শাহজালাল বিমানবন্দর : যাত্রীদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

রক্তস্বল্পতা এক নীরব সমস্যা : অপুষ্টিজনিত এ রোগ থেকে হতে পারে জটিল রোগ > নারী ও শিশুরাই ভুগছে বেশি

পরের সংবাদ

নৈঃশব্দ্যের আভরণ, সুমগ্ন সৃজন

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবিতাগ্রন্থ ‘নৈঃশব্দ্যমুখী অন্তর্দাহরা’ [প্রথম প্রকাশ ; ঢাকা : বেহুলাবাংলা, ২০২২ খ্রি.] কবি শৈলজানন্দ রায়ের অন্তরমগ্নতার বিভূতি।
‘নৈঃশব্দ্যমুখী অন্তর্দাহরা’ সার্বভৌমত্বের দাবিদার আজ। প্রচ্ছদশিল্পী তমা রাণী বৈরাগীকে অন্তরতর অভিবাদন!

ভাব-অনুপোষণা:
মোট ছাপ্পান্নটি কবিতার মর্মজ্যোতিই সংবদ্ধ হয়েছে এ কাব্যে। ঢেউদল অনুপোষণায় দৃশ্যায়ত কবিতাগুলি এক বিশেষ সৃজন-ঔজ্জ্বল্যকে সংরক্ষণ করেছে।
‘মাঠের গল্প’ কবিতাটি অমৃতদ্যুতিতে ভরা। সুধাশ্রীমান ‘ধু-ধু হাওয়ার ঋণ’ আর ‘উদার’-মগ্নতার নিঃসঙ্গ সন্তুষ্টিতে তৃপ্ত। তা মানবিক ঔদার্য-অভীক্ষারই ফাগুন। কবির গদ্যালোকিত উচ্চারণ :
ধু-ধু হাওয়ার ঋণ এবং চাষবাস তার বেশি কিছু নয়, তা সে ফসল ফলুক আর না-ই ফলুক। মর্মার্থ- খোলা মাঠের
অন্তর বরাবরই উদার হয়। …
তবে মাঠকে কিন্তু ঘরের মধ্যে আটকে রাখা যায় না।
‘অসম্পর্কিত’ কবিতাটি দর্শন-অভিক্ষেপ- মানবিক সম্পর্ক-অভিজ্ঞানের অন্তঃপুর-সংযোজনার লালিত রূপদীপ্তি। কবির মনোপটে প্রাকৃতিক উপাদান-বিন্যাস, হৃদয়গ্রাহিতার পরাগায়ন, সনিষ্ঠ ভাব-সঞ্চয়িত অভিনিবেশ নিরুপম কবিতাময় চিত্রাঙ্কনের স্ফূর্তি এনেছে।
‘বিষক্রিয়া’ কবিতায় কবির প্রাণময় বিশ্বাসেরই শিল্পমূর্তি। কবির উচ্চারণ :
ব্যর্থ বীণ বিষের অবদমনের সাঙ্গীতিক নিরাময়-কলা নিয়ে ওষ্ঠের উপরে অনর্থক উঠেছে দুলে। সেই শর্তে আমি
তো বিষাক্ত এবং অস্পৃশ্য হই।
প্রজ্ঞা আর দর্শন-অভীক্ষা ইন্দ্রিয়জ অনুভাবনার ব্যাকুলতাকে আহত করে- এ সর্বজনীন সত্যের শৈল্পিক উচ্ছ¦াস শৈলজানন্দ’র সৃজনরূপমায় প্রকাশিত।
‘ই ইকয়েল টু এম সি স্কয়ার’ কবিতাটি বিজ্ঞাননিষিক্ত এক অনন্য সৃজন। এ কবিতায় ‘মৃত্যুভাবনা’ আর বিজ্ঞানময় কল্যাণ-আর্তি জাগৃতিপ্রস্বেদনের শিল্পায়নকে দ্রষ্টব্য করেছে। কবি শৈলজানন্দ’র আত্মমগ্নতার প্রকরণ সত্যিই অনন্য! আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের কল্যাণকান্তি ছুঁয়ে দিয়েই ত্বরান্বিত আধুনিকায়নের অলিগলি। সঞ্জীবিত পৃথিবীর জীবনবৃদ্ধি প্রকল্প-অভিযান দর্শন-আহরণের পাথেয় খোঁজে। শৈলজানন্দ’র সমান্তরাল প্রশ্ন-প্রণিধান :
এ জগত সংসার অনিত্য … মৃত্যু-সংস্করণ। পৃথিবী নিজে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কাছে সচিত্র বিশ্লেষণ চায়-
এখনো মানুষ কতোটুকু মরীচিকাপ্রবণ আর কতোটুকু তার অপ-অন্তর্ভুক্তিকরণ?
‘বনকাপালিক’ কবিতার উদ্ধৃতি :
চিরল পাতা বেয়ে চুইয়ে পড়া বিকেলের ক্লান্ত রোদের নৈঃশব্দ্য। হয়তো তা তোমার ভিজে কাপড়ের কবিতার
শিল্পসম্মত অনুপ্রাস।
উপর্যুক্ত ভাব-প্রামাণ্য নিরুপম ‘নৈঃশব্দ্য’-সংজ্ঞাপনেরই প্রামাণ্য। মূলত, ইতিহাস-সুস্মিত বাণীময় উপসংহারই মানবিক স্থিতিকে আহ্বান করে। শিল্পসংগত কবিতাশ্রীকেও সংবর্ধিত করে। কবি শৈলজানন্দ’র অন্তরায়তনে শিষ্ট মনন-বিধৃতির শৈল্পিক শক্তি আর অন্তর্দহন, যা আয়ু-উজ্জ্বলও বটে।

কবিতাময় দর্শন-বিন্যাস:
দর্শন এবং কবিতাজ্যোতির সমান্তরাল অভিক্ষেপ ‘ভ্রান্তি অথবা প্রপঞ্চ’ কবিতাটি। প্রাক্তন উপভোগ-সংক্রান্ত এবং উপসংহার-পোষিত অনুভাবনাই প্রকটিত কবির এ কবিতায়।
শৈলজানন্দ’র শিল্পকৌশল নিঃশব্দ-মগ্নতায় সঞ্চয়িত। তার কবিতায় আত্মঃনিঃশেষণ আর অনুভবের সংজ্ঞায়ন প্রক্রিয়াস্থ হয় বাণী-রূপ-কল্পিত উপসংহারে। ‘জৈবনিক ভারসাম্য’ই তো মূলবৃত্তি। তা বস্তুনিষ্ঠ সুশোভন-প্রক্রিয়াই হয় শিল্পশুদ্ধির পাথেয়। ‘সুইসাইড নোট’ কবিতার উদ্ধৃতি :
জীবন তো নিরন্তর মৃত্যুসংশয়ময়- একাকী হাঁসপাখি অসময়ে উড়ে যেতে চায়।
অমৃতের আরাধনা আর পর্যবেক্ষণী কবিতালাপ অপরূপ শৈলজানন্দ’র
‘¯œানান্তর’ কবিতায়! মনোমগ্নতা এবং অনুভবধৃতির সম্মোহন কবির বাক্য-সম্বোধির উপাদানরূপে স্বীকৃত হয়েছে। কবির রূপমগ্নতা, ধী-প্রবৃদ্ধি একাকার তার কবিতায়।
বিশুদ্ধ কবিতালাপ :
চোখে নদী আঁকা পড়ন্ত বিকাল, তীরান্ধ নাবিক বিদিশা পাল। কতোটা রৌদ্রময় কতোটা অধিকতর নত হওয়া ছায়ার
পরিক্রমার প্রবোধ।
বস্তুতঃ শৈলজানন্দ’র মননে অপরূপ উৎপ্রেক্ষা-উপমার অনায়াস-লব্ধ বিন্যাস! অনুভব-ক্রীড়ামোদ তাঁর নৈর্ব্যক্তিক আয়ুষ্মান আলপনায়। ‘রাত্রিকালীন’ কবিতার মর্মার্থদ্যোতনা এমনই।
‘ঘর-সংসার’ কবিতায় কবির উচ্চারণ :
একদিন কবিতার পৃথিবী হবে শুনে সাধ হয়- সেই পৃথিবীর এক কোণে সন্ন্যাস ভেঙে সংসারী হবো। কে-না জানে,
সংসার সুখের হয় কবিতার গুণে!
নির্মেদ মনের নিরুপদ্রব সৌরভ! মানবিক তৃষ্ণাপূরণী সংসারী শিল্পের জয়যাত্রা। মূলতঃই কবির বাসনা-আয়োজনে ইহকালমগ্ন পূর্ণসুখেরই অভিযোজনা। পরাবাস্তবতার অভিষেক কবিতা-সন্নিহিতিরই সত্যায়ত উপচার।

অনুভব-বিভূতির শিল্পায়ন:
কবি শৈলজানন্দ’র গদ্য-সংবৃতি অনুপম অনুভব-বিভূতিকেই সংহত করতে সক্ষম। অনুপম তার শিল্পায়ন! তার বাসনাকান্তি কবিতার আলপনাকেই অপরূপ করেছে। ‘ইচ্ছাবরণ’ কবিতায় তার উচ্চারণ :
ইচ্ছামৃত্যুর পরিবর্তে আমি শুধু শঙ্খচিল হতে চেয়েছিলাম, যাতে খুব উপর থেকে বৃষ্টি ও বর্ষাকাল দুটোই দেখা যায়।
শৈলজানন্দ ‘শুদ্ধতা’র জন্য অনন্য আবাহনে মগ্ন। কবি ‘নৈঃশব্দ্য’-মুগ্ধতায় ধ্যানী হয়ে জীবন-অভিজ্ঞতার আলপনায় আত্মস্থ। বিনীত প্রকাশ-বিন্যাস তার। ‘উড়ে যাবার কথা’ কবিতায় তার নিসর্গ-আবরণ আর মানবিক চেতনা একাকার। কবির প্রেমানুরাগ নন্দিত শব্দ-আহরণে ব্যাপৃত।
শৈলজানন্দ’র কবিত্বে সুতীব্র ধী-জ্যোতির পরিসর! তার সৃজনপটে জীবনবৈধানিক পুষ্টি আর কল্যাণকামী হৃদয়-প্রাবল্যের রঞ্জিত উদ্দীপনা। দর্শন-সঞ্চয়ন-প্রক্রিয়াও বিধৃত। ‘ভ্রমণাত্মক’ কবিতায় কবির কথা :
অন্তরে অসুখ নিয়ে শুধুমাত্র পরিক্রমার আকাক্সক্ষায় ভোরের বৈদ্যবাড়ি যায় ?
অন্তরাশ্রয়ী সুন্দরের বিহ্বল মুগ্ধতায় ভরা ‘বকুল ঝরার দিন’ কবিতাটি। প্রেমালোকিত অদ্বৈত-দ্বৈত লীলাময় ক্রন্দনের বিস্তারণ-ব্যবস্থাপনা- ফাগুন-অস্থির মিলনাকাক্সক্ষার শিল্পরূপও এ কবিতা। অপরূপ ব্যথাতুর নয়নজলের আলপনা :
ফাগুনের চোখের পাতায় ভ্রান্ত কাজল ছিলো। তার উপর যে জল গড়িয়ে পড়া তার ধারা ভুল দিশায় পথহারা হয়ে
আনমনা! যেমন মাঝে মাঝে কিছু জল আচমকা অশ্রæকণা!
শিল্পানুগ প্রকৃতি-বিভূতি বাস্তব অনুকৃতি আর অনুসৃতির পুলকিত রূপমা এক পর্যায়ে পরাবাস্তবতার দুর্লঙ্ঘ্য প্রত্যয়কেই ব্যবহার করে। ‘দ্বৈততা’ কবিতায় সত্যমগ্ন কবির ভাবমগ্নতার সমুদ্দীপ্তি :
মন সর্বদা প্রকৃতির অনুগামী হতে চায়, অথচ সে ভালোবাসে অতিপ্রাকৃতি। বাস্তবতা মানুষের স্বভাব, কিন্তু সে ঝুঁকে
থাকে পরাবাস্তবতায়!
ভাব-সুষম সার্বভৌম মানবিক সোহাগ এবং কাল-¯িœগ্ধতার অভ্যন্তরীণ রসায়ন অবলীলায় শিল্পমগ্ন হয়েছে শৈলজানন্দ’র কবিতালাপে। মানবজীবনধারা এবং নিসর্গপ্রতিমা একাকার-মহিমায় রূপলব্ধ হয়েছে। অন্তরকৃষ্টির অভিযোজনা এবং পুষ্পশ্রীমান সবুজ ধারণ করেছে দিশা-সংবর্ত-লাবণ্যকে! ‘ঘুড়ি’ কবিতায় কবির কথা :
জলের আয়নায় আঁকা ছিলো ভ্রান্ত প্রতিবিম্ব- প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস আর ভবিষ্যতের পরিবর্তে ভেসে ওঠা দরজার
ওপারের পরকাল।

শিল্পমগ্নতার আভরণ:
অব্যর্থ সুশ্যামলিম প্রেমসঞ্জীব অভিব্যক্তিতে ভরা শৈলজানন্দ’র কবিতা। গদ্যায়ত ভাব-অভিনিবেশ, জীবনতত্ত্ব-নিরীক্ষার পটভূমি আর আয়াসলব্ধ শিল্পযোজনা কবির সৃজন-বিস্তৃতির আদৃত-উপাদান। বস্তুতই আত্মদর্শন আর স্থিত অভিনিবেশ তার কবিতাগ্রন্থনার রূপাঞ্জন! তার মর্মবৃত্তায়ত সংসারে সর্বজনীন আত্মিক ‘প্রতœ’-অভিসার! ‘অবহেলিত’ কবিতায় কবির উচ্চারণ :
সমস্যা হলো অবহেলাকে পার্টস অব স্পিস-এর আদলে ভাঙতে গেলেই অভ্যন্তরে কোথায় যেন টুকরো টুকরো
ভালোবাসা এসে ঝামেলা করে- অনেকক্ষণ খুঁড়ে খুঁড়ে ক্লান্ত হবার পর পাওয়া গেলো প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন।
মৃত্যু আর জীবন¯িœগ্ধ অনুভব-সংবৃতি শৈলজানন্দ’র কৃতিতে সংবৃত। তার মৃত্যুচিন্তাবিষয়ক বিবৃতি সরল ও শ্রীমণ্ডিত। সংহত তার বিবৃতি। ‘অভিবাসন’ কবিতায় তার প্রামাণ্য :
শবদেহ বেঁচে থাকার জন্য অভিবাসন চেয়ে হাহাকার করে। … তিউনিশিয়ার ভূমধ্যসাগরে কিংবা জলান্তরে
অন্য কোথাও। একবার ডাঙায় একবার জলে এই দ্বৈত মৃত্যুর কবলে … মৃত্যুনিয়তি। … দূরে … মায়ের চোখের
জল আর বুকভরা দীর্ঘশ্বাসে ভিজে যাচ্ছে অপ্রেষ্য বাতাস।
শৈলজানন্দ’র কবিতা নিবিড় উপমা-আলেখ্যায়ন এবং শেষপর্যন্ত তুমুল যুক্তিবাদী, আধুনিক এবং নৈঃশব্দ্যময়। শব্দযাদুকর এই কবির কবিতায় মিশে আছে গভীর রসবোধ, অভিনবত্ব এবং ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার মত নতুন এক মরমী অতসী কাচ। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি যা দিয়ে অবাস্তব বিষয়কে মনোমুগ্ধকর বাস্তব করে তোলার যাদুকরী দক্ষতা তাকে আলাদা করেছে। তার মেধা, কাব্যময়তা ও প্রগতিমনন ছড়িয়ে পড়–ক সবখানে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়