ইসলামী আন্দোলন : নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা

আগের সংবাদ

কুরবানির পশুর দাম বেশি যে কারণে > আফতাবনগর হাট : এখনো জমেনি হাট গরুও উঠেছে কম

পরের সংবাদ

বদলাচ্ছে লোকশিল্পের ধরন : ঐতিহ্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি উৎসব ও আনন্দপ্রিয় জাতি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা উপলক্ষে তারা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। সেসবের মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে আবির্ভূত হয় বাংলা নববর্ষ; যার স্বাদ, গন্ধ ও আবেদন অন্যান্য উৎসব হতে একেবারেই আলাদা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ, সব বাঙালি সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমগ্র জাতি একই হৃদয়াবেগে একটি মোহনায় মিলিত হয়ে পালন করে এই সর্বজনীন উৎসব। চিরায়ত বাঙালিত্বের অহংকার আর সংস্কৃতির উদার আহ্বানে জাগরূক হয়ে নাচে-গানে, গল্পে-আড্ডায়, আহারে-বিহারে চলে নতুন বছরকে বরণ করার পালা। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালিদের জীবনে সবচেয়ে বড় সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এর মাধ্যমে জাতি তার স্বকীয়তা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার শক্তি সঞ্চয় করে; সচেষ্ট হয় আত্মপরিচয় ও শিকড়ের সন্ধানে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য হলো বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। আর বাঙালিদের কাছে বাংলা নববর্ষ বরণ হলো একটি প্রাণের উৎসব। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। এরূপ নববর্ষই বাঙালি জাতিকে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে আবদ্ধ করেছিল, শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করে স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে শত বছর ধরে অনেক ঐতিহ্যের অনেক গৌরবময় ইতিহাসের ধারক হয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘জব্বারের বলী খেলা’। মূলত চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির মাঠে এ অঞ্চলের বিভিন্ন কুস্তিগীর মানে বলীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই চমৎকার স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজনের প্রতিযোগিতাটি আজো বিভিন্ন বয়সি দর্শকদের কাছে দারুণ আগ্রহের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ উৎসবমুখর পরিবেশে এই কুস্তি খেলা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, যা সবার কাছে জব্বারের বলী খেলা হিসেবে পরিচিত এবং ভীষণ জনপ্রিয়।
বাঙালি নারীর প্রধান পোশাক হলো শাড়ি। শাড়ি ছাড়া তাদের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে না যেন। যে কোনো উৎসবে-পার্বণে নারীর প্রথম পছন্দ হলো শাড়ি। শাড়ির আবার আছে অনেক ধরন। তার মধ্যে অন্যতম হলো জামদানি। এই শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। জামদানি শাড়ি তুলা দিয়ে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের শাড়ি। মসলিনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় শাড়ি জামদানি। জামদানি শাড়ির বয়নে ৭০ থেকে ৮০ কাউন্টের তুলা ব্যবহার করা হয়। বাঙালি নারীদের কাছে প্রাচীনকালের মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয় জামদানি শাড়ি। জামদানি শাড়ির নামকরণ নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, জামদানি শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি ভাষায় জামা অর্থ কাপড় আর দানা অর্থ বুটি। একসঙ্গে যার অর্থ বুটিদার কাপড়। জামদানি শাড়িতে অসংখ্য বুটি দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ফারসি জাম অর্থ মদ আর দানি অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনে মসলিন কাপড় থাকার কারণে এই ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। নকশা ভেদে জামদানির বিভিন্ন নাম রয়েছে। তেরছা, জলপাড়, পান্না হাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলা ফুল, আঙ্গুরলতা, ময়ূরপ্যাঁচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুটিদার, ঝালর, ময়ূরপাখা, পুইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, প্রজাপতি, জুঁইবুটি, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুলসহ আরো অনেক। মসলিনের হাত ধরে জামদানির বেড়ে ওঠা। বাংলার মধ্যযুগে মসলিন ছিল সবচেয়ে মূল্যবান কাপড়। পরবর্তীতে বাংলায় মসলিন কাপড় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও জামদানির পথচলা শুরু হয়। জনশ্রæতি রয়েছে, মসলিন কাপড় নিজ দেশে আমদানির পর যাতে ভারতে আর মসলিন কাপড়ের কোনো কারখানা গড়ে না ওঠে সেই কারণে ব্রিটিশরা কাপড়টির উৎপাদনকারীদের আঙুল কেটে দেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মসলিন কাপড়ের দাম ছিল ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলায় ভালো মানের মসলিনের দাম ছিল ৪৫০ টাকা। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়িসহ অন্যান্য অঞ্চল মসলিন কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে মসলিন কাপড় বিলুপ্তির পথ ধরে বাংলায় জামদানি কাপড় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। আজকাল বাজারে যত নামের শাড়ি পাওয়া যায়, তা আসলে শাড়িগুলোর ‘ব্র্যান্ড নেম’ মাত্র। আমরা জামদানি, বেনারসি, কাতান ইত্যাদি নামেই ডাকি বা চিনি। অথচ আমাদের লোকসাহিত্যে পাওয়া হরেক শাড়ির বাহারি নাম প্রমাণ দেয় যে, আমাদের শাড়ি আমাদের প্রাচীন তাঁতশিল্পীদের মায়ায় তৈরি হতো। কবি জসীমউদ্দীন তার ‘পূর্ববঙ্গের নক্সীকাঁথা ও শাড়ী’ প্রবন্ধে তার সংগৃহীত কিছু শাড়ির নাম তুলে ধরেছেন- কালপিন, বাঙ্গনীগরদ, জলেভাসা, একপাছুন্না, কাচপাইড়, জামদানি, জামের শাড়ি, রাসমণ্ডল, সোনাঝুরি, কুসুমফুল, বাঁশিপাইড়, ল²ীবিলাস, কৃষ্ণনীলাম্বরী, মধুমালা, কুনারি, কলমিতলা… আরো কত মন দোলানো নামের শাড়ি! একেক শাড়ির একেক রূপ।
নকশিকাঁথা হলো সাধারণ কাঁথার ওপর নানা ধরনের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথা। নকশিকাঁথা শত শত বছরের পুরনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা অংশ। নকশিকাঁথা ভারত ও বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণত পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতিদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের আঙুলের সঙ্গে কাপড়ের পাড় আটকিয়ে সুতা খোলা হয়। এই সুতা পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য রেখে দেয়া হয়। সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের পর এর ওপর মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন নকশা, যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি। পুরো বাংলাদেশেই নকশিকাঁথা তৈরি হয়, তবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর ও যশোর নকশিকাঁথার জন্য বিখ্যাত। ২০০৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নকশিকাঁথার ভৌগোলিক স্বীকৃতি পায়। কাঁথা শব্দটির কোনো উৎস স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। সঠিকভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় কাঁথা শব্দটি পূর্বে উচ্চারিত হতো ‘খেতা’ বলে। বাংলায় ধানের ক্ষেতকে অনেক সময় ‘খেত’ বলা হয়। নিয়াজ জামানের মতে, কাঁথা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃতি শব্দ ‘কঁথা’ হতে। ‘কঁথা’ শব্দটির বাংলা হলো ত্যানা। বা কাপড়ের টুকরা। অন্যান্য লোকশিল্পের মতো কাঁথার ওপর দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস, আবহাওয়া, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। সম্ভবত প্রথমদিকে কাঁথা ছিল জোড়াতালি দেয়া কাপড়। পরবর্তীতে এটি থেকেই নকশিকাঁথার আবির্ভাব। পাঁচশ বছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত বইয়ে কাঁথার কথা সবার প্রথম পাওয়া যায়। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ নকশিকাঁথার মাঠ। গ্রামাঞ্চলের নারীরা পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরনো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করে থাকেন। কাঁথা মিতব্যয়ীতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, এখানে একাধিক পুরনো জিনিস একত্রিত করে নতুন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। স্বতন্ত্র থাকার বৈশিষ্ট্য হারিয়েও আরেক রকমভাবে টিকে আছে এই নকশিকাঁথা। তবে বিলুপ্তির পথে রঙিন শিকা। যাকে অঞ্চলভেদে বলে ছিক্কা, ছিক্যা ইত্যাদি। গৃহস্থবাড়ির হেঁশেলসহ বিভিন্ন ঘরের দরজা দিয়ে দেখা যেত, বাতাসে দুলছে পাটের দড়ির এক নান্দনিক শিল্প। ওর ভেতর বসানো পাত্রে আছে লোভনীয় কোনো খাবার। কখনো কখনো সেই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পরাজিত হয়েছে বাড়ির দস্যিদের হাতে। চোখের আড়ালে তারা শিকার ভেতরের পাত্র থেকে ঠিকই বের করে নিয়েছে তুলে রাখা আচার বা মিষ্টি। দোষ হয়েছে সাদা বিড়ালের। বেণির মতো করে নারী বেঁধেছে শিকার দড়ি। গিরা, জালি, লহরির মতো বিভিন্ন নামের পাটে তৈরি শিকায় রং, পুঁতি, কড়ি বসে হয়েছে আরো সুন্দর। প্রয়োজনের সঙ্গে লোকশিল্পে নান্দনিকতা যুক্ত হওয়ার ধাপটি পরবর্তী পর্বের। কিন্তু সহজেই বিকল্প পাওয়া গেছে বলে সেই শিকা আর এখন ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। তেমনি স্মৃতির অ্যালবামে চলে যাওয়া আরেকটি নাম ‘চাঁদোয়া’। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ রাজা দেশ-বিদেশ বেড়াতে বের হয়েছিল সোনার চাঁদোয়া টাঙিয়ে। ফসলের গন্ধমাখা গ্রামের নারীর কাছে পরনের আটপৌরে শাড়ির সোনালি পাড়ই ছিল সেই সোনার চাঁদোয়া তৈরির উপকরণ। নান্দনিক সজ্জা ছাড়াও সংসারের দুর্বলতা ঢাকতে প্রয়োজন হতো এর। ঘরের ভাঙা বেড়া, মাথার ওপরের ঘুণে ধরা বাঁশের আড়া ঢাকতে টাঙিয়ে দেয়া হতো একটি চাঁদোয়া। বিয়ের আসরে বর-কনের মাথার ওপর চাঁদোয়া ধরলে তাদের আরো সুন্দর দেখাত। যে নারীর সংগ্রহে যত বেশি নকশা করা শাড়ির পাড়, তার শিল্পটি হবে তত বেশি সুন্দর। বাংলার লোকশিল্পের এ ঐতিহ্য হারিয়েছে ডেকোরেটরের শামিয়ানার কাছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার কাছে এখন আবার মুখে চুনকালি লাগছে সাদা, লাল, সবুজ ডোরা দাগের সেই শামিয়ানারও। এই বদলের ভেতর কখন যেন নিখোঁজ হয়েছে কাঠের বাক্সে শাড়ির পাড় জমানোর শখটুকুও। তবে নকশিকাঁথার মতো পরিবর্তনে মানিয়ে নিয়ে নামকাওয়াস্তে আছে শীতলপাটি। এই থাকা যে কতটা করুণ, তা বোঝা যায় মৌলভীবাজার গেলে। শীতলপাটির দুঃসময় চলছে। রাজনগর, বালাগঞ্জে পাটিয়ারা সম্প্রদায়ে শতাধিক কারিগর ছিল তিন দশক আগেও। এখন দু-একজন টিকে আছে। সামনে শুধু জাদুঘরে থাকবে শীতলপাটি। গ্রীষ্মকালে বিছানা, বড় চৌকি বা জায়নামাজ হিসেবে শীতলপাটির ব্যবহার ছিল আভিজাত্যের চিহ্ন। মোগল আমলে দিল্লির দরবারে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছিল সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি। সিলেট অঞ্চল ক্ষেত্রসমীক্ষা বিষয়ক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এক জার্নালে পাওয়া যায় পাটি নিয়ে সাহিত্যের নমুনা। এরই একটি ‘ধন আছে জন আছে, আছে নদী-মাটি/ অরিন (হরিণ) আছে, ফাখি আছে, আছে হীতলফাটি।’ সম্পদ, মানুষ, প্রকৃতির ওপর দখলের সঙ্গে শীতলপাটি থাকাটাও যে গৌরবের ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিকি, আধুলি, নয়নতারা, আসমান এমন সব নামের সেই শীতলপাটি এখন শুধু শৌখিন পণ্য। এখন পাটির বায়না আসে ওয়ালমেট, টেবিল রানার হিসেবে। খাটে বা বসার ঘরে পাতার জন্য মানুষ কেনে না। প্লাস্টিকের পাটির কাছে হার মেনেছে এই লোকশিল্প। লোকজ সংস্কৃতির মূল চরিত্রই হচ্ছে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে অগ্রসর হবে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অনেক কিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন হচ্ছি আমরা। অনেকখানি দায় বিদেশি সংস্কৃতিতে নির্ভরশীল হওয়ার মানসিকতা।
‘কড়–ই ফুলের ঝুমকা ফুলে গেঁথে গলার হার, কী দিয়ে সাজাব সীতারে জানি না লো আর।’ গীত শুরু হলেই কোথা থেকে জমাটবদ্ধ হয়ে আসে সব বিষাদ। কী দিয়ে সাজানোর এই আকুতির ভেতর বিষাদ ঝরে পড়ছে অথচ এটি কনে সাজানোর গীত। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানের নানা পর্বে গীত গাওয়া হতো। বিয়ের সব পর্বের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গান গাওয়া হতো। তবে সুরগুলো ঘুরেফিরে প্রায় একই রকম। এসব গান মুখে মুখে তৈরি, মুখেই সুর। নারীরাই গাইত দল বেঁধে। প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে এখনো কিছু কিছু বিয়েতে গীতের আয়োজন থাকে, তবে অনুষ্ঠানের বাধ্যতামূলক অংশ হিসেবে আর নেই এই বিয়ের গীত। বিশেষ উৎসব-পার্বণে সংগীতের ব্যবহার হচ্ছে নিজেকে প্রকাশের জন্য মানুষের দ্বিতীয় শক্তিশালী ভাষা। আবহমান বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিয়ের গীত লোকজ সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু এখন আর কোথাও বিয়ের গীত গাওয়ার প্রয়োজন হয় না। হিন্দি গানের সুর শব্দের বাক্স দিয়ে ছড়িয়ে যায় গোটা এলাকায়। সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করা গানটির সঙ্গে আদতে সম্পর্ক নেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির। নগর থেকে গ্রামে গেলে আমাদের মতো সংযোগ পরের প্রজন্ম অনুভব করতে পারে না। অথচ সংস্কৃতির পরম্পরা ছাড়া ঐতিহ্য টেকে না। এই ব্যবধানে হারিয়েছে অনেক শিল্প। ঘাটু গানের কথা বলা যায়। বাংলাদেশে এখন আর এ গান কোথাও শুনতে পাওয়া যায় না। মেয়েলি গীতের মধ্যে বিয়ের গীত ছাড়াও একসময় শোনা যেত ছাদ পেটানো বা ধান ভানার গান। হারিয়েছে আশ্বিনের গাস্বি উৎসব বা ডেকে বৃষ্টি নামানোর লোকজ সংস্কৃতি। দীর্ঘদিনের খরা কাটাতে বৃষ্টি নামানোর গান গাইত কিশোর-কিশোরীরা। মাথার কুলা নিয়ে মেয়েরা যেত বাড়ি বাড়ি। সব গৃহস্থের কাছ থেকে চেয়ে নিত একমুঠো চাল। গ্রাম ঘুরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মাটিতে পানি ঢেলে কাদা বানিয়ে দেয়া হতো ব্যাঙের বিয়ে। এরপর নেচে-নেচে গাওয়া হতো ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে মালিক’-এর মতো বৃষ্টি আনার গান। এই আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বিশ্বাস, লোকায়ত আচার-সংস্কৃতি। একসময় এ অঞ্চলে সমৃদ্ধ ছিল কুশান গানের আসর। এখন কৃপাসিন্ধু রায়ের একটি মাত্র দল টিকে আছে উত্তরবঙ্গে। তবে এ সংকট যেমন বিশ্বায়নের ফলে তৈরি হয়েছে, তেমনি নিজের ঐতিহ্য সম্পর্কে অনাগ্রহও বড় কারণ। বিয়ের গীত, বৃষ্টি ডাকার আয়োজন, ছাদ পেটানো গান শিষ্টজনের জীবনে স্থান নিতে পারেনি বলে হারিয়েছে। তবে শিষ্টজনরাও কি কখনো ভালোবেসে শুনেছেন এর সুরের ভেতর তার হৃদয়ের সংযোগ আছে! সংযোগ থাকলেও যে লোকশিল্প বা লোকসংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে, তা নিশ্চিত বলা যায় না।
বিত্তবান গৃহস্থবাড়িতে দাপটে থাকা কাঁসা-পিতলের ব্যবহারও হারিয়েছে সময়ে। বিয়ের আয়োজনে উপহারের টেবিলে দেখা যেত কাগজের মালা গলায় ঝোলানো কাঁসার কলসি। পেটমোটা গøাসটার ঠিক মাঝখানে খোদাই করে নাম লেখাতে অবশ্য খানিকটা পয়সা খরচ হতো ক্রেতার। বিত্তবানদের ঘরে কাঁসার থালাবাসন ব্যবহারের চল ফুরিয়েছে। কাচ বসানো কেতাদুরস্ত খাবার টেবিলের জন্য ওই ভারী বস্তুটি হয়ে উঠেছে অনিরাপদ। বরং কাঁসা বা পিতলের শোপিস এখন স্মারকের সামাজিক মর্যাদা পেয়েছে বেশি। ফলে কাঁসা-পিতলের থালাবাসন ব্যবহার কমার সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে এই পেশানির্ভর মানুষের জীবিকা। সেই কারিগরদের হাতে এখন আর উঠে আসে না লতানো সূ² নকশা। জীবিকার অনিশ্চয়তায় তারা বদলেছেন পেশা। এমন করে হারিয়েছে নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি তরল খাদ্য রান্নার ‘ওড়নি’ বা দুই পাথর খণ্ডের মধ্যে পিষে ডাল, ছাতু চূর্ণ করার ‘জাঁতা’ নামের যন্ত্রটি। ঢেঁকির প্রয়োজন মেটাতে পারে ধান ভাঙানোর কলগুলো। ব্লেন্ডার নামক বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি চটপট করে দিতে পারে অনেক কাজ। লোকশিল্পের উপাদান হারালে পেশা বদলের সঙ্গে হারিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো। সেই ভাষা থেকে কখন যেন বাদ হয়ে যায় একসময়ের রোজ শোনা কিছু ধ্বনি। ছিলকে তোলা বা কানি করা শব্দগুলো নিখোঁজ হয়েছে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে। কোনো জাতিসত্তার ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করতে হলে তার সংস্কৃতি সংরক্ষণের বিকল্প নেই। কিন্তু সংরক্ষণের প্রতিশ্রæতি, প্রণোদনার আশ্বাস বহুকালের পুরনো। এর আগে আলোচনা প্রয়োজন, শ্রæতিনন্দন লোকসাহিত্য আর দৃষ্টিনন্দন লোকশিল্পকে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। দ্রুত বিশ্বায়নের এই সময়েও দু-একজন ধনুর্ভঙ্গ পণ করা কারিগর আছেন। তারা মোর্তা কেটে নকশা করেন পাটির। কিন্তু সে কাজ এতটাই মূল্যহীন যে তাদের চোখের পানি মিশে যায় মনু বা খোয়াই নদের ক্ষীণ স্রোতে। আর সন্তানের জন্য ফুল বা পালতোলা নৌকার নকশা সেলাই করা নারী তো চলেই গেছেন সেই কবে।
চট্টগ্রামের কোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি অভিজাত কোনো বিয়ে কিংবা পার্টিতে যাবেন, না কি একই সময়ে অনুষ্ঠিত একটি মেজবানে যাবেন?’ নিশ্চিতভাবে তিনি মেজবানকেই বেছে নেবেন। সময়ের বিবর্তনে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘মেজবান’ এতটাই আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে মেজবানের সামনে অন্যসব খাবার-আয়োজন যেন তুচ্ছ! বলা চলে, চট্টগ্রামের মানুষকে মেজবান যতটা কাছে টানে তার সিকিভাগও টানতে পারে না ২০ পদ মেন্যুর অন্য কোনো খাবার-আয়োজন। মেজবানের প্রতি কেন এই আকর্ষণ, কী আছে মেজবানে, মেজবানটাই বা আসলে কী? এর ব্যাখ্যা হতে পারে এ রকম- পেটভর্তি গো-মাংস খাওয়ার অনন্য উৎসবের নামই ‘মেজবান’। মেজবানের আরেক নাম হতে পারে ‘ইচ্ছামতো খাওয়া’। যেখানে থাকে মাংসের আধিক্য। মূলত গরুর মাংসের উদার ও আয়েশি পরিবেশন হয় মেজবানে। এটাই মূলত চট্টগ্রামের ‘মেজবান’। আরো খোলাসা করে যদি বলতে হয়, একটি নির্দিষ্ট পন্থায় গণভোজের আয়োজনের নামই হচ্ছে ‘মেজবান’। ঠিক কখন থেকে মেজবান-সংস্কৃতির সঙ্গে চট্টগ্রামবাসীর সখ্য তার সুস্পষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, ১৬০০ থেকে ১৮০০ সালের যে কোনো সময় থেকে চট্টগ্রামের মানুষের মেজবান-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত। ‘মেজবান’ শব্দটি ইরানি। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। এর বিপরীত শব্দ ‘মেহমান’। খুব সম্ভবত বাংলাদেশে ইরানি শাহ বংশীয় শাসনামলে এর প্রচলন আরম্ভ হয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একে ‘মেজ্জান’ বলে। ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের নগরী চট্টগ্রাম। পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে নানা উৎসব আয়োজনে বহু পুরনো কোনো শিল্পধারা, খাদ্যাভ্যাস বা পরিধেয় বস্ত্রের বুননরীতি বিধৃত না হলেও সাম্প্রতিক ঐতিহ্যে সফল উপস্থাপনশৈলী এই অঞ্চলের প্রতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চা এই অঞ্চলকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য। যে কয়টি বিষয় চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে ‘মেজবান’ তার মধ্যে অন্যতম। রন্ধনপ্রণালির বৈচিত্র্য ও পরিবেশনের অকৃপণতা মেজবানকে অতুলনীয় করে তুলেছে।
সংস্কৃতি হলো আত্মা বা মনের কর্ষণ। বিভিন্ন সমাজের প্রাপ্ত সামাজিক আচরণ ও নিয়মকানুনের সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ। কোনো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ হয় তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হচ্ছে টিকে থাকার কৌশল। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয়ের নামই সংস্কৃতি। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যার জীবন, সংগ্রাম ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিক সিরিল ডান যথার্থই বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তার দীর্ঘ শালপ্রাংশু দেহ, বজ্রকণ্ঠ, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার বাগ্মিতা এবং জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাকে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস দিয়েছিলেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? সংস্কৃতি মানেই তো অগ্রসর চিন্তা। সংস্কৃতি মানেই তো প্রবহমান নাব্য নদী; নদী তার প্রবহমানতা হারালে যেমন অনাব্য হয়ে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়, নদীজল মজে-পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়; সংস্কৃতি হারালে মানুষও মজানদী হয়ে পড়ে; মানুষের সংস্কৃতিমান থাকতে তার মুক্তির প্রয়োজন অনিবার্য, এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; বঙ্গবন্ধুই আমাদের শিখিয়েছিলেন ‘স্বাধীনতা’ আর ‘মুক্তি’ শব্দ দুটির পার্থক্য। বাঙালির জীবনে অর্থবহ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে খুবই প্রিয় মিষ্টি নাম ছিল বাংলা। তিনি জানতেন, হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঘিরে মধুমাখা বাংলা শব্দটি আপামর বাঙালি জনগণের কাছে কতখানি আবেদনময়। এ সংস্কৃতি তাকে জুগিয়েছে সংগ্রামের প্রেরণা। রাজনীতির ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেও দেশজ সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেন তিনি। সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে কী করা যায়, তা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যেতেন। খ্যাতি ও ঐতিহ্যের অনেক বিষয় অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে খ্যাতি হারাক সেটা কারো কাম্য নয়। বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়