হাসপাতালে খালেদা জিয়া

আগের সংবাদ

অপরাধের স্বর্গরাজ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প

পরের সংবাদ

সিলেটের চা বাগানগুলোতে নেই সরকারি প্রাইমারি স্কুল : স্যানিটেশন ও পানির সমস্যাও প্রকট

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

খালেদ আহমদ, সিলেট থেকে : ছোট্ট সবুজ পাহাড়, নদী-নালা, খাল-বিল প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেট। এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক ও পর্যটক ভিন্ন ভিন্ন নামে একে সম্বোধন করেছেন। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশও সিলেট। এর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক চা বাগান। কয়েক লাখ একর জায়গার এসব চা বাগানে দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ চা উৎপন্ন হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে তা রপ্তানি হয়, আয় হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
তথ্যমতে, শুধু সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে ২৩টি চা বাগান। এসব বাগানে বাস করেন শত শত চা শ্রমিক। কিন্তু তাদের জন্য নেই শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা। নেই চিকিৎসা সেবা। স্যানিটেশন আর পানির সমস্যা তো প্রকট। জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মোমিনছড়া বাগানে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একই উপজেলার মনিপুর চা বাগানে একটি এমপিওভুক্ত প্রাইমারি স্কুল ছাড়া আর কোথাও নেই সরকারি প্রাইমারি স্কুল। কোনো কোনো এলাকায় ৭/৮ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে চা শ্রমিকের শিশুদের যেতে হয় বিদ্যালয়ে।
সিলেট সদর উপজেলার আলী বাহার চা বাগান এলাকায় একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ছাড়া আর কোথাও নেই স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। অসুস্থ হলে জেলা সদরেই আসতে হয় তাদের। এসব বাগানে শ্রমিকদের জন্য নেই কোনো স্যানিটেশনের ব্যবস্থা। এখনো খোলা জায়গায় মলত্যাগ করতে হয় শ্রমিকদের। পাহাড়ি টিলা এলাকার কারণে চা বাগানে টিউবওয়েল স্থাপনের সুযোগ নেই। কুয়ার পানি তাদের একমাত্র ভরসা। চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এমন নানা সমস্যার চিত্র পাওয়া গেছে।
চা বাগানে কর্মরত নারী ও শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ঘাটতিসহ সিলেট বিভাগের অগ্রগতির ধীরগতির কথা উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘের ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের জরিপ অনুযায়ী, সিলেটের চা বাগানের প্রায় ৭৪ শতাংশ শ্রমিক এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। স¤প্রতি ‘সিলেট বিভাগে নারী চা বাগান শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি’ শীর্ষক ইউএন উইমেন বাংলাদেশের ওয়েবিনারে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, চা বাগানে কর্মরত নারী ও শিশুদের মৌলিক চাহিদার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট বিভাগের ধীরগতির কথাও উঠে আসে গবেষণায়।
ওয়েবিনারে আলোচনার প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল- জেন্ডার রেসপন্সিভ প্ল্যানিং অ্যান্ড বাজেটিং এবং চা বাগানের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা। চা বাগানের শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘের যৌথ কর্মসূচির আওতায় সিলেট বিভাগে জিআরপিবি নিয়ে ২০২০ ও ২০২১ সালে দুটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেখা যায়, নারী শ্রমিকরা মাসিক ঋতুস্রাব, মাতৃত্ব এবং সন্তান পরিচর্যার সময়ে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সমস্যার শিকার হয়। তারা প্রতিকূল আবহাওয়ায় দিনে ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কাজ করে। পক্ষান্তরে বিশ্রাম ও পরিচ্ছন্নতার সুযোগ সীমিত। এছাড়া, চা বাগানের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বাল্যবিয়ে, যৌতুক এবং পারিবারিক সহিংসতাও নৈমিত্তিক ঘটনা।
সাধারণভাবে দেশে সর্বজনীন শিক্ষার কথা প্রতিষ্ঠিত হলেও চা বাগানের শ্রমিকদের সন্তানরা অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে দীর্ঘদিন থেকে। চা জনগোষ্ঠীর শিশুদের বেড়ে ওঠায় নেই একাডেমিক শিক্ষার ছোঁয়া।
সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকলেও চা বাগানগুলোয় বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরা সরকারি বৃত্তি পায় না। আবার বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে বর্তমানে সরকারের দপ্তরে ১০টি সরকারি স্কুলের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি খুব শিগগিরই বাস্তবায়নের সম্ভাবনার কথাও জানান তিনি।
রাজু বলেন, সরকার ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা’ কর্মসূচি নিলেও এতদিন বাস্তবায়ন করা হয়নি চা বাগানগুলোয়। তবে চা বাগান কর্তৃপক্ষ এবং এনজিওগুলোর সহযোগিতায় বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। তবে এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতি ও শিক্ষকমণ্ডলী যুৎসই নয়। ফলে চা বাগানের শিশুরা যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, চা বাগানে অভিভাবকরা অধিকাংশ নিরক্ষর বলে সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। এছাড়া সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় বহনের ক্ষমতা ও সামর্থ্য অভিভাবকদের না থাকায় এনজিও পরিচালিত স্কুলের উপর শিশুদের নির্ভরশীল থাকতে হয়। শিশুরা বাড়িতে সাহায্য না পাওয়ায় অনেকে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এভাবে তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়।
চা শ্রমিক নাড়– বাড়ৈ বলেন, শিক্ষার অভাব আমাদেরকে শুধু সভ্যতার আলো থেকেই বঞ্চিত করেনি, নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবার অধিকার থেকেও যেন বঞ্চিত করেছে। আর এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ চা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। চা শ্রমিকের সন্তানরা প্রায় সবাই ছুটির দিনে বা কখনো কখনো স্কুল বাদ দিয়ে সাধ্য অনুযায়ী বাগান বা আশপাশের এলাকায় কাজ করে। এই উপার্জনের অর্থ দিয়ে চলে বিদ্যাচর্চা। মাধ্যমিকের কোঠা পেরোনোর আগেই শেষ হয়ে যায় বাগানের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যাফেয়ার্স (আইডিয়া) এর সহকারী পরিচালক নাজিম আহমদ বলেন, চা বাগানের মানব সম্পদ উন্নয়ন কিংবা শ্রমিক কল্যাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষা। অথচ তা বারে বারে উপেক্ষিত হচ্ছে। এদিকে শিক্ষা যে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ- একথা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। ফলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, উচ্চশিক্ষিত মানুষ মানেই উচ্চ ক্ষমতা-দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ। আমরা মনে করি চা শ্রমিকদের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই, আর এ জন্য জাতীয় বাজেটে চা বাগানের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকা প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি বিদ্যালয়ের জন্য নিজস্ব জমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাগানের জমি তো ইজারা নেয়া। তাই বাগানগুলোয় সরকারি বিদ্যালয় করা যায়নি। তবে স¤প্রতি চা বাগানের জন্য এই শর্ত শিথিল করা হয়েছে। ফলে বাগানের অনেক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। আরো কিছু করার প্রক্রিয়ায় আছে।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়