প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের আন্দোলন দুদিন স্থগিত : প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার আশ্বাস বিএসএমএমইউ উপাচার্যের

আগের সংবাদ

আনন্দে পাঠ উৎসবে মূল্যায়ন : ষষ্ঠ ও সপ্তমে চলছে ‘ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন উৎসব’, ঈদুল আজহার পর মূল্যায়নের বিশ্লেষণ

পরের সংবাদ

দীঘির শহরে এখন দীঘি মেলা ভার

প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এম ফিরোজ মিয়া, কুমিল্লা থেকে : দীঘির শহর কুমিল্লায় এখন দীঘি খুঁজে পাওয়া কঠিন। ধর্মসাগর, নানুয়া দীঘি, রানীর দীঘি ও উজির দীঘিসহ হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি দীঘির অস্তিত্ব থাকলেও উজির দীঘি এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। গত বছর এ দীঘিটিও ভরাটের কাজ শুরু হয়েছিল। লেখালেখির কারণে তা স্থগিত রয়েছে।
কুমিল্লা জেলার ইতিহাস ও বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীতে এক সময় এক হাজারের অধিক দীঘি ও পুকুর ছিল। অনেকের মতে এ সংখ্যা ৮৫৩ বলেও জানা যায়। সেইসঙ্গে ছিল অসংখ্য নিজস্ব ব্যাংক। আর তাই কুমিল্লাকে ব্যাংক ও ট্যাংকের নগরী বলা হতো। সংখ্যাটি ৮৫৩ ধরা হলেও ওই পুকুর ও দীঘির অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দীঘি ও পুকুরগুলোর উপর এখন ১২/১৪ তলা বিলাসবহুল ভবন। দেখে কেউ ভাববেই না মাত্র কয়েক বছর আগেও এখানে দীঘি বা পুকুর ছিল।
বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীর ফরিদা বিদ্যায়তনের দক্ষিণ পাশে জনাদের পুকুর, ঈশ্বর পাঠশালার ভেতরের পুকুর, ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ের খান ভিলার পুকুর, ঝাউতলা এলাকার চেয়ারম্যান গলিতে হাফিজ স্যারের পুকুর, জেলা রেজিস্ট্রার দপ্তরের উত্তর পাশে পুকুর ছিল। আরো ছিল ঠাকুর পাড়ার মাস্টার বাড়ির পুকুর, লাকি হাউসের পুকুর, কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার পাশের দুটি পুকুর, ঠাকুরপাড়া পাল বাড়ির পুকুর। ডিগাম্বরীতলার অমূল্য পুকুর, চর্থার হোচ্ছামিয়া স্কুলের পুকুর, তেলিয়া পুকুরও ভরাট হয়ে গেছে সেই কবেই। ভরাট হয়ে গেছে, ঝাউতলা খান সাহেবের ২২ গন্ডা পুকুর। ঝাউতলা খ্রিস্টান পাড়ার পুকুর, প্রফেসরপাড়ার চার পুকুরের একটিও নেই। সব ভরাট হয়ে গেছে। নগরীর পানপট্রি সড়কের দত্ত পুকুর, ছাতিপট্টি পুকুর, থানার পেছনের দুটি পুকুর ভরাট করে ভবন হয়েছে। কালিয়াজুরি এলাকার শান্তি পুকুরেরও অস্তিত্ব নেই। সংরাইশ এলাকার কালিমন্দির পুকুরসহ তিনটি পুকুর ভরাট হয়েছে। মধ্যপাড়ার পুকুর ভরাটের প্রস্তুতি চলছে। ছোটরা জেলখানা এলাকার পাক্কি পুকুর, মানিক মিয়া কমিউনিটি সেন্টার একটি পুকুরের উপরে স্থাপিত। ঠাকুরপাড়া এলাকার মেট্রো বেকারির পাশের পুকুরও নেই। বিসিকে আটটি পুকুর ছিল, তার একটিও নেই।
নগরীর ঝাউতলায় বেশ কয়েকটি পুকুর থাকলেও এখন হাত ধোয়ার মতো একটি পুকুরও নেই এ এলাকায়। কুমিল্লা ভাষাসৈনিক অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের সুপারিবাগানে দুটি পুকুর, কেডি রায়ের পুকুর, ডিগাম্বরীতলার ধুমকলির পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ঠাকুরপাড়ার মদিনা মসজিদ পুকুরও ভরাট হয়ে গেছে। হাউজিং এস্টেট আদমদীঘিও হুমকির মুখে। ঠাকুরপাড়ার জোড় পুকুরও ভরাট হয়ে গেছে, বাদুরতলা চৌধুরী পুকুর, মোগলটুলির লালা পুকুর নগরীর ছোটরা জংলি বিবির পুকুরও ভরাটের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। পাথুরিয়া পাড়া লস্কর পুকুরও ভরাট করে বাড়িঘর করা হয়েছে। নগরীর বাগিচাগাঁও বড় মসজিদ পুকুরও অর্ধেক ভরাট হয়ে গেছে। জামতলার শিবার পুকুর, গর্জনখোলা পূর্ব পাড়ার পুকুর, কাপড়িয়াপট্টি বনবিহারী বাড়ির পেছনের পুকুর, নাদিপা হাউজিং পুকুর, চকবাজার বাসস্ট্যান্ডের পুকুর, চাঁনকালিবাড়ি পুকুর, ডিগাম্বরীতলা বিহারী পুকুর ভরাট হয়ে গেছে।
নগরীর জিনার পুকুর, কোরবান আলী সর্দার পুকুর, মুরগি বেপারির পুকুর, ঠাকুরপাড়া হেকিম সাহেবের পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। আনন্দ চন্দ্র রায়ের আনন্দ সাগর পাকিস্তান আমলের শুরুতেই ভরাট হয়ে গেছে। হযরত পাড়ার ধোপা পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে বৈদ্য পুকুর ভরাট করা হয়। রায়বাড়ির পুকুর, নগর উদ্যানের ব্যাঙ সাগর, ঠাকুরপাড়ার সারদা পাল মাঠের পুকুর, নগরীর শাসনগাছা ডাকবাংলো পুকুর, চকবাজার বাসটার্মিনাল পুকুর, ডিগাম্বরীতলার আজিজ মজুমদারের পুকুর, অমূল্য পুকুর, ঝাউতলার খ্রিস্টান পুকুর, নজরুল এভিনিউ এলাকার ইন্দ্রকুমার সেনের পুকুর, ঠাকুরপাড়ার আমজাদ ভিলার সামনের পুকুর, কামিনীচন্দের পারিবারিক পুকুর, রামমালা সড়কের পশ্চিম পাশের পুকুর, নিরোদা সুন্দরী স্কুলের সামনের পুকুর, মনোহরপুরের ক্ষিতীশ দত্তের পুকুর, ভিক্টোরিয়া কলেজের ব্যাঙ পুকুর, অমূল্য দীঘি, মনোহরপুর লাকসাম রোডের কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার দীঘি, চর্থা ড্রাইভার সমিতির পুকুর, উত্তর চর্থার নূর বাড়ির পুকুর, মুরাদপুর জানু মিয়া মসজিদের পেছনের বিশাল জলাধার ও অহিদুন্নেছা প্রাইমারি স্কুলের দক্ষিণ পাশের পুকুর, সংরাইশ সাহাপাড়া সর্দার বাড়ির দীঘি, সংরাইশের চম্পা বেগমের পুকুর, সুজানগর খানেকা পুকুর, দক্ষিণ চর্থা হাজী মাসুকের বাড়ির সামনের পুকুর, গর্জখোলার পূর্বপাড়ার পুকুর, হযরতপাড়ার ধোপা পুকুর, দ্বিতীয় মুরাদপুরের হাতির পুকুর, পাথুরিয়াপাড়ার লস্কর দীঘি, ছাতিপট্টির বাঙ্গরা বাড়ির পুকুর, কাপ্তানবাজার এলাকার কার্জন কুটির পুকুর, দারোগাবাড়িতে বড় আন্দরের পুকুর, হোসেন আলী মোক্তারের পুকুর সবশেষ গত কয়েক বছরে। এছাড়া আরো অসংখ্য দীঘি ও পুকুর ভরাট করে প্লট বরাদ্দ এবং ফ্ল্যাটবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
এক সময় কুমিল্লার ঐতিহ্য ছিল প্রতিটি বাড়িতে ব্যক্তিগত পুকুর। ছিল সরকারি পুকুর ও দীঘিও। নগরীর পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা এসব পুকুর থেকে অতীতে মানুষ খাবারের পানির সংস্থান করতেন। সেইসঙ্গে সারতেন পানির নানা প্রয়োজনীয় কাজ। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থা বের হওয়ায় এবং আবাসনকে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে পুকুরগুলো ভরাট করে বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে।
জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী, জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ভরাট হয়েছে সবগুলো পুকুর ও দীঘি। এখন নগরীর ডুমুরিয়া চাঁনপুর এলাকায় বড়মাঠ নামে পরিচিত বিশাল ফসলি মাঠ ভরাট করে আবাসন তৈরির কাজ চলছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনের নীরবতায় কুমিল্লা নগরীতে গত ত্রিশ বছরে শতাধিক পুকুর-দীঘি ও জলাধার ভরাটের ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে কুমিল্লার পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকাকে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন। সিন্ডিকেট করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় দীঘি, পুকুর, জলাধার ভরাটের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবিদরা মনে করছেন নগরীতে বর্তমানে যেসব পুকুর দীঘি রয়েছে তা সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে পুকুর-দীঘি খননের উদ্যোগ ভবিষ্যতে বিপর্যয়মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
ক্রমাগত দীঘি-পুকুর ভরাটের কারণে নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটানোর আধারগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নগরীতে পানিবদ্ধতা ও বিভিন্ন এলাকায় পানির নিত্য ব্যবহারে সংকট দেখা দিয়েছে। পুকুর-দীঘি জলাধারের অভাবে আগুন নেভাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটকে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী নগরীর দক্ষিণাংশের বাইরে দেড়শত পুকুর-দীঘি ছিল। এগুলোর অর্ধেকের বেশিরই অস্তিত্ব এখন নেই। ভূমি সিন্ডিকেটের নজর পড়ায় এগুলোতে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল ভবন।
কুমিল্লা নগরীতে বেশকটি পুকুর-দীঘি ভরাটের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করলেও ফলাফল শুভঙ্করের ফাঁকি। আসলে সরিষায় ভূত থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজ। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ত্রিশ বছরে নগরীর আশি ভাগ পুকুর-দীঘি জলাধার ভরাট হয়েছে রাজনৈতিক প্রভারের ওপর ভর করে। যেখানে ভরাট বন্ধে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বা নীরব ভূমিকা পালন করেছে। আর সেই অবস্থায় অসহায় ছিল পরিবেশ রক্ষার নামে কাজ করা সংগঠনগুলো।
কুমিল্লার পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদের কাছে আমরা কঠোর পদক্ষেপ সবসময় প্রত্যাশা করি। কিন্তু গত কয়েক বছরে নগরীতে যেই হারে পুকুর-দীঘি ভরাট হয়েছে সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ রাজনৈতিক প্রভারের কাছে সবাই ছিল অসহায়। বর্তমানে যেসব দীঘি-পুকুর ও জলাধার বিদ্যমান আছে তা সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনে নতুন করে পুকুর-দীঘি খননের উদ্যোগ নেয়া হলে ভবিষ্যতে কুমিল্লার মানুষ বিপর্যয়মুক্ত জীবন অতিবাহিত করতে পারবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ২২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিব এস এ সামাদ স্বাক্ষরিত এক স্মারকপত্রের মাধ্যমে বলা হয়, ‘কোনো অবস্থাতেই খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে খাল-বিল, পুকুর, নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয় বা জলাধার বন্ধ করা যাবে না।’ কিন্তু আইন অমান্য করে নগরীর এসব দীঘি ও পুকুর ভরাট করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়