ভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শোকজ

আগের সংবাদ

বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব : বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী

পরের সংবাদ

বিদ্রোহী কবিতা : এক শাশ্বত আলো

প্রকাশিত: জুন ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২, ২০২৩ , ১:২১ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি হওয়ায় আমার গর্ব ও আনন্দের অন্যতম অনুঘটক নজরুলের সৃষ্টিসম্ভার। হৃদয়ের সূ²তম অনুভূতিকে শব্দে গেঁথে গেঁথে সুরে তালে ছন্দে মাধুর্যে স্বর্গীয় সুধা সৃষ্টি করে গেছেন প্রিয় কবি, যেন আমারই জন্য, কিংবা আমারই মতো অযুত-নিযুত হৃদয়পেয়ালা পূর্ণ করার জন্য। বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়ে, বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে পেয়ে আমি সৌভাগ্যশালী, এ ভাষার বর্ণে গন্ধে যে সৌন্দর্য, এর অঙ্গে অঙ্গে যে ধ্বনি মাধুর্য, অর্থগত সূ²তা এবং এর বৈচিত্র্যময় ব্যঞ্জনাকে অনুভব করেছি নজরুলকে পাঠ করে, শ্রবণ করে; ডুব দিয়েছি নিজের বোধের গভীরে, হারিয়ে গেছি ভাবনার অতলে। সমুদ্রমন্থন করে যে মণিমাণিক্য পেয়েছি, তা হাতে নিয়ে পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার তাড়িয়ে হেসেখেলে জয় করছি জীবন যুদ্ধের প্রতিটি সংকট। আমার অন্তরের অন্তরে ধ্বনিত হয়-
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য;
‘বিদ্রোহী’ কবিতা যেন এক মহাকাব্য। কবিতার প্রতিটি চরণই যেন এক একটি কবিতা। শুরু আছে, কিন্তু এর যেন শেষ নেই কোনো। যতবার পড়ি, ততবারই শিরায় শিরায় রক্তকণিকারা জেগে ওঠে, বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; কবিতার অক্ষরগুলো পাঠ শেষ হয়, কবিতা শেষ হয় না। সে পাঠককে জড়িয়ে রাখে, পাঠকের সাথে জড়িয়ে থাকে।
বল বীর, চির উন্নত মম শির।
আমি মনে মনে বলি, অস্ফুট স্বরে বলি, কখনো বিদ্রোহী ভঙ্গিতে তেজের সাথে বলে উঠি,
চির উন্নত মম শির। চির উন্নত মম শির। চির উন্নত মম শির। মন্ত্রের মতো, ধ্যানের মতো, সুরের মতো, ঝরনার জলের মতো, শুদ্ধ বাতাসের মতো, সূর্যের তেজের মতো আমার বলাও চলতে থাকে। উচ্চারণ থেমে গেলেও, আমার অন্তরাত্মা বলে চলে, উন্নত মম শির… উন্নত মম শির।
কবিতা এই এতটুকু হলেও কবিতা হতো। এই একটি চরণই আমার এক জীবনের বীরত্বের পাথেয় হিসেবে যথেষ্ট হতো। আর তার প্রতিটি চরণ জীবনের প্রতিটি বাঁকে যেন আলো ফেলে যায়, কঠিনতম সময়ে আমি মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াই, উন্নত মম শির।
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
এত শক্তি, এত আলো প্রবেশ করে হৃদয়ে, তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। সমাজ সভ্যতা যখন নারীকে বলে ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, যখন ভূলুণ্ঠিত হয় নারীর মানবাধিকার, রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দেখি, তখনো আমার মনে হয় না, নারী বলে আলাদা কিছু আমি; আমার একটি কথাই মনে হয়, আমি মানুষ, আমি বীর, উন্নত মম শির।
আমার কাছে হিমালয় কত বার নত হয়েছে, তার হিসাব রাখিনি। কত চড়াই-উতরাই পার হয়েছি, তা যদি কোনো এককে মাপা যেত, তবে গাণিতিক সূত্র দিয়ে হয়তো প্রমাণ করা যেত, “শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!” এমন করে ভাবতে পারতাম কি কখনো? সম্ভবত পারতাম না! নিজের মধ্যে নিজের চেয়েও অধিক এই মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করার জন্য সত্যিই প্রয়োজন ছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার। মাটির মতো এক মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া কোমলমতি এক কন্যাশিশু, বাহুবলে না হোক, মনোবলে বীর হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারছে, বিশ্বাস করতে পারছে, দৃপ্ত পায়ে হাঁটতে পারছে, এর পেছনের জাদুটা কোথায়? ওই যে, আমাদের আছে একজন নজরুল, আমাদের আছে একটি কবিতা- ‘বিদ্রোহী’।
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!
কী এক চিত্রকল্প! কী বিস্ময়কর, রোমাঞ্চকর! আমি আর আমাতে থাকি না, ঠিক যেন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনের মতোই নিজের বিশ্বরূপ দেখতে পাই আমি। পরমাত্মা জেগে ওঠে আমার সত্ত্বায়, আমি নিজেই নিজের বিশালতার পরিমাপ করে কুলোতে পারি না। মর্মভেদী এই কবিতা আমাকে আন্দোলিত করে, আমার ভাবনার জগতে ঝড় তোলে, আবার দেয় শান্ত দিঘির জল।
কবিতাটি পড়লেই বিস্ময় জাগে, এমনভাবেও ভাবা যায়! কত অবলীলায় সমস্ত অন্যায় অত্যাচার, সভ্যতার নামে শাসন, শোষণ, তোষণের মুণ্ডপাত করা যায়! কথাগুলো লিখছি আমি, প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ত্রিশালে থেকে। যে বাড়িতে তিনি গৃহশিক্ষক/জায়গীর হিসেবে থাকতেন, সেখানে গিয়ে গভীর ভালোবাসায় আমি বুক ভরে দম নিই। খুঁজতে থাকি নজরুলের গন্ধ। অতি শান্ত নিরিবিলি পরিবেশই হয়তো তাকে কবিতা লিখতে প্রস্তুত করেছে, এমনটাই ভাবছিলাম। ঠিক তখনই মনে হলো, প্রকৃতির প্রাণ প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ এই ছায়ামায়া ঘেরা গ্রামখানি একশ বছর আগেও হয়তো প্রায় এমনই ছিল। আশপাশের অতি সাধারণ টিনের ঘরগুলোর সঙ্গে কবির সংরক্ষিত ঘরখানার কাঠামোতে অনেক মিল রয়েছে। এই ঘরখানা কি কখনো জানত, তারই অন্তরে অন্দরে তৈরি হচ্ছে দুঃখ, দারিদ্র্য, শোষণ, জুলুম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সুর বাজানো এক কালজয়ী অগ্নিবীণা! যেখানে একই সঙ্গে আছে বীরের সূর্যসম তেজ, আছে প্রেমময় সুরের মূর্ছনা! মনে হলো, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই নগন্য আমি, সেখানেই হয়তো পা রেখেছিলেন প্রাণের কবি। পুকুরের জল ছুঁয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাস আমাকে যেমন ছুঁয়ে গেল, তেমনি কবিকেও ছুঁয়েছিল নিশ্চয়ই। একই আলো হাওয়া জলে কবিও স্নান করেছেন। ভাবতেই পুলক জাগে মনে, শিহরিত হই আবারো।
ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করি,
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমার মতো কত পথিক না জানি এই ঘাটে এসে বসে, পুকুরের জলে খোঁজে কবির ছায়া! না জানি কত জন কবি হয়ে ওঠে তার কবিতা পড়ে পড়ে। চুপচাপ ভাবতে ভাবতে কেবল বিস্ময় জাগে মনে। এমন শব্দচয়ন, এমন ভাবরসের মেলবন্ধন, কোন স্বর্গ থেকে ভেসে এসেছিল, যা তিনি ধারণ করেছিলেন তার হৃদয়নিঃসৃত সুরে ছন্দে তালে! যেখানে প্রেম, ভালোবাসা, দ্রোহ, বিরহ, নিত্য অনিত্য, সুখ দুঃখ, হাসিকান্না, আকাশ বাতাস, স্বর্গমর্ত্য, জন্ম মৃত্যু সব যেন থরে থরে সাজানো হয়েছে। ঠিক সাজানো হয়েছে এমনো নয়; আপনা থেকেই যেন একটি কবিতার দেহকাঠামো নির্মিত হয়েছে। অবলীলায় শব্দের পর শব্দ এসে নিজ নিজ অবস্থান নিয়েছে যেন! এক ভাব থেকে অন্য ভাবে যেন সাগরের জলরাশি ঢেউ খেলে খেলে দোল খেয়ে খেয়ে ভাসছে কবিতার বুকে, কেউ তাকে তৈরি করেনি; যেন কবিতার শব্দমালা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে আকাশে বাতাসে ভেসে চলছে, যেন এই শব্দমালা আলোর মতোই অবিনশ্বর! আসলে এ যেন ঠিক কবিতা নয়, শব্দমালাও আসলে নয়, এ এক আলোর মালা, যা এক নির্জন রাতের ব্রাহ্মমুহূর্তে শাশ্বত আলো থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে কবির চোখের পাতায় পড়ে ঘুম ভাঙিয়েছিল। কবি সেই আলোকরাশিকে শব্দরূপ দিয়েছেন।
একশ বছর আগে রচিত কবিতাখানি ঠিক তেমনই তেজদীপ্ত রয়েছে, আলোর যে কোনো ক্ষয় নেই, লয় নেই। এ কবিতা তাই এভাবেই আলো ছড়িয়ে যাবে, এভাবেই উজ্জীবিত করবে আরো শত শত বছর, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বলে যাবে-
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়