সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল : শান্তিপূর্ণ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৫ শতাংশ

আগের সংবাদ

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী : নির্বাচনের আগে দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে > উদ্ভট ধারণা প্রশ্রয় দেবেন না

পরের সংবাদ

জন্মদিন > আদ্যনাথ ঘোষ : এক স্বপ্ন রোদ্দুরের কবি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একজন কবিকে গভীরভাবে আত্মস্থ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তার কবিতা। তার সৃষ্ট কবিতাই কবির অন্তর-বাহির বুঝে ওঠার, পরিমাপ করার, পরিপূর্ণ চালচিত্র তুলে এনে তার শিল্পিত অবয়ব পরিস্ফুট করার একমাত্র মাপকাঠি। অর্থাৎ কবিকে চিনার জন্য তার সৃষ্টির ভূমিকাটি মুখ্য। আমার প্রিয়ভাজন কবি আদ্যনাথ ঘোষের বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কবিতা পাঠ করে কিছু বলতে গিয়ে এ কথাগুলোই মনে হয়েছে বারবার। কবি আদ্যনাথের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের বয়স খুব বেশি না। কিন্তু বন্ধুত্বের নিবিড়তায় সেটি কখনো অল্প মনে হয়নি। বয়সের দিক থেকে শিগগিরই তিনি অর্ধশতক পূর্ণ করতে যাচ্ছেন। এ বড় আনন্দের বার্তা যে সুস্থ থেকে কবিতার মতো এক সূ² সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে জীবনের অনেকটা পথ তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। একজন কবি যখন কবিতার বিস্তীর্ণ রাজপথ ধরে হাঁটেন তখন তিনি শুধু হাঁটেনই না, দেখেনও অনেক না দেখা দৃশ্যবলি, অনুভবে গেঁথে নেন জীবন ও জগতের বিবিধ রাহস্যিক বিষয়-আশয়। এখানে কবি দর্শনের এক অলৌকিক তথ্য ও তত্ত্বের সন্ধান পান, যা তার সৃষ্টিকে করে ঋদ্ধ ও মহিমান্বিত। কবি আদ্যনাথ ঘোষের কিছু কবিতায় সেই দার্শনিকতার দ্যুতির দেখাও মেলে। কিন্তু তার কবিতার শরীর ও প্রকরণে সম্পূর্ণ প্রবেশ করতে গেলে তাকে ও তার কবিতাগুলোর যতটা পাঠ করা জরুরি, সেই সুযোগ আমার ততটা জোটেনি। এই সীমাবদ্ধতা নিয়েও কবির পঞ্চাশে পৌঁছার মাহেন্দ্রক্ষণটিকে উদযাপন করার আগ্রহে কবি ও তার কবিতার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকার এই প্রয়াসটি আমি নিতে চাই। এটি তার সৃষ্টির মূল্যায়ন অবশ্যই নয়, তবে এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে কবিতার নতুন, পুরনো পাঠকদের সঙ্গে কবি আদ্যনাথের সংযোগ সম্পর্কটি রচিত হলেও হতে পারে বলে আশা রাখতে পারি।
উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা পাবনার সুজানগরে জন্ম নেয়া কবি আদ্যনাথ ঘোষ কবিতাচর্চা শুরু করেন শৈশবকাল থেকেই। স্থানীয় পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাও হতে থাকে সেসব কবিতা। এখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লিখছেন তিনি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলোর রেখা’র দেখা মেলে ২০১৫ সালে। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রতি বছরই একটি বা একাধিক কবিতাগ্রন্থ এসেছে তার হাত থেকে। ২০২১ সাল পর্যন্ত তার কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এগারোতে। এতে বোঝা যায় কাব্যচর্চাই কবি আদ্যনাথ ঘোষের আরাধ্য জগৎ। কবিতাই তার ধ্যান, জ্ঞান ও স্বপ্ন। তার বেশিরভাগ কবিতায় প্রেম ও বিরহ উপস্থাপিত হয়েছে নতুনত্বের আভাস নিয়ে, যা কাব্যরসিককে মাঝেমধ্যে চমকে দেয়। দেখা যাক একটি কবিতার কিছু পঙ্ক্তি। ‘জ্বলে জ্বলে জল হয়, পিপাসা মেটায়। শ্রীরাধিকা, তোমার আমার অনুভব যমুনার জল।’ (যমুনার জল, তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে কাব্য) রাধার প্রেম নিয়ে কবির এ এক চমৎকার অনুভব। প্রেমের আরেকটি কবিতার শেষ তিনটি চরণ এরকম : ‘অথচ অন্তর জানে-আমারই চাঁদে ভরা ছিল তোমারই আগুন’ (তুমি, প্রাগুক্ত)। ভালোবেসে সুখী হওয়ারই প্রত্যাশা সবার। কিন্তু কবির প্রত্যাশা ভিন্ন কথা বলে। তিনি বলছেন, ‘মাটি ভালোবেসে অরণ্যমুখী, আমি ভালোবেসে বিরহী, নির্জনতায় সুখী-শুধু জানা গেল না তুমি ভালোবেসে কেন এত দুঃখী?’ (ভালোবাসার বহুগামিতা, একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুর কাব্য) বিরহের হাহাকারও কবিকে উতলা করে এভাবে : ‘আমাকে ছেড়ে তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে রাতের কালোতে। এ রহস্যের কারণে কাকে যে শুধাই প্রণয়ের পথ সর্বদা চড়াই (তোমাকে দেখাবো, প্রাগুক্ত)। কবির প্রেম ভাবনা নিয়ে বরেণ্য কবি অসীম সাহা তার একটি লেখায় যথার্থই বলেছেন, ‘প্রেমের বহুমুখী প্রকাশের এক দক্ষ কারিগর আদ্যনাথ।’ কবি আদ্যনাথ একইসঙ্গে ব্যক্তিপ্রেমকে ছাড়িয়ে মানবপ্রেম ও প্রকৃতিপ্রেমেও যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। মানুষের মনুষ্যত্বহীনতা কবিকে বেদনার্ত করে। এ বেদনা তিনি ব্যক্ত করেন এভাবে : ‘এ হয়তো অব্যর্থ ভাগ্যলিপির বেদনার রঙের প্রতিচ্ছবি, হয়তো এমনই বিধির বিধান, মনুষ্যত্ববিহীন মানবসভ্যতার দিগন্তরেখা’ (আলোছায়া, প্রাগুক্ত)। শুধু এই বিধির বিধান মেনেই কবি ক্ষান্ত হননি, প্রার্থনা করেছেন নতুন এক পৃথিবীর জন্য। ‘তাই চাই তোমার অনুগ্রহ স্বর্গের সুরভিত বৃষ্টি নতুন পৃথিবীর জন্য, নতুন প্রাণের সজীবতায় আরো বেশি জল চাই ধুয়ে দিতে সকল কালিমা’ (প্রার্থনা, প্রাগুক্ত)। প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে কবি দেখছেন এভাবে : ‘প্রকৃতির প্রতিটি প্রহর আমাদেরই সই; আমাদের সবকিছু জানে বলে, সারাক্ষণ নাচছে আমাদের ঘিরে তাথৈ তাথৈ’ (তাথৈ তাথৈ, প্রাগুক্ত)। কিছু রূপকের আড়ালে কবিচিত্তের বেদনা নান্দনিকভাবে ফুটে উঠতে দেখি আমরা। ‘এ কেমন জলের জরায়ুর জল! বিনিময়ে বেড়ে যায় জলের জলকেলি, প্রণয়ের নদী। তবু কেন বর্ষা-শ্রাবণ! আষাঢ়িয়া ঢল! জলের কারণে জল উপচিয়া পড়ে। তুমি যদি জল চাও, আমি দিই জলচোখ জলেভরা তৃষাতুর নদী।’ (তুমি যদি জল চাও, তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে কাব্য)। এ ধরনের আরেকটি কবিতার কিছু পঙ্ক্তি : ‘তোমার চৈত্র এসে ধীর পায়ে হেঁটে যায় অন্য এক মাঠে আর, আমার চৈত্র কাঁদে বুকের ভিতর বেদনার নৈমিষারণ্যে’ (আমার চৈত্র কাঁদে, প্রাগুক্ত)। একটি চমৎকার দৃশ্যকাব্যের দেখা মেলে কবির ভিন্ন স্বাদের একটি কবিতায়। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও শ্লেষ নিয়ে কবির অভিব্যক্তি এরকম, ‘দেখো গোটা দুপুর আজ উন্মাদ, আগুন আগুন খেলা। পোড়াও শস্যক্ষেত, পাখিডানা ভোর, জ্যান্ত পৃথিবীর গোলকধাঁধা। ভাসাও স্বপনের নাও, রোদ্দুর ডানা, ভোর ভোর আকাশ। ডোবাও দগদগে ঘা, মিথ্যার আকাশ আর আঁধারের বসতি। বলো, দীর্ঘশ্বাস বলো, জীবনবৃক্ষ…বলো অনুভব, বলো…বলো…।’ (অনুভব, প্রাগুক্ত)।
কিছু কিছু পঙ্ক্তি আমাকে স্পর্শ করেছে খুব। তেমন ভালোলাগা কিছু পঙ্ক্তি এ রকম : ‘তবু আজ আঁধারেরা আঁধারের দহনে জ্বলে-
নিঃশেষে লিখে যায়, মৃত্যুই ডেকে আনে জীবনের সূচনা’ (দ্বিবেণীলগন, তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে কাব্য)
‘তবু পৃথিবী ঘুমায়, তার চিরচেনা পথে, আমার পৃথিবী আজ শ্রাবণ, নিরুদ্দেশে’ (মায়াজাল, প্রাগুক্ত)
‘এই যে তুমি, আজো তো শিখতে পারোনি আগুন আর শরীরের খেলা’ (ইশতেহার, প্রাগুক্ত)
‘নির্ঘুম স্মৃতিরা উড়াল দেয় বেনামি বন্দরে, চোখ মেলে চেয়ে দেখে-
কালো ছায়ায় ভরা আকাশ আর অনন্ত নক্ষত্রবিথি’ (রাত্রির গান, একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুর কাব্য)
‘তবুও গাছে গাছে ফুল, কুহু কুহু ডাক, যুবতী বাতাস আমারই উঠোন দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় জীবনফেরির মিলনখেয়ায়’ (আমারই উঠোন দিয়ে, প্রাগুক্ত)
‘যখন ভোরের গান তুলে রাখি যন্ত্রণার বাক্সে আত্মার কী যে কান্না, সে আর আমি ছাড়া কে-ইবা জানে’ (ভোরের গানের প্রতীক্ষায়, প্রাগুক্ত)
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু, ভাষা শহীদসহ দেশপ্রেমের বেশ কিছু ভালো কবিতা আছে তার। কবি আদ্যনাথকে যতটা পড়তে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে তিনি এক স্বাপ্নিক কবি। ‘একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুর’ কবিতায় তারই প্রতিচ্ছায়া যেন দেখতে পাই। এ কবিতার শেষে তিনি হৃদয়ের সবটুকু উত্তাপ ঢেলে দিয়ে প্রগাঢ় আবেগে বলেছেন, ‘পূজার মন্ত্রে খুঁটে নিতে চাই একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুরকণা’। প্রযুক্তির পাথুরে জীবনে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি আমরা। এ বাস্তবতা কবিহৃদয়কে আর্দ্র না করে পারে না।
আধুনিক কবিতা কবির মগ্নতা ও মেধাশ্রিত আবেগ দাবি করে। কবি আদ্যনাথ অবশ্যই মেধাবী এবং যথেষ্ট কবিত্ব শক্তি আছে তার। কবিতায় তার নিজস্ব স্বরও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আবেগকে সুসংহত করে তার শৈল্পিক রূপ দিতে খানিকটা অমনোযোগী মনে হয়েছে কবিকে। ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প নিয়েও একই কথা বলা যায়। এমনটা হয়েছে সম্ভবত কবিতাকে সময় না দেয়ার কারণে। এটি বোঝা যায় ২০১৭ সালে পরপর তিনটি, ২০১৮ সালে দুটি ও ২০১৯ সালে দুটি কবিতাগ্রন্থের প্রকাশ দেখে। তবে একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো-২০২২ সালে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কবির যেসব কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে সেগুলোতে যথেষ্ট পরিপক্বতা ও গভীর জীবনবোধের ছাপ লক্ষ্য করেছি। সে কারণে বলতেই হয়- কবি আদ্যনাথ ঘোষ কবিতার রাজপথ ধরে অনেকটা প্রস্তুতি ও মনোযোগ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন। সামনের দিনগুলোতে তার কবিতাগুলো আরো শিল্পিত ও ঋদ্ধ হবে- সে প্রত্যাশা করতেই পারি। কবির পঞ্চাশে পা দেয়ার সুবর্ণজয়ন্তী দরজায় কড়া নাড়ছে। সেজন্য উষ্ণ অভিবাদন জানাই কবিকে। পঞ্চাশকে তারুণ্যই বলা যায়। কবিতার বিশাল সাম্রাজ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। প্রিয় কবি আদ্যনাথ ঘোষ তারুণ্যের এই অমিত শক্তিবলেই নন্দিত কবিদের সারিতে নিজের জায়গাটি করে নিতে পারবেন সেই আশাবাদ ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তার সুস্থ, সুন্দর ও সুদীর্ঘ জীবন কামনা করছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়