শাহজালাল বিমানবন্দর : যাত্রীদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

রক্তস্বল্পতা এক নীরব সমস্যা : অপুষ্টিজনিত এ রোগ থেকে হতে পারে জটিল রোগ > নারী ও শিশুরাই ভুগছে বেশি

পরের সংবাদ

বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক। তার অনেক সত্তা এবং প্রতিটি সত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একাধারে জ্যোতির্ময় কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, সম্পাদক, সংকলক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, কিশোর সাহিত্যিক ও প্রিয় শিক্ষক। প্রতিটিতেই তিনি সৃজনশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোর সাহিত্য, ৩টি সম্পাদিত গ্রন্থ ও ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। ফলে কোনো একক অভিধায় তাকে অন্তরিত করা অসম্ভব। তবু একজন ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্রের কাছে তিনি এ দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী। হুমায়ুন আজাদের গবেষণা, অধ্যাপনা, সম্পাদনা এবং অপূর্ণ স্বপ্নের প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে বাংলা ভাষা বিষয়ক তার বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা বা ভাষাবিজ্ঞান-ভাবনা। বর্তমান প্রবন্ধ তাই ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের স্বরূপ বিশ্লেষণের প্রয়াস।
ভাষাবিজ্ঞান (লিঙ্গুইস্টিকস) বলতে একটি সংশ্রয় (সিস্টেম) হিসেবে ভাষার প্রকৃতি, গঠন, উপাদানের একক ও এর যে কোনো ধরনের পরিবর্তন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে বোঝায়। যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেন তাদের ভাষাবিজ্ঞানী (লিঙ্গুইস্ট) বলা হয়। ভাষাবিজ্ঞানীগণ নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষাকে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করেন; ভাষার সঠিক ব্যবহারের কঠোর বিধিবিধান প্রণয়ন তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা বিভিন্ন ভাষার মধ্যে তুলনা করে এদের সাধারণ উপাদান এবং অন্তর্নিহিত সূত্রগুলো নিরূপণের চেষ্টা করেন এবং এগুলোকে এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামোয় দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন যে কাঠামো সমস্ত ভাষার পরিচয় দিতে সক্ষম এবং ভাষাতে কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই, সে ব্যাপারেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (২০১১) বইটির উৎসর্গপত্রে বাংলা ব্যাকরণের রূপ নির্মাণে স্মরণীয় যে ৩১ জন ভাষাবিজ্ঞানী-গবেষক, হুমায়ুন আজাদ তাদের অন্যতম। বইটির শুরুতে যে ১৬ জন বাংলা বৈয়াকরণের ছবি সংযোজিত, সেখানেও তিনি উপস্থিত। বইটির সম্পাদকদ্বয়ের অন্যতম অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলি (১৯৯৮) গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “বাংলাদেশে চমস্কিপ্রবর্তিত ‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল’ ভাষাতত্ত্বের সবচেয়ে উৎসাহী প্রবক্তা ও অন্যতম পথিকৃৎ হুমায়ুন আজাদ”।
আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ চম?স্কি প্রমাণ করেন যে কোনো ব্যক্তির অচেতন, অব্যক্ত ভাষাবোধ এবং তার ভাষা প্রয়োগ দুটি ভিন্ন বস্তু। তার মতে, ভাষাবিজ্ঞানীর কাজ হলো মানুষের ভাষাবোধ যেসব অন্তর্নিহিত মানসিক সূত্র দিয়ে গঠিত সেগুলো আবিষ্কার করা। এ প্রস্তাবের সমর্থনে সিন্ট্যাক্টিক স্টাক্চারস (১৯৫৭) ও আসপেক্টস অব দ্যা থিওরি অব সিনটেক্স (১৯৬৫) নামের গ্রন্থগুলোয় চম?স্কি উপস্থাপন করেন তার উদ্ভাবিত ‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ’ নামের একটি ধারণা, যে ব্যাকরণের সূত্রগুলো দিয়ে কোনো একটি ভাষার সমস্ত ‘বৈধ’ বাক্যের গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। চমস্কি আরো বলেন, যেসব ভাষার মানুষই ভাষা বিষয়ক কিছু সর্বজনীন ধারণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, যাদের সমষ্টিগত নাম তিনি দেন ‘বিশ্বজনীন ব্যাকরণ’। চমস্কি বাতিল করে দেন সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানকে। তার উত্তরসূরি চার্লস জে ফিলমোর প্রস্তাব করেন ‘রূপান্তর কারক ব্যাকরণ কাঠামো’ (১৯৬৯)। এর অব্যবহিত পরেই চোমস্কীয় ও ফিলোমোরীয় রূপান্তর ব্যাকরণের কাঠামোতে প্রমিত বাংলা ভাষার বাক্যের এক এলাকা প্রথম বিশ্লেষিত হয় ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের গবেষণায়। ১৯৭৩-১৯৭৬ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষার বাক্যতাত্ত্বিক বর্ণনার জন্য তিনি ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথাগত ব্যাকরণে সাধারণত বাংলা বাক্যের সংগঠনকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীরাও বাক্যের অব্যবহিত উপাদান নির্ণয় করতে গিয়ে ব্যস্ত থাকেন ভাষার বহিরঙ্গ ব্যবচ্ছেদে- ভাষার উপাত্তের ভেতরে প্রবেশে হন ব্যর্থ। ফলে হুমায়ুন আজাদের আগে প্রমিত বাংলা ভাষার বাক্যের ভাষাবিজ্ঞানসম্মত কোনো অধ্যয়ন আমাদের চোখে পড়ে না। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তার গবেষণাকর্মের শিরোনাম প্রোনোমিনালাইজেশান ইন বেঙলি (১৯৮৩)। এর মাধ্যমে তিনি শুধু বাংলাভাষা বিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেননি; সম্ভবত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ওরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙলি ল্যাঙ্গুয়েজ (১৯২৬) এরপর বাংলা ভাষা বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাও করেছেন। গ্রন্থের ১১টি অধ্যায়ে : জেনারেল ইনট্রোডাকশন অ্যান্ড বেসিক রুলস, নাউন ফ্রেজ, কেইস অ্যান্ড কেইস মার্কার্স, প্রোনাউন্স অ্যান্ড প্রোনোমিনালাইজেশান, প্রোনোমিনালাইজেশান প্রোপার, রিফ্লেক্সিভিজেশন, রিসিপ্রোকার স্টাকচারস, রিলেটিভিজেশন, আইডেন্টিক্যাল হেড নাউন ডিলেশন, সেন্ট্যান্স প্রোনোমিনালাইজেশান এবং দ্যা লেক্সিকোন শিরোনামে বিশ্লেষিত হয়েছে বাংলা বাক্য। কিন্তু বাংলা ভাষায় ওই তত্ত্ব-কৌশল পরিবেশিত হয়নি।
একই সময়ে তার শানিত ভাষায় ২৯টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় বাঙলা ভাষার শত্রæমিত্র (১৯৮৩) নামক ৭২ পৃষ্ঠার গ্রন্থ। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের পুুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে প্রাবন্ধিক প্রমাণ করেন যে এ দেশের শাসক, প্রশাসক, শিল্পপতি ও শিক্ষানিয়ন্ত্রকরা প্রতিক্রিয়াশীল আত্মস্বার্থ রক্ষার জন্যই ব্যর্থ করে দিচ্ছেন বাংলা ভাষা ও শোষিতের প্রতিষ্ঠার সব উদ্যোগ। আক্রমণাত্মক ভাষায় লেখা এ বইয়ে হুমায়ুন আজাদ প্রত্যাশা করেন : বাংলার শোষিত শ্রেণি, প্রগতিশীলতা ও বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ঘটবে একই দিনে; কেননা এ তিন একই সূত্রে গাঁথা। বাংলা ভাষার শত্রæ-মিত্র উভয় শ্রেণিকে আজো আলোড়িত করে বইটি। পরের বছরই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ পায় বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪) নামে তার আরেকটি বাংলা বই। দীর্ঘ আটটি পরিচ্ছেদের এ গ্রন্থেই প্রথম বাংলা ভাষায় পরিবেশিত হয় রূপান্তর ব্যাকরণের তত্ত্ব-কৌশল। পরিচ্ছেদগুলোর শিরোনাম হচ্ছে: বাক্য, প্রথাগত বাক্যতত্ত্ব, সংগঠনিক বাক্যতত্ত্ব, রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ, বাঙলা বিশেষ্যপদ, বাক্য সর্বনামীয়করণ, প্রথাগত ব্যাকরণ, সংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান। শেষ দুটি পরিচ্ছেদ-এ লেখক প্রথাগত ও সাংগঠনিক পদ্ধতিতে বাক্য বিশ্লেষণ করে এগুলোকে পরিশিষ্ট হিসেবে জুড়ে দেন- ভাষাবিজ্ঞানে উৎসাহী সাধারণের উদ্দেশ্যে। এভাবে হুমায়ুন আজাদ ভাষাতত্ত্বের প্রধান তিনটি ধারার বাক্য বর্ণনাকৌশলের অনুপুঙ্খ বিবরণ পেশ করেন। লেখক সগর্বে ঘোষণা করেন : প্রধান পরিচ্ছেদগুলো তাদেরই জন্য, যারা আয়ত্ত করতে চান ভাষাশাস্ত্র, ও যারা বিশেষজ্ঞ। এ গ্রন্থে বাক্যবর্ণনায় তিনি তত্ত্বকৌশলের যে বিস্তৃত বিজ্ঞানসম্মত ভাষ্য রচনা করেছেন, তা আজো বাংলা ভাষায় দুর্লভ। অবশ্য, প্রমিত বাংলায় ড. উদয়কুমার চক্রবর্তী ও ড. বিনয় বর্মণ এবং আঞ্চলিক ভাষায় ড. শ্যামল কান্তি দত্ত এ তত্ত্বকৌশলের মাধ্যমে বাক্য বিশ্লেষণে সফলতা পান। তবে আজাদের এ গ্রন্থের ভাষা অনেকটা অনুবাদের ভাষার মতো রূঢ়- পাণ্ডিত্যপূর্ণ; সরল-স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
এ বছরেই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে বাঙলা ভাষা : বাঙলা ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধসংকলন [১৭৪৩-১৯৮৩] প্রথম খণ্ড (১৯৮৪) এবং পরের বছর প্রকাশ করে-বাঙলা ভাষা : বাঙলা ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধসংকলন [১৭৪৩-১৯৮৩] দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৮৫)। দুই খণ্ডেরই প্রধান সম্পাদক হুমায়ুন আজাদ। দুই খণ্ডের এই দালিলিক সংকলনে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষাবিষয়ক ভাবনায় সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। ৭৭৬ পৃষ্ঠার বই প্রথম খণ্ডের পাঁচটি ভাগে স্থান পেয়েছে : প্রথাগত ব্যাকরণ কাঠামো, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, বর্ণমালা ও বানান সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের প্রবন্ধসমূহ। প্রতিটি ভাগের শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ছাড়াও ‘অবতরণিকা : বাঙলা ভাষাতত্ত্ব [১৭৪৩-১৯৮৩]’ শিরোনামে ১০৬ পৃষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষাতত্ত্ব চর্চার শুরু থেকে সমকাল পর্যন্ত একটি চমৎকার বিশ্লেষণ পাঠককে উপহার দেন। ৮৭৮ পৃষ্ঠার বই দ্বিতীয় খণ্ডের ষষ্ঠ থেকে দশম ভাগে : অভিধান সংকলন, উপভাষাতত্ত্ব, ভাষা পরিকল্পনা, পরিভাষা, ভাষাতত্ত্বের বিবিধ দিক নিয়ে যেভাবে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের প্রবন্ধকে বেছে বেছে স্থান দিয়েছেন তা রীতিমতো গৌরব করবার মতো। এ গ্রন্থ দুটো আজো বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়। এ সময় ধানশালিকের দেশ-এর একটি বিশেষ সংখ্যায় হুমায়ুন আজাদ তার প্রিয় বাংলা ভাষা সম্পর্কে লেখেন। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭) নামে। এটি তিনি প্রথাগত রীতি ও ভাষায় ও প্রাজ্ঞ পাঠকদের জন্য লেখেননি। লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী (১৯৭৬) ও এ-বই কিশোর-তরুণদের জন্য লিখতে পেরে লেখক সুখ পান। কিশোরসাহিত্য মনে হলেও এ দুটি বই কতটা তথ্যসমৃদ্ধ তার প্রমাণ- বর্তমানে দেশে বিসিএস পরীক্ষাসহ যে কোনো প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তুতির জন্য এ দুটি বই অবশ্যই পড়েন।
হুমায়ুন আজাদ রচিত বহুল পঠিত ভাষাতত্ত্বের পাঠ্যপুস্তক তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮)। দশটি পরিচ্ছেদে বিভাজিত এ গ্রন্থে : তুলনামূলক পদ্ধতি, ভাষা-শ্রেণিকরণ, ইন্দোইউরোপীয় ও অন্যান্য ভাষাবংশ, ধ্বনিপরিবর্তন ও ধ্বনিপরিবর্তন প্রক্রিয়া, রূপতাত্ত্বিক ও বাক্যিক পরিবর্তন, আর্থ পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা আছে। দশম পরিচ্ছেদে ভাষাতত্ত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো এবং ভাষা পরিবর্তনের কারণগুলো বেশ চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। আলোচনা করেছেন : তরঙ্গতত্ত্ব, আত্মীয়তাবাচক কাঠামো ও বংশলতিকা কাঠামো, ভাষা পরিবর্তনের কারণ ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তকের মতো এ বইটির উপাত্তে যেমন অসঙ্গতি আছে, তেমনি ভাষাও নীরস ও দায়সারা গোছের। বইটির ১০২ পৃষ্ঠায় : যুগ্ম ব্যঞ্জনধ্বনির আগে /ই/, /উ/ উদ্ভবের শর্তানুসারে অপিনিহিতির উদাহরণে বাক্য>বাইক্ক ইত্যাদি সব /ই/ উদ্ভবের উদাহরণ, একটিও /উ/ উদ্ভবের উদাহরণ নেই। এমন ঘাটতি-অসঙ্গতির কারণ হতে পারে তার ভাষাবিজ্ঞান থেকে কথাসাহিত্য ও কাব্য-সাহিত্যে বেশি মনোনিবেশ।
সাহিত্যপত্র ত্রৈমাসিক পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সংখ্যায় হুমায়ুন আজাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন ‘বাঙলা ব্যাকরণের রূপরেখা : একটি প্রস্তাব’ শিরোনামে। তিনি দেখান : ‘প্রথাগত ব্যাকরণে বাঙলাভাষার রূপস্তরটি মোটামুটি বর্ণিত হয়েছে। … সাংগঠনিক বর্ণনামূলক কাঠামোতে বাঙলাভাষার ধ্বনিস্তর কিছুটা বর্ণিত হয়েছে। … রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল কাঠামোতে বর্ণিত হয়েছে বাঙলা বাক্যস্তরের সামান্যাংশ। অন্য স্তরগুলো বর্ণিত হয়নি। … শতাধিক প্রতিভাবান কয়েক শতক নিরবচ্ছিন্ন গবেষণায় ব্যস্ত থাকলেও বাঙলা ভাষার সমস্ত এলাকা বর্ণনা শেষ হবে না।’ তবু তিনি চার শ্রেণির ভাষাবিজ্ঞানী নিয়ে বছরে আধা কোটি করে দশ বছরে বাংলাভাষার একটি ব্যাকরণ রচনার প্রস্তাব পেশ করেন : ‘তার নাম দেয়া যাক বাঙলা ব্যাকরণ। এটি রচিত হবে রূপান্তরমূলক কারক-ব্যাকরণ কাঠামোতে।’ অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এরশাদ সরকার এবং পরে খালেদা জিয়ার সরকার তার প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুধাবন করেনি অথবা করতে চায়নি। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বাক্যতত্ত্ব গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ বের করলে এর ‘ভূমিকা’য় হুমায়ুন আজাদ লেখেন : ‘ভাষাবিজ্ঞান থেকে আমি এখন দূরে আছি, আনন্দ পাচ্ছি অন্য ধরনের লেখা লিখতে এবং দুঃখ পাচ্ছি এ জন্য যে, ব্যাপক একটি বাঙলা ব্যাকরণ লেখার যে স্বপ্ন আমার ছিল, তা বোধ হয় আর বাস্তবায়িত হলো না।’ কিন্তু প্রিয় বিষয় থেকে দূরে থাকা যায়নি, লেখা হলো আরেকটি পাঠ্যপুস্তক অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯)। রূপান্তর ব্যাকরণে অর্থও বর্ণনার বিষয় হয়ে ওঠে; কেননা অর্থই ভাষার প্রাণ। ড. জাহাঙ্গীর তারেক অনুবাদ করেন স্টিফেন উলম্যান এর শব্দার্থবিজ্ঞানের মূলসূত্র (১৯৯৩) এবং রচনা করেন শব্দার্থবিজ্ঞানের ভূমিকা (১৯৯৮)। তবু তখনো বাংলা ভাষায় শব্দার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ চর্চা শুরু হয়নি। হুমায়ুন আজাদের এ বইটি দিয়ে শুরু। এ বইয়ে পাঠক পরিচিত হন অর্থবিজ্ঞানের মূল ধারণাগুলোর সঙ্গে। বইতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচিত হয় অর্থবিজ্ঞানের সমস্যা, অর্থবিজ্ঞানের পরিসীমা, শব্দ অর্থবিজ্ঞান, পরিস্থিতির প্রসঙ্গ, বাক্যের আর্থ সংগঠন, অভিধানতত্ত্ব প্রভৃতি। এখানে উদাহরণ দেয়া হয় বাংলা ভাষা থেকে। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর (২০০৪) ছ’বছর পর আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ভাষাশিক্ষা ও ভাষাবিজ্ঞান পরিচিতি (২০১০)। সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক এ পাঠ্যপুস্তকে পাঁচটি ইউনিটে ভাগ করে ১৫টি পাঠে উপস্থাপন করা হয়েছে বাংলা ভাষার ভাষাবিজ্ঞানীগণের ত্রæটি ও সীমাবদ্ধতা। ভাষাবিজ্ঞানের বিশাল অবয়বের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ সহজ ও অল্প কথায় প্রাচ্যভাষার অন্যতম বাংলাভাষার ও পাশ্চাত্য ভাষার ভাষাবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলোর পরিচয় বর্ণনা করেছেন। এটি মূলত ভাষাবিজ্ঞান-আগ্রহী ছাত্রদের জন্য একটি পরিচিতিমূলক বই। এছাড়া মুহম্মদ আবদুল হাই রচনাবলি (১৯৯৪)-এর সম্পাদকীয় মুখবন্ধ এবং আরো কিছু বিক্ষিপ্ত রচনায় হুমায়ুন আজাদের ভাষাবিজ্ঞান-ভাবনা ছড়িয়ে আছে। আগামী প্রকাশনী থেকে তার সব বইয়ের পাশাপাশি উপন্যাসসমগ্র, কাব্যসমগ্র, কিশোরসমগ্র, রাজনৈতিক প্রবন্ধসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার ভাষাবৈজ্ঞানিক রচনাসমূহ সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত না হলে ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন অসমাপ্ত রয়ে যাবে। গত শতকের দশকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অকাল মৃত্যুর কারণে তার এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। মনীষী পণ্ডিত ও আমৃত্যু জ্ঞানসাধক হুমায়ুন আজাদের সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের উপস্থাপন একক প্রচেষ্টায় দুরূহ। কেবল তার ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক রচনার যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের লক্ষ্যে এ বিষয়ক রচনাবলির পরিচিতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে পাঠকের কাছে পেশ করবার প্রয়াস চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে এ ভাষাবিজ্ঞানীর মৌল প্রবণতাসমূহ চিহ্নিত করবার চেষ্টা হয়েছে। অনুধাবন করা যায় যে, হুমায়ুন আজাদ তার প্রতিভা ও ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়ন-অভিজ্ঞতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে যেতে পারেননি। ভাষাবিজ্ঞানে তার অভিনব অবদান অস্বীকার না করেও বলা যায়: আমরা আমাদের সমকালীন অনীহার জন্যই তার আরও অমূল্য অবদান হতে বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের এই অনীহা কেবল হুমায়ুন আজাদের দুর্বিনীত-আক্রমণাত্মক ভাষায়, উন্নাসিকতায় আর অহংকারে নয়; তার তাত্ত্বিক কাঠামোর ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কেও। আমরা আজো নতুন তত্ত্ব গ্রহণে মৌলবাদী আচরণ করি- প্রথাগত পদ্ধতি আঁকড়ে ধরি, আর সামগ্রিক আলোচনা অবহেলে আবেগধর্মী খণ্ডিত আলোচনায় আরাম পাই- স্বস্তি বোধ করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়