শাহজালাল বিমানবন্দর : যাত্রীদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

রক্তস্বল্পতা এক নীরব সমস্যা : অপুষ্টিজনিত এ রোগ থেকে হতে পারে জটিল রোগ > নারী ও শিশুরাই ভুগছে বেশি

পরের সংবাদ

অনল

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা- এই কথাই ছিল কাজ নেয়ার সময়। মিনতিও সানন্দেই রাজি হয়েছিল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সারাদিন কাজ করার চাইতে দুই হাজার টাকা কম পেলেও এক বাসায় সারাদিন কাজ করা অনেক ভালো।
মিনতির স্বামী ইয়াসিন অবশ্য রাগ করেছিল। দুই হাজার টাকা কি কম!
ইয়াসিন রিকশা চালায়। একসময় তাগড়া জোয়ান ছিল। মুহূর্তেই উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারত গন্তব্যে। কিন্তু করোনা থেকে সেরে ওঠার পর দম কমে গেছে। অমন লম্বা চওড়া লোকটাকে দেখে একটা ভাঙা কাকতাড়–য়ার মতো মনে হয়। একটা ক্ষ্যাপ নামানোর পর আধঘণ্টা বিশ্রাম লাগে। আগে যেখানে মালিকের রোজ দেয়ার পরও হাতে হাজার বারশ টাকা থাকত এখন শত চেষ্টা করেও ছয় সাতশর বেশি আয় হয় না। হবে কীভাবে? শরীর তো চলেই না।
দুটো বাড়ি থেকে ছাড়াই হয়ে মিনতি তখন দিশেহারা। তিনকন্যা এক পুত্র নিয়ে কাদেরাবাদ বস্তিতে একটা ঘর ভাড়া, কমন টয়লেট, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল সমেত প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা গুণতে হয়। মেয়ে তিনটাই স্কুলে যায় এইট, সিক্স আর ফোর। ছেলেটা ছোট হামা দেয় মোটে। মিনতি ছোটটাকে নিয়েই কাজের বাড়ি যেত। এক বাড়ির কাজ শেষ করে তুফান বেগে ছুটত আরেক বাড়িতে। তার কাজকর্ম পরিষ্কার। খুব একটা কামাইও দেয় না। কিন্তু সমস্যা একটাই। বাসার নিচে সিঁড়ির গোড়ায় রেখে আসা বাচ্চাটাকে কিছুক্ষণ পর পর দেখতে যায়। ছোট বাচ্চা, ধনী-গরিব বোঝার বয়স হয়নি। ঘরে ঢোকালে এটা ওটা ঘাটে। হামা দিয়ে এর তার ঘরে চলে যায়। একদিন তো সাবিলার ঘরে গিয়ে বিছানায় উঠে শুয়েছিল! সেই নিয়ে ভয়ানক তুলকালাম। চাকর বাকর ফকিন্নির বাচ্চা বিছানায় উঠল কেন? মিনতি যতই ক্ষমা চায়, বাচ্চা মানুষ বোঝে নাই কোনটা উচিত বা অনুচিত, তবু কেউ শোনে না তার কথা। সেই বাসায় ওই দিনই তার শেষ দিন। এক সপ্তাহ পরে এসে পাওনা নিয়ে যেও বলে কাজ ছাড়িয়ে দিল বাড়ির মালিক। আর কী কপাল এর সপ্তাহ না যেতেই দ্বিতীয় বাসার কাজটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। বিদেশ থেকে নাকি দামি একটা ঘড়ি পাঠিয়েছিল কে! মিনতি সিঁড়ির নিচে রেখে আসা বাচ্চাকে দেখতে বারবার নামে। কাজেই ঘড়ি চুরির দায় পড়ল মিনতির ওপর। বকাবকি, পুলিশের ভয় সব দেখিয়েও যখন মিনতি স্বীকার করল না সে ঘড়ি নিয়েছে তখন তারা আর তাকে কাজে রাখল না।
দুটো বড় কাজ হারিয়ে মিনতির তখন দিশেহারা দশা। ইয়াসিন মাত্র অসুখ থেকে উঠেছে। রিকশা তেমন টানতে পারে না। শরীর কাঁপে। ডাক্তার বলেছে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতে তো নুন ভাতই জোটে না ভালো খাবার পাবে কই। এক মাসেই জমা টাকা ভেঙে খেয়ে রাস্তায় নামার অবস্থা। ঘর ভাড়া বাকি পড়লে তো আর রক্ষা থাকবে না। দিনে একবেলা কোনোমতে খাবার জোটে। তাও ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা বা মরিচ ভর্তা। সঙ্গে কলাইর ডাল কিংবা তেঁতুল ঘুঁটে টক। ঐ এক জিনিস আর কত রোচে মুখে? ছেলেমেয়েরা কাঁদে। ইয়াসিন অসুস্থ, বাচ্চাদের এসব তার সহ্য হয় না। এক একদিন খিস্তি করে বেরিয়ে যায়, এক এক দিন বাচ্চাদের ধরে ধুমাধুম কিলাতে শুরু করে।
মিনতির হাতে তখন কেবল একটা কাজ। এক বাড়ির ছাদ আর সিঁড়ি ঝাড়পোঁছ করা আর কাপড় ধোয়া। আর শুকনো কাপড় সপ্তাহে একদিন লন্ড্রিতে দিয়ে আসা। দুহাজার টাকা মাস শেষে।
জীবন বুঝি আর বাঁচে না।
ঠিক সেই সময় এই বাসাটায় কাজ জুটে গেল মিনতির। মোড়ের দোকান থেকে আধা কেজি আলু কিনে ফিরছিল। ঠিক তখুনি ফ্যাশনদুরস্ত মাঝ বয়সি এক সুন্দরী ডাক দিল, শোনো-
গলার স্বরেই কেমন কর্তৃত্ব। ঘুরে না দাঁড়িয়ে পারল না মিনতি।
তুমি বাসায় কাজ কর?
জি।
এরপর মহিলা টুকটাক কিছু প্রশ্ন করে মিনতির মোটামুটি পরিচয় জেনে নিয়ে বলল, কাল সকাল ৮টায় তোমার এনআইডি, এনআইডি বোঝ তো? জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আমার বাসায় আসবা। মুবিন বাসার এড্রেসটা ওকে লিখে দাও তো।
মুবিন বলে ভদ্রমহিলা যাকে ডাক দিলেন সে গাড়ির ড্রাইভার। মহিলার কণ্ঠ থেকে বাক্যটি ঝরে পড়ার আগেই সে জি ম্যাম, জি ম্যাম- বলতে বলতে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিল।
সেই তো শুরু। বিশাল বাড়ি। দশ তলা বিল্ডিংয়ের অষ্টম তলায় থাকেন নুসাইবা আরেফিন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বড় চাকরি করে। তিনটে বাচ্চা একদম সাহেবদের বাচ্চার মতো। ইংরেজিতে কথা বলে। হাঁটা চলা পোশাক আশাক ও ইংরেজদের মতো। এ বাসায় একজন বাঁধা মহিলা আছে। সে-ই সব কাজ দেখাশোনা করে। মিনতির কাজ তিন বেলা রান্না, স্যার ম্যাডামের লাঞ্চ বক্স তৈরি। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, বাচ্চারা বাসায় ফিরে যা খেতে চাইবে সেই মতো নাস্তা বানিয়ে দেয়া। মাসে বারো হাজার টাকা বেতন। কিন্তু শর্ত হলো কাজে কামাই দেয়া যাবে না আর বাচ্চাকাচ্চা সঙ্গে আনা যাবে না।
বাচ্চা কাচ্চা সঙ্গে না আনলে তার দেড় বছরের নাবিল কই থাকবে? ঐ বাচ্চাকে সে রেখে আসবে কার কাছে?
ইয়াসিনকে বলতেই বুদ্ধি মিলে গেল। মিনতি সবার আগে বের হয় বাসা থেকে আর ইয়াসিন সবার পরে। ইয়াসিন বলল, সে বেরোবার আগে খাটের পায়ার সঙ্গে নাবিলের পা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যাবে। হাতের কাছে পানি খাবার রেখে যাবে। ছোট মেয়ের স্কুল তো ১২টায় ছুটি হয়েই যায়। সে বাসায় ফিরে ভাইকে মুক্ত করে দুজনে মিলে খেলাধুলা করবে, খাবে।
বাচ্চাকে বেঁধে রেখে যেতে প্রথমে মন চায় না মিনতির। বুক ভেঙে আসে। কিন্তু পেটের দায় অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো নাই। মিনতিকেও এ ব্যবস্থা মেনে নিতেই হয়। যতই যা হোক সকাল ৭টার মধ্যে আসা চাই এবং কাজ থাকুক আর না থাকুক সন্ধ্যা ৭টা বাজার আগে যাওয়ার সুযোগ নাই।
কাজের ফাঁকে প্রচুর অবসর পায় মিনতি। তখন রান্না ঘরের পেছনের বারান্দায় বসে নাবিলের কথা ভাবে। আহা ছোট মেয়েটা এসে ভাইয়ের পায়ের বান্ধন খুলছে তো? ছোটটা দুষ্টু আছে। কথাটথাও কম শুনে। নাবিলের জন্য কলা বিস্কিট কেক চিপস যেদিন যেটা পারে রেখে আসে মিনতি। ভয় হয় ছোট মেয়েটা না আবার একাই সব খেয়ে ফেলে!
মিনতি এই শহরেই বড় হয়েছে। কিন্তু শহুরে মেয়েদের মতো চালাক চতুর হতে পারে নাই। ওর ক্ষীণ মনে পড়ে কোন দূরে কোন একটা জল টলমল নদীর পাড়ে কলাগাছ ঘেরা একটা বাড়ি ছিল। সাদা উঠোনে মুরগি চড়ে বেড়াত। ধূসর একটা গাই গরুকে টানতে টানতে মাঠে নিয়ে যেত মা। মনে পড়ে একটা মস্তো বাগানের জামগাছে লবণ মরিচ নিয়ে দল বেঁধে উঠে পড়ত জাম খেতে। ঠা ঠা রোদ জ্বলা দুপুরে পুকুরের সবুজ জলে পাড় থেকে ঝপাৎ ঝপাৎ লাফিয়ে পড়ার সুখ! কিন্তু সেইসব দিন হারিয়ে গেল। মনু কাকাকে খুনের দায়ে বাবাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল।
মনু কাকা মিনতিদের বড্ড আদর করত। হাটে গেলে চিনির মিঠাই, তিলের খাজা নয়ত শম্ভুর আচার কিছু না কিছু আনতই। কতদিন উঠানে পাটি পেতে মনু কাকার সঙ্গে একসঙ্গে ভাত খেয়েছে মিনতিরা। কত জোছনা রাত মিনতিদের বাড়ির উঠোনে বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঘুমিয়ে পড়েছে মনু কাকা এমন নয় যে তার ঘর বাড়ি ছিল না। ঘর বাড়ি বাপ মা ভাই বোন সবই ছিল। বিয়ে করেনি তখনও। স্বভাবটা বাউণ্ডুলে। লোকে পাগলা মনু বলত। সেই মনু কাকার গলাকাটা লাশ পাওয়া গেল এক আষাঢ়ে সন্ধ্যায়। প্রবল বৃষ্টিপাতের মাঝে। ঘোষ বাড়ির ছাড়া ভিটায় ধুনচির বনে।
খুনের দায়ে বাবা ধরা পড়ার পর অভাব নামতে শুরু করল। একসময় গ্রাম ছাড়ল মা। মিনতি আর তার দুই ভাইকে নিয়ে।
মনুচাচাকে বাবা কেন খুন করেছিল? আর বাবা যদি খুন নাই করে থাকে তবে বাবাকে পুলিশে ধরল কেন? ছোটবেলা না বুঝলেও বড় হতে হতে আস্তে আস্তে অনেক সম্ভাবনা জেগে উঠত মিনতির মনে। কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করত মা কে।
কিন্তু কী একটা শঙ্কা গলার কাছে চেপে ধরত। চুপ থাকত মিনতি।
সেই যে শহরে আসা, শহরের প্রতি পদে ভয়ানক সব অভিজ্ঞতা মিনতিকে ভীতু থেকে আরো ভীতু করে তুলেছে। এই শহরটা গত ২০ বছরে যতটা না পাল্টিয়েছে মিনতির মনে হয় এ শহরের মানুষগুলো প্রতিদিন তারচে বেশি পাল্টায়।
অবসরে একা একা কত কথা মনে পড়ে মিনতির। তার মধ্যে দেড় বছরের নাবিলটার কান্না কানে আসে। আম্মু কাইলকা আব্বুরে না কইরা যাইও আমারে যেন বান্ধে না। আমি পা এ দুক্কু পাই- বলে সে তার ছোট্ট পা টা মায়ের কোলে তুলে দেয়। দড়ির লাল দাগ। মিনতি চোখ মুছে বলে, বলমু বাবা। বলে লাল দাগটায় চুমু দিয়ে বলে আমার বাপের আর দুক্কু নাই। আবার চুমু দেয়, আবার বলে, আমার বাপের আর দুক্কু নাই। নাবিল খিল খিল করে হাসে। মিনতির বুকটা হালকা হয়।
মাস দুয়েক হয়ে গেছে। চলে যাচ্ছে দিন। পোচ ডিমের কুসুম গলে যাওয়া, রুটি মোটা হওয়ার কারণে টুকটাক বকা খাওয়া ছাড়া আর কোনো সমস্যা নাই মিনতির। দুপুরে এখানেই খায়। ভালো ভালো তরকারি। মিনতির গলা দিয়ে নামে না। ছেলেমেয়ে স্বামীর কথা মনে পড়ে। একদিন ও বলেছিল তরকারিগুলো বাসায় নিয়ে যেতে চায়। অনুমতি পায়নি। ওর খাবার ওকে এখানেই খেতে হবে তা না হলে অভুক্ত পেটে কাজ করবে কীভাবে?
সেদিন দুপুর পেরিয়েছে। জুম্মাবার। বাসায় গেস্টও আছে। ভালো ভালো সব রান্না হয়েছে। বাড়ির মালকিন নুসাইবা নিজ হাতে রান্না করছেন। স্কার্ট টপস পরা পনি টেল করা নুসাইবাকে দেখে কলেজে পড়া মেয়ে মনে হচ্ছে। বয়সে মিনতিরই মতো কিংবা একটু বড় হবে। অথচ তার পাশে মিনতিকে পঞ্চাশের বুড়ি দেখাচ্ছে। মিনতি মুগ্ধ চোখে নুসাইবাকে দেখে আর কাজে সাহায্য করছে।
রান্নাবান্না শেষে দুইটা বক্সে খাবার ভরে নুসাইবা বললেন মিনতি আজ তোমার খাবারটা নিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাও।
ম্যাডাম, এত খাওন!—মিনতির কণ্ঠ দিয়ে আর কথা বেরোয় না।
নুসাইবা মৃদু হেসে বলেন, আমরা বিকালে বাসায় থাকব না। আর তুমি বাসার সবাইকে নিয়ে খাবে তাই একটু বেশি দিয়েছি। এখন যাও। কাল সকালে ঠিক সময়ে চলে এসো।
নুসাইবাকে মানুষ নয় ফেরেশতা মনে হয় মিনতির। বাসা থেকে দ্রুত রাস্তায় নেমে আসে, মনে মনে ভাবে মহিলাটাকে কত রাগি আর দেমাগি ভাবছিলাম। কিন্তু তার মনটা তো আল্লার এই আসমানের লাহান বড়। না হইলে রান্না কইরা নিজেদের আগে কেউ কাজের মানুষের লাইগা খাওয়া সাজায়! মিনতির চোখের কোণে পানি জমে ওঠে। ঠিক ঐ সময় দেখে দূর থেকে মেজো মেয়েটা দৌড়ে আসছে।
মানে কী? ভ্রæ কুঁচকে ওঠে মিনতির। ফারহানা এমন দৌড়াইয়া যায় কই?
জোরে কন্যার নাম ধরে ডাক দেয় মিনতি। ততক্ষণে ফারহানাও কাছাকাছি চলে এসেছে, আম্মা তাড়াতাড়ি বাসাত লও। —বলে ফারহানা কাঁদতে থাকে। মেয়ের সঙ্গে প্রায় দৌড়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনতি জানতে পারে বস্তিতে আগুন লেগেছে।
দিনের বেলা হওয়ায় খুব বেশি ঘর পুড়তে পারে নাই। লোকজন দ্রুত আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছে। তবুও মিনতিদের ঘরসহ আরও কিছু ঘর আগুনের তাণ্ডবে ধসে পুড়ে একাকার হয়ে গেছে। স্কুল ছুটি না হওয়ায় দীপিকা বাসায় ফেরে নাই বলে ঘরে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখা নাবিলকে মুক্ত করা হয়নি।
বস্তির সামনে দুই বক্স ভালো ভালো খাওয়া হাতে মিনতি দাঁড়িয়ে, হতবাক। এখানে ওখানে তখনও পোড়া ছাইয়ের স্তূপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়