প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা : রাখী দাশ পুরকায়স্থ ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক

আগের সংবাদ

বধ্যভূমি দেখার দায়িত্ব কার : সারাদেশে ৫ হাজারের বেশি বধ্যভূমি, ২২ বছরে ২০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ হয়েছে

পরের সংবাদ

প্রভাত কিংবা প্রহেলিকা

প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লাশের মুখের উপর এক খাবলা মাটি পড়তেই যেন ডান হাতটা নড়ে উঠেছিল। হাত মানে আঙুল। কনিষ্ঠা, কিংবা অনামিকা, নাকি দুটোই? ঠিক মনে পড়ছে না। আসলে নড়েছিল কি? তখনতো কিছু চোখে পড়েনি। তিনটা লোক মিলে গর্ত করলাম। কবরের জন্য গর্ত। কয়েকদিন ধরেই করছি। আমার জাত ভাইদের ধরে ধরে এনে দাঁড় করায় পাকিস্তানি জল্লাদের দল। অত্যাচার, নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত একেকটা মূর্তি। দাঁড়িয়ে থাকে সৌধের মতো। ওরা গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয় বুক। আর আমাদের তৈরি করে রাখা গর্তে আমরাই এক এক করে ফেলতে থাকি বাঙালি স্বজনদের। কোদালে করে মাটি ফেলি মুখে, শরীরে। সমতল জমিতে জন্ম নেয় ঢিবি। ঝুপঝুপ শব্দ হয় মাটির সঙ্গে মাটির দেহের ঘর্ষণে। এর মধ্যে কেউ যদি হাত নাড়ায় চোখে পড়ে কী করে?
ভাদ্র মাস। সাভারের এই বস্তিটা এমনিতেই গুমোট হয়ে থাকে। ঘুম আসতে চায় না। চারদিকে যুদ্ধ, মৃত্যু, লাশ, কবর। এত কবর খুঁড়িনি এই জন্মে। আর এখন খুঁড়তে হচ্ছে গণকবর। মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমার নিজের কবরে মাটি পাবো কি? মরব কীভাবে আমি? পিটিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারবে আমাকে? সুপুরি কাটার মতো করে একটা একটা আঙুল কেটে, চোখ খুঁচিয়ে, হাত-পা ভেঙে ফেলে রাখবে আমাকে? পরে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাব? নাকি নির্যাতন থেকে বাঁচতে গলায় ফাঁস দিয়ে লটকে পড়ব নিজেই? ক্যাম্পে আটকে রাখা নির্যাতিতা সেই মেয়েগুলোর মতো? অথবা একদিন মাঝরাতে সারা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবে বা বোমা মারবে? ঝলসানো মাংসপিণ্ড হয়ে চলে যাব পরপারে? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা আছে পূর্ব পাকিস্তান নামের হাবিয়ায়? মরার পর ভাগাভাগি করে কোনো এক গণকবরে ফেলে দেবে? নাকি নদীর পাশে দাঁড় করিয়ে লাশ ফেলে দেবে জলে? নাকি পুড়িয়ে মারবে? কত হিন্দু যেমন গণকবরে সমাহিত হচ্ছে, আমার লাশও চলে যাবে শ্মশানে, মহাশ্মশানে। দাঁও দাঁও করে জ্বলবে এই দেহ। সেই আগুনের উত্তাপে দুই চোখের পাতা এক হয় না আজকাল।
‘নেকবর ভাই, ঘুমাইছ নাকি? ও, নেকবর ভাই’।
ফজরের আগে আগে বোধহয় তন্দ্রামত এসেছিল। খলিল মিয়ার ডাকে বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে।
‘কী অইছে? ডাকো ক্যান এই মাঝরাইতে’।
‘রাইত কই? আজান পড়ব এহন’ই। বাইরে আসো। কাম আছে’।
অনুমিত একটা উদ্বেগ নিয়ে বের হই। পা কাঁপছে আমার।
‘কী, কও মিয়া’?
‘গায়ে একটা কিছু পইরা লও। শাউনা আইছিল। ডাক পড়ছে। ক্যাম্পে যাইতে হবে’।
‘রাজাকার শাউনা? কী কয় কুত্তার বাচ্চা’?
‘বোঝনা কী কয়? কবর খুঁড়তে হইব। জলদি আসো। নাইলে আমাগোসহ পুইতা রাখব’।
নদীর পাশেই হানাদারদের ক্যাম্প। হেঁটে যেতে লাগবে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। আজ কেন যেন পা চলছে না। মস্তিষ্কে বারবার নিড়ানি দিচ্ছে একটা ভয়ংকর ভাবনা।
এখন ঠিক মনে হচ্ছে, কালকের লাশটা শুধু আঙুলই নাড়েনি, মুখে মাটি পড়তেই যেন মুখটাও হা করেছিল। মুখে মাটি চলে গিয়েছিল? কাঁদা-কাঁদা মাটি। এই বাংলার রক্ত জল মাখা মাটি। বৃষ্টি হয়েছিল পরশু। মুখে পড়তেই থুঃথুঃ করে বের করে দিতে চাচ্ছিল। আর আমি তাকে জীবন্ত পুঁতে দিলাম?
‘কথা কওনা ক্যান, নেকবর ভাই? রাগ করছ? আমার ওপর রাগ কইরা কী লাভ? আমাগো কাম’ই গোর খোঁড়া। আমরা না করলে আরও লোক আছে। মাঝখান দিয়া জীবনটা যাইব। জল্লাদের দল কাওরে ছাইড়া কথা কয় না’।
‘জিন্দা একটা মানুষের মুখের উপর মাটি ফালাইলে পাপ হয়, খলিল? জিন্দা কবর দিলে গুনা হয় না? আহারে, লোকটা মাটি চাপা পড়ার আগে আমারে হাত নাইড়া ইশারা করছিল। কী যেন কইতে চাইছিল। এখন মনে পড়ছে, চোখ মেইলা পিটপিট তাকাইয়া ছিল লাশটা, মানে লোকটা’।
‘তোমার মাথা ঠিক আছে? কই পাইলা জিন্দা-লাশ’?
‘আরে কাইল যে কবর দিলাম। এর মধ্যে একটা জিন্দা লোকরেও আমরা মাটি চাপা দিছি। আসলেই কি একটা লোক? সব মিলায়া ছিল আঠারো জন। আমি নিজে গুনছি। মনে পড়ে’?
‘ভাই, এত লাশের কবর দিতে আমারও দুঃখ লাগে। চোখ ভাইঙ্গা কাঁন্দন আহে। কিন্তু এরকম মাথা খারাপ করলে হয়? আবোলতাবোল বকা বন্ধ করেন’।
‘না, আবোলতাবোল না। ওই লোকটার কথা ভুইলা গেছ তুমি? সাদা একটা চেক শার্ট। কালো প্যান্ট। হাতের দুই-তিনটা আঙুল মাঝখান থেকে কাটা। কালচে রক্ত জমাট বাঁধা ছিল আঙুলে। ভার্সিটি ক্যাম্পাস থেইকা নাকি ধইরা আনছিল। মনে নাই’?
খলিল নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে।
‘অবশ্য সেই ছেলেটাও হতে পারে। ঠোঁটের উপর আর থুঁতনির নিচে কয়েকটা লোম গজিয়েছে মাত্র। নাক টিপলে দুধ বের হবে। মারের চোটে একটা চোখ গলে গেছে। আর মুখে কালশিটের দাগ। এমন একটা বাচ্চাকে মেরে ফেলল হানাদারের দল। আর আমি তুমি মিলা এই নিষ্পাপ ছোকরাকে মাটির নিচে পুঁতে দিলাম’।
খলিল কী একটা বলতে যেয়ে থেমে যায়।
‘আমি মনে হয় ভুল কইলাম। ওই লোকটা না। ওর পাশেই ছিল আরেকটা উদোম লোক। হাড্ডিসার শইল। গালে দাড়ি। ছেঁড়া লুঙিটা কোনোমতে ঢাইকা রাখছিল কোমরের নিচ। লোকটা কি রিকশা চালাইত’?
‘নেকবর ভাই থামেন। ক্যাম্প সামনেই। এমনি দেরি হইয়া গ্যাছে। পা চালান’।
‘নাকি লোক না, মহিলা ছিল খলিল? আমি ঠিকমতো দেখি নাই? কেমনে দেহি কও? আমার মা, বইনরে নির্যাতন কইরা, ন্যাংটা কইরা দাঁড় করাইলে কেমনে চোখ তুলি? ইচ্ছা করে কোদালটা নিয়া পাকিস্তানি শুয়োর আর দেশি শাউনা কুত্তার গলায় কোপ মারি। কোপাইতে কোপাইতে কিমা করি। এহন মনে হইতাছে আমার কোনো এক বোনরেই আমি জিন্দা দাফন করছি কাইল। হাত নাইড়া আমারে কি যেন কইতে চাইছিল জননী’।
‘চুপ, সামনে শাউনা দাঁড়াইয়া আছে। আমাদের দিকে ইশারা করছে। আর কোনো কথা কইবা না’।
‘একটা পাঞ্জাবি পরা মুরুব্বি ছিল না কাল? রায়েরবাজার মসজিদের ইমাম? সে ছিল না’তো, খলিল? ইমাম সাব এক গøাস পানি খাইতে চাইছিল। পাছায় একটা লাথি মারছিল শাউনা। আহারে, লোকটা মনে হয় এক ফোঁটা পানির জন্য মুখটা হা করেছিল। আর আমি সীমারের বাচ্চা তারে দিলাম মাটি’।
‘ওই, হারামজাদা, এতক্ষণ লাগল ক্যান? কমান্ডার সাব তোগো লেইগা সারারাত খাঁড়াইয়া থাকব? মাগি নাড়াচাড়া করলে সাবের ঘুম পায়। মদের নেশা কাটে নাই এখনো। যে কোনো সময় গুলি শুরু হইব। আইজ লোক কাইলকার ডাবল। মাটি বড় কইরা কাটবি। আমি দেইখা আহি, মাগিটা কি আস্ত আছে, নাকি ছিঁড়া ফালাইছে’।
‘হাত চালাও নেকবর ভাই। তাড়াতাড়ি মাটি সরাও। এখন আর কোনো কথা নাই’।
‘কাইল একটা মহা অন্যায় করছি। একটা হিন্দু লোকরে কবর দিয়া ফালাইছি। ওই যে, স্কুলের হেডমাস্টার সাব। সাদা ধূতি, কালচে পৈতা। স্পষ্ট মনে পড়ছে, ‘এইটা কি করলে নেকবর মিয়া। ব্রাহ্মণ’রে গোরে দিলে? আমার ছেলে আছে তো, এখন যুদ্ধ করছে। খবর দিলেইতো এসে মুখাগ্নি করে যাবে। আবার চলে যাবে যুদ্ধে। একটা একটা করে হানাদার বধ করবে অর্জুন।’ আমার কানে যেন এখনো শুনতে পাচ্ছি, খলিল। প্রায়শ্চিত্ত আমারেই করতে হইব। কাইলকার কবরটা কই’?
আমি ছুটতে থাকি। কবরটা আমার চাই। আবার আমি মাটি খুঁড়ব। হয়তো লোকটা এখনো মরেনি। হয়তো বুকের ঠিক মাঝখানটায় জোরে একটা চাপ দিলে, যেমন দেয় হাসপাতালে চিকিৎসকরা, আমি দেখেছিলাম একবার, সেবারের মতো মরাপ্রায় একলোক একটা হাঁফ ছেড়ে আবার শ্বাস নিতে শুরু করবে। একজনই কি বেঁচে আছে? একজন যদি ইশারা করে আর আমি খেয়াল না করি, তাহলে কি এটা সম্ভব নয়, হয়তো আরও অনেকেই আঙুল নেড়েছিল, বাঁচতে চেয়েছিল, আর আমি অন্ধের মতো মাটি ফেলে ঢেকে দিয়েছি ওদের? কিংবা কবরের প্রতিটি লোকই জীবন নিয়ে, হৃৎপিণ্ডে ধুকধুক নিয়ে, ফুসফুসে শ্বাস নিয়ে পড়ে ছিল। সবক’টা কবরের সব বাঙালি এখনও বেঁচে আছে হয়তো। মাটি খুঁড়ে নাড়া দিলেই জেগে উঠবে আবার। এত্ত সহজ, বাঙালিকে মাটিতে পুঁতে ফেলা?
বিশাল বড় এই মাঠ। জায়গায় জায়গায় সবুজ চিড়ে মাটির ঢিবি। একটা ঢিবি মানে একটা গণকবর। সবুজ এই বাঙলাতে এখন অগুনতি লাশ, অগুনতি গণকবর। ঢিবি আর ঢিবি। এখানে ঢিবি অসংখ্য। কালকের কবরটা আমি কোথায় পাই? ওদিকে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে কমান্ডার। তাকে ডেকে এনেছে হতবিহবল শানু রাজাকার। খলিল মিয়া কাঁপছে ভয়ে। সুবহে সাদিকের মৃদু আলোয় সবাই দেখছে একটা লোক দৌড়াচ্ছে কবর থেকে কবরে। হাত দিয়ে মাটি তুলছে খাবলা খাবলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এসে লোকটাসহ কবরগুলো করে দিচ্ছে সিক্ত।
কমান্ডারের নেশা ছুটে গেছে। ব্যাপারটা আর খেলো কিংবা কৌতুকের মতো নেই। তার চোখের সামনে ছুটছে একজন বাঙালি, একজন মুক্তি, একজন বিপ্লবী। বিপ্লবকে চিরদিনের ভয় এই শোষকদের। ঘামে কমান্ডারের উর্দি ভিজতে থাকে। তলপেটে চাপ বাড়তে থাকে। চাপ কমাতে একটা রাইফেল উঠে আসে তার হাতে। নিশানা তাক করে ট্রিগারে আঙুল চাপার চেষ্টা করেন। পাখি মারার মতো করে বাঙালি মারতে হয়, এই দীক্ষায় দীক্ষিত সে। কাজটায় সে পাকা হয়ে গেছে এতদিনে।
যদিও আজ এই প্রভাতে এই বধ্যভূমিতে জীবনে প্রথম আঙুল কাঁপছে তার। অবাক, দুর্বোধ্য এক প্রহেলিকায় আটকে যাচ্ছে সে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়