সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল : শান্তিপূর্ণ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৫ শতাংশ

আগের সংবাদ

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী : নির্বাচনের আগে দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে > উদ্ভট ধারণা প্রশ্রয় দেবেন না

পরের সংবাদ

গল্প > আমার বন্ধু তকদীর

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তকদীর আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ছিল। আমরা তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। দুজনের কেউ হোস্টেলে সিট পাইনি। তকদীর থাকে তার দূর সম্পর্কের কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আমি থাকি একটি মেসে। মেসে ভীষণ হৈচৈ। সেখানে বিচিত্র পেশার মানুষ থাকে। পরিবেশ পড়ালেখার অনূকুলে নয়।
একদিন কমনরুমে আমি আর আমার তিন বন্ধু ক্যারাম খেলছিলাম। তকদীর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখছে। এমন সময় সানু তকদীরকে বলল, পকেটে হাত দে। তকদীর ক্যারাম বোর্ডের পকেটে হাত না রেখে নিজের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এ নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করি। তকদীর লজ্জা পেয়ে চলে যায়।
তকদীর অত্যন্ত শান্ত এবং নিরীহ স্বভাবের। চেহারায় ছিল শিশু সুলভ সারল্য। কারো সাথে বেশি মেশে না। নিজের মধ্যেই সে আপন জগৎ তৈরি করে থাকে। ওকে আমার বেশ ভালো লেগে যায়। অল্প কয়েকদিনেই আমাদের সম্পর্ক গাঢ় বন্ধুত্বে রূপ নেয়। তকদীরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আমার বাড়ি নোয়াখালী।
তকদীর আমাকে বলে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তার থাকতে ভালো লাগে না। তার জন্য থাকার একটা ভালো ব্যবস্থা করতে বলে। আমারও মেসে থাকতে ভালো লাগছিল না। দুজনে মিলে একটা ঘর ভাড়া নিই। খাওয়া-দাওয়া করি পার্শ্ববর্তী একটি হোটেলে। হোটেলটি ছিল একেবারে রাস্তার ধারে। খেতে বসলে রাস্তার লোক আমাদের দেখতে পায়, রাস্তার ধুলাবালি এসে পড়ে।
একদিন তকদীর আমাকে বলে, কারো বাড়িতে লজিং থাকলে কেমন হয়? আমি বললাম, সর্বনাশ ও কাজ কখনো করবে না। লজিং থাকতে গেলে ঘরজামাই হতে হবে।
হোটেলের ম্যানেজার রহমত উল্লাহ মাঝবয়সি। সারাক্ষণ কথা বলে লোকজনকে হাসায়। বয়সের কথা তার খেয়াল থাকে না। রাস্তা দিয়ে পথচারীসহ অনেক স্কুল-কলেজের মেয়েরা যেত। রহমত আমাকে নানা বলে ডাকত। রাস্তা দিয়ে মেয়েদের যেতে দেখলে সে চেঁচিয়ে বলত, নানি, নানি নানা ভাত খায়। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে মেয়েরা দ্রুত চলা শুরু করত। আমি এতে রেগে যেতাম। আশপাশের লোকজন ওর কথা শুনে হাসত। তকদীরও ওদের সঙ্গে হাসত। সে রহমতকে উৎসাহ দিত। এটা তার কাছে একটা খেলা ছিল। কিন্তু আমার আত্মসম্মানে বাধত। দুদিন ওর সঙ্গে রাগ করে কথা বলিনি। আমি কথা না বলায় তকদীর মনে কষ্ট পেয়েছিল।
তকদীর নিজের পরিবারের গল্প বলত। মা-বাবা, ছোট ভাইবোনদের গল্প। মা অন্তপ্রাণ ছিল সে। আমি শৈশবে মাতৃহারা হয়েছি। ওর মুখে মায়ের গল্প শুনতে ভালো লাগত। কল্পনায় ওর মাকে আমার মায়ের জায়গায় বসাতাম।
তকদীরের গল্প, কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল। বেশির ভাগ গল্প-কবিতা সে তার মাকে নিয়ে লিখত। যে বয়সে ছেলেরা কোনো মেয়ের মুখ কল্পনা করে কবিতা লেখে, সে বয়সে তকদীরের কবিতার বিষয়বস্তু ছিল তার মা এবং ভাইবোন।
বিদেশে অর্থাৎ কুমিল্লায় পাঠিয়ে মা তকদীরের জন্য দারুণ উৎকণ্ঠায় থাকতেন। চিঠিতে সব সময় তিনি তকদীরকে নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করা এবং স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার কথা বলতেন। খারাপ লেকের সঙ্গ পরিহার করে চলতে উপদেশ দিতেন। তকদীর এক চিঠিতে মায়ের দুশ্চিন্তা দূর করার আশ্বাস দিয়ে লিখেছিল, ‘মা এখানে আমি এক ভালো বন্ধুর সঙ্গে থাকি। সে সব সময় আমার খেয়াল রাখে। ওর বাড়ি নোয়াখালী’। নোয়াখালীর কথা শুনে তার মা চিঠিতে লিখেছিল, ‘নোয়াখালীর লোকদের ব্যাপারে সাবধান থাকিস। ওরা খুব সাংঘাতিক। ওরা মানুষের মাংস খায়।’ তকদীর সে চিঠি আমাকে দেখানোর পর আমরা খুব হাসাহাসি করি। আমি বাঘের মতো হালুম করে ওকে কৃত্রিম ভয় দেখাই।
মায়ের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য তকদীর ছুটির সময় একবার আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। তকদীরের মা অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে অনেকক্ষণ আমাকে পর্যবেক্ষণ করে ‘মানুষখেকোর’ কোনো চিহ্ন না পেয়ে হতাশ হলেন। আমি মাতৃহারা শুনে আমার প্রতি তার স্নেহ-মমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। আমাকে তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতে থাকেন। আমি যেন ছুটির দিনগুলো তাদের সাথে কাটাই সে জন্য তিনি আমাকে বারবার অনুরোধ করেন।
আইএ পাস করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তকদীরকে তার মা চোখের আড়াল করতে চাইলেন না। তকদীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডিগ্রি কলেছে ভর্তি হয়।
চোখের আড়াল হলে মানুষ মনের আড়াল হয়ে যায়। আমার আর তকদীরের বেলায়ও তাই হলো। অনেকদিন পর তকদীরের এক চিঠিতে জানতে পারলাম, বিএ পাস করে সে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে এবং সেই সাথে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সে আমাকে লিখেছিল, ‘পরাধীন অবস্থায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। দাস স্বল্প শিক্ষিত হোক বা উচ্চশিক্ষিত হোক দাসের পরিচয় শুধু দাস। দেশ স্বাধীন হলে আবার পড়ালেখা শুরু করব।’ বুঝলাম, মাতৃভূমি তকদীরের মায়ের স্থান দখল করেছে। শেষ চিঠি লিখেছিল কসবার রণাঙ্গন থেকে। তখন শত্রæ সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। সে তার যুদ্ধের কিছু অভিজ্ঞতা জানাল। যুদ্ধ শেষে তাদের বাড়িতে আসার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। সে আরো লিখেছিল, ‘আমার মা তোকে একবার দেখতে চায়।’
যুদ্ধ শেষে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই। তকদীর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্যরা তার মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে হত্যা করে, বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেয়। তকদীর যুদ্ধ শেষে তখনো দেশে ফিরে আসেনি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও কেউ বলতে পারে না। ওদের বাড়ির শূন্য ভিটায় দাঁড়িয়ে আমি পুরনো দিনের কথা ভাবতে থাকি। তকদীরের শিশুসুলভ চেহারা চোখে ভাসে, সেই সঙ্গে তার মায়েরও।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়