প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি মেলা

আগের সংবাদ

গুচ্ছের ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়নি : অনিশ্চয়তায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী

পরের সংবাদ

তিন বছরেও ইন্টারনেট পায়নি মহেশখালী দ্বীপ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এম বশির উল্লাহ, মহেশখালী (কক্সবাজার) থেকে : কক্সবাজার সদর থেকে সাগরপথে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। দ্বীপে ঢোকার মুখেই নজর কাড়ে দোতলা ভবনে বড় অক্ষরে লেখা ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী’। দেশের প্রথম ডিজিটাল দ্বীপের প্রধান কার্যালয় বা ডিজিটাল সেন্টার এটি। কিন্তু ডিজিটাল সেন্টারেই ইন্টারনেট সংযোগ নেই তিন বছর ধরে। দিনভর থাকে তালাবদ্ধ।
লবণ, শুঁটকি ও কৃষিনির্ভর মহেশখালীর মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ই-কমার্স খাতে সহায়তা দিতে নেয়া হয়েছিল ‘ডিজিটাল মহেশখালী আইল্যান্ড’ প্রকল্প। কোরিয়ান টেলিকমের (কেটি) কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে সরকার এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। প্রকল্পের আওতায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছিল ২৯টি প্রতিষ্ঠানে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম সরবরাহ, শুঁটকির উদ্যোক্তা তৈরি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পাঁচটি কমিউনিটি ক্লিনিকে টেলিমেডিসিন সেবার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মাধ্যমে মহেশখালীকে দেশের প্রথম ডিজিটাল দ্বীপ ঘোষণা করে সরকার। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ডিজিটাল কার্যক্রমও শেষ হয়ে যায়। এখন অ্যানালগ বা সাবেক দশা পুরো দ্বীপের।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর আইসিটি বিভাগের কোনো দায়িত্ব নেই। ইন্টারনেটবিষয়ক বাকি কাজ বিটিসিএলের (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড) এবং অন্যান্য কাজ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর।
প্রকল্প পরিচালক জাহিদ মোহাম্মদ ফিরোজ বলেন, ‘এ প্রকল্পের পরবর্তী কোনো কাজ কোন দপ্তরের দেখার কথা, তা ঠিক করা ছিল। একাধিকবার বৈঠক করে এটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।’
বিটিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মহেশখালীতে ইন্টারনেট সংযোগ অব্যাহত রাখার দায়িত্ব আমাদের। কোনো সমস্যা থাকলে খোঁজ নিয়ে তা দ্রত সমাধান করা হবে।’
প্রশিক্ষকের বেতন নেই : জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় যে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল, তা তিন বছর ধরে বন্ধ। গত ২৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় গিয়ে ডিজিটাল সেন্টারের ফটক বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় কয়েকজন জানান, প্রকল্পের মেয়াদ শেষে সমাজসেবা অধিদপ্তর বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের দায়িত্ব বুঝে নেয়। কিন্তু এতে কানাকড়িও বরাদ্দ নেই। একজন প্রশিক্ষক দিলেও তার বেতন দেয় না। ফলে প্রশিক্ষক এখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার তিনেক করে টাকা নিয়ে নিজের খরচ চালান। তিন মাসের প্রশিক্ষণ কোর্সে এখন ২০-২১ জন শিক্ষার্থী। আগে ছিল ৭০-৮০ জন।
প্রশিক্ষক মাহমুদুল করিম বলেন, ‘ট্রেনিং সেন্টারটি সমাজসেবার অধীনে। কিন্তু এর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। আমার বেতনও দেয় না। তাই স্টুডেন্টদের কাছ থেকে টাকা নিতে হয়।’ জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (উপপরিচালক) হাসান মাসুদ বলেন, ‘একই ধরনের কাজ বলে প্রকল্প শেষে আমাদের দেয়া হয়। কিন্তু এটি আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ নয়। তাই এ খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। ট্রেনিং সেন্টারের আয় থেকেই যাবতীয় খরচ করা হবে, সে শর্তেই সমাজসেবা এটির দায়িত্ব নিয়েছে।’
ধুঁকছে অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্র : পাশেই ৯ তরণ উদ্যোক্তার শুঁটকি ব্যবসার অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্র। ডিজিটাল সেন্টার থেকে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি কম্পিউটার দেয়া হয়েছিল। উদ্যোক্তা দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প শেষ হওয়ার পর থেকে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। মোবাইল ডেটা দিয়ে কোনোরকমে কাজ চলছে। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। কম্পিউটারও মাঝেমধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।’
মহেশখালী পৌরসভা কার্যালয়েও ছিল প্রকল্পের কার্যক্রম। একাধিক কর্মী জানান, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আলাদা ইন্টারনেট সংযোগ নেয়া হয়েছে। পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ জানান, বিদ্যমান ইন্টারনেট সংযোগ কাজ করছে না। বিটিসিএলে জানিয়েও কাজ হচ্ছে না।
একই অবস্থা আধা কিলোমিটার দূরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়েও। ইউএনও মো. ইয়াছিন বলেন, ‘ডিজিটাল মহেশখালী কার্যক্রমের মধ্যে কম্পিউটার ট্রেনিং ও শুঁটকি উদ্যোক্তাদের কাজ চলমান। তবে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি নেই বললেই চলে। আইওএমের কাছে এসব বিষয় জানতে চেয়েছি। তারা কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। আমরা নিজেদের সংযোগ ব্যবহার করি। মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়। মোবাইল ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করি।’
প্রকল্প শেষ হওয়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিজ খরচে ইন্টারনেট সংযোগ নিলেও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে তা হয়নি। ফলে সেখানকার টেলিমেডিসিন সেবা বন্ধ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আলাদা সংযোগ নিয়েছি। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকে ইন্টারনেট নেই।’ প্রধান কার্যালয়ের দোতলায় একটি কক্ষে প্রযুক্তিবিষয়ক সব সেবা দেয়ার কথা। তা আর হয়নি। কক্ষের একপাশে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কিছু সরঞ্জাম।
মাস ছয়েক আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিদর্শন প্রতিবেদনেও বলা হয়, এ প্রকল্পের আওতায় দেয়া মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, জেনারেটর, সাউন্ড সিস্টেম, আইপিএস, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ, কৃষিজ যন্ত্রপাতি, আসবাব নষ্ট ও অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
জনবল নেই বিটিসিএলের : স্থানীয় কয়েকজন জানান, প্রকল্পের বাইরে মহেশখালীর বিটিসিএল ইন্টারনেট ও টেলিফোন সেবাও অচল এক বছর ধরে। ডিজিটাল সেন্টারের প্রশিক্ষক জানান, গত জানুয়ারিতে রাস্তার কাজের কারণে সংযোগ কাটা পড়ে। বিটিসিএলকে বারবার বললেও কাজ হয় না। এখানে তাদের লোকই থাকে না।
ইউএনও মো. ইয়াছিন বলেন, ‘সমস্যা হলে বিটিসিএলকে জানাই। কিন্তু তারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয় না।’ বিটিসিএল কক্সবাজার শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক মো. হোসাইনুর রশিদ বলেন, ‘অনেক জায়গায় ঠিক করেছি। কিছু জায়গায় সেবা বন্ধ রয়েছে। জনবলসংকটের কারণে সংস্কার করা যাচ্ছে না। সেখানে মাত্র একজন লোক।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, সরকার নানা স্লোগান দিয়ে জনগণকে উজ্জীবিত করে। মহেশখালীকে ডিজিটাল দ্বীপ হিসেবে ঘোষণা তেমনই একটি স্লোগান মাত্র। সরকারের ঘোষণা দেয়ার পরও বিষয়টি বাস্তবায়ন না হওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় এ ধরনের অ্যাকটিভিটি ব্যাকফায়ার করে। এতে মানুষ বিশ্বাস হারায়। সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের কথাই ধরুন, সেখানকার জনগণ কি বলে আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি? কিন্তু আমরা কথায় কথায় বলি, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, অতিকথন হলো মিথ্যা কথন।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়