সিপিডির সংবাদ সম্মেলন : নবায়নযোগ্য জ¦ালানি নীতি বাস্তবায়নে বড় বাধা দুর্নীতি

আগের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্মার্ট বাংলাদেশ : মতিয়া চৌধুরী, সংসদ উপনেতা

পরের সংবাদ

বধ্যভূমি দেখার দায়িত্ব কার : সারাদেশে ৫ হাজারের বেশি বধ্যভূমি, ২২ বছরে ২০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ হয়েছে

প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : গ্রামের নাম হরিহরপাড়া। বুড়িগঙ্গা নদীসংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ জেলায় এই গ্রামের ২০ হাজার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ওই গ্রামে গিয়েছিলেন মার্কিন পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর প্রতিনিধি লুই এম সাইমনস। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে তার প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি তুলে ধরেন একাত্তরের নির্মমতা। তিনি লেখেন, হরিহরপাড়া গ্রামের পাশাপাশি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থান থেকেও বাঙালিদের ধরে এনে পেছনে হাতবাঁধা অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের আগের দিন ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই হরিহরপাড়ায় অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সুকুমার বিশ্বাসের একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর গ্রন্থ অনুযায়ী, প্রতিবেদক যখন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এ প্রতিবেদন পাঠান, তখনো গ্রামটি ছিল জনবসতিশূন্য। অথচ বর্তমান প্রজন্মের কেউ হরিহরপাড়ায় গণহত্যা বা বধ্যভূমি সম্পর্কে জানে না। কারণ হরিহরপাড়া গ্রামে বধ্যভূমির অস্তিত্বই নেই।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়টি দাঁড়িয়ে আছে বহু শহীদের রক্তে রঞ্জিত গল্লামারী বধ্যভূমির ওপর। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে গল্লামারী এলাকায় একাধিকবার গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের লেখক সুকুমার বিশ্বাস। একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর বইতে লিখেছেন, সেদিন গল্লামারীর বিস্তীর্ণ এলাকার যে বীভৎস রূপ দেখেছিলাম, তা আজ আর আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মানব ইতিহাসের করুণতম দৃশ্য যেন আর কোনো মানব সন্তানকে দেখতে না হয়। শুধু গল্লামারীই নয়, একাত্তরে সারাদেশের মতোই খুলনার পথে প্রান্তরে অসংখ্য নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি বানিয়েছিল পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা। ‘১৯৭১ : গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ এর উদ্যোগে ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন প্রবেশপথের পশ্চিম পাশে খুলনা-সাতক্ষীরা রোডসংলগ্ন স্থানে গণহত্যা স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন

করা হয়। ফলকটি উন্মোচন করেন গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দৈন্যদশায় পড়ে আছে ইতিহাসের নির্মম গাথা।
শুধু নারায়ণগঞ্জের হরিহরপাড়া কিংবা খুলনার গল্লামারীই নয়; সারাদেশে এমন হাজারো বধ্যভূমি অযতœ-অবহেলায় সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একসময়ে চিহ্নগুলোও থাকবে না বলে মনে করছেন গবেষকরা।
৩০ লাখ কঙ্কালের ওপর বাংলাদেশ : গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯৮০ এর দশক থেকে সারাদেশে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। ২০০১ সালে জেনোসাইড আর্কাইভ এন্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টারের ব্যানারে বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস লাইব্রেরিতে ৮৩৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেন ডা. এম এ হাসানের নেতৃত্বে ১৩ জনের একটি গবেষক দল। পরে জাতিসংঘের ৫৭তম অধিবেশনেও ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন তারা। প্রতিবেদনে সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার বধ্যভূমি এবং ৮৮টি নদীতীর ও ৬৫টি ব্রিজ চিহ্নিত করেছিলেন তারা, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত গণহত্যা চালিয়েছিল। জানতে চাইলে ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, সারাদেশে ৫ হাজারেরও বেশি বধ্যভূমি। অধিকাংশই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। ঢাকার মিরপুরে ২৩টি বধ্যভূমির মধ্যে মাত্র ১০টি চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশ সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। মিরপুরে শনাক্ত হওয়া বধ্যভূমি- শিয়ালবাড়ী, আলোকদি, মুসলিমবাজার, পল্লবীর কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুরের শিন্নিরটেক, সারেংবাড়ি, গোলারটেক পালপাড়া, বাঙলা কলেজের আমবাগান ও কল্যাণপুর বাস ডিপো। তিনি বলেন, তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কথা বলা হলেও দৃশ্যমান পরিবর্তন হচ্ছে না।
একাত্তরের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আদালতে রিট করেছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। কিন্তু এর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে পড়েনি। এ ব্যাপারে কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৯৮ সালে সরকারের নির্দেশে আমরা সাড়ে ৩ হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছিলাম। ২০০০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি। ৫ হাজারের বেশি বধ্যভূমি রয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুধু আমাদের কাজই বন্ধ করে দেয়নি, কাগজপত্রও বাতিল হয়ে যায়। বর্তমান সরকার এসে কাজটি শুরু করলে আমলাদের দায়িত্ব দেয়ার কারণে কাজটি তলানিতে ঠেকেছে। তিনি বলেন, গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা আদালতে রিট করেছিলাম। কারণ বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে ৩০ লাখ কঙ্কালের ওপর।
২২ বছরে ২০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ : আগে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওপর। ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় হওয়ার পর এই দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে। ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য চারশ ৪২ কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ৩০ জুন ২০২১। দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গত জানুয়ারির তথ্যানুযায়ী, গত ২২ বছরে ২০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। আরো ৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সব করা সময়সাপেক্ষ বলে মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে চিহ্নিত সব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয় বধ্যভূমির তালিকা তৈরি করে সংরক্ষণে কাজ শুরু করেছে। জেলা ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত।
এদিকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের ৩৮ জেলায় ৮০৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে খুলনায় স্থাপিত গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট। তাতে বধ্যভূমি, গণকবর, টর্চার সেলসহ গণত্যার অন্যান্য বিষয় নিয়ে ১৮ হাজার ৯৫৬টি স্মৃতিচিহ্ন শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি ২৬ জেলায় জরিপ শেষ হলে বধ্যভূমির সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন জাদুঘরসংশ্লিষ্টরা।
গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। সেসব গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের কথা এমনকি নির্যাতনের কথা বিজয়ের গৌরব ভাষ্যে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। গণহত্যা, বধ্যভূমি ও নির্যাতনের ইতিহাস সংরক্ষণ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। বধ্যভূমির অনেক স্থান নদনদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে। কিছু দখল হয়ে সেখানে স্থাপনাও নির্মিত হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শনাক্ত হওয়া বধ্যভূমি সংরক্ষণ সম্ভব হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রয়োজন আইন : মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আইন প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকরা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকা জাতির দুর্ভাগ্য মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো শনাক্ত করা হলেও বেশির ভাগই যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আইন হওয়া উচিত।
ডা. এম এ হাসান বলেন, যেসব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেগুলোও রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু কিছু লাভ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে দ্রুত আইন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. এম এ হাসান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়