সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল : শান্তিপূর্ণ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৫ শতাংশ

আগের সংবাদ

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী : নির্বাচনের আগে দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে > উদ্ভট ধারণা প্রশ্রয় দেবেন না

পরের সংবাদ

গল্প > বেখাপ্পা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কোনো এক অজ্ঞাত দিনের ভরদুপুরে মনোজ এসে হাজির হয় আমার অফিসে। মনোজ হালদার, আমার একসময়ের কলিগ। আমরা একসময় একই পত্রিকায় কাজ করতাম। পিয়ন এসে বলল, স্যার আপনার একজন গেস্ট আসছে। রিসিপশনে বসা।
তখন আনুমানিক দুপুর দেড়টা বাজে। এ সময় আবার কে আসবে? কৌতূহলী মন নিয়ে গিয়ে দেখি মনোজ বসে আছে।
-কী ব্যাপার মনোজ? আপনি? কেমন আছেন?
উজ্জ্বল ত্বকের ছিমছাম স্বাস্থ্যের মনোজকে আজ বেশ সতেজ লাগছে। সদ্য সেভ করা গালে সবুজাভ বলয়। গায়ে নীল-সাদা চেক শার্ট। হাতের কবজিতে বোতাম লাগনো। আয়রন করা কালো প্যান্ট। পলিশ করা সু। কাঁধে ঝোলানো ছাই রঙা ব্যাগ। আমাকে দেখে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কেমন আছেন দাদা?
-ভালো। আপনি?
-ভালোই।
-আসেন, ভেতরে চলেন।
আমার পেছন পেছন ভেতরে এলেন মনোজ। পত্রিকার অফিসে দুপুরের দিকটায় মাছি মারা ছাড়া আসলে খুব একটা কাজ থাকে না। কাজ শুরু হয় বিকাল থেকে। সন্ধ্যার দিকে দম ফেলার ফুসরত থাকে না। চলে রাত আটটা-নয়টা অব্দি। দশটায় পুরো ফ্রি। তাই মনোজকে সময় দেয়ার মতো যথেষ্ট সময় হাতে ছিল। টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা শুরু করি।
-বাসার সবাই কেমন আছে?
-চলে যাচ্ছে। আপনার?
-ভালোই আছি। ফেসবুকে দেখলাম, আপনার যমজ ছেলে হয়েছে। কী নাম রেখেছেন ওদের?
-গদ্য ও পদ্য। বৌদি, শব্দার্থ- ওরা কেমন আছে?
-ভালোই।
মনে মনে বুঝতে পারলাম মনোজের আসলে জরুরি কোনো কাজ বা কথা আছে। নইলে তার এই কেমন আছি, ভালো আছি মার্কা সৌজন্যতা এত দীর্ঘ হতো না। আমি তার মূল কথা শোনার জন্য আপেক্ষা করতে থাকি। একসময় বলেন, দাদা লাঞ্চ করেছেন?
বললাম, না। আপনি?
-আমিও করিনি। চলেন একসঙ্গে লাঞ্চ করি।

মাসের শেষ দিকে পকেট ফুটো অবস্থায় বয়সে জুনিয়র কেউ যখন লাঞ্চের জন্য অফার করেন, তখন বিব্রত হতে হয় কি! ভদ্রতা বশে হলেও বেশ কিছু টাকা খসে যায়। তার ওপর আবার নিজের অফিসে অতিথি হিসেবে আসা। ক্যান্টিনে না-হয় আমি আলুভর্তা-ডাল দিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি। গেস্টকে তো আর তা খাওয়ানো যায় না। অন্তত মাছ বা মাংস অফার করতে হয়। ইশ! বললেই হতো লাঞ্চ করেছি। তারপর বিদায় হলে একটু লেট করে টুক করে লাঞ্চ সেরে নেয়া যেত। এই ফাঁকে চা-সিগারেটের ওপর দিয়ে চলে যেত। মুখ ফুটে যেহেতু একবার ‘না’ বলে ফেলেছি, তখন তো আর কিছু করার নেই। কোটে বল থাকে না।
অফিসের দু-তলায় ক্যান্টিন। মনোজকে সেখানে নিয়ে গেলাম। এ সময়টায় ভিড়ের জন্য জায়গা পাওয়া মুশকিল। কোনার দিকে ছোট একটা টেবিল ফাঁকা পেয়ে টুপ করে বসে গেলাম। ক্যান্টিন বয়কে ডেকে বললাম, দুজনের।
সঙ্গে সঙ্গে মনোজ বলে উঠল, না না, আমার লাগবে না- বলেই কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট্ট হটপটটি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। মনে মনে স্বস্তি পেলাম। যাক, কিছুক্ষণ আগের দুশ্চিন্তাটা আর রইল না। কিন্তু মুখে সেই ছাপ ফেলিনি। কৃত্রিম ভাব ফুটিয়ে বললাম, এটা আবার কেমন কথা? আমার অফিসে এসেছেন লাঞ্চ বক্স নিয়ে?
ঠোঁটে কোমল হাসির রেখা ফুটিয়ে মনোজ বললেন, আপনার সঙ্গে কত দিন পর একসঙ্গে লাঞ্চ করছি বলেন তো! প্রায় ছয় বছর তো হবেই। আহ! সেই দৈনিক অবেলার দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে।
দুজনে মিলে লাঞ্চ সারলাম। এতক্ষণে যদিও মনোজের আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারলাম না। অফিসের নিচে ফুটপতে নাঈমের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বললাম, দুটো চা। মনোজের দিকে চোখ রেখে বললাম, আপনার কী চা?
-রঙ চা।
-চিনি হবে তো?
হেসে উত্তর দিলেন, এখনো ডায়াবেটিস হয়নি।
নাঈমকে ইশারা দিলাম। ও জানে, আমারটা চিনি ছাড়া। চা খেতে খেতে বললাম, একটা সিগারেট দাও। মুখের সামনে বেনসন লাইট এগিয়ে ধরল নাঈম। মনোজকে বললাম, আপনার কোন ব্র্যান্ড?
-গোল্ডলিফ সুইচ। দোকানে সুতায় ঝুলানো লাইটারে বুড়ো আঙুলে ঘষা দিলাম।
এখানে অদ্ভুত একটা সাইকোলজি কাজ করে আমার। ধারণা করি, আরো অনেকেই হয়তো এমনটা করে। ধরেই নিই এক চান্সে লাইটারে আগুন জ¦লবে না- এমনটা প্রিকন্ডিশন ম্যান্টলিটি প্রায় সব সময়ই কাজ করে। যদি এক ঘষায় আগুন ধরেও যায়, তাহলেও নিভিয়ে দিই বা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। যাই হোক, সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললাম, আজ আপনার অফিস নেই?
এই প্রথম আমার কোনো কথায় মনোজকে বিব্রত হতে দেখলাম। আমতা আমতা করতে করতে বললেন, মানে, দাদা, কীভাবে বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার চাকরিটা আসলে নেই।
-নেই মানে? অবাক হলাম। মুহূর্তেই মনে মনে খেলা করে গেল- তাহলে কি চাকরি চাইতে এসেছেন? এই সুযোগ তো আমার অফিসে নেই। তাছাড়া কারো জন্য লবিং করার কোনো ইচ্ছাই নেই। আমিই আছি, কোনো একরকম তাল মিলিয়ে, নানা দিক ম্যানেজ করে।
-আপনি তো জানেন, মাস তিনেক আগে আমাদের অফিসে অনেক ছাঁটাই হয়েছে।
-হুম, শুনেছি। হাউসের খবর তো আর মিডিয়াপাড়ায় চাপা থাকে না।
-সেই ছাঁটাইয়ে আমিও আছি।
-আপনি? আপনি কীভাবে হলেন? আপনার মতো ডেডিকেটেড পারসন…
-সেটাই তো কাল হয়েছে। কারো চামচামি করিনি। তেল দেয়ার স্বভাব যে আমার নেই, সে তো আপনি ভালো করেই জানেন। অফিসের কোনো পলিটিক্স বা গ্রুপিংয়ের সঙ্গে ছিলাম না। তাই আমাকে একা ফায়ার করা কোনো ব্যাপারই হয়নি।
-তাহলে, এখন কোথায় কী করবেন ভাবছেন?
-আর যাই করি, অন্তত মিডিয়াতে থাকব না।
-আপনার যেন কী সাবজেক্ট ছিল?
-জার্নালিজম। বড় স্বপ্ন নিয়ে এই ডিপার্টমেন্টে পড়েছি। স্বপ্নের গুড়ে বালি আর বালি। মরুতট বলতে পারেন।
মনোজের কণ্ঠে ক্ষোভ ও হতাশা মিলেমিশে আছে।
-তাহলে কোথায় ট্রাই করছেন?
-বেশ কয়েক কোম্পানিতে সিভি ড্রপ করেছি। দেখি, কী হয়।
মনোজকে তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য বললাম, এখন কি কোথাও ইন্টারভিউ দিয়ে এলেন, নাকি যাবেন?
-না দাদা। আজ কোথাও যাওয়ার নেই। আসলে, বাসায় কেউ জানে না যে আমার চাকরিটা নেই। তাই প্রতিদিনই আগের মতো করে বের হচ্ছি। শিউলিও সব গুছিয়ে দিচ্ছে আগের মতো করে। চাকরি নেই শুনলে বাবা হয়তো স্ট্রোক করবে। সবাই ভেঙে ভেসে যাবে।
-বলেন কী? আপনার স্ত্রী, মা-বাবা কেউ জানেন না?
-না। কারণ বাবা তো বিছানায় পড়া প্রায় পাঁচ বছর হলো। আর্থ্রাইটিসের পেশেন্ট। মা আর শিউলি মিলে যা একটু সামলে নিচ্ছে। মায়েরও তো ডায়াবেটিসে শরীরটা ভেঙে গেছে। এর মধ্যে করোনা এসে সব উল্টাপাল্টা করে দিল। শিউলির অ্যাজমা। ওর করোনা হলো। আমি তো ভয়ে মৃতপ্রায়। ঘরে বয়স্ক বাবা-মা। অন্যদিকে শিউলির কাশি-শ্বাসকষ্ট। পুরো সংসার চলে আমার সেলারিতে। বাসা ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, বাচ্চা দুটোর খরচ, ওষুধপত্র, আরো টুকিটাকি কত কিছু। মাস শেষে অফিসে যাওয়ার ভাড়াটা পর্যন্ত থাকে না জানেন? ধার করে চলতে হয়।
এ কথা শুনে আঁতকে উঠি। মনে মনে ভাবি, টাকা ধার চাইতে এলো না তো আবার? কিন্তু মুখে কিছু বলি না। মনোজকে সেই সুযোগ না দিয়ে বরং আমার ব্যস্ততা বাড়িয়ে তুলি। অস্থিরতা দেখিয়ে বলি, মনোজ, আজ আমাকে দ্রুত পাতা ছাড়তে হবে। বুঝতেই পারছেন পিক টাইম শুরু। আজকে বরং উঠি চলেন। কল দিয়েন। আপনার আগের নম্বরটিই তো আছে, তাই না?
-আছে। স্বরূপ দা… বলেই থেমে গেল মনোজ।
ভাবছি, এই বুঝি টাকার কথা তোলে। তাই নির্লিপ্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
-আর যে পারছি না স্বরূপ দা। বাজারের সব জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। দুই বেলা খাব, সেই সুযোগও নেই। তার ওপর যমজ দুটি ছেলে হয়েছে। এত দিন ধরে বাকিতে তাদের জন্য দুধ নিয়ে গেছি। এখন তো দোকানদারও দিনে তিন বেলা মোবাইলে কল দেয়। মাসওয়ারি দোকান তো আছেই, ওষুধের দোকানে দেনায় ডুবে গেছি। তাই ভাবছি…
-কী ভাবছেন?
-দেখি কী করা যায়? টিসিবির লাইনে দাঁড়ব। কিছু তো সাশ্রয় হবে, তাই না? আর যে পারছি না!
সেদিনের মতো মনোজকে বিদায় করে অফিসে ঢুকলাম। না, মনোজ চাকরি বা টাকা কোনোটাই চাইতে আসেননি। চাইলেও দিতে পারতাম না।
রাত আটটায় ফ্রন্ট পেইজের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এ সময় খবর এলো, লিড স্টোরি চেঞ্জ করতে হবে। রায়েবাজারে এক পরিবারের সবাইকে বিষ প্রয়োগ হত্যা। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মৃত্যু, ঢাকা মেডিকেলে স্ত্রী ও যমজ দুই সন্তানের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গলায় ফাঁস লাগিয়ে প্রাক্তন সাংবাদিকের আত্মহত্যা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়