নিছক অভিমান করে বাড়ির বের হননি। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তার জন্ম, মন তার বিশাল। তিনি বাড়ির বের হয়েছিলেন সবার প্রতি সহমর্মিতা জানাতে। জেলায় জেলায় লোকালয়ে, গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর সময় কাউকে আঘাত করেননি অহিংস এই ঐরাবত। অথচ আসাম থেকে রীতিমতো সরকারি প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে। বঙ্গ বাহাদুর স্থানীয় জনগণের খাতির, যতœ ও আগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। তাকে বঙ্গ বাহাদুর উপাধি দেয়া হয়েছে তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। হাতি গর্তে পড়লে চামচিকায়ও তাকে লাথি মারে- এমন প্রবাদ তার মনোবল ভাঙাতে পারেনি। উদ্ধারকারী দল ব্যর্থ মনোরথ হয়ে দেশে ফিরে যায়। বঙ্গ বাহাদুরের বিশেষ আনন্দ ও তৃপ্তি এই যে এ দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাকে ব্যাপকভাবে সচিত্র (‘সরাসরি’ও) দেখানো হয়েছে। সুন্দর মিয়া বঙ্গ বাহাদুরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে কবিতার চরণ উচ্চারণে বলেন, ‘সঙ্গে করে তিনি এনেছিলেন যে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ, প্রচার মাধ্যমে তাকে করে গেলেন অকাতরে দান’। হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা- এ মহাজন বাক্য বিবেচনায় নিয়ে তার সমাধিস্থলে বিশেষ কমিউনিটি পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে এটা জেনে বিশেষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। স্থানীয় সালিশালয়ে বঙ্গ বাহাদুরের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান নিয়ে একটি রিট মোকদ্দমাও দাখিল হয়েছে এবং লোকালয়ের জাদুঘরে বঙ্গ বাহাদুরের কঙ্কাল রাখার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে জেনে বাবাহকু পর্ষদ আনন্দ প্রকাশ করে পরিস্থিতির প্রতি বিশেষ নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে চলমান সুন্দরবনের সার্বিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের প্রতিও বাবাহকু থেকে বিশেষ সমর্থন জানিয়ে পরিস্থিতি পরীবিক্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সমর্থনকারীদের সমালোচনার আড়ালে প্রকৃত বিষয়টির প্রকৃতত্ব যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে কড়া নজরদারির পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সুন্দর মিয়া বাবাহকু পর্ষদের উচ্চকক্ষ ‘বনে জঙ্গলের’ অধ্যক্ষ শিয়ালেন্দু মামাইয়াকে ‘বঙ্গ বাহাদুরের বিদায়’ এবং ‘সুন্দরবনের সার্বিক স্বার্থ’ সংক্রান্ত দুটি বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশেষ মুলতবি অধিবেশন ডাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। বাবাহকুর বিবৃতিতে লোকালয়ের প্রচার মাধ্যমের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে, তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে বিশেষ তদন্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রেস নোটে সে তদন্ত প্রতিবেদন যাতে যথাসময়ে প্রকাশ পায়,

তা নিশ্চিতকরণের অনুরোধ রাখা হয়েছে।
বাবাহকু সুচিন্তা একাডেমি থেকে বলা হয়েছে, লোকালয়ে আগের শতাব্দীতে বঙ্কিমবাবু নামে একজন ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। কপালকুণ্ডলার আঁকিয়ে ছিলেন। ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’- এই প্রশ্ন নিজের কাছে সে সময় সতত রাখবার সুযোগ পেয়েছিলেন। কখনো ভাবেননি তার ভাবীকালের ভাতিজারা ‘তুমি অধম তাই আমিও অধমের মতো আচরণে অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছি’ বলে বিবৃতি দিতেও বিব্রত বোধ করে না। বরং এরূপ বিবৃতি দিয়ে এ যেন ‘হাইব্রিড নেতা হিসেবে বাহবা লভিবে তুমি এই সোনার ভুবনে’। সিভিল সার্ভেন্ট এবং লেখক বঙ্কিমবাবু হয়তো ভাবেননি তার প্রোপৌত্ররা ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমনের’ প্যারোডি সাজিয়ে ‘যারা গিয়েছে গোল্লায়’ আমরা তাদের টেক্কা দিয়ে ‘দেখাইমু ওরে আঁরাও কম না’। ভাবখানা এই- খোকা বোতল ভেঙে বাহাদুরি দেখিয়েছে। সুতরাং বোতল ভাঙার গানকে জাতীয়করণ করো- খোকা অধিকতর উদ্যমে বোতল ভাঙতে উৎসাহী, উদ্বুদ্ধ হবে।
প্রায় শতবর্ষ পূর্বে রবি বাবু নামে মশহুর এক কবি ঠিকই ভেবেছিলেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তারা উভয়ে সম যাতনা সহ্য করবে।’ তার শতবর্ষ পরে বাবু মহাশয় বেঁচে থাকলে ঠিকই দেখতে পেতেন এখন দোষীকে দিগস্বর করা নয় বরং আঁচলের তলায় রেখে খাঁটি গরুর দুধ ও শুল্কমুক্ত দেশি কলা খাওয়ানো হচ্ছে। চৌর্যবৃত্তিতে পটুরা মাশতুতো বা খালাতো ভাই কিংবা ফার্স্ট কাজিনের মতো আত্মীয়তা পাতিয়ে ‘মুই এর বাড়ি বরিশাল তোমার বাড়ি ঘোড়াশাল আমাদের মধ্যে কত মিল’ জাতীয় হেঁয়ালি সংগীত লাফাইয়া দাপাইয়া ঘাটাইয়া মাঠাইয়া চলিতেছে। শুধু ভালোবাসাবিহীন ‘সত্য’ জানালা দিয়া নহে, ‘ভদ্রতা’ও বিনা টিকেটে পাসপোর্ট ভিসা, করোনার টিকা সনদ ছাড়াই নদী-সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে অমুক-তমুকের দেশে। মাথায় বিস্তর টাক লইয়া চুল সংরক্ষণের ফতোয়া দিয়ে চলছেন বাঁশের চেয়েও প্রলম্বিত ‘প্রতি’ভাবান রা। ‘উপ’দের উপদেশে আসলদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বর্ণচোরাদের বন্যায় ত্যাগী ও নিবেদিতরা হালে পানি পাচ্ছে না। পানি ও তৈল, দুধ ও ঘি এক দেহে লীন হয়ে একে অপরকে টেক্কা মেরে বহাল তবিয়তে থাকছে। থাকবার উপায়ের উপলক্ষের অভাব নেই, কাজীর খাতাতেও হিসাব অফিসের খাতায় হিসাব রাখিবার বালাই নাই একের মাশোহারা অন্যরা নিয়ে যাচ্ছে এবং দপ্তরবিহীনদের মিছিল লম্বা হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে অজানা বস্তায় কাঁঠাল গজাচ্ছে। বায়োস্কোপের মতো একটির পর একটি ঘটনা ও রটনা এসে চাল ডাল হচ্ছে, গাছ মাছ হচ্ছে, নদী খাল হচ্ছে, ভবন সদন হচ্ছে।
আসামের পাহাড়ি বন থেকে সেখানকার বাবাহকুর অন্যতম মিশনপ্রধান ঐতরিক ঐতরিয়া এক বিবৃতিতে বঙ্গ বাহাদুরের অনিসন্ধিৎসু মন ও সহমর্মিমতার দর্শনকে যুগ যুগ ধরে প্রাণীকুল মনে রাখবে বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতরিয়া বলেন, এটা কম কিসে যে প্রায় দুই মাস স্থানীয় মিডিয়ায় শিরোনামে এসেছিলেন তিনি। সেখানকার বন্যা আক্রান্ত মনুষ্যকুলের অভুক্ত থাকার খবরের চাইতে বঙ্গ বাহাদুরকে তৃপ্ত রাখার আয়োজন দেখে ঐতরিয়া যুগপৎভাবে বিস্মিত ও বেদনাবোধ প্রকাশ করেছেন। চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিব্রাজক শ্রেষ্ঠ এই মহান প্রাণীর জীবন সংহার ঘটানো হয়েছে কিনা, তা তদন্তের জোর দাবি জানিয়েছেন ঐতরিয়া। ঐতরিয়া তার বিবৃতির উপান্তে যখন ঠিক তখন একটা কবুতর তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে যায়, কাগজটিতে লোকালয়ের সামাজিক মাধ্যম থেকে ভেসে আসা একটি ইচড়ে পাকা প্রকৃতির ছড়া ছিল-
ব্যাংকের রিজার্ভ চাপা পড়েছে তনুর তলে,
তনু চাপা পড়েছে মিতুর তলে,
মিতু চাপা পড়েছে জঙ্গির তলে,
জঙ্গি চাপা পড়েছে পিস টিভির তলে,
পিস টিভি চাপা পড়েছে রামপালের তলে,
রামপাল চাপা পড়েছে বন্যার পানির তলে,
বন্যার পানি চাপা পড়েছে হাতির তলে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়