পার্বত্য শান্তি চুক্তি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার

আগের সংবাদ

‘বাংলাদেশ বিজনেস সামিট’ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী : সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে বিদেশিদের বিনিয়োগের আহ্বান

পরের সংবাদ

উচ্চ আদালতের ‘বাংলা রায়’ প্রশাসনিক কাজে অগ্রহণযোগ্য

প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আয়েন উদ্দীন : ‘শুধু মামলার দুই পক্ষের এবং জনসাধারণের বোঝার সুবিধার্থে ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে বাংলায় এই রায়টি অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলায় অনূদিত এ রায়কে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহারিক ও সরকারি কাজে শুধু মাননীয় আদালতের প্রকাশিত ইংরেজি রায়টিকে যথার্থ বলে গণ্য করা হবে এবং রায় বাস্তবায়নের জন্য ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায়টিকেই অনুসরণ করতে হবে।’
‘বাংলাদেশ রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ (একটি নিবন্ধিত অংশীদারী ফার্ম), পক্ষে ব্যবস্থাপনা অংশীদার ইফতেখার হোসাইন বনাম দিনে আরা বেগম এবং অন্যান্য’ মামলার বাংলা রায়ের নিচে লেখা উপরের এই ‘দায়বর্জন বিবৃতি’। এ রকম দায়বর্জন বিবৃতি আছে উচ্চ আদালতের বাংলায় অনূদিত সব রায়ে। প্রশাসনিক কাজে অর্থাৎ ব্যবহারিক ও সরকারি কাজে ব্যবহার করা যাবে না বলে দায়বর্জন বিবৃতিতে যেমনটা বলা হয়েছে সেটা সংবিধান ও ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইনের পরিপন্থি বলে মনে করেন আইনজীবীরা। তাদের দাবি, বাংলাদেশের সংবিধানের মতো উভয় ভাষায় উচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশনার সার্টিফায়েড বা অবিকল কপি দিতে হবে। সেইসঙ্গে সেটা সব কাজে ব্যবহার করা যাবে বলেও নির্দেশনা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তার অর্থ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহৃত হবে, অন্য কোনো ভাষা নয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত বাংলা ভাষার প্রচলন সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ, ১৯৭৫ (রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা সংখ্যা ৩০.১২.৭৫, সাধারণ- ৭২৯/১ (৪০০) ১২ মার্চ, ১৯৭৫) -এ বলা হয়, বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন, সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারি অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে, এ বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তা ব্যক্তিগণ সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকর করবেন এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়, বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলা ভাষায় লিখিতে হইবে। এখানে বলা হয়, উপরিউক্ত আইনটি প্রণীত হয়, সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি পূর্ণরূপে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে এবং বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার অব্যাহত রাখার জন্য।
উপরোক্ত আইনের ৩ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বে-আইনি বা অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।
তাই এই দায়বর্জন বিবৃতি সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, মূল জাজমেন্টটায় (ইংরেজি ভাষা) ব্যবহার করতে হবে। ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার দিয়ে অনূদিত রায় মূল রায় নয়। এই রায় (বাংলায় অনূদিত রায়) খতিয়ান সংশোধনসহ নানা সরকারি কাজে যাবে, তখন অধিকার অর্জন করা যাবে না। বাংলা অনুবাদ সেকেন্ডারি ভার্সন। তাই ব্যবহার করা ঠিক না।
ব্যবহারিক ও সরকারি কাজে ব্যবহার উপযোগী মূল রায়ের অবিকল কপি বা অনূদিত কপি তৈরি করতে না পারাকে দুঃখজনক বলেছেন সিনিয়র আইজীবী মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের দুইটা ভার্সন আছে। দুইটাই গ্রহণযোগ্য ও রেফরেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সে রকম উচ্চ আদালতের রায় ইংরেজিতে দিলেও অফিস আদালতে গ্রহণযোগ্য হয় এমন অনুবাদ ব্যবহার করা উচিত। বাংলায় অনূদিত রায়ের নিচে এরকম দায়বর্জন বিবৃতি লেখা ভাষার প্রতি অসম্মান। আদালতের অনূদিত বাংলা রায়কেও অফিস আদালতের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু দায়বর্জন বিবৃতি দিয়ে তো বাংলা ভাষাকে কটাক্ষ করা হয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও অফিস আদালতে উচ্চ আদালতের ইংরেজি রায় ব্যবহারে বাধ্য করা সংবিধান, সংস্কৃতি ও জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং হওয়া দরকার ছিল, মূল রায় হবে বাংলায়। কোনো অফিসে দরকার হলে ইংরেজি অনুবাদ করে নিবে। এখন হয়ে গেল উল্টো।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি চালু হওয়ার সময় সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল স্বীকৃত আইনি পরিভাষার অভাব। ফৌজদারি দণ্ডবিধি, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড, সিভিল প্রসিডিউর কোড, বিস্ফোরক আইন ইত্যাদি পুরনো আইনের স্বীকৃত বাংলা অনুবাদের অভাব। এই বিষয়ে তিনি বলেন, অনুবাদের অভাব তো আছেই। সেইসঙ্গে ইংরেজিতে দেয়া অনেক নির্দেশনা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, আইনজীবীরাও বুঝতে পারে না। আরেকটি সমস্যা হলো, কিছু নির্দেশনা ও আইনি টার্ম বাংলায় ব্যাখ্যার সময় একেক আইনজীবী একেকভাবে করেন। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত একটি সর্বজনীন ব্যাখ্যা (বাংলায়) ঠিক করতে পারেন। ফলে সেটা সবাই মেনে নিবে।
এতোদিনেও বাংলা ‘রাষ্ট্রভাষা’ হয়ে ওঠেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখনো প্রশাসনিক কাজে বাংলা গ্রহণযোগ্য হয় না। এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দাবি করতে হচ্ছে রায় ও আইন বাংলায় হতে হবে, যখন বাংলা ভাষা বিশ্বের ভাষা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনো ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ হয়ে ওঠেনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়