পদ্মা সেতু : মোটরসাইকেল চলাচল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

আগের সংবাদ

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ : বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য টাইগ্রেসরা

পরের সংবাদ

সফল কৃষক আমির হোসেন : সাঘাটায় একই জমিতে ১২ প্রকার ফসল উৎপাদন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ফেরদৌস জুয়েল, গাইবান্ধা থেকে : মাত্র ৪৭ শতক জমিতে দণ্ডায়মান উন্নত জাতের আখ। একই জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেয়ারা ও পেঁপের গাছ। এসব গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মরিচ, নবরতœ কচু ও ডাটা শাক। মালটার গাছে মাটির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে হলুদ ও আদা। জমির চারদিকে দেশীয় কলার গাছ। চারদিকের চারটি আইলে দোল খাচ্ছে নেপিয়ার ঘাস। এভাবে একই জমিতে ১২ প্রকার ফসল উৎপাদন করছেন গাইবান্ধার পুটিমারি গ্রামের কৃষক আমির হোসেন। কৃষি কাজ করেই পাঁচ শতক জমি থেকে তিনি এখন ১৪ বিঘা জমির মালিক। এলাকায় তিনি কৃষিবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
সাঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় ও আমির হোসেনের পারিবারিক সূত্র জানায়, এই জমিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩০০টি উন্নত জাতের লাল বেনারশি আখের চারা রোপণ করেন। প্রতিটি আখ লম্বা হয়েছে প্রায় ১৮ থেকে ২০ ফুট। আখের ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। প্রতিটি আখ ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই জমিতে ২৭০টি উন্নত জাতের পেয়ারার চারা রোপন করেন। সারাবছর পেয়ারা বিক্রি করেছেন তিনি। এসব গাছ থেকে আগামি পাঁচ বছর ফলন পাওয়া যাবে। গত বছরের শেষের দিকে ৫০০টি মরিচ গাছ রোপণ করেন। মরিচ তোলা শুরু হয়েছে।
এই জমিতেই গত বছরের ডিসেম্বরে ৯০টি পেঁপে চারা রোপণ করেন তিনি। প্রতিটি গাছে পেঁপে ধরেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে পেঁপে তোলা শুরু হবে। প্রতিটি গাছে ২০০ থেকে ২৮০ কেজি পেঁপে পাওয়া যাবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬০০টি নবরতœ জাতের কচু (বছরে তিন বার ফলন দেয়) গাছ রোপণ করেন। কচু বিক্রি করেছেন ১৫ মন। যার মূল্য ৬০ হাজার টাকা।
তিনি বারমাসি, বারি-১, বারি-২, বারি-৪, পাঞ্জাব, ডোরাকাটা জাতের মালটার চাষ করেছেন। মালটায় বছরে প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় হবে বলে জনান। এছাড়া মালটার জমিতে ৩০০ কেজি আদা ও হলুদ লাগান। এগুলো এখন অনেকটা বড় হয়েছে। ডাটা শাকের এক কেজি বীজ ছিটিয়ে দিয়েছেন জমিতে। গত দুই মাস ধরে শাক বিক্রি করছেন। গত বছর জমির চারদিকে ৫৫০টি কলার গাছ লাগান। সেগুলো থেকে কলা পাওয়া যাচ্ছে। শতাধিক লেবু গাছ থেকে নিয়মিত লেবু তুলে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। দেড় মাস আগে চারদিকের আইলে নেপিয়ার ঘাস লাগান। ঘাস তুলে নিজের গরুকে খাওয়াচ্ছেন।
বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ১০ লাখ টাকা। এসব ফসলের চাষ করতে উৎপাদন খরচ হয়েছে ২ লাখ টাকা। বার্ষিক খরচ দুই লাখ টাকা। খরচ বাদে বার্ষিক আয় হবে ৬ লাখ টাকা। কৃষি কাজ করেই তিনি পাঁচ শতক থেকে এখন ১৪ বিঘা জমির মালিক (কেনা ও বন্ধক নেয়াসহ) হয়েছেন। অভাব আর তার দুয়ারে হানা দিতে পারে না।
সরজমিন দেখা গেছে, আমির হোসেনের কাঁধে গামছা। হাতে কাস্তে ও পরনে লুঙ্গি। তিনি ওই জমিতে ফসল পরিচর্যার কাজ করছেন। তার সঙ্গে কাজ করছেন স্ত্রী করিমনসহ দুজন মহিলা ও দুজন পুরুষ কৃষি শ্রমিক। জমিতে গুনে গুনে দেখা গেল বারটি ফসলই বিদ্যমান। জমিজুড়ে সবুজের সমারোহ। আমিরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগে তার পাঁচ শতক জমি ছিল। একই জমিতে একাধিক ফসল ফলিয়ে তিনি এখন ১৪ বিঘা জমির মালিক। সব জমিতেই কোনো না কোনো ফসল রয়েছে। সামান্য জায়গাও পরিত্যক্ত নেই। সব জমিতেই চার থেকে ১২টি পর্যন্ত ফসল রয়েছে। জমির আইলে আম, কাঁঠাল, জলপাই, লিচুসহ নানা জাতের গাছ। এমনকি আঙ্গিনা বাদে বসতভিটায় লেবু, আখ ও পেঁপের গাছ লাগিয়েছেন। বাড়িতে রয়েছে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি।
এদিকে কৃষিকাজে বিশেষ অবদানের জন্য আমির হোসেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। তাকে ক্র্স্টে ও ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়।
সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের পুটিমারি গ্রামে আমির হোসেনের (৫৪) বাড়ি। পৈতৃক সূত্রে পাঁচ শতক জমি পান। এ ছাড়া তার কোনো সম্পদ ছিল না। তাই তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। কখনো কখনো ফেরি করে সবজি বিক্রি করতেন। অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটতো। একসময় পাঁচ শতক জমিতে সবজি চাষ শুরু করেন। পরবর্তীতে কৃষি বিভাগের পরামর্শে একই জমিতে একাধিক ফসল ফলাতে থাকেন। এভাবে গত ৩০ বছর ধরে ফসল ফলিয়ে তিনি এখন ১৪ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন।
আমির হোসেনের একমাত্র ছেলে আয়নুল হক পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। বড় মেয়ে লিপি আক্তারের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে আরাফা জান্নাত অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। স্ত্রী করিমন নেছাকে নিয়ে তিন সদস্যের সংসার তার।
কৃষক আমির হোসেন বলেন, বর্তমানে কৃষি ক্ষেত্রে যেসব নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে, আমি সেসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করছি। এর ফলও পেয়েছি। আমি কোনো জমিতেই একটি ফসল করি না। শতকরা ৯০ ভাগ জৈব সার ব্যবহার করে সব জমিতেই চার থেকে ১২টি পর্যন্ত ফসল ফলাচ্ছি। তিনি বলেন, আমার মতো দেশের সব কৃষক যাতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষাবাদ করেন, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। মাসিক উঠোন বৈঠক করে অন্যান্য কৃষক ভাইদের উদ্বুদ্ধ করছি। এছাড়া তিনি সাঘাটার ভরতখালি বাজারে একটি কৃষি পরামর্শক কেন্দ্র খুলেছেন। সেখানে তিনি সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলের কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেখানে দূর দূরান্ত থেকে কৃষকরা এসে পরামর্শ নিয়ে যান।
গ্রামের ইউপি সদস্য পরিমল চন্দ্র বলেন, ইচ্ছে শক্তি ও পরিশ্রম করলে যে কেউ তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। কৃষক আমির হোসেন তার প্রমাণ। তিনি বলেন, আমরাই তাকে দিনমজুরের কাজ করতে দেখেছি। অথচ এখন তার জমিতে অনেক দিনমজুর কাজ করেন। তিনি আমাদের গ্রাম তথা দেশের অহঙ্কার। তিনি এক জমিতেই একাধিক ফসল ফলিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাকে অনুসরণ করে চাষাবাদ করার জন্য গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন।
সাঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাদেকুজ্জামান বলেন, আমির হোসেন একজন আদর্শ কৃষক। তিনি পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফল হয়েছেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়